৬৩ বছরের আগেকার কিছু অভিজ্ঞতা জানতে চেয়েছিলাম পরিচিত কয়েকজনের কাছে, সাদা-মাঠা কিছু স্মৃতি সাজিয়ে দিলেন কিছু পুরনো, ওপার বাংলা থেকে চলে আসা মানুষ:
১৪-১৫ আগস্ট, বরিশাল, পূর্ব পাকিস্তান:
স্মৃতি-কথন : জীবন কৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য , অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, বয়স ৮৩
" তখন আমি বরিশালের ব্রজমোহন ইন্সটিটিউটে ক্লাস নাইনে পড়ি. বরিশালের সহরের পশ্চিম প্রান্তে রাজকুমার ঘোষ রোডের বাড়িতে ছিল আমাদের একান্ন্যবর্ত্তি পরিবারের বাস| দেশ ভাগের খবর নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পরে, সাতচল্লিশের জুলাইতেই আমাদের পরিবার বরিশাল ছেড়ে চলে আসে এই পশ্চিম বাংলায়, চন্দননগরে| কিন্তু আমার স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা ডিসেম্বর মাসে| কাজেই আমি, আমার জ্যাঠা এবং আমার মেজদিদির সঙ্গে বরিশালে রয়ে গেলাম| ১৪ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা দিবস পালন হলো, কিন্তু সেই দিনটা আমাদের প্রবল দুশ্চিন্তায় কেটেছিল তা বেশ মনে আছে| অবশ্য তার আগের ছয় মাস পুরোটাই এক দম বন্ধ করা পরিবেশে কেটেছিল. কখন যে কি হয়, হিন্দু মুসলিম খুনো-খুনির প্রবল আশংকা তখন গোটা শহর জুড়ে| বেশ মনে আছে ১৩ আগস্ট থেকে জ্যাঠা ঘন ঘন রেডিওত়ে কান পাতছিলেন কলকাতায় কোনো দাঙ্গা বাঁধলো কিনা সেই খবর নিতে, কারণ একবার যদি কলকাতায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর আক্রমন শুরু হয় তবে ঢাকা-বরিশালের যত হিন্দু তাদের আর রক্ষে নেই| বেশ মনে পড়ে ১৪ আগস্ট সকাল বেলায় স্বাধীনতার উপলক্ষে এক আনন্দ ফেরি আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিল তখন আমি আর মেজদিদি বাড়ি থেকে বেরোতে যাচ্ছিলাম দেখব বলে| জ্যাঠা কড়া ধমকে আমাদের ঘরে আটকে রেখেছিলেন এবং বুঝিয়েছিলেন যে এ স্বাধীনতা আমাদের নয়, এ দেশ আমাদের নয়, এমনকি বরিশাল সহরের এই বাড়িটাও আর আমাদের রইবে না. তখন বয়স ভারী অল্প ছিল, জুলাইতে যখন পরিবারের সবাই বরিশাল ছেড়ে চলে গ্যালো তখন মনে একটা ধারণা ছিল যে এসবি সাময়িক ব্যাপার, কিছুদিন পরেই সব কিছু স্বাভাভিক হয়ে যাবে আর সবাই এ শহরে ফিরে আসবে. সেদিন জ্যাঠার ধমকানি খেয়ে প্রথম আঁচ করতে পেরেছিলাম পরিস্থিতি কতটা ঘোরালো. ভারী মুষড়ে পড়েছিলাম. মনে পরে সেদিন দুপুরে মেজদিদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল যে 'ভয় পাস না, এ বাড়িতে আবার সবাই ফিরে আসবে'| She tried to console me.
যদ্দুর মনে পরে, ১৪-১৫ আগস্ট, দুটো গোটা দিন জ্যাঠা আমার আর মেজ্দিদিকে ঘর থেকে বেরোতেই দেননি| এদিক ওদিক থেকে খবর পেতাম স্বাধীনতা দিবস পালন হচ্ছে, বরিশালের সমস্ত স্কুলে , কলেজে, আপিস-কাছারিতে, তবে দেশ-ভাগের রেষে সর্বত্রই ছিল অশান্তির ছায়া, হানাহানির আশংকা| ১৫ আগস্ট গোটা বেলা জুড়ে বেশ কিছু দাঙ্গার উড়ো খবর ভেসে আসতে লাগলো, মিছিল স্লোগানের শব্দ শুনলেই কেঁপে উঠছি! রাত তখন দশটা, এমন সময় এক বিভত্স চিত্কারে আমাদের বাড়ি কেঁপে উঠেছিল "মার, মার, মাইরা ফ্যাল, মাইরা ফ্যাল" গোছের একটা চিত্কার করতে করতে এক দল লোক লাঠি-ভোজালি নিয়ে হই হই করে আমাদের বাড়ির উঠোনে দৌড়ে আসে, পরে জেনেছিলাম যে তারা দুজন চোর কে তাড়া করে ধেয়ে এসেছিল মাত্র| কিন্তু তাদের হুঙ্কারে আমার মেজদিদি ভয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন| দুই দিনের মাথায় মেজদিদি ম্যালিন্জাইটিসে মারা যান|
১৯৪৮ সালের ৮ জানুয়ারী আমরা বরিশাল থেকে চলে আসি| বাসা বাঁধি চন্দননগরে গড়ের ধারে উদ্বাস্তু'দের দেওয়া সরকারী জমিতে. এতসবের মাঝে, স্বাধীনতার উত্সব যে কি, সেটা আর টের পাওয়ার অবকাশই পাইনি "
***
১৪-১৫ আগস্ট, ১৯৪৭, জয়নগর, যশোর, পূর্ব পাকিস্তান
স্মৃতি-কথন : বিমলা বালা দেবী, বয়স : ৯৯
“আমাদের বাড়ি ছিল যশোর জেলার জয়নগর গ্রামে| মধুমতির নদীর পার ঘেঁষে ছিল আমাদের বাড়ি, স্নানের ঘাট, সুপুরি বাগান.. সে ভারী মিষ্টি জায়গা| যজমানি আর জমি চাষ করিয়ে আমাদের কাটত| কুলীন বামুনের ঘর; সম্মান-ইজ্জত ছিল প্রচন্ড| কয়েকঘর মুসলমান প্রজা ছিল আমাদের জমি চাষ করবার জন্যে| ৮০-১০০ ঘর হিন্দু পরিবার নিয়ে বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল জয়নগর| তবে মাস খানেক আগে থেকেই সমস্ত কিছু কেমন এক আচমকা বদলে যেতে শুরু করলো! জুলাই মাসের শুরুতেই গ্রামে প্রচুর বাইরের লোক জড়ো হতে লাগলো, শুনলাম তারা এসেছেন পাকিস্তানের বার্তা নিয়ে. সমস্ত হিন্দুদের দূর করে আদর্শ পাকিস্তান তৈরী করতে| কেউ বললে তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা নেতা, কেউ বললে তারা স্রেফ ভাড়া করা গুন্ডা | তা যাই হোক, তারা নিয়মিত এসে সমস্ত হিন্দু পরিবারকে ভয় দেখাতে শুরু করলো যাতে তারা পাকিস্তান ছেড়ে হিন্দুস্তানএ চলে যান| জুলাই শেষ হওয়ার আগেই গাঁয়ের সমস্ত হিন্দু পরিবার ঘর ছেড়ে চলে যায় সুধু আমরা ছাড়া. আমার ভাসুর-ঠাকুর জেদ ধরে বসলেন ,বললেন, 'হিন্দুস্তান পাকিস্তান বুঝিনা, এ গ্রাম আমাদের, এ ভিটে মাটি আমার দাদা-ঠাকুরদার, এ আমরা ছাড়ব না, জয়নগর ছেড়ে আমরা কোথাও যাব না '!
১৪ তারিখ ভোর বেলা থেকে চতুর্দিকে শুধু ঢাকের আওয়াজ আর মধুমতির বুকে শয়ে শয়ে নৌকায় পতাকা উড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার উচ্ছাস " আল্লাহ হো আকবর, পাকিস্তান জিন্দাবাদ"! আমার মনেই কেমন এক আনন্দের শিহরণ জেগেছিল, তবে সে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী ছিল| ওই দিন সকালেই কারা যেন ফের ধমকি দিয়ে গেল যে এক্ষুনি আমরা ঘর ছেড়ে চলে না গেলে ওরা ঘরে আগুন দিয়ে দেবে | আমরা কুলীন ঘর ছিলাম, আমাদের উঠোনে শুধু মুরগি কেন, পেয়াঁজ-রসুন আনাও বারণ ছিল| ১৫ আগস্ট ভোর বেলা কারা যেন আমাদের উঠোনে কাটা মুরগি ও গো-রক্ত ছড়িয়ে রেখে যায় | এক দল মুসলিম প্রজা সেদিন দুপুরে এসে আড়ালে আমাদের সাবধান করে যান যে যারা আমাদের ধমক দিয়ে গ্যাছে, তারা সেদিন রাত্রেই আমাদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ছক কষছে! সেই মুসলিম প্রজাদের সাহায্যে এবং ভালবাসা মিশ্রিত করুনায় যখন আমরা গোটা পরিবার দুটো স্টিমারে করে, ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে, মধুমতির বুক চিরে চিরকালের জন্যে জয়নগর ছেড়ে চলে আসছি, তখন দূর থেকে দেখেছিলাম আমাদের খড়ের চালে সত্যিই করা যেন আগুন দিয়েছে| আর কখনো সে গ্রামে আর ফিরে যাওয়া হয়নি| এর ঠিক তিন দিনের মাথায়, ১৮ আগস্ট আমরা শিয়ালদা স্টেশনে পৌছই |"
“আমাদের বাড়ি ছিল যশোর জেলার জয়নগর গ্রামে| মধুমতির নদীর পার ঘেঁষে ছিল আমাদের বাড়ি, স্নানের ঘাট, সুপুরি বাগান.. সে ভারী মিষ্টি জায়গা| যজমানি আর জমি চাষ করিয়ে আমাদের কাটত| কুলীন বামুনের ঘর; সম্মান-ইজ্জত ছিল প্রচন্ড| কয়েকঘর মুসলমান প্রজা ছিল আমাদের জমি চাষ করবার জন্যে| ৮০-১০০ ঘর হিন্দু পরিবার নিয়ে বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল জয়নগর| তবে মাস খানেক আগে থেকেই সমস্ত কিছু কেমন এক আচমকা বদলে যেতে শুরু করলো! জুলাই মাসের শুরুতেই গ্রামে প্রচুর বাইরের লোক জড়ো হতে লাগলো, শুনলাম তারা এসেছেন পাকিস্তানের বার্তা নিয়ে. সমস্ত হিন্দুদের দূর করে আদর্শ পাকিস্তান তৈরী করতে| কেউ বললে তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা নেতা, কেউ বললে তারা স্রেফ ভাড়া করা গুন্ডা | তা যাই হোক, তারা নিয়মিত এসে সমস্ত হিন্দু পরিবারকে ভয় দেখাতে শুরু করলো যাতে তারা পাকিস্তান ছেড়ে হিন্দুস্তানএ চলে যান| জুলাই শেষ হওয়ার আগেই গাঁয়ের সমস্ত হিন্দু পরিবার ঘর ছেড়ে চলে যায় সুধু আমরা ছাড়া. আমার ভাসুর-ঠাকুর জেদ ধরে বসলেন ,বললেন, 'হিন্দুস্তান পাকিস্তান বুঝিনা, এ গ্রাম আমাদের, এ ভিটে মাটি আমার দাদা-ঠাকুরদার, এ আমরা ছাড়ব না, জয়নগর ছেড়ে আমরা কোথাও যাব না '!
১৪ তারিখ ভোর বেলা থেকে চতুর্দিকে শুধু ঢাকের আওয়াজ আর মধুমতির বুকে শয়ে শয়ে নৌকায় পতাকা উড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার উচ্ছাস " আল্লাহ হো আকবর, পাকিস্তান জিন্দাবাদ"! আমার মনেই কেমন এক আনন্দের শিহরণ জেগেছিল, তবে সে আনন্দ ক্ষণস্থায়ী ছিল| ওই দিন সকালেই কারা যেন ফের ধমকি দিয়ে গেল যে এক্ষুনি আমরা ঘর ছেড়ে চলে না গেলে ওরা ঘরে আগুন দিয়ে দেবে | আমরা কুলীন ঘর ছিলাম, আমাদের উঠোনে শুধু মুরগি কেন, পেয়াঁজ-রসুন আনাও বারণ ছিল| ১৫ আগস্ট ভোর বেলা কারা যেন আমাদের উঠোনে কাটা মুরগি ও গো-রক্ত ছড়িয়ে রেখে যায় | এক দল মুসলিম প্রজা সেদিন দুপুরে এসে আড়ালে আমাদের সাবধান করে যান যে যারা আমাদের ধমক দিয়ে গ্যাছে, তারা সেদিন রাত্রেই আমাদের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ছক কষছে! সেই মুসলিম প্রজাদের সাহায্যে এবং ভালবাসা মিশ্রিত করুনায় যখন আমরা গোটা পরিবার দুটো স্টিমারে করে, ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে, মধুমতির বুক চিরে চিরকালের জন্যে জয়নগর ছেড়ে চলে আসছি, তখন দূর থেকে দেখেছিলাম আমাদের খড়ের চালে সত্যিই করা যেন আগুন দিয়েছে| আর কখনো সে গ্রামে আর ফিরে যাওয়া হয়নি| এর ঠিক তিন দিনের মাথায়, ১৮ আগস্ট আমরা শিয়ালদা স্টেশনে পৌছই |"
******
এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যাক, একটি আধুনিক অভিজ্ঞতা:
১৫ আগস্ট, ২০১০
তন্ময় ম্খুজ্জ্যে (বংপেন, জীবন কৃষ্ণ ভট্টাচার্য সম্পর্কে মাতামহ/ বিমলা বলা দেবী সম্পর্কে পিতামহী)
তন্ময় ম্খুজ্জ্যে (বংপেন, জীবন কৃষ্ণ ভট্টাচার্য সম্পর্কে মাতামহ/ বিমলা বলা দেবী সম্পর্কে পিতামহী)
Disgusting! রবিবারে ন্যাশনাল হলিডে, যাকে বলে Super-Disgusting! ভ্যালুএবেল ছুটি নষ্ট,তার ওপর রবিবার জন-গণ-মনোর ১৫ আগস্ট প্রটোকলে অফিস ছুটতে হবে, তার মানে উইক এন্ড'এ এক ঘন্টার জন্যে হলেও অফিস দর্শন করতে হবে , এর চেয়ে বেশি প্যাথেটিক আর কি বা হতে পারে!শুধু দুটি কন্সোলেসন: দুপুরে লাঞ্চে চিলি চিকেন কাম ইলিশ ভাঁপা এবং সন্ধ্যে বেলায় "ব্যোমকেশ বকশী" ইভেনিং শো!
সর্বোপরি আগামীকাল অর্থাৎ সোমবার মেডিকেল লিভ নিয়ে অফিস কামাই এবং ঘরে বসে একটু উপরি আরাম| ঠান্ডা বড়ি is my idea of celebrating Independence. A Chill Pill that is!
4 comments:
paji
you are gambling with emotions paji....
eisob kanna bohubar byabohrito hoye gechhe bolei ki nijer inchorhe paka paragraph ta ting-ting kore jure diley??? ritwik ghotok thakle ki bolten?? chhya chhya hala harami...ki korsos??? u r tickling it!!!
all the 'shame'
Bhari Shundor Laekha Gulo..
@ aritra sanyal:
It seems you haven't read anything apart from the 'inchorhe paka' part.
If you have read it, you have analyzed it far too intellectually, something that this blog may never scale.
At a more diluted scale, yes, intention was specifically to express amazement and unease at the level of sedate gambling of emotions that is normally attached to 15th of August.
As far as your sympathy towards the mentioned 'emotions' are concerned, swearing by Ritwik Ghatok really does little to build a rational case. It only makes me believe, far too many conjured emotions are floated on days such as these.
Honest comments are unabashedly accepted on this blog. However, obscenities, may not be passed on as enlightening assessments. Hence, I accept the 'haala' and strongly object the 'harami' as a gross and tasteless attempt to make an otherwise well-thought comment a saucy one.
Obscenities will be moderated.
i m none to be blamed for 'hara-'...it's all ritwik...suborrnorekha or komol gandhar
Post a Comment