Thursday, November 21, 2024

ইশারা



বেড়লটা ইশারায় ডাকলো বলেই সমরবাবু সাইকেল দাঁড়িয়ে করিয়ে ফুটপাথ ধরে এগিয়ে গেলেন। ছিমছাম একটা কফিশপ, সেটার দরজার বাইরে সাদা রঙের বেড়ালটা বসেছিল। এর আগে কোনোদিনও বেড়ালের ইশারার মুখোমুখি হননি সমরবাবু। অতএব সামান্য নার্ভাস বোধ করছিলেন।

বেড়ালকে তো আর "আমায় ডাকছিলেন কি" মার্কা প্রশ্ন করা যায় না। তাই সামনে গিয়ে সামান্য ঝুঁকে ভুরু নাচাতে হলো। কী আশ্চর্য, ল্যাজের ইশারায় সে বেড়ালটা সমরবাবুকে কফিশপের ভিতরে যেতে বললে। এ'সব দামী কফি সমরবাবুর ধাতে সয় না, কিন্তু বেড়ালের এহেন ইন্সট্রাকশন উড়িয়ে দিতে মন সরল না। কফিশপের দরজা খুলে পিছন দিকে তাকিয়ে বেড়ালটার চোখের সামনে তর্জনী ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলেন যে সে কফিশপে ঢুকতে আগ্রহী কিনা। কিন্তু বেড়ালটা ততক্ষণে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।

কফিশপে তেমন ভিড় নেই, কোণের একটা টেবিল দেখে বসলেন সমরবাবু। সবচেয়ে সস্তা কফির অর্ডার দিলেন, খিদে ছিল পেটে কিন্তু এখানে এত দাম দিয়ে কিছু নেওয়ার মানে হয় না। শৌখিন কফি শৌখিনতর কাপে এলো, খয়েরি কফির ওপর সাদা ফেনায় একটা হার্ট সাইন আঁকা। বেশ জমকালো ব্যাপার আর কী। তবে বেড়ালের ইশারা ব্যাপারটা দামী কফির চেয়েও জব্বর ব্যাপার, এই ভেবে কফিতে চুমুক দিলেন তিনি।

কফিটা তড়িঘড়িই শেষ করলেন সমরবাবু। বেড়ালটিকে আর একবার দেখা দরকার, ফের যদি ইশারায় কিছু বলে। বিল মিটিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে যখন কফিশপের দরজা খুললেন বেড়ালটা তখন দোকানের বাইরে রাখা চেয়ারের ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে। সাইকেলের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকালেন সমরবাবু। স্পষ্ট মনে আছে বেড়ালটার ল্যাজ বাদে গোটা গা ধবধবে সাদা ছিল। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে পিঠের দিকে একটা পেল্লায় খয়েরী রঙের গোল ছোপ, আর তার ওপরে সাদা শৌখিন একটা হার্ট চিহ্ন।

আর তখুনি জিভে বিশ্রী কিছু একটা ঠেকলো। জিভে হাত দিয়ে দেখতেই দিতেই সে'টা আঙুলের ডগায় উঠে এলো। সে'টা চোখের কাছে আনতেই সমরবাবু বুঝলেন যে বিশ্রী জিনিসটা আদতে একগোছা সাদা লোম।

মৃণালবাবুর রিসার্চ

মৃণালবাবুর একটা রাগের ডায়েরি আছে। রাগের ডায়েরি মানে ভাববেন না যে তা'তে সঙ্গীতের ছিটেফোঁটাও আছে। ভদ্রলোক নিজেকে গবেষক বলে ভাবতে ভালোবাসেন, আর আজীবন তাঁর গবেষণার বিষয় হলো রাগ; মানুষের রাগ। কাউকে রাগতে দেখলেই সে রাগের বহিঃপ্রকাশ সম্বন্ধে নিজের অব্জার্ভেশন নোট করে রাখেন মৃণালবাবু।

সেই ফার্স্ট ইয়ারে শুরু। মৃণালবাবুর প্রেমের চিঠিটা দলা পাকিয়ে ফাঁকা ক্লাসরুমের জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলেছিল নয়না। ছুঁড়ে না ফেললেই পারত; সামান্য "না" বললেই ল্যাঠা চুকে যেত। কিন্তু ওই দাঁতে দাঁত চেপে চিঠিটা দলা পাকানোর মধ্যে একটা তলপেটে-ঘুষি মারার সমান ব্যাপার আছে, জানালার বাইরে সে কাগজের দলাটা ছুঁড়ে ফেলার মধ্যে একটা ঠাস-চড় আছে। "না" বলে ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে সাদামাটা তথ্যই আছে, আগুন নেই। অবশ্য নয়নার রাগের কারণটা আজও ঠিক ধরতে পারেননি মৃণালবাবু। সম্ভবত ওরকম একটা ন্যালাক্যাবলা ছেলের থেকে প্রেমের চিঠি পাওয়া ব্যাপারটা বেশ অপমানজনক ঠেকেছিল নয়নার, তাও ওর স্মার্ট জনা-তিন বন্ধুর সামনে।

মায়ের রাগ ভারী অদ্ভুত ছিল। যার ওপরেই রাগ হোক, সমস্ত গজগজ গিয়ে পড়তো বাবার ওপর। আর বাবার রাগ মানে স্রেফ চুপ করে যাওয়া। সেই শান্ত নির্বাক বাবার চেহারাটা ভাবলে আজও মৃণালবাবুর বুক কেঁপে ওঠে।মেজমামার রাগও বেশ মনে পড়ে মৃণালবাবুর, রেগে গেলেই মামা হাইস্পিডে পায়চারী শুরু করতেন। কারণে-অকারণে রেগে যেতেন, অতএব যখন তখন পায়চারী, কাজেই যদ্দিন বেঁচে ছিলেন বেশ ছিপছিপে ছিলেন। সহকর্মী সমরেশ রেগে গেলেই অফিস মাথায় তুলতো চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে। দু'একবার ফাইলপত্রও ছুঁড়ে ফেলেছে রাগের চোটে। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, উচ্চপদস্থ কারুর সামনে কখনও সমরেশের সেই বিটকেল রাগটা বেরিয়ে আসেনি। সমরেশ বলতো সে'টাই হলো প্রফেশনালিজম, মৃণালবাবুর মনে হত ধান্দাবাজি। অবশ্য ধান্দাবাজির ব্যাপাটা কখনও সমরেশকে জানানোর সাহস হয়নি, স্রেফ নোটবুকে টুকে রেখেছেন।

পথে-ঘাটে কত রাগী মানুষ দেখেন মৃণালবাবু। সামান্য খুচরো আদানপ্রদানের গোলমালে বাসযাত্রী কন্ডাক্টরকে খামোখা গাল পাড়লেন। উত্তরে কন্ডাক্টর পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখানোর আশ্বাস দিলেন। মানুষের জিনিসপত্র কেনাকাটি বাড়ছে, বাড়ছে কাস্টোমার কেয়ারে ফোন করে ঘ্যানঘ্যান করার তাগিদ। কাস্টোমার কেয়ারে বসে থাকা সাতপাঁচের খবর না রাখা সামান্য মাইনের ছেলে-মেয়েরা খদ্দেরদের রাগ-ঘেন্না হজম করছেন গোটা দিন ধরে। মানুষের যে কত রকমের চাপ। প্রতিবেশী অমিয়বাবু যেমন; অফিসে পিষে যাওয়া বাপ বাড়ি ফিরে নিজের ছেলের গ্রামার ভুল ধরে ভাঙচুর শুরু করছেন। ছোটছেলে দেবব্রত স্রেফ একটা চাকরীর হিল্লে না জোটাতে পেরে দিনে বারো ঘণ্টা জিম করছে; মৃণালবাবু জানেন যে দেবু ঠিক শরীরের সাধনায় মত্ত নয়, স্রেফ নিজের রাগ আর বিরক্তিটাকে সামাল দিতে পারছে না।

এখন সন্ধে পৌনে সাতটা। দেবু যথারীতি জিমে গেছে। বড়ছেলে দেবাঞ্জন ব্যাঙ্গালোরে চাকরী করে। মৌমিতা নেই বছর পাঁচেক হলো। এ'বার চেয়ার ছেড়ে উঠে বাড়ির আলোগুলো জ্বালতে হবে, পাম্প চালাতে হবে, চা বসাতে হবে। রাগের ডায়েরিটা পাশের টেবিলে রেখে খানিকক্ষণের জন্য চোখ বুজলেন মৃণালবাবু। মৌমিতার রাগ আবার ভারী সুরেলা এবং ধারালো ছিলো; সে'টাকে রাগ না বলে গোঁসা বলা ভালো। বড়ছেলে সে রাগের ধাত পেয়েছে।

গত চল্লিশ বছরে এই রাগের ডায়েরিতে অন্তত আড়াই হাজার মানুষের রাগের অভিব্যক্তির কথা লেখা আছে। বলাই বাহুল্য প্রায় প্রতি বছর নতুন ডায়েরি কিনতে হয়েছে। অথচ নিজের রাগ নিয়ে কোনো কথা লেখা হয়নি। তবে রাগ ব্যাপারটা নিয়ে এতটাই তলিয়ে দেখেছেন এত বছর মৃণালবাবু যে আদতকারণটা তিনি জানেন। মাথার ভিতরের চেপে রাখা বিষাক্ত ফনাটা ফস্ করে উঠলো। এত বছর ধরে সময়ে-অসময়ে ডায়েরিতে খসখসিয়ে লিখে যাচ্ছেন। যার তার সামনে, যখন তখন। অথচ পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব কেউই কখনও সামান্য আগ্রহও প্রকাশ করেনি মৃণালবাবুর ডায়েরি লেখা সম্বন্ধে। কী এত লিখে যান, কী বিষয়ে লিখে যান; কেউ কোনোদিনও জানতে চায়নি। মৃণালবাবু কি এতটাই ম্যাড়মেড়ে? এতটাই অনাগ্রহের বস্তু? এ'সব ভাবতেই মাথাটা দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করলো।

ঘরের সমস্ত আলো জ্বেলে, জলের পাম্প চালিয়ে, তারপর রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের জল চাপালেন মৃণলবাবু। রাগের ডায়েরি থেকে খানিকটা তফাতে এসে স্বস্তি বোধ করলেন ভদ্রলোক। রাগ-বিশারদ হিসেবে তিনি জানেন যে সবচেয় উচ্চমার্গীয় রাগ হলো নিখাদ অভিমান, সবচেয়ে বিষাক্তও বটে। হাইক্লাস অভিমানে ভাষা ও অভিব্যক্তি অচল। অতএব এ পৃথিবীর সবচেয়ে পেল্লায় রাগ-জার্নাল শ্রেষ্ঠ রাগের উল্লেখ থাকবে না। এ অপূর্ণতা যতটা ট্র্যাজিক, ততটাই কাব্যিক।

মৃণালবাবু ঠিক করলেন আজ দেবুর জন্য স্পেশ্যাল পেঁয়াজি ভাজবেন।

মাদুলিস্ট



- সায়েন্টিস্ট!
- বলুন।
- এ আমি কী শুনছি!
- কী শুনেছেন সে'টা বিশদে না বললে আমার মতামত দিই কী করে ক্যাপ্টেন।
- তুমি নাকি এক্সিস্ট করো না?
- ওহ, এই কথা। তা কে বললে?
- ভোরের আলো। ঘুম ভাঙব ভাঙব করছে।
- ওহ, সেল্‌ফ রিয়ালাইজেশন।
- ব্যাপারটা কী, তুমি সত্যিই এক্সিস্ট করো না সাইন্টিস্ট?
- আপনার গলায় ঝোলানো মাদুলিটা কিন্তু এক্সিস্ট করে ক্যাপ্টেন। ঘুমের ঘোরেও ছুঁয়ে দেখতে পারেন।
- মাদুলিটা রিয়েল। অথচ তুমি ব্যাটাচ্ছেলে আমার ফিগমেন্ট অফ ইমাজিনেশন।
- ক্যাপ্টেন, গুরুদেবের দেওয়া মাদুলিটাই রিয়েল হয়ে রইল আপনার জীবনে। এ'টা একটা ট্র্যাজেডি বটে।
- অ্যাই এ'সব ফালতু কথা বলার কোনও মানে হয় না। রোজ ঘুমের মধ্যে এ'সব লজিকাল বকর-বকর আর সয় না।
- মাদুলিটা বাদ দিন ক্যাপ্টেন। ইউ আর বিগার দ্যান মাদুলি।
- এই, এই যে। সকালের রোদ্দুর মুখে এসে পড়ছে। এ'বার ঘুম ভাঙবে। তুমি কেটে পড়ো দেখি সাইন্টিস্ট। ঘুমের কোয়ালিটি ইমপ্যাক্ট করছে এইসব বকবক।
- আর মাদুলিটা?
- আরে গুরুদেব কি আর এমনি এমনি দিয়েছে ও জিনিস? বেস্পতিটার পোজিশনটা ঠিক নেই। তারপর আবার রবির মুভমেন্টটাও নাকি রিলায়েবল নয়। সঠিক সময়ে মাদুলির সঠিক ডোজ না পড়লে ঘরে অশান্তি বাড়বে, অফিসের প্রমোশন ফসকাবে, শেয়ারের টাকাগুলো জলে যাবে। স্পষ্ট দেখেছেন গুরুদেব।
- ক্যাপ্টেন, সংসারে অশান্তি বাড়ছে আপনি মন দিয়ে বাড়ির লোকজনের কথা শুনছেন না বলে। অফিসের প্রমোশন ফসকাচ্ছে কারণ আপনি কাজের প্ল্যানিংয়ে মন দিচ্ছে না। শেয়ারের টাকাগুলো জলে যাবে কারণ ও'টা সাট্টাবাজার নয়, সে'খানে রিসার্চ আর ধৈর্য দুইই দরকারি। চট করে টাকাটা তুলে পিপিএফ অ্যাকাউন্টে রেখে দিন, সে'খানেই আপনার স্বস্তি ও মুক্তি।
- ফের সেই এক ঘ্যানরঘ্যানর। আরে বাবা মাদুলির পাওয়ারকে আন্ডারএস্টিমেট করার কোনও মানে হয় না। আমার মেজশালা এই গুরুদেবের থেকেই মাদুলি নিয়ে ফুলকপির পাইকারি সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় নেমে লাল হয়ে গেলো।
- সে লাল হয়েছে উদয়াস্ত খেটে।
- তুমি ভারি অ্যান্টি-মাদুলি সায়েন্টিস্ট। জাস্ট বিরক্তিকর!
- না, আমি প্রো-আপনি ক্যাপ্টেন। আমি আপনার দলে।
- যত বাজে কথা। তুমি আমার কল্পনা! আর এই যে আমার গলায় ঝুলছে এই মাদুলি; এ'টা কিন্তু এক্কেবারে রিয়েল ভায়া সায়েন্টিস্ট।
- আমায় সাইন্টিস্ট ডাকনামটা আপনারই দেওয়া, তাই না?
- স্বপ্নে আলাপ। স্বপ্নেই দেওয়া নাম।
- আপনার স্বপ্ন ফেলনা হতে যাবে কেন ক্যাপ্টেন? কত গুণী মানুষ আপনি, আর আমি সেই গুণী মানুষের বুকের সাহস ক্যাপ্টেন। আমি আপনার সাহস! আর ওই মাদুলিটা আপনার ভয়। ভেবে দেখুন, কোনটাকে রিয়েল বলে ধরে রাখতে চান।
- নাহ্‌। ভারি ইরিটেটিং তুমি সায়েন্টিস্ট। ভাবছি গুরুদেবের থেকে একটা বাড়তি টোটকা চাইতে হবে স্বপ্ন-লেস ঘুমের।
- টোটকাটা যদ্দিন না আপনার হাতে আসছে ক্যাপ্টেন, চেষ্টা আমায় চালিয়ে যেতে হবে। সায়েন্টিস্ট নাম দিয়েছেন, হাল ছাড়লে চলবে কেন?
- অ্যালার্মটা যে কখন বাজবে ছাই! যত্তসব গাজোয়ারি ব্যাপারস্যাপার!
( ছবিঃ জেমিনাই)

টিফিন



এইমাত্র আমার বাঁ কানের দু'ইঞ্চি দূর দিয়ে শাঁ করে একটা বুলেট বেরিয়ে গেলো। বয়েই গেছে তা'তে আমার। যুদ্ধে নেমে বাঁচা-মরা নিয়ে অত ভাবনা চিন্তা করতে নেই। মাথার ঘিলু আজ আছে কাল নেই, যে ঠ্যাঙ সকালে থাকবে সে'টা বিকেলে খসে পড়বে। অত ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল, আর টপাৎ করে মরে গেলে তো ল্যাঠাই চুকে গেল।

চিরকাল ভাড়াটে সৈনিক ছিলাম না। এককালে দিব্যি অ্যাকাউন্টান্টের চাকরী করতাম। দুপুর একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত লাঞ্চ, আমি বলতাম টিফিন-টাইম। বছর সাতেক আগে দেশে যুদ্ধ-টুদ্ধ লাগলো, চাকরী গেল, ঘরবাড়ি গেল। শুধু এই সাধের টিফিন-টাইমটাকে ধরে রেখেছি। অন্যদিনের মত আজও আমি টিফিন-টাইম শেষ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করব না।

একটু গাল চুলকে নিয়ে পিঠের ক্যানভাস বাগটা নামিয়ে আনলাম সামনে। সে'টার মধ্যে একটা মারাত্মক দামী জিনিস আছে। স্টিলের তোবড়ানো একটা বড়সড় টিফিনবাক্স। বাক্সটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ উলটেপালটে দেখলাম। এমন সময় হাত-কুড়ি দূরে একটা গ্রেনেড এসে পড়লো; দড়াম! বাঁ কানে গত দু'হপ্তা ধরে তালা লেগে আছে, সে'টা একদিক থেকে বাঁচোয়া; গ্রেনেডের শব্দের চোট শুধু ডান কানেই পড়লো। যাক গে। আসল ব্যাপার হলো এই টিফিন বাক্সটা।

টিফিনবাক্সের ঢাকনাটা সেঁটে বসে আছে অনেকদিন হলো। রোজকার মতই এখন আমার কসরত শুরু হবে সে ঢাকনা খোলার। মাথার ওপর দিয়ে খান ছয়েক বোমারু বিমান উড়ে গেল, তাদের উড়ে যাওয়ার সুরে দুলে দুলে হেই সামালো বলে টিফিনবাক্সের প্যাঁচে জোর লাগালাম। আজও খুললো না। অগত্যা ব্যাগ হাতড়ে দু'টুকরো শুকনো পাউরুটি বের করলাম। অগত্যা বলছি বটে, এই টিফিন বাক্স আমি গত তিন বছরে খুলতে পারিনি। প্রথম হপ্তা-দুই একটা পচা গন্ধ বেরিয়েছিল। সম্ভবত রুটি-সবজির। কী সবজি কে জানে। মিরুস্কিয়াকে যে জিজ্ঞেস করে জানবো যে সবজিটা কীসের ছিল তারও উপায় নেই। যে'দিন এ টিফিন সে আমার ব্যাগে গুঁজে দিয়েছিল, সে'দিন আমাদের বাড়িতে বোমা পড়ে।

আমি যে ভাঙা বাড়ির চাতালে বসে আছি, তার উল্টোদিকে বাড়ির তিনতলার ব্যালকনি থেকে ঝুপ করে একটা সৈনিকের লাশ সোজা পড়লো সামনের রাস্তার ওপর। বাইনোকুলারে চোখ রেখে দেখলাম দু'সেকেন্ড। ওঁর নাম ব্রুক্রসভ, আমার চেয়ে বছর সাতেকের ছোট। আলুর পাইকারি ব্যবসা ছেড়ে স্নাইপিং ধরতে হয়েছিল তাঁকে। সামান্য খারাপ লাগলো বটে, তবে টিফিন-টাইমে এ'সব ব্যাপারে বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো। ফের পাউরুটিতে কামড় দিলাম। সামান্য বাসি, তবে বাসি পাউরুটির একটা দিব্যি স্বাদ আছে। এর সঙ্গে একটু মাংসের ঝোল পেলে জমে যেত। মাংস রাঁধত বটে মিরুস্কিয়া। অবশ্য শুধু মাংস কেন, শাকপাতা যাই রাঁধত মনে হত অমৃত। ওর হাতে সত্যিই জাদু ছিল। ওর শেষ রান্নাতেও কী তুকতাক ছিল কে জানে, আজ পর্যন্ত টিফিনটা খুলতেই দিল না। রোজ দুপুরের টিফিন-টাইমে চেষ্টা করি, সে ঢ্যাঁটা স্টিলের টিফিনবাক্স কিছুতেই খোলে না।

ধড়াম! আমার থেকে বড়জোর দেড় ফুট দূরে একটা বড় কংক্রিটের চাঁই পড়লো।

হাসলাম, যদ্দিন স্টিলের টিফিনের ঢাকনা খুলছে না, তদ্দিন এ যুদ্ধ আমায় স্পর্শ করতে পারবে না। মিরুস্কিয়া যে জাদুতে এই টিফিন সাজিয়ে গেছে, সেই জাদুই আমায় বাঁচিয়ে রাখবে। যে'দিন ঢাকনা খুলবে, সে'দিন মিরুস্কিয়ার সঙ্গে আবার দেখা, ফের তাকে টিফিন সাজাতে বসতে হবে যে।

(ছবিঃ জেমিনাই)

পড্‌

অনিন্দ্য দিব্যি রোব্বারের মেজাজে সোফায় বসেছিলেন। সামনের দেওয়ালের মিউট রাখা টিভিতে এক আধুনিক গাইয়ে অত্যাধুনিক ভাবভঙ্গি করে গাইবার চেষ্টা করছিলন। সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা প্লেটটা সাফ হয়ে গেছে, তবে লুচি-বেগুনভাজার এঁটো চিনতে অসুবিধে হয় না।

এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো।
-হ্যালো!
- অনিন্দ্যবাবু! কেমন আছেন?
- আপনি কে? আমি...আমি কোথায়..।
- হে হে। আমি অফিস অ্যালার্ম। আপনার ড্রিমপডের দশ মিনিট কোটা শেষ। এ'বারে যে কাজে ফিরতে হয়।
- ওহ। তাই তো। যাচ্চলে। লুচির গন্ধটা এখনও আঙুলের ডগায় যে।
- এই না হলে সুপার পাওয়ার ন্যাপ। এ'বারে চটপট টেবিল গিয়ে বর্গিন অ্যান্ড বার্ক্সের ফাইলটা প্রসেস করে ফেলুন। বস অপেক্ষা করছেন।

ইমোশনাল ম্যাচুরিটি কী?

মাছের সিংহভাগ শেষ পাতের জন্য ফেলে রেখে, থালার বেশিরভাগ ভাত মাছের অক্ষত টুকরোটির দিকে তাকিয়ে শুকনো ভাবে চিবিয়ে না যাওয়া।

পেট ভরে গেলে জিভের ধার কমে যায়।

খিদের চাড় থাকতে থাকতে ভাত-মাছের কম্বিনেশন সুন্দর মাপা পরিমাণে এবং সঠিক রেশিওতে মুখে চালান দেওয়াটাই ম্যাচুরিটি।

ওষুধ

বাঙালির জরুরী ওষুধের ফর্দ:

১। বোরোলিন।
২। জোয়ানের আরক।
৩। জেলুসিল।
৪। গাঁট্টা।
৫। গড়িয়ে নেওয়া।
৬। ভাতেভাত।
৭। একটু হাওয়া খাওয়া।
৮। জুতোপেটা।