অনিমেষ বুঝতে পারছিলেন যে ক্লান্তি একেই বলে।
টানা দু'ঘণ্টা ফুটবল পিটিয়েও এমন ক্লান্তি কখনও শরীর জুড়ে আসেনি। তর্ক সাধতে তার
জুড়ি নেই, দুর্বার তর্কের ঝড়ও তাকে কোনদিন এমন শ্রান্ত করে দেয়নি। সাংবাদিকতার
পেশায় প্রায় জীবনভর কাটিয়েও এমন অসহায় ভাবে ঢলে পড়তে হয়নি কখনো তাকে। তবে এ ঠিক
ক্লান্তি নয়; অবসাদ বলা ভালো – বেদনামাখা অবসাদ ঠিক বলা চলে না অবশ্য। বুকের
ব্যথাটা বরং আদৌ টের পাচ্ছিলেন না যেন। তবে বুঝতে পারছিলেন হিসেব মোটামুটি গুটিয়ে
আনা গেছে। বিরানব্বুই। আর কত!
-
“বিনি আছিস?”, অনিমেষ বালিশ থেকে মাথা তুলবার চেষ্টা করলেন,
পারলেন না।
-
“কিছু বলবে বাবা?”
-
“তমাল এসেছিল না?”
-
“তমাল কাকু তোমার পাশেই বসে তো”
-
“ওহ, তমাল না কি ওদিকে?”
-
“ অফ কোর্স, ঠাহর করতে পারছ না? বয়েস হয়ে গেল তোমার”
-
“বিনি, একটু অন্য ঘরে যাবি? তমাল-কাকুর সাথে কিছু...”
-
“বেশি কথা বোল না বাবা...”
-
“প্লিজ বিনি”
-
“আমি আসছি, কাকু দেখো বাবা যেন বেশি...”
-
“তুই যা। আমি আছি। চেহারার অবস্থা তো বেশ ঘোড়েল বানিয়েছ অনিমেষ-দা,
কি ব্যাপার বল তো। সেঞ্চুরির ইচ্ছে নেই?”
-
“তোর ইচ্ছে নেই ? সেঞ্চুরির?”
-
“ছিল। তবে লিভারের আর হার্টের যা অবস্থা, নব্বুই ছুঁতে পারব
না বোধ হয়। মেরেকেটে আর বছর তিন। কি কথা বলতে ডেকে আনলে বল এবার”
-
“সময় কম”
-
“গ্যাঁজ মেরো না”
-
“ফিল করতে পারছি। সিরিয়াস”
-
“জলদি বল। সন্ধ্যের পর আমার বাইরে থাকা বারণ”
-
“লাংসে জল ?”
-
“প্রায় বাড়াবাড়ি”
-
“তোর সেই ব্লগের কথা মনে পড়ে?”
-
“হেঃ, তোমার সাথে আলাপ তো সেই সূত্রেই...”
-
“লেখার হাত তো ঠিকঠাকই ছিল, কেন যে ব্লগটায় নিয়মিত লেখা
বন্ধ করলি...”
-
“তুমি এইটা বলতে আমায় ডেকে এনেছ?”
-
“না:, ঠিক এটা বলতে নয়”
-
“তবে? যাক গে, তোমায় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আজ বাদ দাও। কাল আসব
ফের”
-
“না না তমাল। ওয়েট কর। আজই বলা দরকার। তুই ইন্টারেস্ট পাবি।
একটা মজার ঘটনা”
-
“ভেরি ওয়েল। বল”
-
“তোর ব্লগ আমি আচমকাই পড়া শুরু করি। ইন ফ্যাক্ট যখন পড়া
শুরু করি তখন তোর লেখায় তোর লাংসের মতই যথেষ্ট জল থাকতো।
-
“সিরিয়াসলি তুমি এখন এসব বস্তাপচা ট্রিভিয়া নিয়ে কথা বলতে ডেকেছ?”
-
“পেশেন্স রাখ। ২০১৩’র বইমেলাটা খুব ক্রুশিয়াল ছিল।
ক্রুশিয়াল যে ছিল সেটা পরে বুঝেছি”
-
“কিরকম ?”
-
“ওই মেলাতেই আমার অতনু রায়ের সাথে আলাপ হয়”
-
“হু ইজ অতনু রায়?”
-
“হাফ পাগল। অন্তত তখন তাই ভেবেছিলাম”
-
“আলাপ বইমেলাতেই?”
-
“গিল্ড অফিসের পাশেই যে ফিশফ্রাইয়ের দোকান ছিল, সেখানে
আলাপ। একদম আচমকা। ওই এগিয়ে এসে আলাপ করেছিল। বলেছিল ও নাকি আমার ব্লগ নিয়মিত পড়ে”
-
“তুমি তো তখন অলরেডি ব্লগিং সার্কেলে বেশ তাবড় নাম অনিমেষদা”
-
“ফোট। অতনু রায়ের কথায় আসি। একা গেছিলাম বইমেলায় সেদিন।
হাতে সময়ও ছিল। ছেলেটা একদম সাদামাঠা দেখতে।বয়স সাতাশ-আটাশ। নীল হাফ শার্ট, খয়েরি
প্যান্ট, ময়লা গায়ের রঙ, অগোছালো চুল; সব মিলে ভীষণ ইউসুয়াল একটা প্যাকেজ। তবে
কথায় একটা দুলুনি ছিল। আড্ডা জমেছিল। বই, লেখালিখি এসব নিয়ে ঘণ্টা-খানেক দিব্যি
কেটে গেল। আচমকা অতনু উঠে দাঁড়িয়ে বলে ‘অনিমেষ-দা, তোমার সাথে যে জন্যে আলাপ করতে
এলাম। তোমার বানান নিয়ে শুচিবাই এবার ছাড়’।
-
“তোমায় বললে বানান নিয়ে শুচিবাই ছাড়তে ?”
-
“ভেবে দেখ। আমি তখন একটু ঘাবড়ে গেছি। একটু বিরক্ত। সে আমার
জবাবের অপেক্ষা না করেই হুড়হুড় করে বলে চললে ‘শুচিবায়ুগ্রস্ত পাবলিককে আমার হেভি
ইয়ে লাগে। তা সে যার শুচিবাই-পনাই হোক না কেন। তাই তোমায় আমি বলে যাচ্ছি তোমায় আমি
এর শাস্তি দেব। তমাল দত্ত বলে এক কচি ব্লগার আছে। হেব্বি বানান ভুল করে। তার বানান
ভুলের সংখ্যা যবে দশ হাজার ছাড়াবে, তবে তুমি স্ট্রেট অক্কা পাবে। তোমার বানান নিয়ে
কেরদানি ঘুচে যাবে। এই আমি বলে রাখলাম। আরও বলে রাখি। সে ব্যটা তমাল দত্ত, সে
কোনদিন বেশি বানান ভুল করলেও তোমার শরীর খারাপ হবে। পেট ব্যথা, জ্বর, সর্দি। আর
যেদিন তার ব্লগে বানান ভুলের সংখ্যা দশটি হাজার ছাড়াবে, সেদিন তুমি মালটি হাওয়া।
আমি বলে রাখলাম।‘ আমি বললাম ‘কিন্তু কে এই তমাল দত্ত, আমার তার সাথে যোগটা কোথায় ?’
সে বললে ‘যোগ ? আমি জুড়ে দিয়ে গেলাম’। বলেই সে হাওয়া। আমি বেকুব হয়ে আমার তিন
নম্বর ফিশ ফ্রাই হাতে দাঁড়িয়ে রইলাম খানিকক্ষণ”
-
“তুমি কি ভীমরতি শেয়ার করতে আমায় ডেকেছ?”
-
“আমি এ অবস্থাতেও জ্যামিতি সামলাতে পারব। কিন্তু ওই পাগলার
কাছেই আমি প্রথম তোর নাম শুনি। ইন্টারনেট ঘেঁটে তোর ব্লগ খুঁজে বের করি। পড়ি।
সাজেশন দেওয়া শুরু করি। কিন্তু সেই অতনুর পাগলামির কথাটা কিছুতেই মন থেকে ঠিক ঝেড়ে
ফেলতে পারিনা। আর তোর বানান ভুল এতটাই হত...যে পড়তে পড়তে জেনুইন শরীর খারাপ লাগতো।
গ্যাস, অম্বল তো অন্তত হতই”
-
“তোমার ফিডব্যাকের ফ্লোয়ের সাথে আমার পোস্টের কোয়ালিটিও
ইম্প্রুভ করেছিল, তুমি পুশও করতে”
-
“ফোট। তবে রিয়েলি স্পিকিং, ওই অতনুর স্মৃতি মুছে ফেলতে
পারিনি কখনও। তোর ব্লগের বানান ভুল জমে উঠলে বুকের ভিতর একটা শিরশিরানি হতই। তাই
ক্রমাগত তোকে শুধরে যেতাম”
-
“অখাদ্য। বানান ঠিক করাটা নয়। ব্যাকগ্রাউন্ডটা। যা সব বলে
চলেছ”
-
“ আমিও সেটাই ভেবে এসেছি। আজ সকাল পর্যন্ত”
-
“আজ আবার কি হল...”
-
“তুই কি আবার ব্লগ লেখা শুরু করেছিস?”
-
“এই কদিন আর কি। কিছু করার নেই। কনসালটেন্সিও ছাড়তে হল শরীরের
জন্য। গোটা দিন ঘরে বসে। চেষ্টা করি। তবে শেয়ার-টেয়ার করি না। তোমাকে বলা হয়নি
কারণ তোমার শরীরের যা অবস্থা...তুমি জানলে কি করে ?
-
“অতনু বলেছে”
-
“তার সাথে তোমার দেখা হয়েছে ?”
-
“সে আমার সাথে এসে দেখা করেছে”
-
“অন গড। আজ দুপুরে বিনি যখন বাইরে গেছিল ঘণ্টা খানেকের জন্য
তখন সে ব্যটা দেখা করতে আসে। কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল। স্মার্টলি ঘরে ঢুকে
পড়লে। তার বয়েস বাড়েনি একদমই। সেই নীল শার্ট আর খয়েরী প্যান্ট। সেই বইমেলার মতই।
-
অনিমেষ-দা প্লিজ। অনেক ফালতু কথা হল। তুমি এবার রেস্ট নাও।
-
চুপ করে শোন যেটা বলছি। সেই জানালে যে তুই আবার লিখছিস।
বানান-ভুলের ভাণ্ডার ফের স্ফীত হচ্ছে। তুই এ যাত্রায় প্রথম পোষ্ট লিখেছিস গত
বুধবারের আগের বুধে। ঠিক বলছি?
-
সম্ভবত। তাতে কি হল ?
-
সেখানে প্রচুর বানান ভুল রে তমাল। এ বয়েসে এসেও। সেদিনই
আমার সেকেন্ড অ্যাটাকটা হল।
-
বানান ভুল হতে পারে। তাই বলে তার জন্যে...রাবিশ
-
আমিও তাই বলেই উড়িয়ে দিতাম রে। কিন্তু অতনুর বয়স বাড়েনি এক
চুলও। এটা কি একটা সুপার-ন্যাচারাল ব্যাপার নয় ?
-
বললাম তো। তোমার ভীমরতি। বিশ্রাম নাও এবার অনিমেষদা।
-
শোন তমাল। অতনু আরও বলে গেছে যে গতকাল তুই যে পোষ্ট
লিখেছিস, সেটাকে ধরে তোর টোটাল ভুলের সংখ্যা এখন নয় হাজার নয়শো আটানব্বইই। অনলি টু
শর্ট।
-
আর দুটো বানান ভুল হলেই তুমি... ?
-
খালাস।
-
ধুর। যত জালিয়াতি। আমি চললাম। বিনিকে ডেকে দিচ্ছি।
-
সাবধানে তমাল। সাবধানে।
-
প্লিজ। ঘুমোও। অ্যাই বিনি। এদিকে আয়।
***
এই অতনুর ভুত তমাল-বাবুকে মাথা থেকে নামাতেই হত।
বয়েসের ধাক্কায় অনিমেষদার মাথায় ব্যমো হয়েছে নির্ঘাত। তবে এ বয়েসেও নিজের মাতৃভাষায় লেখালিখি করতে গিয়ে বানান ভুল করছেন, এটা ভাবতে তমালবাবুর ভারি লজ্জা
লাগে।
সমস্ত বাড়তি চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে কীবোর্ড
টেনে নিলেন তমালবাবু। আজ নতুন একখানা পোষ্ট। প্রায় জোর করেই লিখতে বসা আর কি।
দু চার লাইন লিখতেই বেজে উঠলো মোবাইল।
-
হ্যালো
-
তমালকাকু, বিনি বলছি...
-
কি হয়েছে, তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন ?
-
বাবা এই মাত্র আচমকা ‘ণত্ব বিধান’ বলে দুবার চীৎকার করেই
কেমন হয়ে গেল। শরীরময় খিঁচুনি। মনে হচ্ছে আবার অ্যাটাক। ডাক্তার-কাকু
আসছেন...তুমি কি আসবে একবার ?
5 comments:
Jaa taa!! :D
Jaa taa!! :D
সত্যিই মাঝে মাঝে আপনার পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে হয়। মন থেকে বললাম।
A Thousand Words movie tar songe mil pelam.
A Thousand Words movie tar songe mil pelam.
Post a Comment