এক সময়ে অনেকের প্রেমে পড়া দেখেছি। স্কুলে কলেজে তিন ভাগের দু'ভাগ ছেলেরা যেমন ভাবে বাকি এক ভাগের প্রেমে সাঁতরানো দেখে মুখে বাহবা আর মনে মনে দুয়ো দেয় আর কী; সে'ভাবেই।
সুগন্ধি চিঠি, 'দিল' চিহ্ন দেওয়া ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড, কাচের বুদ্বুদে বলডান্স করা দম্পতি থেকে পালিয়ে হাফ বিয়ে, ব্লেডে হাত কেটে নাম লেখা। কিন্তু সে সব প্রেম বাপটুদার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। বাপটুদা আমার চেয়ে মাত্র দু'ক্লাসে ওপরে পড়ত, এবং আমায় নিয়ম করে কেমিস্ট্রি পড়াত। বলা ভালো আমায় টেনেটুনে পাস করাত।
সেই বাপটুদার চাবুক কলেজ প্রেম নিয়ে চারটে কথা টুকে রেখে দেওয়া উচিৎ। ওর বাইশ নম্বর চিঠি যখন নিমকি-দি না ছিঁড়ে মিচকি হাসল, সে'দিন থেকেই বাপটুদা বাউল বনে গেছিল। মাঝেমধ্যেই অন্যমনস্ক হয়ে সোফার কুশন-কভার চিবিয়ে মায়ের কাছে বিস্তর গাঁট্টা খাচ্ছিল। আমায় বলে দিয়েছিল "কেমিস্ট্রিফেমিস্ট্রি পড়ে কী হবে রে? পূর্ণেন্দু পত্রী পড়। সময় কম। পড়ে ফেল"। বুঝেছিলাম কেমিস্ট্রিতে পাস করার ব্যাপারটা ঝুলে গেল।
যা হোক। বাপটুদার মুখে সেই প্রথম শুনেছিলাম "ফোকাস ছাড়া প্রেম দাঁড়াবে না। কমিটমেন্টে এস্পারওস্পার নেই"। সমস্ত বন্ধু ত্যাগ করেছিল। নেহাত কেউ পাশে না থাকলে প্রেমিকের কোটগুলো নোট করার কেউ থাকবে না, তাই বোধ হয় আমি আশেপাশে ঘুরঘুর করলে বিরক্ত হত না।
বাপটুদার প্রেম-ফোকাসের প্রথম শহীদ আমার কেমিস্ট্রি। এর পর পাড়ার নাটক। বাপটুদার "বিবাহ বিভ্রাট"য়ে হিতেন হওয়ার কথা ছিল। দেড় মাস রিহার্সালের পর দল ছেড়ে দিল। এই সময় নাকি মনে "পজিটিভ ভাইব" পোষা উচিৎ; "বিবাহ বিভ্রাট" নামটা অত্যন্ত গোলমেলে। তাছাড়া প্রেমিকের স্পন্টেনিটি নাকি পার্ট মুখস্থ করলে নষ্ট হবে। নিমকি-দি "ওগো হ্যাঁগো" শুরু করলে তো বাপটুদা পাশে প্রম্পটারকে পাবে না। নিমকিদির স্বপ্নে বিভোর বাপটুদার পান্তুয়া খাওয়া অসম্ভব বেড়ে গেছিল। আর যে'টা আমার জন্য কেমিস্ট্রির চেয়েও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে'টা হল বাপটুদা ওর বাবার পকেট মারা বন্ধ করে দিয়েছিল। মন-চুরিতে হাতেখড়ির পর নাকি এ;সব ছিঁচকে চুরি আর সাজে না। এ'দিকে বাপটুদার বিবেকানন্দবাজিতে আমার বিকেলের ফ্রী ফুলুরি জলে যাওয়ার উপক্রম।
বাপটুদাকে ডি-ফোকাস করার জন্য ফলাও করে ক্লাবের পিকনিকের মেনু শুনিয়েছিলাম। পাঁঠার কালিয়া, মুর্গি ভাজা শুনে বলল "নিমকির কপালে ছোট্ট টিপ বড় মানায়। সে'টা নিয়ে একটা কবিতা লিখতে হবে। পিকনিকটিকনিকে কবিরা তাস খেলে, হুল্লোড় করে; নষ্ট হয়"।
মোদ্দা কথা চোখের সামনে দেখছিলাম বাপটুদা মহাপুরুষ বনে যাচ্ছে অথচ ওকে বাঁচাতে চেয়েও আমি কিছু করতে পারছিলাম না। নিমকি-দির ওপর বড় রাগ হচ্ছিল। বাপটুদা সবে টেবিল টেনিস খেলা শেখাতে শুরু করেছিল, বিকেলের সেই সময়টা এখন সে নিমকিদির টিউশন থেকে ফেরার রাস্তায় অপেক্ষা করে থাকে। নিমকিদি লেডিবার্ড সাইকেলে চেপে আলতো হাসি ভাসিয়ে বেরিয়ে যাবে, সেই কয়েক সেকেন্ডের আবেশের জন্য ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে থাকে।
বাপটুদা একরকম হাতের বাইরে চলেই গেছিল। আর কোনও উপায় নেই দেখে কেমিস্ট্রির খান দুই গাইড বই জোগাড় করে ফেলেছিলাম। পাড়ার পিকনিকের জন্য বিস্তর ছোটাছুটিও শুরু হয়ে গেছিল। আচমকা এক বিকেলে বাপটুদা বাড়ি এসে হাজির। পিকনিকের মাংস কে রাঁধছে সে খবর নিলে, কেমিস্ট্রি বই খুলে দু'একটা প্রশ্ন করে কান মুলে দিলে। ঠাহর করতে পারলাম শেষ পর্যন্ত ওর বাইশ নম্বর চিঠিটা বোধ হয় নিমকিদি ছিঁড়ে ফেলেছে। আপদ চুকেছে ভেবে নিজেই নিজের মনের ভিতর খানিকটা লাফিয়ে নিলাম। মুখে অবশ্য বললাম "আহা বাপটুদা, তোমার কী কষ্ট"।
"কষ্ট? কষ্ট কীসের? সমস্ত কষ্টের ওষুধ এখন আমার পকেটে। বাবা গতকাল মাইনে পেয়েছিল বোধ হয়। কড়কড়ে দু'টো একশো টাকার নোট সরিয়েছি। আজ আর ফুলুরি নয়। রুটি, ডিম তড়কা, ডিম ভুর্জি আর থামস আপ। তারপর এক জোড়া হরিদার নারকোলের সন্দেশ। কেমন"?
"নিমকিদি না করেছে তো? বল্টেদার সঙ্গে ঘুরছে নাকি"?
"বল্টেকে বাগে আনা আমার বাঁ হাতের খেল"।
"তোমার বাইশ নম্বর চিঠি নিমকিদি ছিঁড়ে ফেলেনি? আগের একুশটার মত"?
"না। ছিঁড়ে ফেলেনি। উলটে উত্তর দিয়েছে। গদগদ উত্তর"।
"তাহলে? আমায় কেমিস্ট্রি পড়া ধরছ যে বড়"?
"নিমকির সে প্রেমের চিঠিময় বানান ভুলের ল্যান্ডমাইন ছড়ানো রে! আর রজনীকান্তের লাইন রবীন্দ্রনাথে গুলিয়েছে। প্রেম করব না টিউশনি পড়াব? টিউশনির জন্য এই তুই তো আছিস, প্রিমিয়াম কেমিস্ট্রি গাধা"।
পরে পাড়ার কিছু দুর্জনে রটিয়েছিল বল্টেদার প্রভাবেই নিমকি মুচমুচিয়ে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেছিল। আমি অবশ্য বাপটুদার কাছে বাইশ নম্বর চিঠির উত্তর হাতেকলমে দেখতে চেয়ে কেমিস্ট্রি পাস ডকে তুলতে চাইনি। এমন কী বাপটুদার আচমকা গুরু দত্ত ভক্তির কারণও খুঁজতে যাইনি; ফ্রী ফুলুরির মায়া বড় মায়া।
সুগন্ধি চিঠি, 'দিল' চিহ্ন দেওয়া ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড, কাচের বুদ্বুদে বলডান্স করা দম্পতি থেকে পালিয়ে হাফ বিয়ে, ব্লেডে হাত কেটে নাম লেখা। কিন্তু সে সব প্রেম বাপটুদার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। বাপটুদা আমার চেয়ে মাত্র দু'ক্লাসে ওপরে পড়ত, এবং আমায় নিয়ম করে কেমিস্ট্রি পড়াত। বলা ভালো আমায় টেনেটুনে পাস করাত।
সেই বাপটুদার চাবুক কলেজ প্রেম নিয়ে চারটে কথা টুকে রেখে দেওয়া উচিৎ। ওর বাইশ নম্বর চিঠি যখন নিমকি-দি না ছিঁড়ে মিচকি হাসল, সে'দিন থেকেই বাপটুদা বাউল বনে গেছিল। মাঝেমধ্যেই অন্যমনস্ক হয়ে সোফার কুশন-কভার চিবিয়ে মায়ের কাছে বিস্তর গাঁট্টা খাচ্ছিল। আমায় বলে দিয়েছিল "কেমিস্ট্রিফেমিস্ট্রি পড়ে কী হবে রে? পূর্ণেন্দু পত্রী পড়। সময় কম। পড়ে ফেল"। বুঝেছিলাম কেমিস্ট্রিতে পাস করার ব্যাপারটা ঝুলে গেল।
যা হোক। বাপটুদার মুখে সেই প্রথম শুনেছিলাম "ফোকাস ছাড়া প্রেম দাঁড়াবে না। কমিটমেন্টে এস্পারওস্পার নেই"। সমস্ত বন্ধু ত্যাগ করেছিল। নেহাত কেউ পাশে না থাকলে প্রেমিকের কোটগুলো নোট করার কেউ থাকবে না, তাই বোধ হয় আমি আশেপাশে ঘুরঘুর করলে বিরক্ত হত না।
বাপটুদার প্রেম-ফোকাসের প্রথম শহীদ আমার কেমিস্ট্রি। এর পর পাড়ার নাটক। বাপটুদার "বিবাহ বিভ্রাট"য়ে হিতেন হওয়ার কথা ছিল। দেড় মাস রিহার্সালের পর দল ছেড়ে দিল। এই সময় নাকি মনে "পজিটিভ ভাইব" পোষা উচিৎ; "বিবাহ বিভ্রাট" নামটা অত্যন্ত গোলমেলে। তাছাড়া প্রেমিকের স্পন্টেনিটি নাকি পার্ট মুখস্থ করলে নষ্ট হবে। নিমকি-দি "ওগো হ্যাঁগো" শুরু করলে তো বাপটুদা পাশে প্রম্পটারকে পাবে না। নিমকিদির স্বপ্নে বিভোর বাপটুদার পান্তুয়া খাওয়া অসম্ভব বেড়ে গেছিল। আর যে'টা আমার জন্য কেমিস্ট্রির চেয়েও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে'টা হল বাপটুদা ওর বাবার পকেট মারা বন্ধ করে দিয়েছিল। মন-চুরিতে হাতেখড়ির পর নাকি এ;সব ছিঁচকে চুরি আর সাজে না। এ'দিকে বাপটুদার বিবেকানন্দবাজিতে আমার বিকেলের ফ্রী ফুলুরি জলে যাওয়ার উপক্রম।
বাপটুদাকে ডি-ফোকাস করার জন্য ফলাও করে ক্লাবের পিকনিকের মেনু শুনিয়েছিলাম। পাঁঠার কালিয়া, মুর্গি ভাজা শুনে বলল "নিমকির কপালে ছোট্ট টিপ বড় মানায়। সে'টা নিয়ে একটা কবিতা লিখতে হবে। পিকনিকটিকনিকে কবিরা তাস খেলে, হুল্লোড় করে; নষ্ট হয়"।
মোদ্দা কথা চোখের সামনে দেখছিলাম বাপটুদা মহাপুরুষ বনে যাচ্ছে অথচ ওকে বাঁচাতে চেয়েও আমি কিছু করতে পারছিলাম না। নিমকি-দির ওপর বড় রাগ হচ্ছিল। বাপটুদা সবে টেবিল টেনিস খেলা শেখাতে শুরু করেছিল, বিকেলের সেই সময়টা এখন সে নিমকিদির টিউশন থেকে ফেরার রাস্তায় অপেক্ষা করে থাকে। নিমকিদি লেডিবার্ড সাইকেলে চেপে আলতো হাসি ভাসিয়ে বেরিয়ে যাবে, সেই কয়েক সেকেন্ডের আবেশের জন্য ঘণ্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে থাকে।
বাপটুদা একরকম হাতের বাইরে চলেই গেছিল। আর কোনও উপায় নেই দেখে কেমিস্ট্রির খান দুই গাইড বই জোগাড় করে ফেলেছিলাম। পাড়ার পিকনিকের জন্য বিস্তর ছোটাছুটিও শুরু হয়ে গেছিল। আচমকা এক বিকেলে বাপটুদা বাড়ি এসে হাজির। পিকনিকের মাংস কে রাঁধছে সে খবর নিলে, কেমিস্ট্রি বই খুলে দু'একটা প্রশ্ন করে কান মুলে দিলে। ঠাহর করতে পারলাম শেষ পর্যন্ত ওর বাইশ নম্বর চিঠিটা বোধ হয় নিমকিদি ছিঁড়ে ফেলেছে। আপদ চুকেছে ভেবে নিজেই নিজের মনের ভিতর খানিকটা লাফিয়ে নিলাম। মুখে অবশ্য বললাম "আহা বাপটুদা, তোমার কী কষ্ট"।
"কষ্ট? কষ্ট কীসের? সমস্ত কষ্টের ওষুধ এখন আমার পকেটে। বাবা গতকাল মাইনে পেয়েছিল বোধ হয়। কড়কড়ে দু'টো একশো টাকার নোট সরিয়েছি। আজ আর ফুলুরি নয়। রুটি, ডিম তড়কা, ডিম ভুর্জি আর থামস আপ। তারপর এক জোড়া হরিদার নারকোলের সন্দেশ। কেমন"?
"নিমকিদি না করেছে তো? বল্টেদার সঙ্গে ঘুরছে নাকি"?
"বল্টেকে বাগে আনা আমার বাঁ হাতের খেল"।
"তোমার বাইশ নম্বর চিঠি নিমকিদি ছিঁড়ে ফেলেনি? আগের একুশটার মত"?
"না। ছিঁড়ে ফেলেনি। উলটে উত্তর দিয়েছে। গদগদ উত্তর"।
"তাহলে? আমায় কেমিস্ট্রি পড়া ধরছ যে বড়"?
"নিমকির সে প্রেমের চিঠিময় বানান ভুলের ল্যান্ডমাইন ছড়ানো রে! আর রজনীকান্তের লাইন রবীন্দ্রনাথে গুলিয়েছে। প্রেম করব না টিউশনি পড়াব? টিউশনির জন্য এই তুই তো আছিস, প্রিমিয়াম কেমিস্ট্রি গাধা"।
পরে পাড়ার কিছু দুর্জনে রটিয়েছিল বল্টেদার প্রভাবেই নিমকি মুচমুচিয়ে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেছিল। আমি অবশ্য বাপটুদার কাছে বাইশ নম্বর চিঠির উত্তর হাতেকলমে দেখতে চেয়ে কেমিস্ট্রি পাস ডকে তুলতে চাইনি। এমন কী বাপটুদার আচমকা গুরু দত্ত ভক্তির কারণও খুঁজতে যাইনি; ফ্রী ফুলুরির মায়া বড় মায়া।
2 comments:
Ei lekhatio bhalo.tobe bes purus-ponthi gandho! :)
Bnochadar jonno sotti khub dukkho hocche.......
Post a Comment