এই টিভি ইন্টারনেটের যুগেও ছাপানো বই পাবলিক খায়। ভালোই খায়। অন্তত বইমেলার শনিবারের ভিড় পরখ করে আনন্দবাজার তাই বলছে। রবিবারের বইমেলা আরও দাপুটে ভঙ্গিতে সেইটেই প্রমাণ করলে। বই প্রতি অন্তত দেড় খানা মাথা আজ বোধ হয় বইমেলায় ছিল। সে একেবারে টেরিফিক কাণ্ড। বই মেলা চত্বরে পা রাখলাম এক পিতা-পুত্রের পিছন পিছন।
পুত্র ক্রমাগত
ঘ্যান ঘ্যান চালিয়ে যাচ্ছিলে – “ বাবা, ইট ইজ টু ক্রাউডেড হিয়ার। লেট্স গো ব্যাক”
বাবা ক্রমাগত
ধমকে কাউন্টার করে যাচ্ছিলেন – “ গো ব্যাক মানে ? বই ইজ ইওর বেস্ট ফ্রেন্ড, এটা আর
তুমি কবে শিখবে ? দিন দিন থ্যাবড়া গণেশ তৈরি হয়ে চলেছ, বই কে চিনতে শিখবে কবে ? বই
মেলার ভিড় সাসটেইন না করতে পারলে বই ভালবাসবে কি করে ? কম্পিউটার গেমেই তোমার ঘিলু
চটকে পাতুরি বানিয়ে ফেললে”।
***
বাহাত্তর নম্বর
পাতায় পেজ মার্কটা রাখা ছিল। অর্জুন সাবধানে তিয়াত্তরে ল্যান্ড করলে।
***
বইমেলার পড়ন্ত
রোদে আরামবাগের উইং স্ট্রিপ্স। রিচি বেনো থাকলে পদ্য লিখতে পারতেন। পাশ থেকে ভেসে
এল কথোপকথনের টুকরো –
- “ গুরু, বই ছাড়া সারভাইভ করা যেত। কিন্তু মুর্গি না থাকলেই
কেস”
- “বইয়ের পিডীএফ হয় কিন্তু কাবাবের হয় না। হুইচ প্রুভ্স যে
কনসেপ্ট হিসেবে বইয়ের চেয়ে কাবাবের ইন্ট্রিনসিক ভ্যালু ও ভায়াবিলিটি বেশি"
***
প্রথম দু চার
পাতা পেরিয়ে একবার বইতে সেঁধিয়ে গেলে আর আশেপাশের চিৎকার-কলরোল অর্জুনের কানে
রেজিস্টার করে না।
***
দু খানা লম্বা
লাইন। এক মাঝ-বয়সী ভদ্রলোক আচমকা হাহাকার করে উঠলেন।
- “ এটা টয়লেটের লাইন নয় ? এ যে দেজ পাবলিশার্স’য়ের লাইন তা
কি ছাই আমি জানতাম! কোথায় যে লাইন দুটো ইন্টারসেক্ট করেছে ঠাহর করতে পারিনি। এখন উপায় ?
ক্যালামিটি যে!”
***
দুটো চ্যাপ্টার
শেষ হতে অর্জুন ব্যাগ খুলে জলের বোতল বের করে এক চুমুক খেলে। আসে পাশে তাকিয়ে
দেখলে হই-হই-রই-হই কাণ্ড। বেশ ভিড় জমে গেছে। এক চা-ওয়ালা কে ডেকে এক কাপ লেবু চা
নিয়ে ফের সে মন দিলে বইতে।
***
“ বাবা,
ছিন্নমস্তার অভিশাপ কিনে দাও প্লিজ। ওইটা আমার এখনও পড়া হয়নি”, এক বছর চোদ্দ’র
খোকা ককিয়ে উঠলে। বুক আনচান করে উঠলো,- আহা রে, আমার যে আর না পড়া-ফেলুদার
এডভেঞ্চার নেই।
***
অর্জুন ঝড়ের বেগে
এগিয়ে যাচ্ছিল, বইয়ের নায়কের সঙ্গে একাত্ম হয়ে।
***
লিট্ল ম্যাগাজিন
এনক্লেভে প্রবল উত্তেজনা। কমিটমেন্ট যে কাকে বলে তা এ পাড়ায় না আসলে টের পাওয়া
যাবে না। কমিটমেন্ট লেখার প্রতি, কবিতার প্রতি, বইয়ের প্রতি, নতুন ধরনের কিছু করার
তাগিদের প্রতি।
এখানে সবই
অ্যাবস্ট্র্যাক্ট। পাবলিক এখানে পাঁয়তারা কষেন না আঁতলামোর পাল্লায় পড়ার ভয়ে, আর এখানের
কবি ও লেখকরা পাবলিকের পরোয়া করেননা ইন্টেলেক্ট লেভেল ঝুলে যাওয়ার ভয়ে। এখানে
বিক্রিবাটা বলতে একে অপরের বই কেনা।
এক তরুণ কবির বই
প্রকাশ হল একটা টেবিল ঘেঁষে। মোড়ক উন্মোচন করলেন এক প্রবীণ স্বল্প-নামী কবি।
হাততালি দিলেন আরও দু দশজন উঠতি কবি। তরুণ কবি হাততালি-ওয়ালা’দের দু পিস লেড়ো-সহ চা
খাওয়ালেন; যদিও বইটি তিনি ছাপিয়েছেন নিজের পয়সা খরচ করে। তার বইটি দু চার পিস
কিনবেন তার পরিচিত কয়েকজন, আর বাকি কপিগুলো তাঁর বাড়ির চিলেকোঠায় ডাই হয়ে পড়ে
থাকবে।
পরিচিত এক বন্ধুর
প্রকাশ করা এক লিটল ম্যাগাজিনের বইমেলা-বিশেষ সংখ্যার এক কপি কিনে সরে পড়লাম।
বন্ধুটি “ থ্যাংকস” বললে। সে জানে যে এ পত্রিকা পড়ার ধৈর্য ও সততা আমার নেই। তবুও।
***
এদিকে ভিড়টা বেড়ে
যাওয়ায় অর্জুন কে উঠতে হল। হেঁটে একটু এগিয়ে গিয়ে সুবিধে মত জায়গা দেখে বসে ফের বই
খুললে সে। বইটি প্রায় শেষের দিকে। ক্লাইম্যাক্স দানা বাঁধছে।
***
দেখলাম “চাঁদের
পাহাড়”য়ের কমিক্স; থুড়ি – গ্রাফিক নভেল। সমস্তটাই হাতে আঁকা শুধু শঙ্করের মুখের
বদলে দেব’য়ের মুখটি সুপার-ইম্পোজ করে বসানো। দোকানি জানালে যে পাবলিক নাকি খুব
খাচ্ছে। সিনেমার রেশ এখনও কাটেনি কি না।
সদ্য কেনা বাঁটুল
সমগ্রটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরলাম। সেন্টিমেন্টে নয়, ভ্যাঁপসা ভিড়েও কেমন আচমকা গায়ে
কাঁটা দিয়ে ঠাণ্ডা লাগছিলো।
***
অর্জুন কয়েক
মিনিট বই বন্ধ করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলে। শেষ দু পাতা পড়বার আগে সে মনে মনে বইটার
সারটুকু ঝালিয়ে নিচ্ছে। নিজেকে প্রস্তুত করছে বইয়ের শেষ দুটো পাতার জন্যে। কাহিনীর
নায়কের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ আসন্ন; শেষ দু পাতায় আরও জোরালো ভাবে নায়কের পাশে থাকতে
চায় অর্জুন।
***
অনিকেতের সঙ্গে
দেখা হয়ে গেল বই মেলায়। অন্তত বছর দুই পর। কফি সহ জমাট আড্ডা হল। ফিসফিস’য়ের স্টল
থেকে ফিশ-ফ্রাই। অনিকেত নিজের বারো বছরের ভাগ্নের জন্যে বাংলা গল্পের বই কিনতে
এসেছে। ভাগ্নে-বাবুটি বাংলা পড়তে পারলেও, গল্পের বই যেটুকু যা পড়ে তা ইংরেজিতেই।
ওর মধ্যে বাংলা সাহিত্যের প্রতি ইন্টারেস্ট ইঞ্জেক্ট করতে চাইছে অনিকেত। আমার থেকে
সাজেশন চাওয়ায় সোজা বলে দিলাম “ সুকুমার কিশোর সমগ্র ইনক্লুডিং পাগলা দাশু অ্যান্ড
লক্ষণের শক্তি-শেল আর বিভূতিভূষণ কিশোর সমগ্র ইনক্লুডিং মরণের ডঙ্কা বাজে, চাঁদের
পাহাড় অ্যান্ড হিরে-মানিক জ্বলে। ক্যাপিচুলেট করতে হলে এই দুই ব্রহ্মাস্ত্রই
যথেষ্ট। নয়তো ও মালকে তুমি ব্লাইটন আর রাউলিং’য়ের কবলেই ছেড়ে দাও”
***
অর্জুন বইটা বন্ধ
করে তার ভালো লাগাটা উপভোগ করছে। শরীরটা বই মেলার প্রাঙ্গণে বেশ দৃষ্টিকটু ভাবে
এলিয়ে দিয়েছে। তিন ঘণ্টার পড়ার অবসাদ যতটুকু, ভালো লাগার আদুরে ক্লান্তি তার চেয়ে
অনেক বেশি। বইমেলায় বসে বই পড়াটা তার একধরনের ফেটিশ।
আচমকা ঘড়িতে
দেখলে পৌনে আটটা বাজে। আটটা নাগাদ তন্ময়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা চার নম্বর গেটের
কাছে। বইটা ব্যাগে চালান করে অর্জুন চার নম্বর গেটের দিকে হাঁটা দিলে।
***
তিনটি ছেলে
মাটিতে লেপটে বসে মনের সুখে গেয়ে চলেছে “কখন তোমার আসবে টেলিফোন”। তাঁদের ঘিরে জনা
দশেক কলেজ পড়ুয়া। আর আমি।
ঠিক তক্ষুনি
বউয়ের ফোন। বাড়ি ফেরার পথে যেন এক লিটার সর্ষের তেল নিয়ে ফিরি। লঘু-কেসে
কোইন্সিডেন্স বলে চালালেও, এমন মুহূর্তে সমাপতন শব্দটা ব্যাবহার করবার বিশেষ
প্রয়োজন। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম পৌনে আটটা। এবার বেরোনো যাক। তবে বেরোবার আগে অর্জুনের
সাথে দেখা করা দরকার। ওকে দেওয়া কথামত চার নম্বর গেটের দিকে এগোলাম।
***
চার নম্বর গেটের
কাছে পৌছতেই দেখলাম অর্জুন দাঁড়িয়ে আছে।
- “ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ?” জিজ্ঞেস করলাম।
- “ এই দু মিনিট হল। কেমন কাটালে বই মেলায় আজ ?”, অর্জুনকে আজ
পর্যন্ত কখনও না হেসে কথা বলতে দেখিনি।
- “ নিজের জন্যে বই কেনা, উপহার দেওয়ার জন্যে বই কেনা। বই
দেখে বেড়ানো। আড্ডা। গান শোনা। চালের দানার ওপর নিজের নাম লেখালাম।
তিন কাপ চা, এক রাউন্ড বেগুনী, এক পিস ফিশ ফ্রাই এবং তন্দুরি চিকেন খেলাম। সব মিলে
কমপ্লিট বই মেলা সন্ধ্যে। ব্রিলিয়ান্ট ভাবে কাটলো। তুমি আজ বইমেলায় কেমন কাটালে ?
- “ভায়া, আমি বইমেলায় নিজের মত করে একটু বই-পড়া রেখে গেলাম
বরং”, সলজ্জ ভাবে জানালে অর্জুন।
5 comments:
বস এটা সাম্প্রতিককালের সেরা বংপেন...!
বস এটা সাম্প্রতিককালের সেরা বংপেন...!
লজ্জায় এই কথা বলা যায় না ঘনিষ্ট বন্ধুকে কিন্তু এটা ই সত্যি , উল্লিখিত এই তরুণ কবি টি বোধহয় আমার একান্ত প্রিয় এক বন্ধু , নাকি সবার ই এরকম হয় ?
” এক তরুণ কবির বই প্রকাশ হল একটা টেবিল ঘেঁষে। মোড়ক উন্মোচন করলেন এক প্রবীণ স্বল্প-নামী কবি। হাততালি দিলেন আরও দু দশজন উঠতি কবি। তরুণ কবি হাততালি-ওয়ালা’দের দু পিস লেড়ো-সহ চা খাওয়ালেন; যদিও বইটি তিনি ছাপিয়েছেন নিজের পয়সা খরচ করে। তার বইটি দু চার পিস কিনবেন তার পরিচিত কয়েকজন, আর বাকি কপিগুলো তাঁর বাড়ির চিলেকোঠায় ডাই হয়ে পড়ে থাকবে।“
পরিচিত এক বন্ধুর প্রকাশ করা এক লিটল ম্যাগাজিনের বইমেলা-বিশেষ সংখ্যার এক কপি কিনে সরে পড়লাম। বন্ধুটি “ থ্যাংকস” বললে। সে জানে যে এ পত্রিকা পড়ার ধৈর্য ও সততা আমার নেই। তবুও।
লজ্জায় এই কথা বলা যায় না ঘনিষ্ট বন্ধুকে কিন্তু এটা ই সত্যি , উল্লিখিত এই তরুণ কবি টি বোধহয় আমার একান্ত প্রিয় এক বন্ধু , নাকি সবার ই এরকম হয় ?
” এক তরুণ কবির বই প্রকাশ হল একটা টেবিল ঘেঁষে। মোড়ক উন্মোচন করলেন এক প্রবীণ স্বল্প-নামী কবি। হাততালি দিলেন আরও দু দশজন উঠতি কবি। তরুণ কবি হাততালি-ওয়ালা’দের দু পিস লেড়ো-সহ চা খাওয়ালেন; যদিও বইটি তিনি ছাপিয়েছেন নিজের পয়সা খরচ করে। তার বইটি দু চার পিস কিনবেন তার পরিচিত কয়েকজন, আর বাকি কপিগুলো তাঁর বাড়ির চিলেকোঠায় ডাই হয়ে পড়ে থাকবে।“
পরিচিত এক বন্ধুর প্রকাশ করা এক লিটল ম্যাগাজিনের বইমেলা-বিশেষ সংখ্যার এক কপি কিনে সরে পড়লাম। বন্ধুটি “ থ্যাংকস” বললে। সে জানে যে এ পত্রিকা পড়ার ধৈর্য ও সততা আমার নেই। তবুও।
অসাধারণ লিখেছেন তো! ঠিক যেন একের পর এক ছবি ভেসে উঠল চোখে।
Post a Comment