Thursday, November 6, 2014

হারমোনিয়াম


সে সময়টা সপ্তাহে অন্তত তিনদিন সন্ধ্যাবেলা মা গাইতে বসতো। সন্ধ্যাবেলা, সন্ধ্যে দিয়ে।বিছানার এক কোণে মা। সামনে হারমোনিয়াম। ডায়াগোনালি অন্য কোণে আমি, বাবু হয়ে বসে। ক্লাস সিক্স বা সেভেন। হাফ প্যান্ট। ঘরের কোণে চেয়ারে ঠাকুমা। ঢুলছে। শ্রীকৃষ্ণের একশো আট নাম আধোঘুমেও বিড়বিড় করে চলতো। আমার ডাকনাম দিয়েছিল গোপাল। হরিনাম যত মুখে আসে তত নাকি ভালো। স্নেহ উথলে উঠলে গোপালের আগে নাড়ু প্রি-ফিক্স হয়ে যেত।

স্মৃতির ছক সাজাতে বসলে মায়ের কালচে সবুজ ছাপার শাড়িটাই মনে পড়ে। বাটিক প্রিন্টের বিছানার চাদর। ঘরময় ভারতদর্শন ধুপের সাথে অল্প ধুনো মেশানো মেজাজ। মায়ের হারমোনিয়ামের বয়স আমার চেয়ে অনেক বেশি, মা ছোটবেলায় ওটাতেই গান শিখেছিল। বিয়ের পর বাক্স-প্যাঁটরার সাথে ওটাও মায়ের সাথে এ বাড়িতে আসে। হারমোনিয়ামের ওপর খোলা মায়ের গানের খাতা। খাতাটাও মায়ের ছোটবেলার – আধ-ছেঁড়া, লাল বাঁধাইয়ের।

গানের খাতার প্রথম পাতায় একটা ছড়া আর দু কলি আলপনা আঁকা। নীল কালির ফাউন্টেন পেনে। ছড়াটা হচ্ছে :
“ গানের খাতার প্রথম পাতায় এঁকে দিলাম আলপনা
স্মৃতি আমার কইবে কথা আমি যখন থাকবো না”।
মায়ের হাতের লেখা ভারি মিষ্টি ও শান্ত। কোন ভারিক্কি চাল নেই, স্নেহ আছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদকে মা লেখার যত্নে খাতায় মুড়ে রেখেছিল।

হারমোনিয়ামের পিনপিনে সঙ্গতে মা গাইছে-

"ওগো, তোরা কে যাবি পারে। ওগো, তোরা কে।
আমি   তরী নিয়ে বসে আছি নদীকিনারে॥" 

গালে হাত রেখে আমি শুনছি। মার গলা ভারতদর্শনের সুবাসে মিশে যাচ্ছে। আমি ভাবছি একটা নদীর কথা। চওড়া হলেও কুলুকুল মেজাজ আছে। এবং কোনও এক বিদঘুটে কারণে ভাবতাম একটা খয়েরী রঙের নৌকার কথা। নদীর ওপরের আকাশ লালচে – সন্ধ্যেয় লাল। মা গাইছে। আমি মিউজিকে মজবার বেসিক্‌স বুঝতে শুরু করছি।

 ও পারেতে উপবনে
              কত খেলা কত জনে,
     এ পারেতে ধূ ধূ মরু বারি বিনা রে”

 এ জায়গায় এসে মার চোখে বুজে আসতো, গানটা দুলে দুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আরম্ভ করতো। আমি তর্জনীর ডগাটা বিছানায় ঠুকে তাল মেলাবার চেষ্টা করতাম।

গানটা ঝপাৎ করে একটা সিরিয়াস ল্যান্ডিং করতো যখন মা সুর নামিয়ে আনতেন এ জায়গায় –
"এই বেলা বেলা আছে, আয় কে যাবি।
     মিছে কেন কাটে কাল কত কী ভাবি।" 


সঙ্গীত বুকে দানা বাঁধতে শুরু করা একটা ইভেন্ট বটে। গান কি শুধু গলায় বাস করে ? গানের কান? হৃদয়? মা চেষ্টা করেছে। আমি যৎসামান্য নিতে পেরেছি। মা আমায় রবীন্দ্রনাথ দিয়েছে, সুমন দিয়েছে।
এর পর মা অবলীলায় সুর খেলিয়ে গানটার ওপারে চলে যেত-
 "সূর্য পাটে যাবে নেমে,
              সুবাতাস যাবে থেমে,
     খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে সন্ধ্যা-আঁধারে
       ওগো, তোরা কে যাবি পারে।
আমি   তরী নিয়ে বসে আছি নদীকিনারে" 

গানের শেষ বেলায় গানের দুঃখটা জুঁইফুলের দাপটে ফুটে উঠত। সন্ধ্যেটার বাঁধুনি দৃঢ় হত।

বয়স, সংসারের ঘষামাজায় আমার মা’টা আজকাল বড় ক্লান্ত থাকে। গুণগুণ করে হঠাৎ গেয়ে ওঠা গুলো আছে। কিন্তু হারমোনিয়াম বা সেই লাল গানের খাতা আর বিছানার বাটিক চাদরের ওপর নামে না।

মাকে বেয়ে আমার গানের কান রবীন্দ্রনাথে, অতুলপ্রসাদে, সুমনে উঠে এসেছে। তাঁরা কৃতঘ্ন নন – আমার মায়ের হারমোনিয়ামে বাঁধা সন্ধ্যেগুলোর গন্ধ তারা মাঝেসাঝেই আমার দিকে ছুঁড়ে দেন। আমি ডাইভ দিয়ে লুফে নিতে কসুর করিনা।   


3 comments:

Anonymous said...

একটা মন কেমন করা অপূর্ব লেখা। হঠাৎ করে ছোটবেলার একরাশ স্মৃতি মনে পরে গেল। সন্ধেবেলায় লোডশেডিং হয়ে গেলে হ্যারিকেনের আলোটা কম করে দিয়ে মা একের পর এক গান শোনাত - আজি গোধূলি লগনে, ধাঁয় জ্যনো মোর সকল ভালবাসা...

ঋজু গাঙ্গুলী said...

সাবাশ বংপেন| অদ্ভূত একটা মন-কেমন-করা ভালোলাগা আর বিষাদের চাদর দিয়ে মুড়ে দিলেন আপনি আমায় এই লেখাটার মধ্য দিয়ে|

AM said...

Bhison sundor lekha..ar thik
amar o chotobelar moton..