“সাবেকী ঘুম হলো গিয়ে হালদারদের পুকুরের চার কিলোর রুই বুঝলি পচা, সাবধানে খেলিয়ে বালিশের ডাঙ্গায় তুলে ফেলতে হয়” এই বলে ভোম্বলদা চ্যবনপ্রাশের চামচটা মুখে পুরলেন। ভোম্বলদা আমার দূরসম্পর্কের পিসতুতো দাদা। পাঁচ বছর পর আমাদের বাড়িতে এসেছেন । দাদা বলছি তবে বয়েসে আমার থেকে বেশ বড়, প্রায় চল্লিশ। বিয়ে-থা করেননি, বর্ধমানের গলসিতে বাস এবং সেখানেই আলুর পাইকারী ব্যবসাদার ভোম্বলদা। রাত্রের খাওয়া-দাওয়া সেরে আড্ডা চলছিলো। সেখানেই ভোম্বলদা বাতলে দিচ্ছিলেন “ঘুমাইবার সঠিক পদ্ধতি”। ভোম্বলদার জবানীতেই টুকে দিলাম বাকিটা:
“শরীর-মনে ঘুমের মালিশ ছড়িয়ে দেওয়াটা যতটা বিজ্ঞান, ততটাই শিল্প। ঘুম ঠিক কোন মুহূর্তে গ্রীপ করতে হবে, ঠিক কতক্ষণ জুড়ে ঘুমোতে হবে, এ সবই ভারী গুরুত্বপূর্ণ। মোটের ওপর রাত্রে ঘুমের প্ল্যানিঙ্গ করতে হবে ৬ থেকে আট ঘন্টার মধ্যে। নিজের শরীর কে জরিপ করে জেনে নিতে হবে যে কতক্ষনের ঘুম দেহের জন্যে পর্যাপ্ত। তবে ৬ ঘন্টার কমে ভাব যায় না, আট ঘন্টার বেশি ঘুমলে আলিস্যি আস্তে বাধ্য। ঘুমোতে কখন যাবি? সেটাও ব্যক্তি বিশেষে নির্ভর করবে। তবে কিছুতেই রাতের খাওয়ার ১ ঘন্টা আগে নয়, অথবা ২ ঘন্টা পড়ে নয়। ঠিক হ্যায়? এইবারে আমার ফর্মুলা মেপে একটা চেকলিস্ট তৈরি করে নে ফর দ্য বেস্ট ঘুম পসিব্যল।
- প্রাথমিক প্রয়োজন: একটি ব্যস্ত দিন। দৈনিক খাটুনি হলো গিয়ে সুপার-আলজুলাম। ছুটি থাকলে দিনে ২ ঘন্টা হাঁটাহাঁটি করে নেওয়া ভালো।
- ঘুমোতে যাওয়ার আধ ঘন্টা আগে, এক চামচ চ্যবনপ্রাস (শীতকালে) অথবা অল্প তালমিছরি সেবন। নিয়মিত অভ্যেসে দেখবি প্যাভলভ সাহেবের কুকুরের মত, চ্যবনপ্রাস বা তালমিছরির চামচ দেখলেই মনটা ঘুম-ঘুম করে নেচে উঠবে। এটা এক ধরনের কন্ডিসনিং।
- টেলিভিশনের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আস্তে হবে শুতে যাওয়ার অন্তত এক ঘন্টা আগে। অডিও-ভিসুয়াল মামদো-বাজি মনকে চঞ্চল করে রাখে। চঞ্চল মন ঘুমের বাগানে জলহস্তী। সঙ্গীত চলতে পারে, নরম শিউলির মত সমস্ত গান। বড়ে-গুলাম আলী, আমির খান, দেবব্রত চলতে পারে। ভাঙ্গরা-রকের হাতে মন কে ছেড়ে ঘুম রক্তাত্ব করে লাভ নেই। তবে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ১৫ মিনিট আগে পর্যন্ত চলতে পারে সঙ্গীত। তারপর থেকে মন কে ক্রমশ ব্ল্যাঙ্ক করে ফেলতে হবে।
- যন্ত্রের হাতে ঘুমের দায় ছাড়লে ভূগতে হবে। কিরকম? এয়ার কন্ডিসনার ছাড়া ঘুম আসবে না এমন লাট-সাহেবী বাংলাদেশে সাজে না। লোড-শেডি, লো-ভোল্টেজ’য়ের দেশের প্রাণী আমরা। যেকোনো পরিস্থিতিতে ঘুমের বন্যা বইয়ে দিতে হবে। আয়েসি লোকেদের ঘুম ভারী পাতলা হয়। ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজেকে সর্বহারা করে শুতে যেতে হবে। বুর্জোয়া মানেই বিত্ত্ববান ঘুমহীন জাতি।
- মোবাইল। সুইচ অফ। Analysis নিষ্প্রয়োজন।
- বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এলার্ম ঘড়ির ব্যবহার এড়িয়ে চলাই ভালো। এলার্ম দেওয়া মানেই একটা অঙ্ক মাথায় নিয়ে শুতে যাওয়া। ঘুমের গঙ্গা-জলে এলার্মের কেরোসিন না মেশানোই ভালো।
- পুরুষের জন্যে: স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করে ঘুমোতে যাওয়ার তীব্র-অহংকার তথা দু:সাহস’য়ের কোনো মানে হয় না। পুরুষের ঘাড়ে একটি বই দুটি মাথা তো নেই।
- শোয়ার ঘর থেকে খুটখুট শব্দ করে চলা ঘড়ি, ফ্যানের হাওয়ার তালে খস-খস করা ক্যালেন্ডার, ল্যাপটপ বা কম্পিউটার বা খবরের কাগজ দূর করে দেওয়া কর্তব্য।
- শুতে যাওয়ার আগে বই পড়া চলতেই পারে। সহজ সুন্দর পাঠ্য যা।সঞ্জীব-বিভূতিভূষণ চলতেই পারে। কিছুতেই চলবে না পত্রিকা, গোয়েন্দা গপ্প বা থ্রিলার। হাতের কাছেই থাকুক বুক-মার্ক, আচমকা বই বন্ধ করার প্রস্তুতি থাকতে হবে তো।
- বিশ্বাস আধুনিক মশা-মারিয়ে যন্ত্রে নয়, মশারিতে থাকুক।
- ধবধবে বিছানা, পাতলা নরম বালিশ। পাশবালিশ বিলাসি ব্যাপার, অভ্যেস না থাকাই ভালো। আর হ্যাঁ, নারকোল ছোবড়ার সাবেকি জাজিম’য়ের ঘুম-পাড়ানি কোয়ালিটি আধুনিক কার্ল-অন গোছের গদির চেয়ে অনেক বেশি।
- বালিশে মাথা রেখে মনে মনে দিনের রিভিউ নয়, আগামী সকালের চিন্তা নয়; সমুদ্দুর বা পাহাড়ের চিন্তা আসুক। ঘুম সহজ হবে, স্বপ্ন পরিশীলিত হবে”
ছোটোখাট একটা ঘুম-লেকচার দিয়ে যখন ভোম্বলদা যখন থামলো ততক্ষণে দেখি রাত অনেক হয়ে গ্যাছে। ভোম্বলদাকে গুডনাইট বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবো, এমন সময় শুনি ভোম্বলদা অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠলো।
-“কি হলো বলো তো ভোম্বলদা?”
-“কি ম্যাসাকার বল তো!”, ভোম্বলদা ভেবড়ে গিয়ে বললে, “ঘুমের বড়ির শিশিটাই আনতে ভুলে গেছি, আজকের ঘুমটা গেলো গোল্লায়”
1 comment:
গাঙ্গুলি নারায়ণ? নিদ্রায় পলায়ন মনটা;
অবশ্য উত্তম; গদ্যেতে ভূত কম৷ ঘন্টা
বাজলো কি বাজেনি, সুচিত্রা সাজেনি আজকেও,
তাই অভিধান দেখে বানানের আলেখ্যে গদ্যটা ভালো করে সাজিও৷
Post a Comment