Tuesday, January 6, 2015

নিরালাপুর

দু’মাইল হেঁটে এখানে আসতে হয় নিশিকান্তবাবুকে। বাড়ি থেকে বেশ দূরে। বসতি এখানে নেই। রেল লাইন আছে। এক কোণায় একটা পুকুর, শাপলায় ভরা। ঝোপঝাড় আধো জংলা জায়গা। ট্রেন চলাচল বিশেষ নেই এ লাইনে। আপ আর ডাউন মিলে দিনে পাঁচটা লোকাল ট্রেন আসা যাওয়া করে। একটা সিমেন্টে বাঁধানো উঁচু জায়গা মত আছে ডাউন লাইন ঘেঁষে। সেখানে বসতে ভালোবাসেন সত্তর বছরের নিশিকান্ত। গায়ে শাল, গলা কান জড়িয়ে মাফলার, হাতে লাঠি। বাহাত্তর বছর হতে চললো, হাতে লাঠি তো থাকবেই। তবে এ বয়েসেও যে দৈনিক চার মাইল হন্টন চালিয়ে যেতে পারছেন, সেটাই বা কম কী। 

এ জায়গাটা বেওয়ারিশ, কেউ তেমন আসা যাওয়া করে না। তাই নিজেই এ জায়গার একটা নাম দিয়ে নিয়েছেন নিশিকান্ত; নিরালাপুর। ঠিক বিকেল চারটে বাজলে নিরালাপুরে এসে পৌঁছন নিশিকান্তবাবু। চারটে বত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে আপ লাইনে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন পাস করে। সেটা চলে গেলে উঠে পড়েন নিশিকান্তবাবু। ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে আসেন। পকেটে থাকে দু’টো বিস্কুট। কাঁধের ঝোলা থেকে আনন্দবাজার বের করে পড়তে শুরু করেন, খবরের কাগজ বিকেলে পড়ার অভ্যাসটুকু তার বহুদিনের। কাঁধের ঝোলায় থাকে ছোট ট্রানজিস্টার। এ যন্ত্রটা আজ থেকে বারো বছর আগে শিলিগুড়ি থেকে কিনেছিলেন নিশিকান্তবাবু। এখনও দিব্যি চলছে। আকাশবাণীতে আধুনিক বাংলা গানের আসর বসে বিকেল চারটে থেকে, চড়ুই শালিকের কিচিরমিচিরে মিশে যায় রেডিওর গান। বেশির ভাগ দিনই ব্রজবালা এসে হাজির হয় লেজ নাড়তে নাড়তে। ব্রজবালা নামটা নিশিকান্তবাবুরই দেওয়া। নেড়ি হলেও থিন অ্যারারুটে আপত্তি নেই ব্রজবালার। নিশিকান্তবাবু না ওঠা পর্যন্ত পাশে এলিয়ে শুয়ে থাকে ব্রজবালা, সামান্য থিন অ্যারারুটেই অনুগত হয়েছে সে। 

চারটে বত্রিশের পর পরই যখন প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলে যায়, নিশিকান্তবাবু পাততাড়ি গুটিয়ে নেন। লেজ নাড়তে নাড়তে চলে যায় ব্রজবালা। আকাশ বিকেল-লালচে হয়ে আসে। ট্রেন যাওয়া লাইনের মৃদু কাঁপুনি তখন অল্প রয়ে যায়। ট্রেনটার চলে যাওয়া নিশিকান্তবাবুর কাছে আত্মীয়র মত হয়ে গেছে। ট্রেনটার চলে যাওয়ার ঝমঝম তার কাছে একমাত্র আপনজনের মত।

বাড়ি ফিরেই কান্না পায় নিশিকান্তবাবুর। এটাও নিয়মিত।স্ত্রী গীতালি নেই আজ পাঁচ বছর হল। খোকা ব্যাঙ্গালোরে। প্রতিবেশী বন্ধু হরেন সমাদ্দার বা নীলমণি সেনগুপ্ত দু’জনেই হাওয়া আজ বেশ ক’বছর। নিশিকান্তবাবু আছেন। রোজই ভাবেন, আর নয়, এভাবে থেকে লাভ নেই। ইনসমনিয়ার কল্যাণে ঘুমের বড়ির অভাব নেই নিশিকান্তবাবুর সংগ্রহে। সাহসের অভাব আছে তেমনটাও নয়, নিশিকান্তবাবু জানেন সেটা। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার মনে হয়, আহা রে, ব্রজবালা থিন অ্যারারুট বড় ভালোবাসে। আর কয়েকটা দিন অন্তত ব্রজবালাকে বিস্কুট খাইয়ে আসতে ইচ্ছে করে নিশিকান্তবাবুর। থেকে যেতে হয়।

ব্রজবালাও যে কতটা একা সে খবরটুকু টের পাওয়া হয়ে ওঠে না নিশিকান্তবাবুর। নিরালাপুরেই লাইনের ধারে বেওয়ারিশ জন্ম, এবং জন্মাবধি ব্রজবালার যন্ত্রণা হল যে তার মানবজন্মের স্মৃতিটুকু মুছে যায়নি। মানব জন্মের স্মৃতি বয়ে কী কুকুরে জীবনে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব? মোটেই নয়। তাই রোজ বিকেলে সমস্ত সাহস জড় করে লাইনের ধারে চলে আসে ব্রজবালা, ট্রেন ধেয়ে আসলেই তার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে যন্ত্রণা দূর করতে। কিন্তু পারে না সে। রোজই ভদ্রলোক আসেন, এসে বসেন চায়ের কাপ আর আনন্দবাজার নিয়ে। বরাবরের মত। তাকে আদর করে কাছে ডাকেন, একটা বিস্কুট মুখে গুঁজে দেন। শুধু গীতালি বলে না বলে ব্রজবালা বলে ডাকেন। এটুকুই যা দুঃখ। ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া আর হয় না ব্রজবালার।         

3 comments:

malabika said...

নিশিকান্তের ব্রজবালা থাকাটা নাহয় ভাগ্যিস্‌ বলে চালানো যায়, ব্রজবালার নিশিকান্ত থাকাটাকে কি বলা যায় বলো দেখি? ভারি মুস্কিল। এখানে আবার পূর্বজন্মের স্মৃতির একটা হাল্‌কা হাওয়া! বাপ্‌রে।

Unknown said...

Kudos

debalina said...

Onnorokom premer golpo...ha ha