বাজারের মুখে এসে
রিক্সা থামতে কালোকইবাবু আনন্দবাজারটা মুড়ে পাঞ্জাবির ঝোলা পকেটে গুঁজলেন। ছপাত
শব্দে আনাজ বাজারের ঘোলা জল ঠেলে এগিয়ে গেলেন আমিষ বাজারের দিকে। শাক-পাতি পরে
কিনলেও হবে, কিন্তু বেলা বেড়েছে কি টাটকা মানুষজন সব হাওয়া হয়ে যাবে। গিন্নী
এদিকে আবার কচি মানুষের মাথা দিয়ে আজ ঘিলু-চচ্চড়ি রাঁধবেন, খোকা বড়-খাল থেকে
ফিরছে আজ গরমের ছুটিতে।
হুড়মুড় করে এগিয়ে
যাবেন এমন সময় ছলবাত শব্দে ধাক্কা বিধুকাতলা বাবুর সঙ্গে।
-“ সামলে কালোকইবাবু, সামলে। আমার এমন
ধ্যাপস চেহারাটি চোখ এড়ায় কি করে মশায় ?”, এক গাল হেসে বললেন
বিধুকাতলা।
-“ ইয়ে, মানে দেরি হয়ে গেল
কিনা। বেলা বাড়লেই তো আবার সেই অন্ধ্র থেকে চালান আসা মরে সাদা হয়ে যাওয়া মানুষ কিনতে হবে। টেস্ট নেই, কেরোসিনের গন্ধ। দাম
দু পয়সা বেশি দেব কিন্তু বাঙালি কচি খোকামানুষ ছাড়া রবিবারের পাতে পোষায় না”
-“ তা যা বলেছেন। তবে
মাগ্যির বাজারে, রোজ রোজ বাঙালি খেতে হলে যে ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্স লাটে উঠবে মশায়
, হে হে হে হে”
, হে হে হে হে”
গপ্পে আটকে থাকলে
কালোকইবাবুর চলবে না। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে সোজা এসে পড়লেন মানুষ বাজারের
হইচইয়ে। জিনিষপত্রের দাম যেভাবে
বাড়ছে, সাধারণ মাছেদের কাছে বাঙালি মানুষ তো দুরের কথা, মারাঠি মানুষ বা নিদেন
পক্ষে কেরলের দোসা খেয়ে বড় হওয়া বিস্বাদ মানুষও নিয়মিত পাতে ঠেকানো অসম্ভব
হয়ে পড়ছে। আসলে ইলিশ সরকার গদিতে আসার পর থেকেই মুদ্রাস্ফীতি যেভাবে বেড়ে চলেছে
তা বলার নয়। অভাবী মাছেরা আজকাল নিরুপায় হয়ে গুজরাতি মানুষও খেতে বাধ্য হচ্ছে।
দুর্যোগের দিন; তবে মাছ মানুষ না খেয়ে টিকবে কি করে
?
কালোকই বাবু এদিক ওদিক
হন্যে হয়ে না ঘুরে সোজা গিয়ে থামলেন রামবোয়াল মানুষওয়ালার দিকে। রামবোয়াল
কালোকই বাবুর অতি বিশ্বস্ত, আজ পর্যন্ত সে পচা মানুষ গছায়নি কখনও। লুঙ্গিতে ফিরতি গিঁট বেঁধে
রামবোয়াল কানকো বের করে হাসলে – “ আয়েন কালোকই বাবু, বলেন। কচি বাঙালি
নেবেন না পেট চওড়া উঁড়ে ?
দামের চিন্তা করেন না যেন”
- “ শোন হে রামবোয়াল, খোকা আজ বাড়ি ফিরছে।
দরাদরি আজ করব না। মানুষ যেন এ-ক্লাস পাই”
- “ আজকে ভোরেই সাপ্লাই
পেয়েছি। এক্কেরে কলকেতার মানুষ বাবু। নিয়ে নেন। পুরা মানুষ নেন, তিনশোয় কিলো দেব”
- “ তিনশো ঠিক আছে। কিন্তু
টাটকা জ্যান্ত কলকাতাইয়া চাই রামবোয়াল। বুঝলে ? আর আমরা তিনজন মাছ, পুরো মানুষ নিয়ে করব
কি। কচি দেখে এক পিস মানুষ দেখাও, বুক থেকে পেট টুকু
কেটে নেব। আর অর্ধেক মাথা। ঘিলু সহ। বুঝলে ? “
- “ ঠ্যাং দুটোর জন্যে যে
খদ্দের পাব না বাবু, তিনশোয় কি করে দেব ?”
- “ আহ, রামবোয়াল, বাড়াবাড়ি কর কেন ? তিনশো অনেক। ওই যে ওই
কচি কলকাতাইয়াটা জ্যান্ত কি ? লাফাচ্ছে না কেন ? “
- “ অত কচি খান নেবেন না
পাশের বড় কলকাতাইইয়া মানুষ-খান নেবেন কত্তা ?”
- “ না হে, এ সময় ধেড়ে মানুষের
পেটে বাচ্চা থাকে, স্বাদ কমে যায়। তুমি বরং কচি কলকাতাইয়াখানাই দাও। কিন্তু নড়ে না
কেন কচি মাছটা, টাটকা নয় নাকি ?”
- “ কি যে বলেন বাবু। পেট
চিরলে দেখবেন ফিনকি দিয়ে টাটকা রক্ত বেরোয় কেমন। আমাদের মাছেদের রক্তের সঙ্গে
কোনও ফারাক পাবেন না গো”
- ফিরিস্তি দেওয়া ছাড়।
কচি কলকাতাইয়া খানা দুএক পিস এদিকে দাও দিকি বাবা রামবোয়াল, টিপে টুপে দেখি কেমন
তাজা সব। যেটা পছন্দ হবে নেব”
******
আমরা কি না মানুষ, তাই জলের তলে শ্বাস
নিতে পারি না। ক্রমশ অসাড় হয়ে আসছিলাম, মানুষের ঢিপির মাঝে
শুয়ে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে আমার চারপাশ। আমার চারিদিকে বীভৎস সব ষণ্ডা মার্কা
মাছেরা মূর্তিমান মৃত্যুর মত হাঁকডাক করে চলেছে। পাশে থেবড়ে শুয়ে আমার মা। মা
ক্রমশ আমায় বলে যাচ্ছিলেন শ্বাস আটকে মরে যাওয়ার যন্ত্রণা বঁটিতে কাটা পড়ার
চেয়ে অনেক কম। মা নিজে মারা যাচ্ছে বলে তেমন দুঃখ পাচ্ছে বলে মনে হল না, মা’র যত চোখ ছলছল আমি মরে
যাচ্ছি বলে। মা শুধু চাইছে আমি যেন বঁটিতে কাটা যাওয়ার আগে দম বন্ধ হয়ে মারা
যাই।
- “ এই খোকা শুনতে পাচ্ছিস
আমার কথা ?”
- “ হ্যাঁ, মা। খুব কষ্ট হচ্ছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে। এক বাক্স অক্সিজেনের ভেতরে আমাদের রেখেছে বটে জ্যান্ত রাখার
জন্যে, কিন্তু এত মানুষের কি এত কম অক্সিজেনে গুজরান হয় বল ?”
- “ধুর বোকা, তোকে কি জ্যান্ত রাখার
জন্যে অক্সিজেনে রেখেছে ? অল্প অক্সিজেনে তুই ছটফট করবি। তুই যত ছটফট করবি, মাছেদের তোকে তত বেশি
পছন্দ হবে। মাছেরা ছটফটে মানুষ খেতে পছন্দ করে কি না। তোকে বেশি লাফাতে দেখলেই কেউ
চটাং করে তোকে পছন্দ করে তুলে বঁটিতে সপাং করে কেটে দেবে। সে ভারি কষ্ট খোকা। তার
চেয়ে অসাড় হয়ে শুয়ে থাক, দেখবি বঁটিতে কাটা
পড়বার আগেই দম ফুরিয়ে মারা যাবি। কষ্ট কম হবে অনেক।
- “ তুমি কাঁদছ মা ?”
- “ আসলে কিছুক্ষণ আগেই
তোরা বাবাকে ওরা এমন ভাবে... আর তুই...কি বয়স তোর...”
- “ কেঁদো না মা... কেঁদো
না...”
- “ চুপ। কতবার বলবো ছটফট করিস না, তোর রক্তের ছিটে গায়ে
নিয়ে আমি মরতে চাই না খোকা। ছটফট করিস না। দম বন্ধ হয়ে শেষ হয়ে যা সোনা আমার।
বঁটিতে যাস না। যাস না”
1 comment:
Machke jodi manush banalen manush ke manush rekhe dilen keno.....
Post a Comment