Monday, April 30, 2012

মশারির ব্যাপার

মশা দূর করবার প্রযুক্তি যতই এগিয়ে আসুক, কোনও টোটকাই নাইলনের ভালোবাসা কে টেক্কা দিতে পারবে নামশারিকী অনাবিল, বঙ্গ-গৃহস্থালির সব চেয়ে কমনীয় টুকরো এই মশারি। নীলে, সবুজে, হলুদে, সাদায় মিহি-মসৃন জাদুএক সময় প্রতিটি বাঙালি খাটের স্নেহ-অংশ ছিলো স্ট্যান্ড বা খুঁটি; মশারি টাঙ্গাবার জন্যে। সেই স্ট্যান্ড এই মশা-মারা লিকুইডেটরের যুগে প্রায় অবলুপ্তঅথবা ঘরের বিশেষ প্রান্তের বিশেষ পেরেকটিতে পৌছবার জন্যে মশারির কোণে ঝুলতো বিশেষ মাপ বিশিষ্ট দড়ি (ক্ষেত্র বিশেষে পায়জামার দড়িও)গৃহস্থের গার্হস্থ-Efficiency’র পরিমাপ বুঝতে হলে তার মশারি টাঙ্গানোর ভঙ্গি কতটা অবলীলা-মিশ্রিত, সেটা বুঝে নিলেই চলবে। আমার মত দরকচা মারা আদমি যে মশারি-টাঙ্গাতে গিয়ে লম্বা-চওড়া মাপতেই যে হিমশিম খাবে, সেটাই স্বভাবিক।

মশারি ছিলো দাপুটে ঘুমের প্রাথমিক শর্ত; তাজমহলের সফেদপনা আর বাঙালির রাতের বিছানার ওপর মশারি একই রকম আবশ্যক।পরিপাটি করে পাতা পরিষ্কার কড়কড়ে চাদর, নরম পাতলা বালিশ, পুষ্ট-পাশ-বালিশ বিশিষ্ট এক ঘুমমোহিনী বিছানা। নীল-নাইলনের মশারি টানটান করে টাঙ্গানো, পরিপাটি করে তোশকের নীচে ঠেলে দেওয়া মশারির কাপড়ের বেসএকপাশে শুয়ে ঠাকুমাঅন্যপাশে ডেসিম্যাল সাইজের আমিঠাকুমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমায় ঘুম পাড়ানো, আমার বক বক।ঠাকুমা বলতেন “বলো দেখি নাড়ুগোপাল, ‘ঘরের মধ্যে ঘর/তার মধ্যে বসে আছেন ভোলা মহেশ্বর’,কী ব্যাপার সেটা?”

আমি বলতাম “মশারি”

Wednesday, April 25, 2012

বিকেল

দুপুর আর সন্ধ্যের মাঝের সময়টুকু বিকেল করে গড়ে তুলতে হয়।  

গ্রীষ্মের হবু সন্ধ্যে। অচানক একদিন জলদি অফিস ফেরত।সাবান-ফেনায় গা ভাসিয়ে সাবেকী স্নান। ধবধবে ফতুয়া-পাজামা। পরিষ্কার ব্যালকনিবেতের চেয়ারে নরম কুসন। টবে পাতাবাহার, জবা ফুরফুরে। আকাশ সবে হলদে ও লালের মধ্যে হিসেব ভুল করতে শুরু করেছে। নরম হাওয়ার পাউডার মাখা কাঁধের পাশে আলগোছে ঘুর ঘুর। হাতে আদা মেশানো দার্জিলিং-চায়ের অমৃত-পানীয় সৌখিন খয়েরী আল্পনার বর্ডার দেওয়া সফেদ কাপে। রান্না-ঘর থেকে ফুলুরি ভাজার তেল-কড়াইয়ের মনমোহিনী চড়-চড় শব্দ। নিক্কন ও নারী কন্ঠের চাপা সুরে অতুলপ্রসাদি

বিকেল বিকেলের মায়াবী খাতে আপনি বয়ে চলবে। শুধু দিনের বাসী খবরের কাগজটি আওতার মধ্যে না থাকলেই হলো।     

Monday, April 23, 2012

এখন গরম-তখন গরম

গরম বেড়ে চলেছেপাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেজাজের গরমিল। অফিসিও ইঁটের পাঁজা তেতে থাকে বারো মাস, ফাইল-সেলস-হিসেব-পত্তর ছোলাভাজা হয়ে মুখের কোণে ড্যালা পাকিয়ে থাকে সর্বক্ষণ কিন্তু গেলবার উপায় নেই।কিন্তু প্রাকৃতিক পারদ-থাপ্পড় এই অফিসের উত্তাপকে আরও দু:সহ করে তোলে। মুস্কিল হচ্ছে সেই বয়সটা নেই যে বয়সে বোশেখের দুপুরের রোদ কোন বিপন্নতা ছিল না, বরং গরমের ছুটির দুপুরের ক্রিকেটের আবেদন ছিল আরও অনেক বেশি ক্ষিপ্র। 

অনেক ভেবে দেখলাম, গরমের নির্মমতা কিন্তু ছেলেবেলায় কখনো মালুম হয় নি। অথচ সে সময় ঠান্ডা অফিস ঘরের বদলে ছিলো ঘট-ঘট শব্দে ফ্যান ঘোরা ক্লাসঘর, মোটরগাড়ির আমুদে ছায়ার বদলে ছিলো সাইকেল, ফ্রিজ-ঠান্ডা জলের বদলে ছিলো মেটে-কূঁজোর জল; যাবতীয় গরম-বিরোধী-উপাদান সত্বেও, বোশেখ কে এখন এত প্রচন্ড মনে হয় যে বলার নয়আমার সহকর্মীর ভাষায়, দুপুরে রাস্তায় পা রাখলে মনে হয় চল্লিশ লিটার থাম্স-আপ কিনে ড্রামে ভরে, নিজেই সেই ড্রামে উদোম হয়ে ঝাঁপ দিয়ে তুফানি করিঅথচ ছেলেবেলায় মার বারণ অগ্রাহ্য করে দুপুর রোদে মাঠে ছুটে গিয়েছি।এখন ভাবলে মনে হয় পাগলামিখেলা শেষে বিকেলে ঘণ্টী-বাজানো গাড়ি থেকে কিনে খাওয়া চার আনার বরফ-লেবু জল; আহা:! এমন তৃপ্তি বোধ করি আর জন্মেও জুটবে না  আর এখন লিটার লিটার গ্লুকোজ-গোলা জল খেয়ে পেট ফুলে যায় কিন্তু তেষ্টা মেটে না

Sunday, April 22, 2012

চেনা দু:খ - চেনা সুখ

উত্তর কোলকাতার এঁদো গলিপরিচিত বাঁকচায়ের দোকানপুরনো এসবেসটাস আর দরমায় বাঁধা ছোট্ট একটু দোকানমেসের গা-ঘেঁষাবছর কুড়ির এক মেদিনীপুরের যুবক ও তার পিতৃদেব কতৃক পরিচালিতযুবকের নাম অমিত, আমরাও বলতাম অমিতের চায়ের দোকানদোকানের আসবাব সর্বস্ব বলতে একটি উনুন, তিনটি বিস্কুটের বয়াম (লেড়ো, নোনতা ও মিষ্টি ধরন সমৃদ্ধ), কাঁচের এক গুচ্ছ চায়ের গেলাস, সসপ্যান-কেটলি সমৃদ্ধ সামান্য বসন-পত্র, এবং রাস্তার ধারে ফেলে রাখা একটা সরু বেঞ্চি। চা ছাড়াও সেখানে জুটতো ডিম-পাউরুটি এবং পাড়াতুতো আড্ডা-সমূহ।

ওই বেঞ্চিতে বসে চায়ের চুমুক ছিলো আমাদের মেসিও সান্ধ্য-প্রদীপ জ্বালানো। দোকান খোলা থাকতো রাত এগারোটা পর্যন্তঅতএব অসময়ে চুমুকও যে জুটতো না তা নয়এমনি এক শীতের রাত। মেসের গুমোট ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম চায়ের অজুহাতে। তখন রাত সাড়ে দশরাতের খাওয়া হয়ে গ্যাছে। অমিতের দোকান প্রায় খালি। বেঞ্চিতে একাই বসলাম। মাঝ-ডিসেম্বরের রাত্রি। গলিতে কোলকাতার ধোয়া-ধুলো মেশা কুয়াশা, সমস্তটা আবছা।গলির ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো দৃষ্টি আরও গুলিয়ে দেয়। অমিতের বাবার গলার গামছাটা বছরের এই সময় মাফলার হয়ে ওঠে। উনুন ঘেঁষে বসে থাকে বাপ-ব্যাটা। ঘন-দুধ মেশানো বহু জাল খাওয়া চায়ের গেলাসে চুমুক দেওয়া মাত্রই , দোকানের রেডিও থেকে ভেসে আসা কবির সুমনের “চেনা দু:খ চেনা সুখ”। আগে বহুবার

Thursday, April 19, 2012

লুচি-জলখাবার' কথা

প্রতিটি লুচির সঙ্গে আমি উর্বর থেকে উর্বরতর হয়ে চলি। বেগুনভাজার প্রতিটি কামড়ের ফলে আমার রন্ধ্রে জড়ো হয় স্নেহ-উল্লাস। আলু ভাজা যে মুহূর্তে জিভ ছুয়ে যায় সে মুহূর্তে আমি খুঁজে পাই দিন খাই-নির্ভরতার স্পর্শ। ধবধবে, ময়দায় প্রস্তুত, বর্তুল অতি-দৈবিক সৃষ্টি এই লুচি, কখনো গোল বেগুন ভাজার খোবলানো হৃদয়, কখনো মিহি আলু-ভাজার সাথে নিবিষ্ট হয়ে; মুখের ভিতরে লালা-মিশ্রিত হয়ে স্বর্গীয় মণ্ডে পরিণত হয়। সেই প্রাণাধিক লুচি-আলু-বেগুন মণ্ড গলা বেয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় উদরে নামে বটে, কিন্তু রসিক মাত্রই জানেন যে লুচির জাগতিক অস্তিত্বটুকু উদর-মুখী হলেও; লুচির পরমাত্মা নেমে আসে মানব হৃদয়ে। স্নায়ু এরপর সড়গড় হয়ে ওঠে, মানসপটে ভেসে ওঠে জিহ্বা-প্রেরিত সূর্যদয়নোনতা-ঝালের তৈল স্পর্শ ঝেড়ে লুচি-খন্ড স্বল্প-মিষ্ট পায়েসে গা-ভাসিয়ে খোঁজে উন্মেষ। পবিত্রতা পায় এক অতি সাধারণ নাগরিক প্রাত:রাশ।

এরপর জিলিপির সহজ কামড়ে নির্মল ভালোবাসায় স্তিমিত হয়ে আসে সকালের ক্ষুধা। সুস্বাগতম দিন ও দৈনিক যুদ্ধগুলি। 

বঙ্গ-হিন্দী

বঙ্গ হিন্দির মত সুমিষ্ট চাবুক ভূ-ভারতে বিরল। এক দিন কোলকাতায় কাটিয়ে এলাম। হৃদয়-বদ্ধ করে আনলাম কিছু আণবিক বঙ্গ-হিন্দির টুকরো; বাস-ট্রাম-ফুটপাথ-অফিস; যাবতীয় উত্‍স হতে। যত্ন করে টুকে রাখলাম ব্লগেভাষা-সোনা এক্কেবারে!

-“ বেয়ারা, তুমকো কতবার বলা হ্যায় চায়ের কাপ কানায় কানায় ভরকে চা নাহি দেনে কো! চলকে টেবিল মে পরকে গন্দা কর দেতা হে”  

-“সর্দারজি, কেতনা দিন সে ট্যাক্সি চালাতা হ্যায় তুম?”

-“আরে লাখোটিয়াজি, এই ফোনে আওয়াজ কাট-কাট জাতা হ্যায়!আমি রাখতা হ্যায়, আপ রিটার্ণ কল কিজিয়ে”

-“লাড্ডু হোগা তা মোতিচুর, জার্নি হোগা তো বহুদূর”

যেমন-তেমন

আঁকশি অতি দাপুটে একটি যন্ত্র। নীল-কালির দোয়াত থেকে ড্রপারে করে ফাউন্টেন পেনে রঙ চুষে নেওয়া, সবচেয়ে সাবলীল নষ্টালজিয়াআয়নায় দেখে ডান-দিক বাঁ-দিক গুলিয়ে ফ্যালার হিসেব করবার মত ফুর্তি বিরলসিনেমার শব্দ বন্ধ করে দিয়ে চালিয়ে, শুধু সাব-টাইটেল পড়ে নিজের মনে শব্দ গুছিয়ে নেওয়া এক অতি উত্তেজক খেলাশাল পাতার ফাঁক থেকে খুঁটে আনা ডাল মাখা ভাত অপূর্ব সুস্বাদু। স্কুল-প্রেমিকার ক্লাসে ফেলে যাওয়া ক্লাস-ডাইরীর পাতার ঘ্রাণ বুক ভরে নেওয়ার উত্তেজনা প্রশ্নাতীত। অফিসের টেবিলে বসে পাশের টেবিলে খবরের কাগজের খস-খসয়ের মত দাবীদার ফাঁকির ডাক আর হয় না। চায়ের কাপে বৃষ্টির ফোঁটার মত বিকেলের আলস্যকে আর কেউই ডাকতে পারে না।“মা আসছি”য়ের চেয়ে জমাট প্রতিশ্রুতি আর কীই বা আছে।

হাসিমাখা-অশ্লীলতা বিহীন সমালোচোনা, হাসি ছুঁড়ে ভাসিয়ে দিতে অক্ষম শাসক-গোষ্ঠীর চেয়ে উঁচু তাঁবু আর কোনও সার্কাসের নেই।   

Wednesday, April 4, 2012

ঘুম-বাজি

“সাবেকী ঘুম হলো গিয়ে হালদারদের পুকুরের চার কিলোর রুই বুঝলি পচা, সাবধানে খেলিয়ে বালিশের ডাঙ্গায় তুলে ফেলতে হয় এই বলে ভোম্বলদা চ্যবনপ্রাশের চামচটা মুখে পুরলেনভোম্বলদা আমার দূরসম্পর্কের পিসতুতো দাদাপাঁচ বছর পর আমাদের বাড়িতে এসেছেন । দাদা বলছি তবে বয়েসে আমার থেকে বেশ বড়, প্রায় চল্লিশবিয়ে-থা করেননি, বর্ধমানের গলসিতে বাস এবং সেখানেই আলুর পাইকারী ব্যবসাদার ভোম্বলদারাত্রের খাওয়া-দাওয়া সেরে আড্ডা চলছিলোসেখানেই ভোম্বলদা বাতলে দিচ্ছিলেন “ঘুমাইবার সঠিক পদ্ধতি”ভোম্বলদার জবানীতেই টুকে দিলাম বাকিটা:

“শরীর-মনে ঘুমের মালিশ ছড়িয়ে দেওয়াটা যতটা বিজ্ঞান, ততটাই শিল্প। ঘুম ঠিক কোন মুহূর্তে গ্রীপ করতে হবে, ঠিক কতক্ষণ জুড়ে ঘুমোতে হবে, এ সবই ভারী গুরুত্বপূর্ণ। মোটের ওপর রাত্রে ঘুমের প্ল্যানিঙ্গ করতে হবে ৬ থেকে আট ঘন্টার মধ্যে। নিজের শরীর কে জরিপ করে জেনে নিতে হবে যে কতক্ষনের ঘুম দেহের জন্যে পর্যাপ্ততবে ৬ ঘন্টার কমে ভাব যায় না, আট ঘন্টার বেশি ঘুমলে আলিস্যি আস্তে বাধ্যঘুমোতে কখন যাবি? সেটাও ব্যক্তি বিশেষে নির্ভর করবেতবে কিছুতেই রাতের খাওয়ার ১ ঘন্টা আগে নয়, অথবা ২ ঘন্টা পড়ে নয়ঠিক হ্যায়? এইবারে আমার ফর্মুলা মেপে একটা চেকলিস্ট তৈরি করে নে ফর দ্য বেস্ট ঘুম পসিব্যল।

Sunday, April 1, 2012

ম্যাওরামের যৌবনলাভ

(বিজ্ঞাপনের যুগ, Bongpen’ও পিছিয়ে নেইএটি একটি বিশেষ বিজ্ঞাপন-মূলক পোস্ট)

ম্যাওরামের বেড়ালের বয়েস হয়েছে যথেষ্টসে কালের জাঁক আর নেইতুরুক-তুরুক লাফিয়ে আর চলতে পারে নাহুলো মহলে আর সে ইজ্জত নেই, মেনি মহলে সেই আগের দেমাক নেইনখ নরম হয়ে এসেছে, ইঁদুর ধরতে গেলে হাঁপ উঠে যায়। শরীরেও আর আগের গত্তি নেই। ম্যাওরামের ভারী দু:খ

দু:খ সইতে না পেরে ম্যাওরাম চললে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে সমুদ্দুরে পড়ে এ বীতশ্রদ্ধ জীবন বাদ দিতে। ম্যাওরাম যেই না পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিতে যাবে অমনি তার সামনে ভেসে উঠলেন বিল্লিশ্বর, সেই প্রবাদপ্রতিম দেবতা।

-“করিস কী ব্যাটা? রোককে!”
-“না বিল্লিশ্বর, এ বৃদ্ধ জীবনে না আছে ইজ্জত না আছে ইঁদুর, আমায় ঝাঁপ দিতে দিন”
-“এক ঝাঁপে কী হবে রে নাদান বিল্লি? তোর যে নয়টি জীবন? একটি ঝাঁপে কী হবে?”
-“তাই তো, কিন্তু বিল্লিশ্বর! একবারে নয়টি মরণ ঝাঁপ কিভাবে দি? কী উপায়?”
-“উপায় নেই বাবুসোনা, আত্মহত্যা বিড়ালের ভাগ্যে নেই”
-“তবে আমি কী করি প্রভু? এ যে বড় বিটকেল জীবন”
_ “সমাধান আছে বত্‍স, এই শিশিটা নাও”

বিল্লিশ্বর কোঁচড় থেকে একটি ছোট্ট শিশি বার করলেন।