Friday, January 10, 2014

পৃথিবী সৃষ্টির মুলকথা ও বাঙালি

  • একদিন। থুড়ি। সে সময় দিন ছিল না। সংখ্যা ছিল না। সমস্ত বলতে এত্তটুকু কনা; পরমাণুর চেয়েও ছোট; মামুলি একটা ব্যাপার।
    সেই মামুলি ব্যাপারের মধ্যে ছিল আজকের যাবতীয় সমস্ত কিছু, আজকের যতটুকু শক্তি তার সমস্তটুকু।  গ্যালাক্সিদের দল, তারা’দের ঘুর পাক, ডায়ণোসর, পিরামিড, মহেঞ্জদাড়ো, আপনার মর্নিং ওয়াক, মিনিবাসের ঘ্যাংর-ঘোর, বসের চেল্লানি, গিন্নির শপিং, কংগ্রেস-বিজেপি, উৎপাত-তবলা; সমস্ত।
    ওই এত্তটূকু দানার মধ্যে ছিলো অধুনা জিন্দগির যাবতীয় উৎপাত। তার বাইরে কিস্যুটি না, স্থান-কাল-পাত্র-বাপ্পি লাহিড়ী; কিস্যুটি না। ওই দানার পেটে রইলে সমস্ত সম্ভাবনা।  সহজ ভাষায় সর্ষে বাটা ইলিশের হাতছানি বুকে নিয়ে রয়েছিলো সেই দানাটি।
    এরপর ?  
    একখানা দানা নিয়ে মহাকাল বয়ে যাবে ? কলকাতা আসবে না ? অফিস টাইম, ট্রামের রুমঝুম, চৌবাচ্চার জল, পুজোর ছুটি, কাতলার ঝোল; এসব বাদ দিয়ে থেকে যাবে সময়হীন অন্ধকার ? তা কি করে হয়। অতএব ডেকে উঠলো ব্যাং, ডোবার নেংটি মালটির কথা বলছি না। বিগ-ব্যাং।
    তুমুল বিস্ফরন। ব্যাস, ছড়িয়ে পড়তে লাগলো আলো, হাইড্রোজেনের ফিডীং বোতল হাতে ছুটে বেড়াতে লাগলো বাচ্চা-মহা-জগত। হাইড্রোজেন মাটির মানুষ; বউ বললে কাঁচকলার ঝোল ভাত খেতে আর অমনি সে হাসি মুখে গপাগপ গিলে নিলে, বস বললে চোপড়াও আর অমনি সে চুপসে গেলে। সেই হাইড্রোজেন এন্তার পরিমানে এদিক-সেদিক করে বেড়াতে লাগলো মহাফুর্তিতে; ব্যাচেলর লাইফের বেদম ফুর্তি। হাইড্রোজেন কনার ঠোকাঠূকিতে মাঠে এলে হিলিয়াম আর অমনি গনগনে আগুন পিন্ড হয়ে জ্বলে উঠলে অগুন্তি তারা। হ্যাপি দিওয়ালি।
    তারারা জ্বলে চললে আর গণ্ডা খানেক অন্য মাল উগড়ে দিতে লাগলে; নাইট্রোজেন, অক্সিজেন ইত্যাদি।র‍্যান্ডম গ্যাভিটির খেল। কিন্তু শুধু এসব মালে কি আর চলে ? গিন্নীর বিছেহারের সোনা মাংতা, লোকাল ট্রেনের হ্যান্ডেলে লোহা মাংতা, আরও কত অন্য ধরনের মাল মাংতা। তবে উপায় ?
    উপায় ফের দড়াম। তারারা ফাটতে শুরু করলে; সে এক অন্য রঙবাজি। সুপারনোভা কয় তারে। আপনার চারিদিকে যদি ক্যাটরিনা, প্রিয়াঙ্কা, বিপাশা, করিনা ও বিদ্যা মিলে যদি হুট করে দুম-দাম নাচতে আরম্ভ কর; তাহলে যেমন ভিসুয়াল তৈরি হবে; সুপারণভা খানিকটা তেমনই কেসসুপারনভা “ঝলক দিখলা যা”  নেত্য-বাজির সঙ্গে তুলনীয়। তা এই মুজরো থেকে বাঙালি কি পেলে ? বাঙালি পেলে স্যাঁতস্যাঁতে বাথরুমের লোহার বালতি , বনেদী কেতা মারার কাঁসার থালা  আর মেয়ের বিয়ের সোনা কেনার টেনশন।  এ ছাড়াও ফলাও মাল বেরোলো। কিপটে মানুষ মাত্রই বুঝবেন যে আজ যে মাল ফেলটু, সেই মালই কাল ফেলু মিত্তির হয়ে যেতে পারে- অতএব কিছুই ফেলে দেওয়া যায় না। ব্রহ্মাণ্ডও কিচ্ছুটি ফেলে দেয় নি। বর্মি বাক্সে সব মাল জমে ক্ষীর হয়ে রয়েছে। এবং থাকবে।
    দুমদাম বোমাবাজিতে আরও একখানি কাণ্ড ঘটে গেলো। তারারা নিজেদের শাগরেদ পেলে; বসের লেজুড় ধরা রাস্কেলগুলোর মত গ্রহরা পাক খেতে লাগলে তারাদের ঘিরে। সেদিক থেকে বাঙ্গালির সাথে গ্রহদের ভারি মিল; আমরা ঘুরঘুর করতে ভারি ভালোবাসি।
    তো এই যাবতীয় কেলো-বাজির মাঝে টুকি মারলে সূর্য আর এম-এল-এ’য়ের পোষা ল্যাংড়া গুণ্ডার মত হাজির হলে পৃথিবী। নয় গুণ্ডার তৃতীয় গুন্ডা; পৃথিবী। যেখানে তৃণমুল-সিপিএম খেঁউড়ে বাঙালি একদিন ঢেঁকুর তুলবে।      
    তখন পৃথিবীর রোয়াবই আলাদা; পাগলা কুত্তার মত খেই-খেই করে ছুটে চলেছে- দিন তখন মাত্তর ছয় ঘণ্টার, চব্বিশ ঘণ্টার নয়। পৃথিবী তখন জিবনমুখি গায়ক- উস্কখুস্ক চেহারা, গালে ব্রন, বুক ভর্তি আগুন। কাব্যি করা আগুন নয়; আদত গনগনে আগুন। তখন থাকলে টের পেতেন জ্যৈষ্ঠ দুপুর আসলে এলুমিনিয়ামের ডিবে থেকে বের করা এক টিপ নস্যিও নয়।   
    কিন্তু বাঙালি ভারি নরম পাবলিক, আশ্বিন মাসেও রোদে মাথায় ছাতা আর রাতে গায় কাঁথা ছাড়া চলে না। অমন গোলমেলে পৃথিবীতে বাঙালি লঞ্চ করবেন; বিধাতা অমন গো-মুখ্যূ নন।
    অতএব আর এক পিস হাত-বোমা। আরেকবার পৃথিবীর সাথে টক্কর অন্য এক বেওয়ারিশ মালের। সেই মালটি টুকরো টুকরো হয়ে গায়েব হয়ে গেলেও, পৃথিবী গেল অঙ্ক পরীক্ষার আগে পাতি ছাত্রের মত ঘাবড়ে। ঘূর্ণনের গতি গেল ভেস্তে, দিনের সাইজ হয়ে গেল চব্বিশ ঘণ্টা। আর ফাঁকতলে পৃথিবীর জুটে গেল একটি চ্যালা; চাঁদ। প্যালা আর টেনির হেঁড়ে গলায় “ এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভালো” গাইবার পথ প্রশস্ত হলো। চাঁদ একটা বড় হিল্লে করে দিলে, গ্র্যাভিটির মালাবদলে পৃথিবীর মিনিবাস-দুলুনি কে আলতো কন্ট্রোল হলোবাঙালিদের আবার বেশি ঝাঁকুনি পোষায় না।
    পৃথিবী থিতু হতে শুরু করলে, আকাশে জমলো মেঘ। শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি।  সে ভয়ানক বৃষ্টি, ভাগ্যিস তখন রবীন্দ্রনাথ সিনে ছিলেন না, নয়তো কমসে কম বারো কোটি টন বর্ষা-কাব্যি-কেতাব বাজারে ছেড়ে দিতেন। তো সে বর্ষায় আমহারস্ট স্ট্রিটে নৌকো না চললেও, পৃথিবী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলে – ঘামাচি পিঠে জলের ছিটে পড়লে যা হয় আর কি।
    বাঙালি মননের সিঁথির সিঁদুর পুরীর সমুদ্র। সেই সমুদ্রের জোগাড় হলো এবার পৃথিবীতে। চমৎকার; বাঙালি আর এক ধাপ এগিয়ে গেল স্টেপ আউট করার দিকে। সমুদ্র ফুঁড়ে পাহাড়, জমি – জমি বিনে প্রমোটারি চলে না, ফ্ল্যাটবারিও ওঠে না। জমি মাস্ট।
    হিমালয়-টিমালয় আড়মোড়া ভাঙবে অল্প পরেমহাদেশ-টেশ তখন দলা পাকিয়ে আছে সব। কিন্তু সমুদ্দুরের পেটে তখন লাগ ভেল্কি ব্যাপার। টুকটাক এদিক-ওদিক নাইট্রোজেন-হাইড্রজেন-আবোলতাবোল মালকড়ি মিলে চতকে-মটকে এক হিল্লে ব্যাপার তৈরি হলো; এমিবা। তারা এগরোল খায় না, কফি হাউসে আড্ডা মারে না, জেলুসিলের তোয়াক্কা করে না, মাঙ্কি টুপি পড়ে না – কিন্তু তারাই আমাদের পূর্ব পুরুষ। মাইরি। এলো ব্যাক্টেরিয়া, তার বহু যুগ পরে আমরা ভিক্টোরিয়া মেমরিয়ালের বাগানে বসে লুকিয়ে হামি খাবো। আর এই সব ব্যাকটেরিয়া-এমিবা মিলে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে ছাড়তে লাগলো অক্সিজেন; প্রচুর অক্সিজেন- যাতে আমরা একদিন অটো-ট্যাক্সির ধোঁয়া মিশিয়ে কলকাতাইয়া ফুসফুস ভরে নিতে পারি। তোফা। এলো ছোট-সেজ-মেজ সাইজের গাছ এবং এলো মাছ। ইয়েস স্যার, প্রথম সরীসৃপ বলতে মাছ। এ থেকেই মালুম হয় যে বিধাতা পৃথিবীর সৃষ্টিই করেছেন বাঙ্গালি মাছ গিলে গিলে ফৌত হবে বলে।
    কিন্তু জলে কাহাতক খেল জমে ? কিছু সরীসৃপ লেংচে লেংচে গিয়ে উঠলে ডাঙ্গায়।  জলে নরম ডিম পাড়লেও চলতো, ডাঙ্গায় এসে তারা শুরু করলে শক্ত খোলসে ডিম পাড়তে, এতে বাঙ্গালির ফ্রিজের শেল্ফে ডিম সাজিয়ে রাখতে সুবিধে হবে। এর পাশাপাশি ইতিউতি উঁকি মারছে নেহাতই এলেবেলে স্তন্যপায়িরা
    ডাঙ্গায় চড়চড় করে বাড়তে লাগলো সরীসৃপদের আয়তন – চারিদিকে তখন ডাইনোসর। অমন রাক্ষুসে জানয়ারগুলোর সাথে বাঙ্গালির থাকা চলে না; রিস্ক ব্যাপারটা আমাদের কোনও কালেই পছন্দ নয়।ফাঁকা গলিতে কুকুর দেখলেই বুক ঢিপঢিপ করে, চিরিয়াখানার বাইরে বাঘ মানেই আপদ। অতএব বিধাতা নতুন টেকনিক প্রয়োগ করলেন। ফের এক ধুমকেতুর টক্কর পৃথিবীর সাথে, সমস্ত ডাইণোসর সমূলে গায়েব। পড়ে রইলে শুধু রোগা পটকা পঞ্চাশ পাউণ্ডের কম ওজন বিশিষ্ট জানয়ারেরা। তোফা।
    তদ্দিনে মহাদেশ-টেশ দাঁড়িয়ে পড়েছে মোটের ওপর। বেদম জঙ্গল, উদোম সমুদ্দুর, উলঙ্গ পাহাড়। সমুদ্দুরে হাবিজাবি প্রাণী। গাছে গাছে সাত-পাঁচ রকমের প্রাণী; তাঁদের মধ্যে এক প্রকার ভারি বেয়াক্কলে, বাঁদুরে। সেই বাঁদুরে ব্যাটাগুলোর আবার স্পষ্ট হাতের আঙ্গুল সবআলুপোস্ত-ভাত খেয়ে আঙ্গুল চাটবেন না ?
    বড় বড় গাছ আর গাছে গাছে বেশ রয়েছেন বাঁদর-দাদাবাবুরা। এমন সময় পৃথিবীময় ভীষণ ভাবে ঘাস গজাতে লাগলো। তাতে একটা মুশকিল হলো, প্রচুর ঘাসের জন্যে জায়গা করে দিতে বড় গাছের সংখ্যা কমে এলো। তা আদি-বাড়িতে লোকজন খুবে বেড়ে গেলে, প্রতিষ্ঠিত কচি খোকা-বউমারা নতুন ফ্ল্যাটে উঠে যাবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। তেমনি গাছ কমে আসায়, কিছু সিম্পাঞ্জি গোছের পাবলিক গাছ ছেড়ে নেমে এলেন জমিতে। এবং জমিতে নেমেই তারা অদ্ভুত একটা আবিষ্কার করে ফেললেন- চার পায়ে রগড়ে চলার থেকে দুই পায়ে হাঁটলে চারপাশে নজর রাখার ভারি সুবিধে। এবং তাতে আরো বড় সুবিধে হচ্ছে যে অন্য পা জোড়া কে হাত জোড়া হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তবেই না এক কালে গিয়ে সৌরভ গাঙ্গুলি কভার ড্রাইভ হাঁকবেন, পিতা অঙ্কে ফেল করা সন্তানকে আড়ং-ধোলাই দেবেন, উত্তমকুমার সুপ্রিয়ার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নেবেন। তবেই না। ঘাড় কুঁজো হয়ে বাঁদুরে চলা-ফেরায় বেজায় অস্বস্তি, বাঁদর ক্রমশ সোজা হয়ে হাঁটলেন। হাঁটলেন। জিবনানন্দ হাঁটা শুরু করলেন।
    এবং মানষ আগুন জ্বালাতে শিখলে। মাংস পুরিয়ে খেলে যে সহজ-পাচ্য হয় এইটা বড় কথা নয়, এই আগুনে আগামী দিনে বাঙালি ভরা কড়াইয়ে বেগুনি ভাজবে সেইটেই হলো আদত সত্য। পরম সত্য। আগুনের হাত ধরে ভাষা এলে – বঙ্কিম কে আসতে হবে, রবীন্দ্রনাথ কে আসতে হবে, সুনীল কে আসতে হবে। গুহায় যারা ছবি আঁকলেন, তারা বাঁদুরে নন, তারা গণেশ পাইনের দলে। মানুষের দলে।
    একটা হিম-যুগ এসে গেল। মানুষ মচকালো না। মচকালে চলবে ? তবে বহু বছর পরে জয়েন্ট ফেল করে আত্মহত্যার চেষ্টা করবে কে ? নেভার। মানুষ কে লড়তেই হতো। বরফ ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে মহাদেশের খণ্ড গুলো জুড়ে গেলো বরফের সব ব্রিজে। পাবলিকও ছড়িয়ে পড়লে, আজ যেমন বেহালা টু নিউ টাউন ছড়িয়ে যাচ্ছে মানুষজন। হিমযুগ শেষে বরফের সেতু গুলো গলে সাবাড় হয়ে গেল, মহাদেশগুলো ফের হয়ে পড়লে বিক্ষিপ্ত আর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলো হয়ে পড়লেন বিছিন্ন। ওই উল্টোডাঙ্গা ফ্লাই-ওভার ভেঙ্গে পড়ায় যে হুজ্জুতি হলো, সে রকমই একটা কিছু আর কি।   
    এরপর বাঙ্গালির আত্মপ্রকাশ রোখা অসম্ভব ছিল। একে একে চাকা-চাষবাস-আদি শহর-লিপি-সঙ্গীত-উপনিবেশ স্থাপন-শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি ছুঁয়ে বিধাতার আশীর্বাদ ধন্য বাঙালি এসে স্পর্শ করলে চর্যাপদ। তারপর থেকে ক্রমশ;  হরতাল, ইসবগুল, আড্ডা, দিবা-নিদ্রা, পাঁঠা কষা ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালি পৃথিবীর বিবর্তনকে ক্রমাগত উর্বর থেকে উর্বরতর করে চলেছে।   
     


No comments: