১।
ট্রেনের জানালার বাইরে উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ফুরফুরে বসন্তের
হাওয়া। আহা। মনে কেমন করে ওঠে গো। কিন্তু এই ভালো লাগার মধ্যেই আচমকা দাড়িতে
অস্বস্তিকর চুলকানি শুরু হল; ট্রেনের জানালার পাশে বসবার এই এক ঝামেলা। এত কয়লা
মাখা ধুলো ওড়ে; যাচ্ছেতাই এক্কেবারে। এদিকে আজিমগঞ্জ ঢুকতে এখনও আধ ঘণ্টা। জল সাবান দিয়ে ভালো করে মুখ না ধোয়া
পর্যন্ত সোয়াস্তি নেই। গুনগুন করে একটা চলতি গানের কলি ভেজে নিজের মনকে নিজের দাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন রবীন্দ্রনাথ।
২।
-
“ আমি কোথায় ?”
-
“ বোলপুরে”
-
“ কিন্তু আজিমগঞ্জ
যাচ্ছিলাম যে...”
-
“ আপনি কে? চারিদিকে এত
অন্ধকার কেন? আপনাকে দেখাই যাচ্ছে না যে...”
-
“ আমায় দেখে কি কাজ ?
আমি যেমনটি বলবো, আপনি তেমনটি করবেন। ব্যাস। কোনও ঝুট ঝামেলা থাকবে না তাহলে”
-
“ শরবৎ হবে ? গলা শুকিয়ে
এসেছে গো”
-
“ টিউবওয়েলের জল চলবে ?”
৩।
রবীন্দ্রনাথ ভারি ভেবড়ে রইলেন। কি গেরো। এদিকে আবার অম্বলটা মাথা চারা
দিয়েছে। ট্রেনে ওই ভাজা পোড়া খাওয়া মোটেও ঠিক হয় নি গো। এরা যে কোথায় নিয়ে এলো।
যাওয়ার ছিল আজিমগঞ্জ, আর এসে পড়লেন বোলপুর না তিব্বত কোথায় যেন।
৪।
হাতে সোনার মেডেলটা নিয়ে মুচকি হাসলেন রবীন্দ্রনাথ। থুড়ি, মেডেল নয় –
নোবেল। তাঁর নিজের নামের মেডেল। এত
দিন নিজ গুনে কত কিছুই না আদায় করে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এমন সোনার লকেট। আহা, বেশ ওজন আছে গো। ভরি কত
করে আজকাল কে জানে।
৫।
-
তুমি ভূত ?
-
তুমি কি ভয় পেলে ?
-
ঠাট্টা করছেন স্যার ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার নাম । আমি ভয় পাব ?
-
তুমি কি কর রবীন্দ্রনাথ
?
-
আপনার ভাবগতিক দেখে
আপনাকে অবিশ্বাস করবার অবিশ্যি কোনও কারণ নেই। বেশ একটা ভূত ভূত ব্যাপার আছে বটে আপনার মধ্যে। গাছের ডাল থেকে ঝোলা আপনার ওই ঠ্যাং দুটো দেখেই কেমন বুকের মধ্যে
খলবল করেছে। তাই বলতে বিশেষ লজ্জা
নেই। ইয়ে, আমি পকেট-মার। আজিমগঞ্জ লাইনে সব থানার বড়বাবু আমায় এক ডাকে চেনেন রবিন
পকেট-কাটা বলে। ভারি ইয়ে আর কি।
-
তোমার পদবী কি সত্যিই
ঠাকুর ?
-
আজ্ঞে আমার দাদু পাবনার মধু ডাকাতের দলে পাচক
ছিলেন। তাঁকে মধু ডাকাত আদর করে ডাকতেন গুপী ঠাকুর। সেই থেকে দাদু নিজের পৈতৃক
পদবী পাত্র থেকে ঠাকুর করে নেন। রবীন্দ্রনাথ নামটা অবিশ্যি, বুঝলেন কি না ভূত বাবু, আমার মায়ের দেওয়া।
-
বুঝলাম। তা এই বোলপুরে কী মনে করে ?
-
আর বলেন কেন। এক দল
ডাকাত আমায় হুজ্জতি করে ধরে আনলে। বললে আমায় সুযোগ করে দেবে তাঁরা শান্তিনিকেতন
থেকে সোনার নোবেল হাত সাফাই করার। কাজটা অবিশ্যি আমায় ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে হত না।
এ তো আর গা জোয়ারি ডাকাতি নয়, অতি সূক্ষ্ম হাতের কাজ। মিউজিয়াম থেকে নোবেল চুরি।
তা ভগবানের দয়ায় বলতে নেই, দারোগারা নিজের মুখে স্বীকার করেন যে আমার আঙুলের ডগায়
মাখন রয়েছে। তা সে ডাকাতরা চাইলে আমি যেন ওই সোনার মেডেল চুরি করে তাঁদের হাতে
দিয়ে দি। তাঁরা সে নোবেল বেচে ফুর্তি করবে
আর আমায় দেবে এঁটো হাড়-কাঁটা। ওরা
রবীন্দ্রনাথের পকেট মারার হাতযশ’য়ের কথা জানে, কিন্তু জানেনা যে আমি
পালাতেও ওস্তাদ। ভিড় ট্রেন থেকে হাফ ডজন পকেট কেটে নিমেষে উবে যেতে পারি। থানায় মাঝে মধ্যে যাই সে তো শুধু বউ’য়ের
প্যানপ্যানানি থেকে দুদিন দূরে থেকে জিরিয়ে নিতে। নোবেলও চুরি করলাম, আর ওই
ডাকাতের দল যারা আমায় ট্রেন থেকে উঠিয়ে এনেছিল; তাঁদের চোখেও ধুলো দিয়ে ফসকে এলাম।
হে হে হে।
-
না:, মানতে হবে যে তুমি
গুণী লোক।
-
হে হে হে, আপনাদের
আশীর্বাদ আর কি।
-
তা এখন চললে কোথায় ?
-
আজ্ঞে ভেবেছিলাম বাড়ি
গিয়ে সোজা বউয়ের হাতে তুলে দেব সোনার মেডেল খানা। কিন্তু তারপর ভেবে দেখলাম বউ তো
সোনা গলিয়ে সমস্ত টাকাই ঢেলে দেবে সংসারের পিছনে। ছাতের এসবেস্টস সারাই কর রে, খোকার নতুন প্যান্টালুন কেন
রে, ছাগল কেন রে, বেগুন চাষ কর রে; মাগীর বায়নাক্কা কি কম ? তাই ভাবলাম থাক বিটি
তুই সংসার নিয়ে, আমি বরং এই সোনা বিক্রি করে দুদিন একটু ফুর্তি করি। বাংলা খেয়ে
খেয়ে হদ্দ হয়ে গেলাম গো ভূত-দাদা। সেই
কবে হুইস্কি খাইয়েছিলে দিনু-চোর, পুরকায়স্থদের
আলমারি থেকে ঝেড়ে। ভাবছি কদিন একটু হুইস্কি-টুইস্কি খাই। পাঁঠার কিমা, কাবাব-টাবাব
থাকবে সাথে। ওদিকে শেওড়াফুলির মেয়ে-পাড়াতে শুনেছি নতুন মেয়েছেলে এসেছে গো। মাস
ছয়েকের দেদার ফুর্তি হয়ে যাবে এই সোনা বেচে।
-
তুমি যথার্থই গুণী
রবীন্দ্রনাথ।
-
তা আপনার নামটা ভূত-কত্তা ? ও কি ? গায়েব হয়ে গেলেন নাকি ? ও মশাই ?
৬।
তুই এই সোনার মেডেল
কোথায় পেলি রে বউ ?
-
লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে গো। মা
লক্ষ্মী এত দিনে মুখ তুলে চেয়েছেন। একটাও বেস্পতিতে পাঁচালি পড়া বাদ দিই নি। তা সে
জ্বর, পেট খারাপ যাই হোক।
-
না মানে, আমি তো এমনই
একটা মেডেল গতকাল...
-
সেটা তাহলে অন্য কিছু
হবে গো।
-
না রে বউ, এই মেডেলটাই
তো চুরি করলাম গতকাল বোলপুরে।
-
ধুর, গতকাল বোলপুরে কী করে থাকবে গো এই মেডেল ? গতকালই তো আমি আমার লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে এটা পেলাম।
-
মাইরি। আমার বুক পকেটে
ছিল। ভূতদাদার সঙ্গে দুটি সুখ-দুঃখের গপ্প করছিলাম। আচমকা দেখি ভূতও হাওয়া, আর পকেটের মেডেলও।
-
ভুতের সাথে গপ্প ? তোমার
মাথা বিগড়েছে। এখন নিশ্চিন্তে দু দিন গ্যাঁট হয়ে বাড়িতে বসো তো দেখি। মেলা কাজ।
ছাদের এসবেস্টস মেরামত করতে হবে, খোকার নতুন প্যান্টালুন কিনতে হবে, একখানা নতুন ছাগল
আনতে হবে। তাছাড়া ভাবছি জমিখানায় বেগুন চাষ করব। কেমন ? এই সোনা বেঁচে সব হয়ে
যাবে। বল ?
-
যা: শালা।
৭।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তাঁর আপ্লুত বউ যখন
সোনার ড্যালা নিয়ে বিহ্বল, তখন তাঁদের ছোট্ট বাড়ির ভাঙা অ্যাসবেস্টসের ছাদে মৌজ
করে শুয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিচ
থেকে পকেটমার রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর বউয়ের কথাবার্তা ভেসে আসছিল। ভারি মিঠে লাগছিল
রবীন্দ্রনাথের। গোটা জীবন তো দিস্তে দিস্তে লিখেই কাটিয়ে দিলেন। এতদিন পর, ভূত হয়ে অন্তত একটা তাবড় কাজ করলেন – পকেট মারলেন। আহা, ভাবতেই তাঁর গান
আসছে। ভুতেরা যদি লিখতে পারতো তবে তিনি এই ছাদে শুয়েই খান কুড়ি গান লিখে ফেলতেন-
এতটাই আনন্দ হচ্ছে তাঁর।
ভাবা
যায় ? শেষে কিনা রবীন্দ্রনাথ পকেট মারলেন?
তাও কার পকেট মারলেন ? এক পকেট মারের পকেট
মারলেন।
তাও বেছে বেছে কোন পকেট-মারের পকেট মারলেন
রবীন্দ্রনাথ ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।
4 comments:
কাণ্ডকারখানা bhaloi likhechhen, tobe du'ekta banan khub drisTi-koTu legechhe, parle thik kore deben.
1. nijer "dnaaRi" -->daaRi
3. matha "chaara" -->chaaRa
5. "aagge" aamar -->aaNgge
5. odike "sheorapuli" -->sheoRapuli
6. sona "bNeche" --> beche
fantastic idea, no doubt.
beauty... awesome
Aha, boddo valo, khasha, shoresh likhe6o go dada.. :)
Post a Comment