-
মা তুই কাঁদছিস ?
-
আমি যে অভাগী
বাবা, না কেঁদে উপায় কী ?
-
ধুর পাগলী। তুই
হলি আমার লক্ষ্মী।
-
লক্ষ্মী না ছাই।
আমার ভালোবাসার মানুষটিকে খেলাম। তার রাজ্যকে খেলাম। তার পরিবারটাকেও বাদ দিলাম
না।এবার তোমাকে খাব। আমার চেয়ে বড় অভাগী আর কে আছে?
-
মামণি। মা রে। অমন করে না। তুই ইন্দ্রকে
প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিস। ইন্দ্রও তোর জন্যে জান কবুল করেছে। ইন্দ্র যে ভাবে শেষ
শ্বাসটুকু পর্যন্ত তোর জন্যে বুক চিতিয়ে লড়ে গেছে, আমার ভাবতে গর্ব হয় যে সে আমার
ছেলে। এ বুড়োর বুক ভরে আসে এই ভেবে যে আমি অমন এক ভালোবাসার ছেলেকে লালন করেছিলাম।
মনে রাখিস মা, সে শুধু তোর জন্যে এই অসহায় যুদ্ধে যুঝতে যায়নি, সে লড়েছে সমস্ত
নারী জাতির সম্মানের জন্যে।
-
আমার বুকে যে কি পাথর জমাট হয়ে আছে কী বলি। আমার বাবার কথা মত রাক্ষুসে
ধনী সে রাজপুত্রকে বিয়ে করলেই সমস্ত ঝামেলা মিটে যেত। কেন যে ইন্দ্র আর আমার
ভালোবাসার জন্যে তুমি এত বিপদের সম্ভাবনা কাছে টেনে নিলে! কেন সমস্ত আশঙ্কা
সত্ত্বেও আমায় সে অন্ধকার দেশ থেকে নিয়ে এলে বাবা ? কেন আমায় এত আগলে রাখলে ? কেন
এত স্নেহে বাঁধলে নিজেকে? তুমি এতটা না করলে হয়তো ইন্দ্র কষ্ট পেত। কিন্তু তোমার এ
সোনার রাজ্য এমন ছারখার হয়ে যেত না।
-
সোনার রাজ্য ? মা রে, আমিই বোকা। ভেবেছিলাম, দেশে বড় সৈন্যদল পুষলে কার কি
মঙ্গল হবে? সামরিক খরচা দশ ভাগের এক ভাগ করে দিয়ে শিক্ষা ও চাষবাসের খাতে খরচ
দশগুণ করে দিয়েছিলাম। আমাদের দেশের প্রত্যেক মানুষ দুধ ভাতের সোয়াদ পেতে শুরু
করেছিলে। আশার সোনায় মুড়ে দিয়েছিলাম এ ছোট্ট রাজ্যে প্রত্যেক ধুলোর কণা কে। কিন্তু
সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে গেল মা। সমৃদ্ধি আগলে রাখতেও যে তরবারি লাগে, অন্যায়ের
প্রতিবাদ করতেও যে ধনুকের ছিলা বাঁধতে হয়, সেই সহজ কথাটা তোর এই বুড়ো বাপ ভুলে
গেছিল। সে দিক থেকে আমিই তোর অপরাধী। তোকে যারা তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছিনিয়ে নিয়ে
যেতে এসেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রেখে যাওয়ার সৎ সাহস আমার আছে মা, কিন্তু
যুদ্ধ জয় করার ক্ষমতা নেই।
-
কেন এ সর্বনাশা
যুদ্ধ নিজের রাজ্যের বুকে টেনে নিলে বাবা? ইন্দ্রকে তুমি ভালবাসতে, সে তোমার ছেলে,
রাজপুত্র। কিন্তু তুমি না রাজা ? তুমি তো সমস্ত প্রজার পিতা। তুমিই তো এতদিন তাদের
সস্নেহে লালন করেছ। নিজের ছেলের ভালোবাসাকে আগলে রাখতে তাঁদের ভেসে যেতে দিলে কেন
বাবা ?
-
মা রে। আমি অত
হীন নই যে নিজ স্বার্থে দেশকে জলাঞ্জলি দেব। আমরা সক্কলে, এই দেশ রুখে দাঁড়িয়েছি
নারীজাতির সম্মানের স্বার্থে। তোর জন্যে শুধু নয় মা। দেশের ভালোর জন্যে, দশের
ভালোর জন্যে তোর মত লক্ষ্মী প্রতিমাকে ভাসিয়ে দিতে আমি বিন্দু মাত্র দ্বিধা করতাম
না রে। কিন্তু ওই জানোয়ারদের হাতে পড়ে তুই অসহায় কান্নায় ডুবে যাবি, আর তোর হয়ে
লড়াই করার সাহস আমাদের থাকবে না? যে দেশে কাপুরুষের আধিপত্য থাকে, সে দেশ যে
অন্ধকারের দেশ। তুই ইন্দ্র’র প্রেমিকা না হয়ে যদি আমার দেশের কোন কৃষকেরও প্রেমিকা
হতিস, তোকে আমি একই ভাবে ছিনিয়ে আনতাম শত্রুর ঘর থেকে। তাহলেও তোর জন্যে আমরা একই
ভাবে দেশ ও প্রাণ উজাড় করে যুদ্ধ করতাম। আমার ইন্দ্র তাহলেও এমনই অবলীলায় প্রাণ
দিত তোর জন্যে...।
-
বাবা...!!
-
কাঁদিস না রে
মা...সমস্ত যুদ্ধ জুড়িয়ে যাবে একদিন। ভালোবাসাটুকুই থাকবে। জানিস মা, এ যুদ্ধ এত
সহজে আমরা হারতাম না। ওদের খুনে বাহিনীকেও রুখে দিতে পারতাম...যদি বিভুটা
বিশ্বাসঘাতকতা না করতো...।
-
কাকামশাই ?
-
হুম। যাক গে। ভালো
থাকুক সে। এবার যে তোর এই বাপ কে ছেড়ে দিতে হবে মা...যুদ্ধে যেতে হবে যে...।
-
বাবা, তুমি যাবে
? এ বয়েসে তুমি ওই জন্তুগুলোর সামনে যাবে...? না না না...
-
আমায় যেতেই হবে
মা গো, আমার কত হাজার ছেলেগুলো আমার ডাকে হাসতে হাসতে জান খোয়ালে, এ বাপের কি এখন
ঘরে মন টিকবে ?
-
না বাবা না, তুমি
না থাকলে আমি কি করবো ?
-
আমার স্মৃতি-ভার
যে তোকেই দিয়ে যেতে হবে মা...আগলে রাখিস। আসি মা...।
**
-
এসো হে, পুরুতঠাকুর,
শুনেছি তোমার লেখার হাতটি সরেস ?
-
আজ্ঞে, আপনার
আশীর্বাদ।
-
আমার যুদ্ধ জয়ের
তো একটা বৃত্তান্ত লেখার দরকার বাওয়া।
-
আদেশ করুন রাজন।
-
লিখতে তো হবেই
বাবা পুরুত। বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে ক্যামন দ্যাখালাম খেল? বেশ্যা মাগির সাহস দেখ, আমি
রানী করতে চাইলাম,তাতে তার মন ধরলে না। বিটি এই আদিবাসী রাজার ছেলের প্রেমে
হাবুডুবু খেলে। হারামজাদী পালিয়ে এলে! এ আদিবাসী রাজারই বা কি অসভ্যতা। সে আমার
নজরের মেয়েকে গায়েব করে ? দিলাম হুড়কো গুঁজে। আদিবাসী রাজা, তার আবার নাকি দশটি
ব্রাহ্মণের সমান জ্ঞান, শুনে গা পিত্তি জ্বলে যায় গো। তাই না ?
-
তা তো বটেই। তা
তো বটেই আর্যপুত্র।
-
আদিবাসীদের রাজ্য
তাও আবার নাকি সোনার রাজ্য , এমন সুখ সেখানে। জ্বালিয়ে দিয়েছি। উচিৎ শিক্ষা
দিয়েছি। তাই না ?
-
একদম রাজন। তাও
তো আপনার নরম মন। সে মাগীকে প্রাণে না মেরে আপনার হারেমে স্থান দিয়েছেন...
-
ঠিক। ঠিক। আমার
মন বেশ নরম। আমার উচিৎ ছিল সে বিটিকে ধরেই গলাটা কচ করে কেটে দেওয়া। তা না করে
একটু আগুনে পুড়িয়ে নিয়েছি মাত্র। তাকে একটু শায়েস্তাও করা হল আবার পবিত্রও করে নেওয়া
হল, নোংরা আদিবাসীদের মধ্যে ছিল কি না।
-
প্রায় শাস্তি
দেওয়া হলই না আর কি। দয়ার শরীর আপনার রাজাধিরাজ।
-
লোকে তো তাই
বলছে। আমার এমন দয়ার শরীর বলেই সে মেয়েছেলে এখনও প্রাণে বেঁচে আছে। যাকগে, পুরুত,
শোনো, এ আদিবাসী ঢ্যামনা রাজাকে কচুকাটা করা এ যুদ্ধের কাহিনী তোমায় লিখতে হবে। বুঝেছ
?
-
অবশ্যই রাজন। যেমনটি ঘটেছে অবিকল তেমনটিই
লিখবো...।
-
দেখ কাণ্ড। তুমি
কি ক্যালানে পুরুত ? যা হয়েছে তা অবিকল তো ওই খাজাঞ্চীও লিখে দিতে পারবে। তুমি
তাহলে কি ছিঁড়তে এসেছ এখানে ?
-
মার্জনা মহারাজ।
-
আচ্ছা মাকাল মাল
সব পুষি আমি মাইরি।
-
মার্জনা রাজন।
-
মনে দিয়ে শোন। এ
লেখা যেন এমন হয় যাতে লোকে সহস্র বছর পরেও সে লেখা পড়ে আমায় ধন্য ধন্য করে। বুঝেছ
?
-
স্পষ্ট।
-
আমার মধ্যে যে
একটা দেবতা দেবতা ভাব আছে, সেটা তুমি অস্বীকার করতে পার ?
-
আধ মাইল দূর থেকে
আপনাকে দেখলেই আপনার দেব-জেল্লা চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ে রাজন।
-
বেশ। তা সে
জেল্লার আভা যেন লোকে সহস্র বছর পরেও পায়। বুঝেছ ?
-
জলের মত।
-
আর এই আদিবাসী
রাজা, যাকে আজ দশ টুকরো করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলাম। তার ব্যাপারে কেচ্ছা লেখ। পারবে
না ?
-
খুব পারবো।
-
ওই হারামি আদিবাসী
রাজার এত সাহস যে সে আমার হবু বউ চুরি করে আনে? সে আদিবাসীর ছোটলোকের নামে এমন
কালি লেপতে হবে তোমায় যাতে সহস্র বছর পরেও লোকে তাকে ঘৃণা করে...বুঝেছ ?
-
দিনের আলোর মত।
-
আর হ্যাঁ, ওই
মেয়েছেলে, যে অবশেষে আমার কবলে। তার ব্যাপারে মন্দ লিখ না। বেশ ডাঁসা সে। তাকে যে
রানী করতে হবে। হে হে হে হে...।
-
বুঝেছি রাজন।
তেমনটাই হবে। লেখনী আর গ্যাঁজায় এমন সুস্বাদু মণ্ড আমি তৈরি করবো, আপনার খ্যাতি
তিন লোকের সীমানা ছাড়াবে। আপনি দেবত্ব-লাভ করবেন রাজন। আস্থা রাখুন এ ব্রাহ্মণের
ওপর।
-
বাহ, তুমি বেশ
চটপটে তো। তোমায় নিয়ে আমি বেশ খুশি। লেখা পছন্দ হলে, তোমার ট্যাঁকে আমি
স্বর্ণমুদ্রা চাষ করবো। হে হে হে...তা তোমার নামটা কি যেন ?
-
আজ্ঞে, বাল্মীকি।
3 comments:
পাঁচ-ছ'বার পড়ে ফেললাম রে।
এইটুকুই। ব্যস! বাকিটা যা যা বাজারে বিকোয়, স্রেফ গাঁজা!
সাধু! সন্ন্যাসী! ইত্যাদি...
Boro bhaalo laaglo. Tobe kicchhu mone na korle ekta change suggest korbo ?
Kobir naam jante she jodi bolto "roton"
Post a Comment