Monday, August 26, 2013

মাধুকরী


ঘুগনি। পাঁঠার কিমা ছড়ানো আবেদনময় ঘুগনি। এলুমিনিয়ামের ডেকচিতে টগবগ করে ফোটা পিকাসো মেজাজের ঘুগনি।

মোড়ের মাথার মাধবদা’র ঠেলা।  থরে থরে ষ্টীলের প্লেটে ঘেরা ঠেলার চারপাশ। কেরোসিনের পাম্প দেওয়া স্টোভের গনগনে আঁচ। তার ওপরে মোহময় সেই ডেকচি। যার ভেতরে ফুলে ফেঁপে উথলে উঠছে ঘুগনিয় ঈশ্বর। পাশে প্লাস্টিকের মাঝারি মাপের সবুজ গামলার তিন ভাগ জুড়ে কুচোনো পেঁয়াজের ঢিপি আর বাকিটা জুড়ে লংকা কুচি।
ঠেলার অন্য প্রান্তে রয়েছে ষ্টীলের একটা বেয়াড়া সাইজের বাটি – ওতে আছে তেঁতুল গোলা জল। সঙ্গে এক এলুমিনিয়াম গামলা সেদ্ধ খোসা না ছাড়ানো ডিম এবং এক বড় থলি ভরা মোহন বেকারির লম্বা পাউরুটি।

মাধবদা ঠিক সন্ধ্যে ছটায় ঠেলা নিয়ে মোড়ের মাথায় আসেন। ঘুগনি গরম করে নিতে তার লাগে মিনিট কুড়ি। তারপর তার ঠেলা ঘিরে খরিদ্দার জমতে থাকে। তিন ধরনের খরিদ্দার;
এক দল যারা শুধু ঘুগনি খান।
একদল যারা এক প্লেট ঘুগনি খেয়ে একটা বা দুটো ডিম সেদ্ধ খান।
আর আর এক দল যারা ঘুগনিতে ভিজিয়ে পাউরুটি খান।
মাধব’দার ঘুগনি পরিবেশন দেখাবার মত ব্যাপার ছিল। খদ্দের নতুন হলে জিজ্ঞেস করে নিতেন নুন-ঝাল-টক কেমন পড়বে ? মাধবদা বলতেন;
“শুধু ঘুগনি কাঁচা মাটির মত ব্যাপার, তাতে তুমি কেমন ভাবে পেয়াজ-লংকা কুচি তেঁতুল জল, বিট নুন ছড়িয়ে চাস-আবাদ করবে সেটা তোমার ব্যাপার। কাজেই খদ্দেরের থেকে আগে জেনে নিতে হয় যে সে কেমন স্বাদ চাইছে।  নয়ত দেখব সে চাইলে ধান; আমি ফলিয়ে দিলাম ফুলকপি। বুঝলে ?”      

মাধবদা অতি যত্নে প্লেট চামচ ধুতেন। ঝকঝকে প্লেটে গরম ধোঁয়া ওঠা পাঁঠার ঘুগনি; তার ওপর পেঁয়াজ কুচি-লংকা ছড়ানো, তেঁতুল জল মিশিয়ে নেওয়া। আহা:, ভাবলেই জিভে-চোখে জল চলে আসে।

ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে মাধবদা’র ভাঁড়ার সম্পূর্ণ ভাবে খতম হয়ে যেত; গোটা বছর, প্রত্যেক দিন। দিনে এই সোয়া ঘণ্টার ব্যবসা চলত মাধবদার। সেই সোয়া ঘণ্টা পাশের অন্য ঘুগনির দোকানগুলো মাছি মারত, মাধবদা ঠেলা সরিয়ে চলে গেলে তবে তাঁদের ঘুগনি বিক্রি খোলতাই ভাবে শুরু হত। এমন ছিল মাধবদার ঘুগনির সুনাম।

একদিন মাধবদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে সে আরও বেশি করে ঘুগনি-ডিম সেদ্ধ নিয়ে আসে না কেন। তাহলে সে আরও বেচতে পারতে; আরও মুনাফার সুযোগ থাকত। এক গাল হেসে মাধবদা বলেছিলেন;

“ আরে ধুর, এতেই যা দু পয়সা আসে তাতে আমার দিব্য চলে যায়। আরে বাবা, আমি কি ব্যবসা করি না কি গো ? আমি করি মাধুকরী। দরকারের বেশি পয়সাকড়ি নাড়াচাড়া করে তারপর চিন্তায় চিন্তায় গোল্লায় যাই আর কি। আমাকে বোকা ঠাউরেছ ?”