Sunday, March 16, 2025

অন্য গ্যালাক্সিতে



রাত সোয়া দশটা; বাসস্টপে একলা দাঁড়িয়ে ছিলেন সহদেব সাহা। ভদ্রলোকের বয়স চুয়ান্ন, চেহারা মজবুত। কাঁচাপাকা চুল, দিন চারেক না-কামানো খোঁচা দাড়ি গালে। কাঁধে ঝোলানো ফলস-লেদারের জরাজীর্ণ অফিস ব্যাগ। নীল-সাদা চেক হাফ শার্টটা ময়লা, পায়ের চামড়ার চটিটা যে অন্তত বছর তিনেক পুরনো তা বলে দিতে হয় না।

অন্তত ঘণ্টাখানেক হলো এ'খানে দাঁড়িয়ে সহদেববাবু। খান চারেক বাস এসে চলে গেছে। সদ্য কেনা বিড়ি বান্ডিলটাও অনেকটা খরচ হয়ে গেছে। সাড়ে দশটা নাগাদ অফিস ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল ফোনটা বের করলেন তিনি। এলাকাটা এতটাই নিরিবিলি যে মোবাইলে নম্বর ডায়্যাল করার পিকপিক শব্দটা বোধ হয় রাস্তার ও'পার থেকেও শোনা যেত।

- হ্যালো।
- আজ্ঞে, আজ্ঞে আমি সহদেব।
- সহদেব?
- সাহা। রেজিস্ট্রেশন নম্বর বারো বাই সি অব্লিক থ্রি ফোর সেভেন সিক্স নাইন ট্যু।
- বলুন সহদেববাবু।
- এ'টা স্টারফ্লায়্যার কোম্পানির হেল্পলাইন তো?
- আমি স্টারফ্লায়্যারের কাস্টোমার কেয়ার এক্সেক, জেমিনাই দত্ত।
- জে...জেমিনাইবাবু..। আমি রাজি। আপনাদের অফার, আমার আপত্তি নেই ও'তে।
- শিওর?
- আজ্ঞে।
- ফ্যামিলির কথা ভেবে দেখেছেন?
- যে আজ্ঞে।
- স্ত্রীর কথা ভেবে..।
- আপনাদের স্পেসশিপে জায়গা নেই কি?
- আছে তো। তবু। ভালো করে ভেরিফাই না করে নিলে..।
- আমি প্রস্তুত কিন্তু। এলআইসি, ব্যাঙ্ক; সব ব্যাপারস্যাপার আজ সামলে নিয়েছি। কারুর কোনো অসুবিধে হবে না।
- টাকাটাই তো একমাত্র সুবিধেঅসুবিধের ব্যাপার নয়।
- আপনার তাই ধারণা জেমিনাইবাবু?
- আমি ঠিক সে অর্থে সংসারী নই।
- তা'হলে আপনি বুঝবেন কী করে?
- ইয়ে। আর ফেরা হবে না কিন্তু।
- জানি। অন্য গ্রহ।
- অন্য গ্যালাক্সি সহদেববাবু।
- অন্য শহর হলেও একই ব্যাপার হত আমার জন্য।
- ইয়ে সহদেববাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আপনি আগ্রহের বশে রাজি হচ্ছন না বাড়ি থেকে পালাচ্ছেন?
- ছেলেবেলার পর বাড়ি থেকে পালানো যায় কি?
- বাড়ির লোক, অফিসের লোক, পাড়ার লোক খুব খোঁজখবর করবে আপনার মাসখানেক।
- স্বাভাবিক। ক'টা দিন উমার বড্ড খারাপ কাটবে। তারপর সামলে নেবে ঠিক।
- আর একবার জিজ্ঞেস করছি। আপনি নিশ্চিত তো?
- একশোবার।
- বহুত খুব। দশটা বেজে বেয়াল্লিশ মিনিট বারো সেকেন্ডে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়াব আপনার সামনে। চার দুই চার দুই নম্বর। বিনাবাক্যব্যয়ে উঠে পড়বেন।
- ট্যা..ট্যাক্সি?
- কলকাতার রাস্তায় ফ্ল্যায়িং সস্যার নামালে স্টারফ্লায়্যারের ব্যবসা টিকবে ভেবেছেন?

**

সহদেববাবুর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ভদ্রলোক টের পেলেন যে তার পরণে একটা সুতীর শাড়ি। শরীরটা মারাত্মক ভাবে অচেনা। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন ভদ্রলোক। চারপাশ তাকিয়ে টের পেলেন এ'টা তাঁর মধ্যমগ্রামের ফ্ল্যাটের শোওয়ার ঘর। মাথা তখনও ঝিমঝিম, গায়ের ব্লাউজ ঘামে ভিজে গেছে। হুড়মুড়িয়ে ঘরের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। অবাক হয়ে নিজেকে দেখলেন সহদেববাবু, বা বলা ভালো দেখলেন উমাকে। বিশুর "মা" ডাক শুনে বুক কেঁপে উঠলো তাঁর, কখন সে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাননি তিনি।

"মা, থানা থেকে বড়বাবু ফোন করেছিলেন। এলাকার সমস্ত হাসপাতাল মর্গ ওরা খুঁজে দেখেছে। বাবার কোনো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না"।

"সহদেব সাহাকে আর যে খুঁজে পাওয়া যাবে না রে বিশু", বলে মস্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উমাদেবী।

***
(ছবি: জেমিনাই)

ফুচকা ও প্রেম



আন্তর্জাতিক ফুচকা ফেডারেশন সম্প্রতি একটা রিপোর্টে জানিয়েছে ফুচকার পরিসরে সেরা প্রেমের লাইন কোনগুলো। সে রিপোর্ট আমার হাতে কী'ভাবে এলো তা জেনে আপনাদের কোনো কাজ নেই। লাইনগুলো কী কী সে'টা বরং জানিয়ে দিই।

"আর একটা খাও না, এই তো। আমার ফাউটা...নাও না। নাও বলছি তো"।

"দাদা! ও ঝাল কম খায়, ওর আলুমাখাতে যতটা ঝাল কম দেবেন ততটা আমারটায় বাড়িয়ে দেবেন। ব্যালান্স রাখতে হবে তো নাকি"।

"আহা, দু'টো বাটি নেওয়ার কী দরকার"।

"হ্যালো? হ্যাঁ। শুনছি। হ্যাঁ হ্যাঁ, আলুকাবলিটা প্যাক করাবো বলেই তো দাঁড়ালাম। কী? ফুচকা খাচ্ছি কিনা? ধুস। তোমায় ছাড়া ফুচকার মুচমুচ নেতিয়ে যায় যে"।

"গন্ধরাজ লেবুটা একটা জব্বর ডাইমেনশন যোগ করে না? ঠিক যেন আমাদের রিলশনশিপে তোমার ঘ্যানঘ্যানানি "।

"আমার উনি আবার ফুচকায় টকজল খান না, স্রেফ শুকনো ফুচকা। বলতে পারেন, উনি ফুচকা-ভিগান"।

সাহিত্য গুল

হাইকোয়ালিটি গুল আদতে সাহিত্য।

যে গুল যুক্তিতে কলুষিত নয়, বরং ফুর্তিরসে টইটম্বুর; সে'টাই আদর্শ।
তা'তে স্কেল বসানো হিসেবকিতেব থাকবে না, থাকবে আড্ডার পেট্রোলে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ফেলার উস্কানি।

নিখুঁত গুল পাতে পড়া মাত্রই সবাই জানবে সে'টা গুল অথচ উড়িয়ে দিতে পারবে না।

গুণী গুলবাজদের আগলে রাখুন। চা-শিঙাড়া খাওয়ান। শুধু ভোট দেবেন না।

মিস্টার চ্যাটার্জির শেষ ক'টা দিন



- মিস্টার চ্যাটার্জি।
- হুঁ?
- জানলাটা খুলে দিই?
- নার্স, হাতে আর কয়েকটাদিন মাত্র। ভিটামিন ডি দিয়ে করবটা কী। তার চেয়ে বরং টিভিটা অন করুন। ভালো সিনেমাটিনেমা কিছু দেখা যাক..।
- বাইরেটা দেখতে ইচ্ছে করছে না?
- জানালার বাইরে দু'টো নিম গাছ, একট কদমগাছের অর্ধেক দেখা যায়। বাকি সবই হাইরাইজ। মরে যাচ্ছি বলে জোর করে রোম্যান্টিক মেজাজ তৈরি করার কোনো মানে হয় না।
- সরি। আমি টিভি চালিয়ে দিচ্ছি।
- ডাক্তার বর্মন আমার রিকুয়েস্টটার ব্যাপারে কিছু বলেছেন?
- মাংসভাত পারমিট করবেন বলে তো মনে হয় না।
- ফুল।
- ও'ভাবে বলবেন না। বর্মন স্যারের মত ডাক্তার..।
- সরি, ওকে আমার ফুল বলা উচিৎ হয়নি।
- ইট ইজ ওকে।
- ব্লাডিফুল।
- কোন চ্যানেল দেখবেন?
- নার্স, আপনার খারাপ লাগলো? ডাক্তার বর্মনকে দু'টো কড়া কথা বলেছি বলে?
- না না..।
- করেক্ট। মনে রাখবেন আমি মারা যাচ্ছি। কয়েকদিনের মধ্যে। সিম্প্যাথি অলিম্পিকে টীম হুইলচেয়ার বা টীম ব্রেইলের আগে টীম শ্মশানকে এগিয়ে রাখাটা আপনাদের কর্তব্য।
- এ'ভাবে যে সবার সঙ্গে গা জ্বালানো সু্রে কথা বলছেন, তা'তে মনে মনে শান্তি পাচ্ছেন?
- বানিয়ে মিথ্যে বলার চার রইল না। অনেকটা নিশ্চিন্দি বোধ করছি।
- কোন চ্যানেল চালিয়ে দি বলুন তো? ক্রিকেট?
- টিট্যুয়েন্টি হলে ফাইন। লম্বা ফর্ম্যাট দেখার সময় নেই। সামান্য তাড়া আছে।
- সিনেমাই হোক।
- হিন্দি। মারপিটের। প্রিটেনশাস উঁহুআহা দেখে গাল চুলকাতে পারবো না।
- এই সিনেমাটা চলবে? নতুন রিলীজ..। প্রচুর অ্যাকশন।
- গুড। এ'বারে আসুন। ঘণ্টা তিনেক আমায় ডিস্টার্ব করবেন না।
- আমি নার্স। আপনার যা সিচুয়েশন আমি আপনার পাশে না থাকলে..।
- প্রচুর ইন্টিমেট সিন আছে এই সিনেমায়। আপনি পাশে থাকলে আমার ইনটেনশন যে কোনদিকে যাবে..।
- আপনাকে শায়েস্তা করার ক্ষমতা আমার আছে।
- নিজেকে শায়েস্তা করার ক্ষমতা আমার নেই। আপনি দেখতে তেমন মন্দ নন। শেষ পাতে নিজের চরিত্রের এই দিকটা ফলাও করার মানে হয় না। এমার্জেন্সি বেল আছে তো, আপনি আসুন।
- আর ইউ শিওর মিস্টার চ্যাটার্জি?
- নার্স, আপনার প্রফেশনে এই ন্যাকামো ব্যাপারটা খাপ খায়?
- আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।
- আপনার কোয়ার্টার তো হসপিটাল কম্পলেক্সেই। খামোখা এ'খানে বসে থাকা কেন। কোয়ার্টারে যান। বিপদআপদ হলে ছুটে আসতে বড়জোর মিনিট পাঁচ।
- আপনি এত খবর জোগাড় করলেন কী ভাবে? আমি তো কখনও..।
- আমার লিভারটা গেছে। মগজ, চোখ-কান বেশ টনটনে।
- আর জিভের ধারটাও।
- প্লীজ, ফ্লার্ট করবেন না। আমি আপনার পিসেমশাইয়ের বয়সী। যদি আপনার তেমন সুন্দরী পিসি থেকে থাকে আর কী।
- ভারি বিটকেল আপনি।
- মনে রাখবেন। আমি মারা যাচ্ছি। আনন্দ সিনেমাটা মনে করে হামেশা চোখটা ছলছলে করে রাখাটা সবার কর্তব্য।
- আর আপনার কাজ সবাইকে বিব্রত করে কথা বলা?
- আপনি ব্লাডিফুল নন। তবে বড্ড বেশি কথা বলেন। এ'বার আসুন। শারুক্কখান এসে পড়েছেন।
- আমি বাইরের বেঞ্চিতেই বসছি..।
- গো ব্যাক টু ইওর কোয়ার্টার..। আপনার জন্য আমার প্রেশার বাড়ছে..।
- আশ্চর্য! বেশ, আমি আসছি। লছমনকে বলে যাচ্ছি..।
- পিন্টুকে আমার হয়ে বার্থডে উইশ করে দেবেন।
- আপনি কী করে আমার ছেলের কথা...আর আজ যে ওর জন্মদিন সে'টাও বা..।
- আমি আপনার মোবাইল কল..ইয়ে..ওভারহিয়ার করি।
- আমি আপনার রুমে কখনও পার্সোনাল ফোন কল নিইনি।
- ইয়ে, চ্যাটফ্যাট পড়ে ফেলেছি হয়তো।
- মিস্টার চ্যাটার্জি!
- ভুলবেন না। সিম্প্যাথি অলিম্পিক। আমি আনন্দ সেহগল।
- আসুন। পিন্টু স্কুল থেকে ফিরে অনেকক্ষণ একা বসে।
- আমি ঘণ্টাখানেকেই ফিরে আসবো।
- আমার হাতে হপ্তাদুই আছে। খামোখা অত তাড়াহুড়ো কেন।
- কেক আনবো?
- ব্লাডিফুল পারমিশন দেবে?
- আমি রিকুয়েস্ট করবো ডাক্তার বর্মনকে..।
- আপনার রিকুয়েস্ট থাকলে বর্মন আমায় শুধু কেক কেন, লুচি বেগুনভাজা নিজের হাতে খাইয়ে দেবে।
- আপনার ইঙ্গিতটা শোভন নয় মিস্টার চ্যাটার্জি..।
- আপনি সিঙ্গল, ব্লাডিফুল সিঙ্গল এবং সৎ।
- আপনি ভীষণ ই্নট্রুসিভ! আর এ'টা রীতিমতো অন্যায়..!
- আসুন এ'বার। সুইমস্যুটে নায়িকা স্ক্রিনে এসে পড়েছেন। খামোখা আপনার সঙ্গে খেজুর করার মানে হয় না। সন্ধের ভিজিটিং আওয়ার্সের পর আমি বর্মনকে আর্ম ট্যুইস্ট করে আপনার কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেব।
- শাটাপ মিস্টার চ্যাটার্জি!
- নার্সদেবী, পিন্টুকে সে ব্লাডিফুল ভালোবাসে। স্নেহ করে। পিন্টুও তাকে পছন্দই করে।
- হাউ ডু ইউ নো?
- আমি শুধু আপনার মোবাইল চুরি করে পড়ি ভেবেছেন? ব্লাডিফুলের জার্নাল রয়েছে তার মোবাইলে, সে মোবাইলের পাসওয়ার্ড আবার আপনার জন্মদিন আর সে ক্যাবলা ডাক্তারের পকেট থেকে দিনেরবেলা মোবাইল সরালে সে রাত্তিরে গিয়ে টের পায়।
- কেক আনবো, কেমন?
- ব্ল্যাক ফরেস্ট প্লীজ। এইবারে, গেট আউট!
(ছবি: AI)

মনমোহন বৃত্তান্ত

বেয়াল্লিশ বছরের জীবনে মনমোহন মিত্র একদিনের জন্যও চাকরী বা ব্যবসার মত ফেরেব্বাজিতে পা দেননি। মনমোহনের দাদুর বাবা ছিলেন বর্ধমান জেলার ইসমাইলপুর গ্রামের জমিদার। জমিদারি, পয়সাকড়ি, জমিজায়গা সবই অবশ্য মনমোহনের দাদুর আমলেই উবে যায়। মনমোহনের বাবা ও মিত্র পরিবারের ব্ল্যাকশিপ,চন্দ্রমোহন বনেদী বংশের মুখে কালি লেপে রেলের ক্লার্ক হয়ে চাকরীতে ঢুকেছিলেন, পরিবারসহ এসে উঠেছিলেন কলকাতার এক ঘিঞ্জি কোণার এক দেড়-কামরার বাড়িতে। মনমোহন অবশ্য বংশমর্যাদায় ছোপ পড়ে এমন কিছু করেননি। ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে জীবন কাটিয়েছেন। স্কুলের অঙ্ক মাস্টার ক্লাস সেভেনে সামান্য অঙ্ক ভুলের জন্য কান মুলে দেওয়ায় আর স্কুল-মুখো হননি। দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারি বংশের রক্ত যার ধমনীতে বইছে, সে সামান্য স্কুলমাস্টারের মুখচোপা শুনতে যাবে কেন? আর শিক্ষা কি আর বইখাতা ডিগ্রিতে আছে নাকি, মনমোহন বিশ্বাস করেন স্রেফ চোখকান খোলা রাখাটাই যথেষ্ট।

সামাজিক দায়িত্ব বলতে মাঝেমধ্যে বালিগঞ্জের ছোটমামার বাড়িতে ঢুঁ মেরে থাকেন তিনি। ছোটমামা অজিত দত্ত ডাকসাইটে উকিল, অগাধ টাকাপয়সা। সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো ছোটমামা বিয়ে-থা করেননি। তদুপরি নিশ্চিন্দির ব্যাপার হলো বড়মামা কলেজে পড়ার সময় তিন দিনের জ্বরে মারা গেছিলেন। কাজেই ছোটমামার তিনকুলে এক ওই মনমোহন ছাড়া আর কেউ নেই। বালিগঞ্জের বাড়ি, সিন্দুকের সোনাদানা, ব্যাঙ্কের টাকা পয়সা, শান্তিনিকেতনের ভিলা থেকে বাড়ির চাকরবাকর ও বাবুর্চি ননীরাম পর্যন্ত মনমোহনকেই পকেটস্থ করতে হবে। এ অবস্থায় চাকরী-ব্যবসার চিন্তা করা পাপ। আপাতত একটু হাতটান সামাল দিয়ে চলতে হয়, কারণ ছোটমামার থেকে পাওয়া মাসহারাটা তেমন পকেট-ভরা নয়। তবে ও নিয়ে সবিশেষ মাথা ঘামালে জমিদারিই আমেজ নষ্ট হয়। ছোটমামার হার্টের ব্যামো, ব্লাডশুগার চড়া, এ'ছাড়াও আরও নানাবিধ গোলমেলে রোগ লালনপালন করেছেন বহু বছর। বয়সও নয় নয় করে আশি পেরিয়েছে। এখন-তখন ব্যাপার হয়েই বহুদিন টিকে ভদ্রলোক। বালিগঞ্জের বাড়িতে এসে মামার শরীরের অবস্থা মাঝেমধ্যে যাচাই করে যায় মনমোহন। বুড়োর সঙ্গে খানিকক্ষণ খেজুরে আলাপও জুড়তে হয়, না হলে ননীরামের হাতের পোলাও, মাংস, বিরিয়ানি ইত্যাদি আদায় করা যায় না।

ভাদ্র মাসের এক শনিবার সন্ধেবেলা দু'পাত্তর চড়িয়ে রেডিওয় টপ্পা শুনতে বসেছিলেন। এমন সময় বালিগঞ্জ থেকে ছোটমামার আর্দালি মেহবুব এসে হাউমাউ রব তুলে খবর দিলে মামা আচমকা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। অমনি প্রফুল্ল চিত্তে একটা ভালো দেখে সুতীর পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মনমোহন। শ্মশানে বডির একটা হিল্লে করে নিজের বাসায় ফিরে এলেন ভোরের দিকে। আসার আগে অবশ্য মামার সেক্রেটারি অমরেশকে বলে এসেছেন শ্রাদ্ধটা রাজকীয় ভাবে সারতে হবে, অন্তত আড়াই হাজার লোক নেমন্তন্ন করে দেখাতে হবে যে অজিত দত্তর ভাগনে ভারি মামুলি চিজ নয়। বাড়ি ফিরে নিজের চৌকিতে গা এলিয়ে শ্রাদ্ধের আয়োজন নিয়েই জল্পনা-কল্পনা করছিলেন। কত চিন্তা, শ্রাদ্ধে নহবত বসালে লোকজন নিন্দে করবে কী না, মৎস্য-মুক্তির দিন একটা স্পেশ্যাল ইলিশ উৎসবের আয়োজন করাটা বাড়াবাড়ি হবে কিনা; এমন হাজারো চিন্তা। তা'ছাড়া এ'বার এই ভাঙাচোরা বাড়ি ছেড়ে বালিগঞ্জে গিয়ে উঠতে হবে, রাজ্যপাট বুঝে নিতে হবে। ভোর হলে স্নান করে বেরিয়ে কালীঘাটে পুজো দিয়ে এলেন, অনেকদিনের পুরনো মানত তাই দেরী করা চলে না।

দুপুরের দিকে ভাতেভাত খেয়ে একটু ঘুমের তাল করছেন এমন সময় অ্যাডভোকেট নরেন মণ্ডল এসে হাজির। প্রৌঢ় মানুষ, আর আপত্তিকর-ভাবে বিচক্ষণ। একসময় ছোটমামার জুনিয়র ছিলেন, দু'জনের মধ্যে ভারী দহরমমহরম ছিল। ভদ্রলোক মনমোহনকে পছন্দ করেন না। মনমোহন ভদ্রলোককে পাত্তা দেন না। নরেনবাবু আজ এসে ঘোষণা করলেন যে তিনি এসেছেন ছোটমামার উইলের ব্যাপারে বিশদে জানাতে। এ অবস্থায় খানিকটা মিঠে ব্যবহার না করে উপায় কী।

- বলুন নরেনকাকা, স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু আছে, তা এই বেলা বুঝে নেওয়া ভালো।
- হ্যাঁ, তাই ভালো মনু।
- তাঁর আগে বলুন, চা খাবেন? আমার এই বাসায় অবশ্য চা বিস্কুটের বেশি কিছু নেই। কিন্তু বালিগঞ্জে গিয়ে একবার গুছিয়ে বসতে দিন। তারপর আপনি এলেই দামী ওয়াইন খাওয়াব। তা'ছাড়া ননীরাম চমৎকার কাবাব বানায়, নেহাত মামার বাতিকে ও'সব এদ্দিন হতো না...।
- সে'সব কথা থাক এখন। যা বলছিলাম...।
- হ্যাঁ, সম্পত্তির ব্যাপারটা এইবারে...।
- অজিতবাবুর উইল অনুযায়ী তুমি পেয়েছ এক ট্রাঙ্ক কাঁসার বাসনপত্র।
- ও'টা আবার আলাদা করে বলার দরকারটা কী, সবকিছুই যখন...।
- আলাদা? আলাদা কীসের। ও'টাই পেয়েছ তুমি। আর ইয়ে, তোমার মাসহারাটাও এ'বার বন্ধ হলো।
- মামা কি বাড়ি-ঘরদোর টাকা পয়সা সব আশ্রম-ফাশ্রম কোথাও দিয়ে গেছে?
- না, ওই কাঁসার বাসনের ট্রাঙ্ক ছাড়া যা কিছু স্থাবর-অস্থাবর সবই পাচ্ছে বিনোদিনী দাসী।
- বিনোদিনী দাসী? মামা গোপনে বিয়েথা করেছিলেন?
- না না। বিনোদকে অজিতবাবু হপ্তা-খানেক আগে বাড়ি এনেছিলেন নিউ মার্কেট থেকে। বিনোদিনী একটা দিশি টিয়াপাখি।
- মামা নিজের টাকাপয়সা সব একটা টিয়াপাখিকে দিয়ে গেছে?
- অল্পদিনের মধ্যে খুব ভালো বেসে ফেলেছিলেন। তাই গত শনিবার আমায় ডেকে এই উইল বানানোর ব্যবস্থা করে যান।
- কই, গতকাল বালিগঞ্জের বাড়িতে তো তাকে দেখলাম না।
- অজিতবাবু মারা যাওয়ায় তাঁর ভারী মনখারাপ কিনা, তাই সে দু'দিন সে বাইরের লোকের সামনে আসেনি।

জমিদারবাড়ির রক্ত বইছে মনমোহনের শরীরে, অল্পে ভেঙে পড়লে তাঁর চলবে কী করে। মাসহারাও যখন বন্ধ হলো, তখন সে টিয়াপাখির মন যুগিয়ে চলা ছাড়া আর উপায় কী। ফি শনিবার দুপুর নাগাদ দু'শো গ্রাম লাল লঙ্কা কিনে বিনোদের সঙ্গে দেখা করে আসেন মনমোহন। ননীরাম ভেজানো ছোলা দিয়ে যায় দু'জনকে; মনমোহনকে স্টিলের প্লেটে আর বিনোদিনীকে রুপোর বাটিতে।

বিনোদিনী মোটের ওপর গালগল্প চালিয়ে নিতে পারে। মাঝেমধ্যে একই কথা বারবার বলে চলে বটে কারণ তার শব্দের স্টক সে অর্থে মজবুত নয়। তবে রসবোধ আছে। পকেট ফাঁকা হলেও মনমোহনের মেজাজটা রহিস, কাজেই বিনোদের উপর কোনো রাগ পুষে রাখেনি সে। শুধু একটাই ছোট্ট সমস্যা। বিনোদিনী "হরি দিন তো গেল সন্ধে হলো" গাইতে পারে, "হরি হে মাধব" বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারে, ননীরামকে "রান্নায় মন নেই তোমার" বলে খোঁটা দিতে পারে; পারে না শুধু মনমোহন নামটা উচ্চারণ করতে। মনমোহন গেলেই সে বিগলিত সুরে বলবে, "রাস্কেলটা এসেছে, রাস্কেলটা এসেছে, রাস্কেলটা এসেছে"। ভারী অদ্ভুত, তবে ওই সামান্য ব্যাপারটা গায়ে মাখেন না মনমোহন।

অফিসটাইম



কী অদ্ভুত। আজ বাসস্টপ প্রায় ফাঁকা বললেই চলে। আশেপাশের দোকানপাটগুলোতেও লোকজন কম, কয়েকটা দোকানের আবার শাটার নামানো। কে জানে কেউ বনধ-টনধ ডেকেছে কিনা। সুদীপবাবু অফিস-টাইমের ঝুলোঝুলিতে দিব্যি অভ্যস্ত, তবে মাঝেমধ্যে এমন ফাঁকায় ফাঁকায় অফিস যেতে পারলে মন্দ লাগে না।

পৌনে আটটার এল-সেভেন-বাই-সতেরো বাসটা অবশ্য টাইমেই এলো। আজ বাসও প্রায় ফাঁকা। জনা সাতেক লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। একটা পছন্দসই জানালা বেছে বসে পড়লেন সুদীপবাবু। এপ্রিল মাসের রোদ্দুরও মিষ্টি মনে হলো ভদ্রলোকের। খান-তিনেক স্টপেজ পেরোনোর পরেও বাসের লোকজন তেমন বাড়লো না, শহরটাই আজ যেন ঝিমিয়ে আছে।

মিনিট দশেকের মাথায় কন্ডাক্টর এগিয়ে এলেন। এ রুটে বছর সতেরো যাতায়াত করছেন সুদীপবাবু, প্রায় সব কন্ডাক্টরই তাঁর মুখ-চেনা, মাঝেমধ্যে "ভালো তো?" গোছের হাসির আদানপ্রদানও হয় তাঁদের সঙ্গে। কিন্তু এই ভদ্রলোককে ঠিক চেনা ঠেকল না। পরিপাটি চেহারা, বয়স ওই সুদীপবাবুরই মত, চল্লিশ পেরিয়েছে নির্ঘাত।

"একটা পলসন স্ট্রিট অফিস মোড়" বলে মানিব্যাগ বের করলেন সুদীপবাবু। কী আশ্চর্য, কন্ডাক্টর মিষ্টি হেসে বললেন, "আপনার আজ টিকিট লাগবে না"। খানিকটা হকচকিয়ে কন্ডাক্টর ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন সুদীপবাবু। অমায়িক মেজাজে কন্ডাক্টর বললেন,

- এ রুটের পুরনো কাস্টোমারদের জন্য আজ স্পেশ্যাল ট্রিপ, ভাড়া লাগবে না!
- মানে?
- মানে, এ রুটের বাস বছর দশেক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও যারা আমাদের সঙ্গে ছাড়েনি, তাঁদের জন্য স্পেশ্যাল হাওয়া-খাওয়া ট্রিপ।
- ইয়ার্কি মারছেন?
- তৌবা তৌবা।
- টিকিটটা দিন।
- এ রুট এখন বন্ধ, বললাম তো সুদীপবাবু। আজ আপনাদের ট্যুর অফ অনার। উপভোগ করুন।

কন্ডাক্টর সরে গেলেন। ফালতু ইয়ার্কি সুদীপবাবুর ঘোর অপছন্দ, তাও আবার সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষের মুখ থেকে। পাত্তা না দেওয়াই ভালো।

বাস পলসন স্ট্রীটে পড়ার পর জানালার বাইরে চেয়ে আরও খানিকটা অবাক হতে হলো সুদীপবাবুকে। রাস্তাটা একই আছে, কিন্তু এলাকার দোকানপাট বাড়ি-ঘরদোরগুলো সব কেমন অন্যরকম। অফিসপাড়ার বাসস্টপ আসতে নেমে পড়লেন তিনি, কন্ডাক্টরকে আর ভাড়া নিয়ে সাধাসাধি করার মানে হয় না। বাসস্টপের পাশেই অমিয়র পান দোকান। সে'খানে দাঁড়িয়ে একটা ফ্লেক ধরিয়ে অফিসের দিকে হেঁটে যাওয়াটা পুরনো অভ্যাস। আজ অমিয়কে দেখে সামান্য অবাক হতে হলো। সে যেন একদিনের মধ্যে অনেকটা বুড়িয়ে গেছে।

- শরীর কেমন অমিয়?
- ওই, যেমন থাকে আর কী।
- একটা ফ্লেক।
- সে কী, আপনি আবার সিগারেট ধরলেন নাকি? কী দরকার বলুন তো এ বয়সে। চ্যুয়িংগগামেই তো বছর কয়েক দিব্বি চললো। ও জিনিস আর ধরবেন না।

সামান্য বিচলিত বোধ করলেন সুদীপবাবু। স্ত্রীকে একটা ফোন করা দরকার, রহমানের এসটিডি বুথটা অমিয়ের পানের দোকান ঘেঁষে। কিন্তু সে'দিকে তাকেতেই টের পেলেন ওখানে রাতারাতি একটা এটিএম গজিয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে টের পেলেন তাঁর বুক পকেটে মোবাইল ফোন। আর সবচেয়ে বড় কথা, অমিয়র পানের দোকানের সামনে নিজের মারুতি গাড়িটা বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না; 'নো পার্কিং' এলাকা; যখন-তখন ট্র্যাফিক পুলিশ চালান ধরিয়ে দিতে পারে।

শেষ চিঠি



- চিঠি? পোস্টাপিসের ছাপ মারা তায় আবার!

- এই যে, এই দেখুন না মশাই। আপনার নামে। এই যে আপনার নাম লেখা, শ্রী অরিন্দম সাহা, সতেরো নম্বর মন্মথ দত্ত লেন। এইখানে সই করে রিসিভ করে নিন। তারপর আমার ছুটি।

- গত মাসে পোস্টাপিস সব বন্ধ হয়ে গেল না? গভর্নমেন্ট ডিক্রি বেরোলো..। চাদ্দিকে কত লেখালিখি। নিউজচ্যানেল জুড়ে কত খবর।

- হয়ে গেলো তো। পোস্টবাক্সে পড়ে থাকা শেষ কিস্তির চিঠিগুলো বিলি হলো চটজলদি। পোস্টঅফিসে আমরা যারা চাকরি করতাম তারা সবাই অন্যান্য সরকারি অফিসে ট্রান্সফার হলে বা ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট পেলে। ফাইলপত্র বিদেয় হলো। পোস্টঅফিসঘর যা ছিল সবই বেচে দেওয়া হচ্ছে। পোস্টবাক্সগুলো একদু'টো মিউজিয়ামে দেওয়া হয়েছে, বাকি সব স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে।

- আর আপনি?

- আমি মন্দার সমাদ্দার। আমি কিন্তু পোস্টম্যান নই। কলপুকুর পোস্টঅফিসের পোস্টমাস্টার ছিলাম। ওই, রিটায়ার করিয়ে দিলে। আজ শুধু এই স্পেশ্যাল অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে..।

- বুঝছি না। এই চিঠি আপনার স্পেশ্যাল অ্যাসাইনমেন্ট?

- সরকারি অডিটে দেখা গেছে যে গোটা দেশে এই একটা চিঠি ডেলিভার না হয়ে পড়েছিল। তাই আমায় তলব করা হয়েছে..। যদিও এ চিঠি নাকি সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পার হয়ে যাওয়া পর পোস্ট হয়েছিল। তবু, ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট অনুযায়ী এ'টাই এ দেশের পোস্টবাক্সে পড়া শেষ চিঠি। কাজেই স্পেশ্যাল অর্ডারে এ চিঠি নিয়ে আমি নিজে এসেছি।

- এ'টাই তবে পোস্টাপিসের শেষ চিঠি?

- এ'টাই। সই করে দিন প্লীজ।

***

অরিন্দমবাবু,

এই চিঠি কেউ পাবে না। তা'তেই মঙ্গল। প্রশ্ন হচ্ছে, তবে এ চিঠি লিখছি কেন? কারণ সুইসাইড নোট ব্যাপারটা একটু নাটুকে না হলে চলে না। সরকারবাহাদুরের নিদান অনুযায়ী আজ রাত বারোটার পর পোস্টবাক্স যে'সব চিঠি পড়বে তা ডেলিভার হবে না। আমি সোয়া বারোটা নাগাদ এ চিঠি পোস্ট করবো। অতএব এ সুইসাইড নোট চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে।

এ চিঠি যেন অন্য কারুর হাতে না পড়ে, তাতেই আমার নিশ্চিন্দি। মারা যাওয়া নিয়ে মরাকান্না আমার নাপসন্দ। নেহাৎ কিছু একটা না লিখলে সুইসাইড ব্যাপারটা ম্যাড়মেড়ে দেখায়।

যা'হোক। এ'দিকে হলো না। অন্যদিকে পৌঁছে ভালো থাকবেন, প্লীজ।

ইতি

অরিন্দম।

***

- কী মুশকিল স্যার, বলছি তো। ভদ্রলোক স্পষ্ট আজ সকাল আমার থেকে চিঠিটা ডেলিভারি নিলেন আর রিসিভ করা সইও দিলেন। ওর নিজের বাড়ির সামনে।

- মিথ্যে কথা আর কত বলবেন মন্দারবাবু। স্বীকার করে নিন না ওই রিসিভ করা সই জাল। আর চিঠিটা আপনি জাস্ট ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।

- মাক্কালী বলছি ও চিঠি আমি নিজের হাতে অরিন্দমবাবুর হাতে তুলে দিয়েছি!

- ভদ্রলোক গত পরশু নিজের বাড়িতেই সুইসাইড করেছেন। আজ বিকেলে পুলিশ দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে দেখে বডি পচতে শুরু করছে। তাও আপনি অম্লান বদনে মিথ্যে চালিয়ে যাবেন?