- তুমিই সেই ছেলে ?
- হ্যাঁ
- বাঃ, মুখের আদল খানা তো বেশ। তা তুমি এখানে কেন এসেছ জানো ?
- দিদি পাঠালে। আপনার সাথে দেখা করতে।
- তোমার দিদি তোমায় আমার কাছে কেন পাঠিয়েছে সেটা তোমার জানা
আছে?
- হ্যাঁ
- কি কারণে, বল দেখি।
- দিদি চায় আমি আপনার মত হই। আদব-কায়দায়।
- হুম। তুমি চাও না ?
- জানি না।
- হুম। এই টিউটোরিয়াল কিন্তু বড় কঠিন। আদব-কায়দা, বা যাকে
আমরা বলি এটিকেট, রপ্ত করা নেহাত সহজ নয়।
- দিদির ভীষণ ইচ্ছে...
- জানি না।
- বেশ। তা আমার মত একটা বুড়োর সাথে নিজের স্বভাব মেলানো যে
খুব কঠিন। সেটা মনে হচ্ছে না?
- মনে হয়েছে।
- তবে ?
- দিদি খুব চাইছে। দিদি আমার ভালোই চাইবে।
- ব্রেকফাস্ট করেছ ?
- না
- তাই তোমার মুখটা এত শুকনো লাগছে। কি খাবে বল।
- না না...তেমন খিদে পায়নি...
- লজ্জা কিসের। খালি পেটে শেখা যায় নাকি কিছু...
- না না...আপনি চিন্তা করবেন না...
- ফার্স্ট লেস্ন ফর ইউ। তুমি বয়েসে ছোট, একটু লাজুক থাকবে
সেটা খারাপ না। কিন্তু এতটাও মুখচোরা থেকো না যে নিজের খিদের কথা মুখ ফুটে বলতে
পারবে না। টোস্ট, দুধ, সিরিয়াল, এসব চলবে তো ?
- না মানে ওসব আমি...
- অভ্যাস নেই ?
- আসলে কোনদিন খাইনি তো...
- কি খাও তুমি জলখাবারে রোজ ?
- কখনও রুটি সবজি। কখনও ভাত ডাল তরকারী।
- সে কি। ইভেন রাইস ?
- হ্যাঁ।
- দ্যাট এক্সপ্লেইনস তোমার পেটে বাড়তি মেদ কেন জমেছে। কিন্তু
আমার মত হতে হলে তোমায় সায়েবি আদব-কায়দা রপ্ত করতে হবে হে। তোমার দিদি তোমায় আমার
কাছে সে জন্যেই পাঠিয়েছেন। শুধু কোট-প্যান্টালুন আর টাই পড়লেই আমার মত হওয়া যাবে
না ভাই। তুমি আমার চেহারা টুকলি করতে পারো, কিন্তু আমার আত্মা, আমার মেজাজটুকু আয়ত্ত
করতে পারবে না সহজে। বুঝেছ?
- হ্যাঁ।
- ক্লাস শুরু করার আগে, তোমায় কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। তোমার
কেরিয়ার এত ইনকনসিসট্যান্ট কেন। উচ্চমাধ্যমিকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট অথচ তারপর
জয়েন্ট বা মেডিক্যালে না গিয়ে তুমি গেলে ইংলিশ অনার্সে এবং সেখানেও রেজাল্ট বেশ
খারাপ। মাস্টার্স দেখছি সেরেছ নম নম করে, করেস্পনডেন্সে। সেখানেও পুওর মার্কস।
- কেরিয়ারকে কখনও শেষ কথা মনে হয় নি। তাই জয়েন্ট দিইনি।
- ওহ! আইডিয়ালস্। দু বছর দশ মাস ধরে কেরানীর চাকরি করছ এবং
সেখানে পদোন্নতি হয়নি কোন। দেখতে পারছি সে চাকরি তুমি সদ্য ছেড়েছ অন্য এক কেরানী
গোছের চাকরিই নিয়ে। কি লাভ হল সে চাকরি ছেড়ে ?
- ভেবেছিলাম পালটে যাবে সমস্ত কিছু।
- কি পালটাতে চেয়েছিলে ?
- চৌত্রিশ মাস কাজ করেছি সেই প্রথম চাকরীতে, তার মধ্যে অন্তত
কুড়ি মাস মাইনে ঠিক মত পাইনি জানেন! কোনও না কোনও বাহানায় বেশ কিছু টাকা প্রায়
প্রত্যেক মাসেই কাটা যেত। একে অল্প পয়সা, তাতে মাইনে কাটলে গায়ে লাগবে না বলুন
স্যার ?
- হুম।
- তাছাড়া সেই আদ্যিকালের জাবদা খাতায় কলম পিষে যাওয়া। তাই
ভেবেছিলাম নতুন চাকরি পেলে অন্তত...
- নতুন চাকরিতেও তো তুমি সেই কলমই পিষছ...
- কিন্তু চাকরি দেওয়ার সময় তারা তেমন কথা বলেন নি, বিশ্বাস
করুন। অন্তত আমি বিশ্বাস করেছিলাম। ভেবেছিলাম অন্তত কম্পিউটার ঘেঁষা কিছু কাজ হবে।
মাইনে সামান্য বাড়বে। কিন্তু জয়েন করার পরে টের পেলাম আমার হাল একই থেকে গেছে।
- বুঝলাম। দেখ, তোমার দিদি আমায় খুব রেসপেক্ট করে। ও খুব চায়
যে তুমি আমার মত হও। ওর ধারণা সেটা হলেই তোমার উন্নতি হবে। তোমার ভাগ্য ফিরবে। বাট
ফর দ্যাট টু হ্যাপেন, ইউ উইল রিয়েলি হ্যাভ টু পুল ইওর সক্স আপ মাই বয়।
- হ্যাঁ ?
- তোমায় ভীষণ খাটতে হবে। কারণ বদলটা আনতে হবে তোমার মজ্জায়...
- মজ্জায়...
- অফ কোর্স। এই ভাত আলুসিদ্ধ ব্রেকফাস্ট খাওয়া ল্যাদল্যাদে অ্যাটিচিউড
থাকলে চলবে না।
- ভাত আলু সেদ্ধ চলবে না স্যার ?
- মিনিমাম লেভেলে রাখতে হবে।
- না মানে ঘি দিয়ে মেখে...
- উফ! বিষ। বিষ। ইংলিশ ব্রেকফাস্টের ওপর তোমায় ট্রেইন করতে
হবে দেখছি।
- না মানে ভেবে দেখুন স্যার...গরম ভাতের মধ্যে এক চামচে গরম
ঘি ছড়িয়ে এক তাল আলু সেদ্ধ মেখে...
- শাট আপ। আহাম্মকের মত কথা বল না। এই আহাম্মকির জন্যেই তুমি
কেরানী আর আমি চল্লিশ বছর ধরে অন্তত দশ খানা কোম্পানিকে আঙুলের ইঙ্গিতে নাচিয়ে
চলেছি।
- হ্যাঁ
- তুমি কনভিন্সড্ নও। তাই তো ?
- স্যার। কেরিয়ারের জন্যে ঘি আলু সেদ্ধ ছাড়বো ?
- হোয়াট ? তুমি কি নিনকমপুপের মত কথা বলছ, জানো?
- নিনকমপুপ নয় স্যার। এটা কবিতার ভাষা। দামী স্যুটের ভারে
ন্যুব্জ হয়ে আপনি গরম বাঁশ-কাঠি চালের পদ্য আর সেই ভাতের ঢিপির বুক চেরা ঘিয়ের রোমান্সকে
অগ্রাহ্য করছেন ? আপনি কি ভাবছেন, আপনি ভালো আছেন ? হ্যাঁ, আপনি দশটা কোম্পানির এম
ডি হয়ে মাতব্বরি করতে পারছেন। কিন্তু সর্ষের তেল আর ভাজা শুকনো লঙ্কা দিয়ে মোলায়েম
করে মাখা আলুসিদ্ধ চেটেপুটে খেয়ে; দু হাত তুলে ‘সব পেয়েছি’ বলে নাচতে পারবেন
? সে সব আপনি স্বপ্নেও পারবেন না স্যার।
জীবনে কোনও কিছু পাওয়ার জন্যেই আমি আমার ঘি-ভাত-আলুসিদ্ধ’র অ্যাডভেঞ্চারকে ত্যাগ
করতে পারবো না। আমি চললাম।
- চললাম মানে ? তুমি কি উন্মাদ ? তোমার দিদি জানলে তোমায় আস্ত
রাখবে ভেবেছ ?
- আমার পরনের এই ফতুয়ার ওপরের দুটো খোলা বোতাম দেখেছেন স্যার
? এক দাদা চেয়েছিলেন আমায় সহবত শেখাতে, বোতাম এঁটে বাবু হয়ে ঘুরে বেড়ানো শেখাতে।
কিন্তু নিজেকে দুমড়ে বাবু বনে থাকবো, এমন এলেবেলে আমি নই স্যার। দাদাকে সাইড
করেছি, ফতুয়ার দুটো বোতাম এখনও খোলাই থাকে। এখন দিদি আমার গার্জেন। তিনি চাইতেই
পারেন যে আমি আপনার মত সাহেব হই। কিন্তু এ শর্মা কে গা জোয়ারি কিছু করানো যায় না
স্যার। আসি।
- শোন কলকাতা, তুমি ভুল করছ। আমার কাঁধে ভর দিয়ে তোমার মত কতশত বান্দা রোজ কেরিয়ার
বৈতরণী পেরচ্ছে। তুমি সোনার সুযোগ হারাচ্ছ।
- আমি সোনা পাগল নই, কবিতা লেখার অভ্যাসটুকু না হারালেই আমার
চলে যাবে। আসি লন্ডন স্যার। ভালো থাকবেন।
1 comment:
Ashadharan !!
Post a Comment