Thursday, April 30, 2015

বন্‌ধের ব্যাপারে দু'টো কথা

বন্‌ধ ব্যাপারটা নিয়ে দু’টো কথা আছে।

১। বন্‌ধ খারাপ।
২। বন্‌ধ ভালো।

ওই এক নম্বরে যেটা বললাম, সেটা স্পষ্ট। এ যুগে বন্‌ধ ততটাই উপযুক্ত পলিটিকাল হাতিয়ার; যতটা বুধবারের চিত্রহার বা একটা ক্যাসেটে বারোটা গান বা ইনল্যান্ড লেটার। তবে ভেজা গাব্বা পিচে ইনকিলাবি স্কুপ শট খেলতে রাজনৈতিক দাদা-দিদিরা অতীব পটু; তারা জানেন যে ভোটে বিদ্রোহী আই-পি-এলো মেজাজটা ছড়িয়ে দিতে পারলেই পাবলিক খাবে। ওসব উন্নয়ন-টুন্নয়ন লম্বা ইনিংসের খেললে জুটবে কাঁচকলা; টেস্ট ম্যাচে আজকাল সকলের সুপরিকল্পিত অরুচি। কাজেই তারা বন্‌ধ রাখবেনই, আর আমরা ছুটি হ্যাংলারা ডাইভ দিয়ে ল্যাদ লুফে নেবই। ওটাই আমাদের ধর্ম- বাঙালি ধর্ম। হুজুগ হল ঈশ্বর, ড্যাং ড্যাং হল নৃত্য পুজো। কিন্তু এসব করে আর ক’দিন? বুড়ো বাঙালি বাপ-মায়েরা বোধ হয় চিরকালই ফ্রি ওয়াইফাইতে বাঙ্গালরে চেন্নাইতে দিল্লীতে বম্বেতে বসে থাকা চাকুরীরত ছেলেমেয়েদের সাথে স্কাই চ্যাট করে যাবন।

এইবারে। ইয়ে। এক নম্বরের ব্যাপারটা রইলো। ঠিক আছে। সত্য কথা। উন্নয়ন আদ্দির পাঞ্জাবীর মতই জরুরী। তবে কী না...বন্‌ধ থাকবে না? বাঙালি স্রেফ জিডিপি জিডিপি করে শেষ হয়ে যাবে? হুজুগ ফুর্তি হঠাৎ তুর্কি জীবন থাকবে না? গপাগপ পয়সা কামিয়ে বাঙালি পাতি অক্কা পাবে? তাই কী হয়। আমরা সর্বহারার দল, আমরা প্রতিবাদী পাবলিক, আমরা হঠাৎ ছুটিতে বিশ্বাসী। আমাদের বন্‌ধটুকু অন্তত থাক।

এক আর দুই পাশাপাশি থাকে কী করে?
থাকবে।

বন্‌ধ খারাপ কেন? রাজনীতির কাদা মাখা বলে। গাজোয়ারির আখড়া বলে। যে বন্‌ধ নেতা নেত্রীর গালে মুনাফা চুমু, সেই বন্‌ধই পাবলিকের আখেরের পিছনে কষিয়ে লাথি; তাই বন্‌ধ গোলমেলে।  
বন্‌ধ ভালো কেন? হঠাৎ ছুটির আবেশ। কে দেবে? বন্‌ধ ছাড়া আমাদের হঠাৎ ছুটির স্নেহ কে এনে দেব?

এবারে।
সলিউশন।
নেতারা বন্‌ধ থেকে দূরে থাকুন। প্রতিবাদ হোক, তবে নতুন দিগন্ত কিছু আবিষ্কার হোক। জিন্‌সের যুগে বাঘ ছাল লুঙ্গির কোন মানে হয় না।
কিন্তু তাহলে বন্‌ধের কী হবে? বছরে দু’পিস বন্‌ধ না হলে বাঙালির কী হবে? যে কোন ছুটি হলে হবে না। ছুটি আর বন্‌ধ এক নয়, ঠিক যেমন এক নয় ফুলশয্যার কপিবুক ভালোবাসা আর আচমকা চিলেকোঠা।
তবে?

বন্‌ধ আসুক আলোর উৎসব হয়ে, হঠাৎ ছুটির দিন হয়ে। উগ্র হুঙ্কারে নয়। একটা পেল্লায় স্ক্রীনওলা কম্পিউটার; যেটা আসলে একটা র‍্যান্ডম বন্‌ধ-ডে-জেনারেটর। সেটা লাগানো থাকবে হাওড়া ব্রীজের মাথায়।  ফি বছর তিনশো তেষট্টি দিন স্ক্রীনটি আবছা কালো হয়ে থাকবে। শুধু বছরের দু’টি মহামূল্যবান সন্ধেবেলা ঝলমল করে উঠবে র‍্যান্ডম-বন্‌ধ-ডে-জেনারেটরের পেল্লায় স্ক্রিনটি; জানিয়ে দেবে “আগামীকাল বন্‌ধ, আনন্দ হোক”। যে কোন দু’টো দিন; অবশ্যই ছুটির দিন বাদে- প্রোগ্রামিংটা হবে তেমনই। সেই দু’দিন উল্লাসী আলস্যে ভেসে যাবে বঙ্গদেশ। (ইয়ে, বাস ট্রাম ট্রেন যেন চলে, ওষুধের দোকান আর হাসপাতালগুলো যেন খোলা থাকে)।

ব্যাস। সর্বহারার দল হাওড়া ব্রীজের মাথায় লাগানো সেই মনোরম স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে জীবনের সমস্ত দুঃখ ভুলবে। স্ক্রিনটার ডাকনাম দেওয়া হবে – জীবনানন্দ। 

Wednesday, April 29, 2015

কোল্যাটেরাল

তার প্রতিশ্রুতির দম কতটা?

সে যদি বলে “আমি বন্ড পেপারে লিখে দিতে পারি”, জানবেন হিসেবে গরমিল আছে।

সে যদি বলে “মাইরি বলছি”, জানবেন সে আলগোছে সিরিয়াস, হালকা অছিলায় ফসকে যেতে পারে।

সে যদি “তিন সত্যি” দিয়ে বলে, তার তিনটে বালখিল্য সত্যি নিয়ে জাগ্‌লিং খেলতে পারেন।

সে যদি “মা কালীর দিব্যি” দিয়ে আশ্বাস দেয়, তাহলেও বেসিকালী কোন গ্যারেন্টি নেই। দিব্যি-টিব্যি কলিতে দিব্যি আউটডেটেড হয়ে পড়েছে।

সে যদি বলে “গড প্রমিস”? শুনুন, এ যুগ গডফাদারের যুগ। গড যে আমজনতার ব্যক্তিগত ব্যাপারে খুব একটা নাক গলাতে পছন্দ করেন না, এটা এখন সর্বজনবিদিত।

সে যদি এই বলে ভরসা দেয় যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না হলে আপনি তার “মরা মুখ” দেখবেন, জানবেন সে ডাকওয়ার্থ লুইসে খেলতে চাইছে। চোখের জলে যুক্তির পিচ ভাসল বলে। আপনি হতবাক ম্যাকমিলানের মত এক বল খেলতে নামছেন বাইশ রান করার জন্য।

সে যদি বলে “মায়ের দিব্যি”, জেনে নিন কার মা। শেষে দেখলেন তার প্রতিশ্রুতির সঙ্গে আপনার মাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হল।

সে যদি গা ছুঁয়ে বলতে চায়? ভালো না লাগলে সাবান কেনার খরচা চান। ভালো লাগলে জড়িয়ে ধরুন, প্রতিশ্রুতির দরকারটা কী?

কোল্যাটেরাল থাকলেই প্রতিশ্রুতি নড়বড়ে হয়ে যায়।

সে বললে “কথা দাও রোজ চিঠি লিখবে?”
উত্তর পেলে “লিখতেও পারি”, কিন্তু সে কণ্ঠে সামান্য বাষ্প। ওই হচ্ছে প্রতিশ্রুতি।  

Tuesday, April 28, 2015

ইলিশিয়

আসল রুপো কি খনি থেকে উঠে আসে? উঠে আসে পদ্মা আর গঙ্গার বুক চিরে; ইলিশের গায়ে ঝিক্‌মিক্‌ করতে করতে। সাঁঝের গড়িয়াহাটের মাছের বাজারের বাল্বের আলোর হলুদ মখমল সেই রুপোর তবকে মিশে গলগলে সোনা তৈরি হয়। এই অ্যালকেমির সূত্র শুধু বাঙালির মানিব্যাগের রক্তে লেখা থাকে। আদত পদ্মার মায়াময় স্বাদ পেতে হলে অন্তত কিলো প্রতি কড়কড়ে দু’টো পাঁচশো আর একটা একশো টাকার নোটকে ভাসিয়ে দিতে হয়। কিন্তু এই হ্যাশট্যাগের যুগে কেষ্টর জন্য কষ্ট করার চেয়ে ইলিশের পিছনে মনোনিবেশ করা ঢের ভালো। 

আড়াআড়ি একে অপরের বুকে শুয়ে থরে থরে রুপোমাখা বাজার মোহিনীর দল। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে মেপে নেওয়া পেটির পরিসর, সামান্য টিপে পদ্মা পরবর্তী বরফ বন্দী জীবনের দৈর্ঘ্য বুঝে নেওয়া; ইলিশবিলাসী হওয়া সহজ নয়। ইলিশ চেনার আর্ট হারিয়ে যাচ্ছে। ইলিশ চেনার নিরিখে দাদু ছিলেন শরদিন্দুর ব্যোমকেশ, বাবাকে বাসু চ্যাটার্জির ব্যোমকেশ বলা যায়। আমি বোধ হয় দিবাকর ব্যানার্জির বিয়োমকেশ। দাম বুঝে কোয়ালিটি মেপে নিতে হয়। বড় দুঃখ। বাজার থেকে দ্রাবিড় ভেবে আনি, আর এদিকে বাড়ি এসে ইলিশ ব্যাটা সাদাগোপান রমেশ হয়ে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে অকারণ খোঁচা দিয়ে চলে। 

কিন্তু খাপে খাপ ইলিশ যদি আসে। যদি সে আসে। সাদা ধবধবে টুকরো। পেটির ত্রিকোণ বুক আলো করে জমাট বাঁধা ডিম। অঙ্কের মাস্টার শুভঙ্কর স্যার বলতেন ইলিশ পেটি ট্রায়াঙ্গুলার নয়, ট্রায়াঙ্গল হল ইলিশপেটিয়ুলার। সেই রূপকথার মত ইলিশের ডিম সহ পেটি ভাজা; ষ্টীলের থালার এক কোণে। থালার ঠিক মাঝখানে দুই হাতা ভাত। সেই ভাতের টিলার মাথায়; শিবের মাথায় ভক্তি ভরে জল ঢালার মত; ঢেলে দেওয়া ইলিশ ভাজা গরম তেল। শিবের মাথায় প্রণাম করে ধুতরো ফুল দেওয়ার মত করে ভাতের টিলার মাথায় রেখে দেওয়া একটা লম্বা সরু কচি সবুজ কাঁচা লংকা। ভক্তি। পুজো। সাধনা। এটাই। সেই লংকা নুনের সাথে ভাতে ডলে, ভাতকে তেল দিয়ে আদর করে মেখে নেওয়া। একটু ইলিশ, একটু ডিম ভাতের দলার সাথে মুখে উঠে আসবে। 

বাইরে তখন যেন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে। রেডিও থেকে তখন যেন ভেসে আসে “ওরে, নীল যমুনার জল, বল রে মোরে বল, কোথায় ঘনশ্যাম”। জিভের রাধা তখন ইলিশি কৃষ্ণে মাখো মাখো।       

Sunday, April 26, 2015

নিরো

-    তুমি জানো তুমি কী বলছো অনিন্দ্য?
-           জানি।
-           না তুমি জানো না। তোমার মগজে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে।
-           আমি আপনাকে জোর করে বিশ্বাস করতে বলছি না প্রফেসর সেন। আমি আপনাকে ডাকিনি। আপনিই এখানে এসেছেন আমার খোঁজে।
-           হ্যাঁ, এসেছি কারণ ইউনিভার্সিটি থেকে দুদিন ধরে তুমি নিখোঁজ। হস্টেলে ফেরোনি। রিসার্চ টিমের কেউ তোমায় দেখেনি। তোমার বাড়ির লোকেরা তোমার খোঁজ করে পাচ্ছে না। তুমি কারোর কল রিসিভ্‌ করছো না। ঝাড়া দুদিন পর মাঝ রাত্তিরে তোমার ফোন পেলাম আর সেখানে এমন আবোল তাবোল বকলে তুমিভেবেছটা কী? রাত দুটোর সময় সমুদ্রের ধারে এমন হদ্দ হয়ে বসে আছো। চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে নির্ঘাত নেশা-টেশা করেছো।
-           আমি কোন নেশা করি না প্রফেসর। আপনি সেটা জানেন। আমি আপনাকে ফোন করে বলেছি কারণ কথাটা নিজের মধ্যে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমার মনে হয়েছিল অন্তত আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন। আপনার অন্তত কথাটাকে আবোল-তাবোল মনে হবে না।
-           ওকে। বেশ। তুমি বলছো যে তোমার এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে? ইনফ্যাক্ট, তোমার কথা অনুযায়ী ভিনগ্রহের প্রাণীরা নিজে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তাই তো?
-           যোগাযোগ করেছে। তবে...
-           তবে কী?  
-           তবে তারা যে ভিনগ্রহের প্রাণী, সেটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি না। তবে এটুকু নিশ্চিত যে তারা এ পৃথিবীর কেউ নয়।
-           তুমি আমার সব থেকে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র অনিন্দ্য। সেটা আমি বরাবর উঁচু গলায় বলে এসেছি। তাই বলে পাগলামি রেয়াত করবো না। ভিনগ্রহের প্রাণী কী না তুমি নিশ্চিত নও। আবার তারা পৃথিবীরও নয়। এ সমস্ত উদ্ভট কথা ইউনিভার্সিটির বাইরে গেলে লোক হাসবে।
-           আমি ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিচ্ছি প্রফেসর।
-           সেসব কথা আমি পরে শুনবো। এবার ওঠো। এই শীতের রাত্রে ঢেউয়ে পা ডুবিয়ে ভেজা বালিতে লেপটে  বসে থাকার ছেলেমানুষি তোমার সাজে না অনিন্দ্য। প্লিজ উঠে পড়। সবাই তোমার জন্য চিন্তা করছে।
-           প্রফেসর। ওরা আছে। ওরা যোগাযোগ করেছে। আমার পাশে একটু বসবেন?
-           অগত্যা। সিগারেট খাবে? তুমি না খাও, আমি একটা ধরাই।
-           শুনবেন?
-           কী?
-           আমার কথা। শুনবেন প্রফেসর?
-           অনিন্দ্য, তোমায় ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কাল শুনবো না হয়?
-           আপনি শুনলে আমার ক্লান্তি খানিক দূর হবে।
-           ব্যাপারটা কী বল তো?
-           ওরা আমাদের খুঁজে পেয়েছে প্রফেসর।
-           ওরা কারা অনিন্দ্য?
-           অন্য দুনিয়ার লোকজন।
-           ইউ মিন, অন্য গ্রহ?
-           প্রফেসর। অন্য ব্রহ্মাণ্ড।
-           অনিন্দ্য। আজ থাক। কাল শুনবো।
-           প্লীজ প্রফেসর। আপনার শোনাটা ভীষণ জরুরী।
-           কে কী ভাবে যোগাযোগ করেছে তোমার সঙ্গে।
-           আমি ওর নাম দিয়েছি নিরো।
-           অন্য ব্রহ্মাণ্ডের যে প্রাণী তোমার সঙ্গে  যোগাযোগ করেছে, তার নাম দিয়েছো নিরো?
-           প্রাণী বলতে...সে মানুষ। নিরো মানুষ।
-           অন্য গ্রহের...থুড়ি...অন্য ব্রহ্মাণ্ডের মানুষ। রাইট?
-           রাইট প্রফেসর।
-           প্রশ্ন হচ্ছে, সে, অর্থাৎ নিরো, তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করলো কী ভাবে?
-           সহজে হয়নি। বহু চেষ্টার পর নিরো চিনতে পেরেছে সেই ভাষাটা যা আমরা দুজনেই বুঝি। বাইনারি।
-           যোগাযোগের মিডিয়াম?
-           আমার মগজের ভেতর থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ তৈরি করে বাইনারি সঙ্কেতে আমার সঙ্গে কথা বলেছে নিরো।
-           বটে?মগজের ভেতর থেকে ওয়েভ জেনারেট করলো কী ভাবে নিরো? সে তো ব্রহ্মাণ্ডের মানুষ...।
-           প্রফেসর। তার ব্রহ্মাণ্ড আমার মগজের মধ্যেই রয়েছে।
-           অনিন্দ্য। আর ইউ ইভ্‌ন সিরিয়াস অ্যাবাউট দিস?
-           আমাদের মগজের নার্ভ কোষ গুলোর শেষ প্রান্তে রয়েছে অ্যাক্সন টার্মিনাল।
-           যার মাধ্যমে আমাদের মগজের ভেতরের অনুভূতিগুলো ইলেক্ট্রনিক ইম্পালস হয়ে একটা নিউরন থেকে অন্য নিউরনে চালান হয়। কিন্তু তার সঙ্গে কী এই নিরোর গপ্পের কী সম্পর্ক অনিন্দ্য।
-           ওই অ্যাক্সন টার্মিনালগুলোর অভ্যন্তরে যে সূক্ষ্মতম পরমাণু রয়েছে, তাকে যদি বহু সহস্র সহস্র কোটিগুণ বড় করে আমরা কোনদিন দেখতে পেতাম প্রফেসর...তাহলে...তাহলে...
-           তাহলে কী অনিন্দ্য?
-           তাহলে আমরা দেখতে পারতাম...যে ওই অ্যাক্সন টার্মিনালের প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যে রয়েছে কয়েক লাখ...কয়েক লাখ ব্রহ্মাণ্ড...।
-           হোয়াট নন সেন্স।
-           ননসেন্স নয় প্রফেসর। আমাদের মগজের নিউরনগুলোর প্রান্তের কিছু পরমাণুতে লুকিয়ে রয়েছে প্যারালাল ব্রহ্মাণ্ডরা...অবিকল আমাদেরই এই ব্রহ্মাণ্ডের মতই...বিগ ব্যাংএর প্রশ্রয়ে গজিয়ে ওঠা...গ্র্যাভিটি...হাইড্রোজেন হিলিয়ামের খেল...অসংখ্য গ্যালাক্সি...সুপারনোভা...তারামণ্ডল...গ্রহদের জটলা...আর রয়েছে এই পৃথিবীর মত গ্রহ...যেখানে রয়েছে আমাদের মত মানুষ...
-           তোমার নিরো...
-           বলতে একটু ভুল হল প্রফেসর...নিরো একজন কেউ নয়।
-           নিরো একজন কেউ নয় মানে?
-           মন দিয়ে শুনুন প্রফেসর। আমাদের নিউরনের পরমাণুর কোলে লেপটে থাকা অসংখ্য ব্রহ্মাণ্ডগুলো অবিকল আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডের মতই। আমাদের ধরনের গ্যালাক্সি, তারা, সুপারনোভা বা গ্রহ সেখানে আছে আমি এমন বলছি না। বরং আমি জানি যে সেখানের গ্যালাক্সি,তারা, সুপারনোভা বা গ্রহ অবিকল আমাদেরই মত।
-           হোয়াট ডু ইউ মিন বাই অবিকল আমাদেরই মত?
-           মানে সেখানেও মিল্কি ওয়ের এক প্রান্তে সৌরমণ্ডল, সেখানেও পৃথিবী। বিবর্তন, মানুষ। আপনি। আমি।
-           কী বলছো এবার তুমি অনিন্দ্য! সেখানেও পৃথিবী আর আমি তুমি ?
-           প্রফেসর প্যারালাল ওয়ার্ল্ড। সমস্তই এক। শুধু সময়ের পরিভাষা আর গতিটা আলাদা।
-           উফ। এবার আমার মাথাটাও গুলিয়ে দিচ্ছ অনিন্দ্য।
-           প্রফেসর সেখানে সময়ের গতি আমাদের চেয়ে অনেক বেশী। অতএব সেখানের ব্রহ্মাণ্ড ও পৃথিবী আমাদের চেয়ে বহু সহস্র কোটি বছর এগিয়ে গেছে।
-           নিরো কে?
-           নিরো একদল মানুষ যারা এই প্যারালাল জগতগুলোর মধ্য যোগাযোগ বাঁধতে চাইছে। প্রফেসর। ওই পৃথিবীতেও আমি, অর্থাৎ অনিন্দ্য সরকার ছিলাম। আপনিও ছিলেন প্রফেসর সেন।
-           ওই পৃথিবী বলতে তোমার মগজের নিউরনের ভিতরের পরমাণুর মধ্যে লুকিয়ে যে সব ব্রহ্মাণ্ড, তার যে কোণ একটাতে...
-           তার প্রত্যেক ব্রহ্মাণ্ডে আমরা ছিলাম প্রফেসর। আর ইয়ে, এই ব্রহ্মাণ্ডগুলো সমস্ত নিউরনে ছড়িয়ে আছে, আপনার নিউরনেও আছে। শুধু সেখানের সময়ের গতি আমাদের এই পৃথিবীর সময়ের চেয়ে অনেক বেশী দ্রুত। সেখানে বিবর্তনের গতি স্বাভাবিক ভাবেই অনেক দ্রুত, ইতিহাসও তেমন ভাবেই দুদ্দাড় করে আমাদের পরে শুরু হয়েও অল্প সময়েই আমাদের আগে শেষ হয়ে যাবে। কাজেই সেই পৃথিবীতে আমি আর আপনি ইতিহাস হয়ে গেছি।
-           নিরো কারা অনিন্দ্য?
-           ওই যে বললাম। যারা এই প্যারালাল ব্রহ্মাণ্ডগুলোর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতে চাইছে।
-           তারা কারা?
-           আমি।
-           হোয়াট?
-           আমার মগজের মধ্যের প্যারালাল ব্রহ্মাণ্ডের আমি, অর্থাৎ সেই পৃথিবীর অনিন্দ্য, ধরুন তাকে বলছি অনিন্দ্য.১। সেই অনিন্দ্য.১ এই প্যারালাল জগতের হিসেব বুঝতে পেরে আমায় ব্রেইন ওয়েভ জেনারেট করার প্রযুক্তি খাটিয়ে আমায় মগজে বাইনারির মাধ্যমে প্যারালাল পৃথিবীর বার্তা পাঠিয়েছে। সেটা আমি ইন্টারপ্রেট করতে পেরেছি। কিন্তু মুশকিল হল, অনিন্দ্য.১ আর আমি, ধরা যাক আমি অনিন্দ্য.০, আমাদের সময়ের নিরিখে ফারাক এতটাই, যে আমি অনিন্দ্য.১এর বাইনারি মেসেজ মনে মনে ডিকোড করার আগেই আমার মগজের প্যারালাল অনিন্দ্য.১ গায়েব। আফটার অল, জীবন মৃত্যুর সাইকেল সব ব্রহ্মাণ্ডেই বহাল রয়েছে।
-           প্রশ্ন হচ্ছে, অনিন্দ্য.১ কী ভাবে জানলো এই প্যারালাল ব্রহ্মাণ্ডের হিসেব? অ্যাক্সিডেন্টাল ডিসকভারি?
-           না। অনিন্দ্য.২ তাকে জানিয়েছে।
-           অনিন্দ্য.২?  অর্থাৎ অনিন্দ্য.১এর মগজের ভিতরে যে প্যারালাল পৃথিবী...সেখান থেকে?
-           ঠিক ধরেছেন প্রফেসর সেন।
-           গুলিয়ে যাচ্ছে অনিন্দ্য।
-           গুলিয়ে যাওয়ার তো কিছু নেই প্রফেসর। অনিন্দ্য-(এন) অনবরত খবর দিতে চেষ্টা করছে অনিন্দ্য-(এন মাইনাস ওয়ান) কে আর এই ভাবে সিরিজ চলছে। এইটাই যোগাযোগের সূত্র। প্যারালাল পৃথিবীগুলোর। এই সিরিজাটার নামই নিরো প্রফেসর।  জীবন রহস্য আর মাধ্যাকর্ষণের সহজ যোগটা বুঝতে পারছেন না প্রফেসর সেন?
-           কী বলছো অনিন্দ্য...তুমি পাগল...
-           এই ঠাণ্ডা হাওয়াতেও আপনি ঘামছেন প্রফেসর সেন। আপনি জানেন আমি পাগলামি করছি না। আমাদের চিন্তাশক্তি, যা নিউরন থেকে নিউরনে ধাবিত হচ্ছে, সেই চিন্তা শক্তির ইলেকট্রিক ইম্পাল্‌সই একটা গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে মাধ্যাকর্ষণ সাপ্লাই দিচ্ছে, সহজ ভাষায় তাকে ধারণ করছে। জীবন শক্তি দুর্ঘটনা নয় প্রফেসর, সময়ের বাঁধনে ব্রহ্মাণ্ড বিভিন্ন স্তরে দাঁড়িয়ে আছে।
-           থামো অনিন্দ্য। প্লীজ। ধর্ম, বিজ্ঞান সমস্ত কিছু...
-           কিছুই তো মিথ্যে নয় প্রফেসর...সমস্তই সেই অমোঘ সত্যের কথাই বলে আসছে। আমার চিন্তা শক্তি গ্র্যাভিটি হয়ে আমারই মগজে ব্রহ্মাণ্ডদের লালন করছে। ঠিক যেমন আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের মাধ্যাকর্ষণ আসলে আর কিছুই নয়, এক অতিকায় মগজের চিন্তা শক্তি মাত্র। আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ড তার চিন্তা শক্তির ইন্ধনে চালিত হচ্ছে। তার মনের ভিতরের সুখ দুঃখের প্রবাহের ইলেকট্রিক ইম্পালস গ্র্যাভিটি হয়ে আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের তারা গ্রহদের ধরে রেখেছে।
-           মানে আমাদের অস্তিত্ব টিকে আছে অন্যের মগজে...
-           হ্যাঁ প্রফেসরআমাদের পরমাত্মা সে বা তারা বা প্রত্যেকে। আমার ঈশ্বর আপনি ও আমার ঈশ্বর আপনি। তার বা তাদের মগজের সেই পরমাণুটির আয়ুর সঙ্গেই আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের আয়ু জড়িয়ে। আর আমরা অবিনশ্বর প্রফেসর। আমরা সর্বত্র, সমস্ত স্তরে রয়েছি। মনে রাখবেন সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডই কিন্তু এক। এই যে সমুদ্রের ঢেউ আমাদের পায়ে ঝাপটা মেরে যাচ্ছে প্রফেসর, সেই ঢেউগুলো আর কিছুই নয়, সে ঈশ্বরের চিন্তা ঢেউ যা মাধ্যাকর্ষণ হয়ে আমাদের ব্রহ্মাণ্ডকে বেঁধে রেখেছে আর এই সমুদ্রে ঢেউ তুলছে।
-           আর তোমরা। অর্থাৎ অনিন্দ্যরা হচ্ছ নিরো, এক ব্রহ্মাণ্ডে থেকে অন্য ব্রহ্মাণ্ডে নিজের সমান্তরাল অস্তিত্বের খবর পাঠিয়ে চলেছ। তাই তো?
-           হ্যাঁ। ওই যে বললাম, সময়ের প্রত্যেক কণায় দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য-(এন) চেষ্টা করছে অনিন্দ্য-(এন মাইনাস ওয়ান)এর মগজে বাইনারিতে বার্তা পাঠাতে। ধরুন আমি যদি অনিন্দ্য-(জিরো) হই, তাহলে এবার আমায় উঠে পড়ে লাগতে হবে অনিন্দ্য-(মাইনাস ওয়ান)কে বার্তা পাঠানোর জন্য। অবশ্য আমার পাঠানো বার্তা অনিন্দ্য-(মাইনাস ওয়ান) আত্মস্থ করার আগেই এ দুনিয়া থেকে আমার চলে যেতে হবে, আমাদের সময়ের হিসেব যে আলাদা। কিন্তু বাইনারিতে সে মহাজাগতিক অনিন্দ্য-(মাইনাস ওয়ান)কে বার্তা পাঠাতে প্রযুক্তির তোলপাড় দরকার। সেরকম যথাযথ প্রযুক্তি আবিষ্কারে আপনার সাহায্য যে আমার ভীষণ দরকার প্রফেসর। আপনি পাশে থাকবেন না?
-           ওয়েল। দেখি। আমি যদি প্রফেসর সেন-(মাইনাস ওয়ান)কে আবিষ্কার করে একটা অন্য নিরোর দল তৈরি করতে পারি। হে! কী বলো? এবার চলো। সবাই তোমার অপেক্ষা করছে অনিন্দ্য।    

~~~~

এই পোস্টের "ইন্স্পি‌রেশন" - একটা কবিতা।

কবি- সঙ্ঘমিত্রা হালদার

কবিতার নামঃ আলো-অন্ধকার


সামান্যই পোকা যেভাবে হেঁটে যায়,
মনে হয় বলি, বড় হয়ে ওঠো
আরও বড়, তোমার মহিমা ছাড়িয়ে বড়

দেখি পোকা সেভাবেই হেঁটে যায়
এত সরল
যেন পৃথিবীতে কেউ আসেইনি কোনদিন
যেন পৃথিবীর গর্ভ হবে

যেন আমাকে আবিষ্কার করছি সে ইচ্ছের মারে

ব্রেনের সাইরেন এসে দাঁড়াচ্ছে পা ভিজিয়ে