সন্ধ্যে বেলা। বিশাল একটা
মাঠ। একজনকে বাদ দিলে, সম্পূর্ণ ফাঁকা। মাঠের ঠিক মাঝখানটায় বসে পাপন। হূই দিকে একটা গোলপোস্ট আর ঠিক উল্টো দিকে একটা। এক-ছটাক
দু-ছটাক ঘাস মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে, অল্প বালি, অল্প কাদা। শুধু মাঠের ঠিক মাঝখানটায়, অর্থাত্ পাপন যেখানে বসে আছে, সেইখানটা
একটু ন্যাড়া; কারণ এইটা হল ক্যাম্বিস বলে খেলার ক্রিকেটের
পীচ। পাপন বাঁ হাতে ব্যাট করে। সবে রিভার্স স্যুইপটা হাতে আসছে। গরম পড়ে
গেলে অবশ্য শুধু ফুটবল আর ফুটবল। বর্ষায় করায় ল্যাপ্টা-লেপ্টি হয়ে ফুটবলের যে কী মজা; আহা। মান্তুদা তো এই মাঠে প্র্যাকটিস করেই কলকাতার ফার্স্ট ডিভিশনে চান্স পেয়ে গেছিলো।
ঘাস উপড়ে ফেলে গোড়ার ফ্যাকাশে সবুজ দিকটা জুত্ করে চাটতে
পারলে মিষ্টি স্বাদ জ্বিভে লাগে। বিকেলের আড্ডায় মগ্ন হয়ে কতবার ঘাস মুখে দিয়ে ফেলেছে পাপন। গরু হয়ে থাকাটা নেহাত্
মন্দ নয়; ঘাস
ব্যাপারটায় অসুবিধে বিশেষ নেই, তাছাড়া অঙ্কস্যারের গরু বলে ডাকটা আর অপমানজনক লাগবে না
। এই মাঠেই প্রতি রবিবার বিকেলে নন্তু-মামা গল্পের আসর বসাতেন। পাড়ার সমস্ত ছোটোরা নন্তু-মামাকে ঘিরে বসতো, শোনা হতো কত গপ্প; ট্রয়ের হেলেন থেকে জোয়ান অফ আর্ক, অফুরন্ত স্টক ছিলো মামার। আর ছিলো গপ্পের শেষে নিমাইদার আইসক্রিম। মাঠের পাশেই রোজ বিকেলে ঘুরপাক খায় দুজন ফিরিওয়ালা, আইসক্রিম নিয়ে নিমাইদা আর রাখোহরি কাকু’র ফুচকার ঠ্যালা।
। এই মাঠেই প্রতি রবিবার বিকেলে নন্তু-মামা গল্পের আসর বসাতেন। পাড়ার সমস্ত ছোটোরা নন্তু-মামাকে ঘিরে বসতো, শোনা হতো কত গপ্প; ট্রয়ের হেলেন থেকে জোয়ান অফ আর্ক, অফুরন্ত স্টক ছিলো মামার। আর ছিলো গপ্পের শেষে নিমাইদার আইসক্রিম। মাঠের পাশেই রোজ বিকেলে ঘুরপাক খায় দুজন ফিরিওয়ালা, আইসক্রিম নিয়ে নিমাইদা আর রাখোহরি কাকু’র ফুচকার ঠ্যালা।
মাঠের চার ধার দিয়ে বেশ কিছু গাছ; নিম, কৃষ্ণচুড়ো, দেবদারু। নলা-পাগলার হাতে লাগানো গন্ধরাজ
গাছটা বেশ ঝাঁকড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি একটা আম গাছও রয়েছে এবং আমও হয় প্রচুর;
মজা
হচ্ছে যে সব আমই বিষ-টক, পাখিরাও ঠোকরায় না। ওই আম শুধু খেলার মাঠ থেকে
কুকুর তাড়ানোর কাজে লাগে। তবে
বিশুর দিদি ওই আমও এমন চমত্কার মাখতো নুন-লঙ্কা দিয়ে;যে ভাবতেই জ্বিভে সরাত্
করে জল চলে আসে।
এই মাঠ জুড়ে একটা চমত্কার বহুতল বাড়ি
উঠবে। আট-তলা। পার্কিং, মাল্টি-জিম, বাগান সহ। পাপনের বাবাও এ বহুতলে একটা
ফ্ল্যাট বুক করতে পেরেছেন। সহজ ছিলো না, বহুলোক আবেদন করেছিলেন ফ্ল্যাটের জন্যে; নেহাত্ বরাত জোরে লটারীতে নাম উঠেছে
পাপনের বাবার। বাড়িতে ভীষণ ফুর্তি; বাবা পাড়ার সব্বাইকে ডেকে মাংস ভাত খাওয়াবে বলে প্ল্যান করছেন। সাউথ খোলা ব্যালকনি
বলে জমাটি ফুর্তি চলছে পাপনের বাড়িতে।
শুধু পাপন কিছুতেই খুশি হতে পারছে না এই মাঠ জুড়ে ফ্ল্যাট
বাড়ি ওঠার খবরে। পাপনের শুধু মনে হচ্ছে ওর আর রিভার্স স্যুইপ শানানো হবে না,
কাদায়
মাখামাখি ফুটবল খেলা আর হবে না, কচি ঘাস আনমনে দাঁতে কাটতে কাটতে আড্ডা দেওয়া হবে না,
নন্তু-মামার
গল্পের আসর আর বসবে না, খেলা শেষে রাখোহরি কাকুর ফুচকা বা আলু-কাবলি খাওয়া হবে
না,
বিশুর
দিদি হাতের আচার খাওয়া হবে না; শুধু বাবার কেনা নতুন ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে হাওয়া
খেতে হবে।
কাল থেকেই কাজ শুরু হওয়ার কথা। নন্তু-মামা অনেক চেষ্টা
করেছিলেন ব্যাপারটা আটকাতে, জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত
আবেদনও করেছিলেন; গত পরশু কে বা কার এসে নন্তু-মামাকে
বেদম পিটিয়ে গ্যাছে; নন্তু-মামা এখন হাসপাতালে। বাবা বলেন
নন্তু-মামার নুইসেন্স ভ্যালু বড্ড বেশি।
পাপনের ভীষণ কান্না পাচ্ছে। পাপনের মা নেই। পাপনের জন্মের সময়ই মা চলে
যান। মা’কে জড়িয়ে ধরলে শুয়ে থাকলে
নাকি সমস্ত দু:খ কেটে যায়। পাপন
উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো মাঠের ওপর।
No comments:
Post a Comment