মারা যাওয়ার পরেই
কোথাও একটা যাওয়া দরকার। লাশটা ক্যালক্যাটাতে পড়লেও নিধুবাবু প্রথমে ভাবলেন বৈঁচিতে যাবেন।
বাপ-কাকার ভিটের পাশে দিব্যি বাঁশবন, সেখানে কাটাবেন কিছুদিন। তারপর ভাবলেন
মধ্যমগ্রাম গেলে কেমন হয়? মেজোপিসির
শ্বশুরবাড়ি সেখানে। সেই ছেলেবেলার পর আর সেখানে যাওয়া হয়নি, পিসেমশায়দের বিশ বিঘে
জমির ওপরের আম বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যাবে। তারপর মনে হল পান্ডুয়া ব্যান্ডেল
করে তো জীবনটাই কেটে গেল। ভূত হয়ে যদি সামান্য ঘোরাঘুরিই না হল তবে তেমন মারা
যাওয়ার মূল্য কোথায়।
তাই তিনি সোজা
চলে এলেন প্যারিসে। প্যারিসে আইফেল টাওয়ার আছে সে কথা তিনি জানতেন। ফরাসীদের কেতার
জবাব নেই; তা সে খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা, প্রেম-চুমু, সাহিত্য; যে ব্যাপারই হোক না
কেন। এটাও অবিশ্যি তার শোনা। তাছাড়া চন্দননগরটাও তো ওদেরই হাতে গড়া শহর। জায়গাটা
নিশ্চয়ই মধ্যমগ্রামের চেয়ে কম যাবে না। পছন্দমত গাছপালা ও প্রতিবেশী জুটলে সেখানে
কিছুদিন থাকবেন, নয়তো হাতের পাঁচ বৈঁচি তো রইলই।
প্যারিসের ঝাঁ
চকচকে একটা রাস্তার ওপর নামতেই অঘোরের সঙ্গে দেখা। অঘোর দে, বারাসাত পোস্টঅফিসে তার সহকেরানী ছিলেন। গত
পৌষের আগের পৌষে মারা যান। বাতাসে ভাসছিলেন অঘোর, সেই নিধুবাবুকে প্রথম চিনতে
পারলে।
-“ও অঘোরবাবু, কী
আনন্দ কী আনন্দ। এই তো। কিচ্ছুক্ষণ আগে, ট্রেনের দরজায় মাথা ঝুলিয়ে হাওয়া
খাচ্ছিলাম। পোস্টে লেগে গোলমাল হয়ে গেল আর কী”।
-“যাক, ভালো
লাগলো তুমি এলে। এমনিতে বাঙালি ভূত এখানে টিকতে পারে না কিনা। আমিই একা টিকে রইলাম”।
-“কেন, টিকতে
পারে না কেন?”, ভূত-ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন নিধুবাবু।
উত্তরে হাওয়ায়
একটা সাদা চাদর পাতলেন অঘোরবাবু। আর ফস করে সেখানে সাজিয়ে দিলেন একটা প্লেট, কিছু
বাটি আর একরাশ রকমারি চামচ।
-“দেখ। এ দেশে
ভূতেদের জগতে আইন বলতে একটাই। তুমি পচা মাছ খাও আর কবর খুড়ে মড়ার ঘিলু খাও, তোমায়
খেতে হবে পুরো দস্তুর কেতা মেনে; সঠিক চামচে। এইটে হচ্ছে ডিনার স্পুন, ডিনার নাইফ
আর ডিনার ফর্ক, পচা ডিমের ভর্তা, ছাই মাখা পচানো কাকের মাংস, চুল-চচ্চড়ি, ইত্যাদি
দিয়ে ডিনার সেরে নেওয়ার জন্য। এই হচ্ছে বাটার স্প্রেডার, শ্লেষ্মার মাখন
কাদা-রুটিতে লাগাবার জন্যে। স্যুপ স্পুন, ধুলো-মশলা দিয়ে ফোটানো বেড়ালের রক্ত-স্যুপ
খাওয়ার জন্যে। আর এই যে এক জোড়া ছোট চামচে; ডেজার্ট স্পুন ও ফর্ক নখ মেশান পচা
রাঙা আলু বা অন্য কোন মেঠাই খাওয়ার জন্যে। বুঝলে?”
- “এক বেলা খাওয়ার
জন্যে এতগুলো চামচ? ব্যবহার করতেই হবে?”
-“চামচ ব্যবহার
না করে খেলে এ দেশ থেকে খেঁদিয়ে দেওয়া হয় ভাই নিধু। ফ্রেঞ্চ ভূত-আইনই সেরকম”।
নিধু খানিক ভাবলেন।
প্যারিসে এসে কিছুদিন না থেকে কেটে পড়ার মানেই হয় না। তিনি অঘোরকে বললেন “চামচে
খাওয়াদাওয়া করতে তো আমার কোন অসুবিধাই নেই অঘোরবাবু। আপনি একমিনিট দাঁড়ান, আমি
আমার চামচ খানা নিয়ে আসি”।
হুশ করে কলকাতা
গিয়ে হুশ করে প্যারিসে অঘোরবাবুর সামনে ফেরত এলেন নিধুবাবু। ভূত হয়ে এই এক মস্ত
সুবিধে। যা ভেবেছেন ঠিক তাই, তার ডেডবডিটা এখনো দমদমের কাছে লাইনের ধারেই পড়েছিল।
-“অঘোরবাবু, চামচ
এনেছি”, এই বলে ঝপাৎ করে একটা রক্ত মাখা মাংসের টুকরো অঘোর বাবুর চামচের দলের পাশে
রেখে দিলেন, “এই হল আমার জ্যান্ত অবস্থার মাল্টি-পারপাস চামচ। বুঝলেন কী না। ডিনার
স্পুন কাম ডিনার নাইফ কাম ডিনার ফর্ক কাম বাটার স্প্রেডার কাম স্যুপ স্পুন কাম
ডেজার্ট স্পুন কাম ডেজার্ট ফর্ক কাম আমার জ্যান্ত অবস্থার হাত। ভাগ্যিস আমার
ডেডবডিটা সরাবার আগে পৌঁছতে পেরেছিলাম, তাই এমন সুন্দর চামচ সমগ্রটা সহজেই খুবলে
আনতে পারলাম। এখানে তাহলে আমিও চামচ দিয়েই খাবো। চলুন, আপাতত আপনার গাছে গিয়ে উঠি,
তারপর ধীরেসুস্থে নতুন বাসা খুঁজে নেওয়া যাবে”।
2 comments:
ভূত হলে কি এত বীভৎস হতে হয়?
Haaa haaa
Post a Comment