তখন আমি বেশ ছোট। প্রেম করা ব্যাপারটা তখনও ডেঁপোমি বলেই জানি। বিকেলে হন্যে হয়ে ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেট খেলি। জ্যামিতিকে ভয় পাই। নন্টেকে ফন্টের চেয়ে বেশী ভালোবাসি। সদ্য সাইকেল চালানো শিখে মনে হয় ডানার আনন্দ বুঝি। তিনটে সিঁড়ি না টপকে পা ফেলতে পারি না। ফুল প্যান্ট পরি শুধু বিয়েবাড়ি যেতে হলে। আঁকাতে ভালোবাসি আর আঁকার মাস্টারকে ভালোবাসি না। ফড়িং ধরতে পারি, আর তার লেজে সুতো বেঁধে ঘুড়ির মত ওড়াতে পারি। গদা আর তীর-ধনুক, দু’টোতেই সমান পারদর্শী। স্কুল ফেরতা দুপুরে মাকে জড়িয়ে না ধরলে ঘুম আসে না। রবিবারে বাবার পাশে গুটিসুটি হেঁটে মাছের বাজার যাই, এই মাছ নাও-ওই মাছ নিও না বলে কাদা জলে ছপছপ করি। সন্ধেবেলা মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে হাত পা ধুয়ে দুধ মুড়ি খেতে বসি। অকারণে বন্ধুদের সাথে পেট ফাটিয়ে হাসতে পারি, একে অপরের টিফিন কেড়ে খেতে পারি।
সেই সময়।
কোন এক বিকেলে। কোন এক বৃষ্টির বিকেলে। কালচে মেঘলা বিকেলে। লোডশেডিং হব হব করেও হয়নি এমন বিকেলে। বাড়িতে ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছোট একটা টিভি। তাতে একটা চ্যানেল। দূরদর্শন। তা রাতে বন্ধ। দিল্লী কলকাতা বাংলা হিন্দি মিলে বাকি সময়টুকু। সেই সময়।
টিভিতে একটা সিনেমা চলছিল। নজর সিনেমায় ছিল না। নজর ছিল আকাশের দিকে। বৃষ্টি কি থামবে না? আজ কী খেলা হবে না? বন্ধুরা কি ডাকতে আসবে না?
হঠাৎ। সিনেমার ফাঁকে। এক আকাশ মেঘ ভারী কলকাতা। কালচে অন্ধকারে কলকাতার সিলুহ্যেট। এমন একটা কণ্ঠস্বরের ভেসে আসা যা যেন নিশ্চিত ভাবেই মেঘে থেকে চুইয়ে পড়া, কিছুতেই তা টিভি থেকে আসা নয়। মিষ্টি অথচ গম্ভীর। নরম, ঠাণ্ডা অথচ ধারালো। অভিমানী কিন্তু সজল নয়। তিনি গাইছেন।
“এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে”।
তখনও রবীন্দ্রনাথকে ঘাঁটাবার বয়স নয়। কিন্তু শিহরণ আর হেমন্তর সম্ভবত বয়স থাকেনা। অমন ভাবে কেউ কখনও ডাকেনি। আদুরে ভাবে গমগমে অথচ জাপটে ধরা সুর।
“বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে”।
অন্তর শব্দে আটকানোর বয়স সেটা নয়। তবে উসকোখুসকো চেহারার একটা ডানপিটে মেয়ে তখন স্ক্রিনে। আচমকা নেমে আসা বৃষ্টিতে ভালোবেসে অসহায়। ওর চুলে দানা দনা বৃষ্টি, ওর হাসি উপচে পড়ছে কিন্তু হই হই করছে না। সে হাসি ঘাসে এমন ভাবে পা ফেলে যাতে ঘাসের ডগাটিরও ব্যথা না লাগে। বৃষ্টি গাঢ় হয়ে আসে, রিমঝিমে মেজাজে গানটা গুটিগুটি এগিয়ে যায়;
“স্বপন দুয়ার খুলে এসো, অরুণ আলোকে এসো মুগ্ধ এ চোখে, ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে এসো আমার ঘরে”।
শব্দের খোসা ছাড়াবার বয়স সেটা নয়, তবে সুরে ভেসে যাওয়ার বয়স নেই। আর সেই ছায়ামূর্তিটা, অন্ধকার আর বৃষ্টিতে ক্রমশ আবছা আর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পাশের হেঁটে যাওয়া লোকটা, সাইকেলটা, টেনে নিয়ে যাওয়া রিক্সাটা তার গোচর হয় না আর। পৃথিবীটা ফাঁকা হতে হতে মিষ্টি কালচে ক্যানভাস হয়ে ওঠে, শুধু সে, বৃষ্টি আর গম্ভীর নিরস কয়েকটা বাড়ি। মেয়েটার গা বেয়ে গানটা বেড়ে ওঠে :
“দুঃখ সুখের দোলে এসো, প্রাণেরও হিল্লোলে এসো,ছিলে আশার অরূপ বানী ফাগুন বাতাসে, বনের আকুল নিঃশ্বাসে-- এবার ফুলের প্রফুল্ল রূপ এসো বুকের পরে”।
মেয়েটা ভীষণ ভিজতে চাইছে কিন্তু ঝমঝমে বৃষ্টিও তাকে যথেষ্ট উপচে ফেলতে পারছে না।
সে মেয়েটিকে যে কী ভীষণ ভাবে ভালোবেসে ফেলা যায়। আমি হতবাক হয়ে সেটা বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম অনেকদিন আগের কোন এক বৃষ্টির বিকেলে আমার মা অমন ভালোবাসায় টাপুর টুপুর হয়ে ভিজেছিলো, অমন নরম হেসে জল ঠেলে হেঁটে চলেছিল দিক না চিনে। আমার মা। গান ছাড়া আমার মা হয়ই না। আমার মা। অমন ভালোবাসায় মজে বৃষ্টিতে হেঁটেছিল। আমার মা।
7 comments:
Ei gaanta amar o khub e priyo
bhishon moner kachherr gaan, tobe kaeno sheta jantam na, odbhut ekta bhalo laga o dukkho laga mishey chhilo ei gaantay amar jonye, apnar jonye oboshyo onyorokom gaanta
jahok, lekhata boroi bhalo laglo, shudhu gaanta priyo othoba apnar lekha bhalo lage bolei noy, ei lekhata sotyi monke chhuye gaelo, hoyto bhul bujhchhi but tao lekhatay khanikta hoyto apnake dekhte pelam prothombar .... Bhalo thakben
ভালো লাগলো। চালিয়ে যান।
জানা গেল, তোমার ছোটবেলার 'সেই সময়টা' বড্ডই মায়াময়, সুন্দর ছিল। আজ কি মনে হয়, সময়টা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কিছু একটা হারিয়ে গেল?
গানটা সত্যিই মনে রাখার মত। ঠিকমত গাইলে বৃষ্টির মাধুর্য, ভালোবাসার গাঢ়তা, সবই একসাথে জড়িয়ে ধরে দেহে-মনে। মনে করিয়ে দিলে, ফিরিয়ে দিলে ছেলেবেলাটা।
ভালভাবে গান শোনার জন্য তোমার মার কাছে পৌঁছান যায় না?
আগুন যেমন পুড়িয়ে শুদ্ধ করে দেয়, তেমনি এই সিনেমাটা মনের ভেতরটা পুড়িয়ে শুদ্ধ করে দেয়। ছেলেবেলার এক টুকরো ছবি মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ
Amader Chhotobelata thik ekirokom Chhilo
Ekannoborti paribaarey manush | Jartuto Khurtuto Bhaiyera hutoputi koray khela kortam aar erokom bhabey Brishti upobhog kortaam
Jotoboroi hoi jotodurei jai 'sei somoi' ta theke mukti nei..
অসাধারণ! ভীষণ ভীষণ ভালো লাগল।
শেয়ার করছি ফেসবুকের দেওয়ালে।
Post a Comment