Wednesday, May 27, 2015

খুচরো প্রেমের গল্প

তিথি দরজা খুলে দেখলে নিমু দাঁড়িয়ে। এদিকে ঘরের ভিতরে সমরের লাশ। তিথি নিমুকে জড়িয়ে ধরল।
ওদিকে নিমুর পিছনে দাঁড়িয়ে ঘাড় পছন্দ করছিল সমর।



**

থার্ড ক্লাসটা ছিল অডিটের।
দীপার নজর এড়িয়ে ওর খাতার ভাঁজে চিরকুট চালান করলে দেবু।

"তোকে লালে বেশ মানায়"।


খানিক পর দীপা সেটা দেখতে পেয়ে চিরকুটের পিছনে লিখে ফেরত পাঠালে;
"আজকেকে তো সাদা সালোয়ার, লাল দেখলি কই?"।

দেবু নতুন চিরকুট লিখলে "আমার পকেটে ছুরি, আর মনে এইটুকু ভিসুয়াল ক্ল্যারিটি থাকবে না?"।

**
প্রেমের গল্প - ৩
"আই লাভ ইউ স্যুইট হার্ট"....
এই বলে পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরলেন ভূতোবাবু।
- আমি না হয় মোটা, তাই বলে নিজের প্রেমিকাকে পাশবালিশ বলে ডাকবে গো?
- আমি না হয় ভূত, তাই বলে নিজের প্রেমিককে ভূতোবাবু বলে ডাকবে গো?


**
সাদা ফুলকে ভয় পান সমরেশ। 
ওরা রাতে ফোটে। ঠিক যেমন ভাবে মাঝরাতে সাদা থান গায়ে নীলিমা বারান্দায় আস; সেরকম ভাবেই রাতের কালচে নিস্তব্ধতায় সাদা ফুলেরা ফোটে।

সাদা ফুলেদের মতই, নীলিমাকে দেখেও ভয় পান সমরেশ। কিন্তু এর কোন মানে হয় না। 
মানুষ হয়ে ফুলকে ভয়? 
বর হয়ে বউকে ভয়? 
ভূত হয়ে মানুষকে ভয়?


**
রাতে পৌনে দু'টো। একদিকে আকাশ গুমোট করা মেঘ। অন্যদিকে মে মাসের ভ্যাপসা গরম। একটুও হাওয়া নেই।
এক প্রেমিক আর তার প্রেমিকা; গায়ে গা লাগিয়ে লেপ্টে শুয়ে ছাদে। আমি তাদের মুগ্ধ হয়ে দেখি, তাদেরই পাশে বসে।
প্রেমিকটি আমার সদ্য খুলে রাখা ডান পায়ের হাওয়াই চটি, প্রেমিকাটি বাঁ পায়ের।

**
"দেশ, বন্ধু, পরিবার, সম্মান, যশ, নিজের জীবন; সমস্ত ভাসিয়েছি। কিন্তু একবারের জন্যেও অনিচ্ছুক তুমিকে জাপটে ধরতে যাইনি।
তবু বলবে সবটাই স্পর্ধা? প্রেম নেই এতটুকু?"

নির্বাক সীতাকে পিছনে ফেলে আত্মহত্যার যুদ্ধে গেলেন রাবণ।

পঞ্চম

সোমনাথ অবাক হলে অনুপের চিঠি পেয়ে। মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে অনুপ ব্যাটা এমন গুছিয়ে হাতে লেখা চিঠি পাঠাতে গেল কেন? রোজ যেখানে ফোনে কথা হচ্ছে। “চাকরিবাকরি না থাকলে যা হয় আর কী”, সোমনাথ ভাবলে, “ব্যাটা এখন চিঠি লিখে ল্যাদ কাটাচ্ছে”। আনন্দবাজারটা সরিয়ে রাখলে সে। অদিতি ছেলেকে স্যুইমিং ক্লাস থেকে আনতে গেছে। শনিবারের এই অলস সময়টা বেশ লাগে সোমনাথের। মোবাইল স্পীকারে শ্রীকান্ত আচার্যর রিমেক গান নিরিবিলি বেজে চলেছে। পাশের টেবিলে ছুটির আধ খাওয়া ব্রেকফাস্টের প্লেট- লুচি, আলুভাজা আর সন্দেশ। উইকেন্ডের এই সময়ে ইজিচেয়ারটা জাস্ট মায়াবী ভঙ্গিমায় জড়িয়ে থাকে সোমনাথকে। ড্রাইভার কমলেশ চিঠিটা দিতে ভেতরে এসেছিল; সোমনাথের ভাষায় এটা এক প্রকারের ট্রান্স-ভঙ্গ। চিঠিটা খুলে পড়ার আগে সোমনাথ ভাবল অনুপকে ফোন করে সামান্য গাল ঝাড়বে, চিঠি লেখার মত প্রাগৈতিহাসিক একটা কাজ করে ফেলার জন্য। একটা ফোন করলে কি দোষ ছিল?

অনুপের ফোনটা সুইচ্‌ড অফ।

চিঠিটা পেয়ে যে নেহাত খারাপ লাগছিল তা নয়, আজকাল চিঠি ক’টা লোকে পায়। খামটা খোলার আগে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘরের এয়ার কন্ডিশনারটা চালিয়ে দিল সোমনাথ। ইজিচেয়ারে ফেরত এসে খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বার করলে। ভালো কোয়ালিটির মোটা কাগজে লেখা চিঠি, ভাজ করা।
চিঠিটা ভাজ খুলে মেলে ধরলে সোমনাথ।

“সোম,
শোন। এর আর কোন মানে হয় না জানিস। মানে এমন জীবনের। চাকরি নেই। বউ কেমন নির্দয় ভাবে ডিভোর্স দিয়ে কেটে পড়লে।পৈতৃক বাড়ি ছিল, তাই মাথায় ছাদ আছে। তবে সে ছাদের ফুটো মেরামতের পয়সা নেই। আর ছাদ মেরামত! ডাল ভাত জুটছে না। তোদের থেকে চেয়ে-চিন্তে আর কতদিন। আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন যাই বলিস; তা তো তোরা চারজনই। সেই কলেজের সময় থেকে। আমার কত ঘ্যানঘ্যান সহ্য করে এসেছিস তোরা। তবে আর কতদিনই বা সহ্য করবি।
তোদের সবার কেরিয়ার গ্রাফ এখন তুঙ্গে, এক মাত্রই আমি রয়ে গেলাম এ ফেইল্‌ড কেমিস্ট অ্যান্ড আ ফেইল্‌ড হাসব্যান্ড। সবাই একসঙ্গে জড় হলে আমি যে কী ভীষণ অড ওয়ান আউট হয়ে পড়ি; তোদেরও হয়তো অস্বস্তিতে ফেলে দিই।  
ইন ফ্যাক্ট তোদের সাথে যোগাযোগ ছাড়া কী করে সারভাইভ করবো; সেটা ভাবতেও যেমন চিন্তা হয়- তেমনি তোদের সাথে দেখা করতেও ভয় হয় রে। তোদের জগতটা বড় দূরের হয়ে গেছে রে আমার পৃথিবীর থেকে। ইন ফ্যাক্ট, আমার বারবার মনে হয় আমি হয়তো তোদের এমব্যারাস করে ফেলি আমার ছিঁচকাঁদুনী দিয়ে।
তাই বলছিলাম, এর আর মানে হয় না। তুই, বিপিন, নীলয় আর অভীক; তোদের আমি যে কতটা ভালোবাসি সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। সেই সেকেন্ড ইয়ার থেকে। তবু তোদের থেকে আমায় দূরে যেতে হবেই রে।
তোদের থেকে দূরে চললাম। প্লীজ রাগ করিস না। মৃত্যুর আগের শেষ চিঠি, তাই আর ভ্যানতারা বাড়ালাম না।

ভালো থাকিস।
ইতি
অনুপ”

সোমনাথের মাথাটা বনবন করে ঘুরছিল, শরীরে একটা চাপা অস্বস্তি। অনুপ কি পাগল হয়ে গেল? বিপিনকে ফোন করার জন্য মোবাইলটার দিকে হাত বাড়ালে সে; কিন্তু তার হাত যেন অসাড় হয়ে আসছিল। অনুপ সুইসাইড করতে যাচ্ছে? তাই দু’দিন ধরে ওর কোন খবর নেই? তাই এখন ওর ফোন সুইচ্‌ড অফ
?
**
ভোর তিনটেয় অ্যালার্ম দিয়েছিল অনুপ। ঘুম থেকে উঠে সবার আগে দাড়ি কামিয়ে নিলে। গতকালই একটা নতুন আফটার শেভ এনেছিল; এটা একটা বাড়াবাড়ি রকমের শৌখিনতার কাজ বলা যেতে পারে; তবে আজ আর কিছুই এসে যায় না। পরনের লুঙ্গিটা ছেড়ে একটা হাফ প্যান্ট পরে খানিকটা ফ্রি হ্যান্ড করে নিল সে। সামান্য ঘাম ঝরাটা মনের জন্য ভালো। সোমনাথ, বিপিন, নীলয়, অভীকরা আজকে তার চিঠিটা পাবে, ব্যবস্থাটা সেভাবেই করা। বিগ্‌ ডে। স্নান বাথরুমের কাজ সেরে এসে একটা সুতির পাঞ্জাবী গায়ে চড়াল সে, সঙ্গে পুরনো একটা জিন্‌স। উদ্ভট খেয়ালে খানিকক্ষণ গতকালের খবরের কাগজ পড়ে নিল অনুপ।  

ব্যাগ গুছিয়ে বেরোতে বেরোতে ভোর পাঁচটা হয়ে গেল অনুপের। অবশ্য, বেশি কিছু সঙ্গে নেওয়ার অবকাশ কোথায়। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে ওরা চিঠিটা পাবে। সোমনাথ সম্ভবত সবার আগে পাবে। 

এত কাছের মানুষজন ছিল ওই চারজন, দূরত্বটা অস্বাভাবিক তো ঠেকবেই। তবে তাকে তাড়াতাড়ি হারিয়ে যেতে হবে। যেতে হবেই। 

ঘটনাটার খবর পুলিশ পাবে আর ঘণ্টা চারেক পর হয়তো। সোমনাথদের লেখা চিঠির কাগজে মাখিয়ে রাখা আছে সেই বিষাক্ত কেমিক্যাল, যার স্পর্শে চামড়ায় দাবানলের মত বিষ ছড়িয়ে পড়ে; পনেরো মিনিটের মধ্যে নির্ঘাত মৃত্যু। সেই বিষাক্ত কেমিক্যাল,  যেটার পেটেন্ট নেওয়ার সাহস হয়নি এতদিন অনুপের। অনুপ জানে যে ওকে কেউ চেনেনি। বন্ধুরাই কেউ পাত্তা দেয়নি ওর ক্ষমতাকে- ভার্মা অ্যান্ড ভার্মা কেমিক্যাল্‌সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর তো কোন ছাড়। অবিশ্যি, বিষাক্ত কেমিক্যাল আবিষ্কার ওই ভার্মা অ্যান্ড ভার্মা কেমিক্যাল্‌সের ল্যাবরেটরিতেই। তার গত কুড়ি বছরের গোপন প্যাশন ছিল – বিষাক্ত কেমিক্যাল নিয়ে পড়াশোনা। দুনিয়া না জানুক, অনুপ নিজে জানে ভারতবর্ষে তার মত রসায়নবিদ খুব কমই আছে।   

বন্ধুত্বের চৌহদ্দিতে অড ওয়ান হয়ে থাকাটা যন্ত্রণার। আর বন্ধুদের করুণার স্পর্শ পাওয়া যে কী রক্তক্ষয়ী, অনুপের চেয়ে ভালো আর কে জানবে? কিছু একটা করতেই হত। আত্মহত্যা ব্যাপারটা অনুপের কাছে ঘৃণ্য মনে হয়। তাই ওই চারজনকেই দূরে ঠেলে দিতে হল। ট্যাক্সিতে উঠে পিঠের ব্যাকপ্যাকের চেন খুলে নাইরোবির টিকিট আর পাসপোর্টটা আরেকবার দেখে নিল অনুপ।   

Monday, May 25, 2015

অনিলের রাত


রাত জাগার অভ্যেসটা অনিলের এখন বেশ কাজে লাগছে। রাতভর না ঘুমিয়ে নিঝুম কলকাতা জুড়ে টইটই করতে পারার সুযোগটা তার কাছে স্বপ্নের মত। এই লাগামছাড়া জীবনটাই তো সে চেয়েছিল চিরকাল। 

রাত দশটা বাজলেই "খোকা এবার ঘুমোতে যা" বলে মায়ের ঠ্যালা; একদমই ভালো লাগতো না অনিলের। মা ঘুমিয়ে পড়লে সে চুপিচুপি ছাদে উঠে যেত মাদুর বগলদাবা করে। রাতের আকাশের দিকে চেয়ে রাত কাটাতে ভারী ভালো লাগতো তার।

দিনভর আলস্যে কাটিয়ে রাতভর টহল দেওয়ার জীবনটাই কাম্য ছিল তার। এবং শেষ পর্যন্ত সে জীবন তার জুটলো জীবনের অন্য দিকে। অন্ধকার নামলে এখন তার আড়মোড়া ভাঙা।  মায়ের নজর এড়িয়ে আর তাকে রাত্রিবেলা ছাতে উঠে যেতে হয় না; এখন সে নিভৃতে ছাদে নেমে আসে অন্ধকার গভীর হলে।

মাতাল ট্রাক ড্রাইভারটাকে "ধন্যবাদ" বলতে মন চায় অনিলের; সেই দিনটার জন্য। কিন্তু সে উপায় আর কই?

ছবির ক্রেডিট : শ্বেতা 

Tuesday, May 19, 2015

ব্যথার কথা

-আপনিই ডক্টর ভগবান দাস?
-আজ্ঞে হ্যাঁ। বলুন।
-আমি দৈনিক দিবাকর থেকে আসছি। আমি সাংবাদিক। অনুমান রায়।
-ওহ। আপনিই ফোন করেছিলেন গতকাল।
-হ্যাঁ। আমিই করেছিলাম ফোন।
-ভেতরে আসুন। ইয়ে...ড্রয়িং রুমে বসে তাহলে কাজ নেই। আপনি তো আমার সেই মডেল দেখতে এসেছেন। তাই তো?
-হ্যাঁ।
-তাহলে সোজা চলুন ল্যাবরেটরিতে যাই।

**
-এটাই আপনার ল্যাবরেটরি ডক্টর দাস?
-হুঁ। সাবধানে আসবেন প্লীজ। এত ঘুপচি ঘরটা। দিনের বেলাতেও অন্ধকার। বাতিটাও পাল্টানোর সময় এসেছে।
-আরও সফিস্টিকেটেড একটা সেটআপ এক্সপেক্ট করেছিলাম কিন্তু
-ব্যবস্থাপনার অবিশ্যি ঘাটতি নেই এখানে। তবে কী মিস্টার রায়সৃষ্টি ব্যাপারটাই একান্তই হৃদয় দিয়ে হওয়া দরকার। টেকনোলজি দিয়ে গতি পরিবর্তন সম্ভবদিগন্ত পরিবর্তন নয়। এদিকে আসুন। এই টেবিলটার দিকে। আপনার পায়ের কাছে অনেকগুলো শিশি বোতল পড়ে আছে। সাবধানে আসবেন।
-এইটে আপনার মডেল?
-হ্যাঁএই কাঁচের বাক্সে যে কালো ধোঁয়াশা মত দেখতে পারছেন। সেটাই আমার মডেল।
-না মানে ঠিক বুঝলাম না। আমাদেরই এই ব্রহ্মাণ্ডের মতই একটা সমার্থক দুনিয়া আপনি তৈরি করতে চলেছেন তাই তো? খালি সাইজে বহু গুণ ছোট।
-বহু বহু বহু গুণ ছোট। কতটা ছোট সেটা সংখ্যায় বোঝাতে গেলে আপনাকে হোঁচট খেতে হবে। আপনার পাঠকরাও ঠাহর করতে পারবেন না। আর এই মডেলটা কে বুঝতে আপনাকে এইখানে একটা চোখ রাখতে হবে। এটা মাইক্রোস্কোপ যেটা এই মডেলটাকে সবিস্তারে দেখতে ও বুঝতে সাহায্য করে।  
-এইখানে চোখ রাখবো কী?
-হ্যাঁ। দাঁড়ান। ফোকাসটা একটু অ্যাডজাস্ট করে দিই। দেখতে পারছেন অনুমানবাবু?
-হ্যাঁ। এবারে স্পষ্ট। ওই যে। ওই তারাদের ক্লাস্টারগুলো...
-বিভিন্ন গ্যালাক্সি। জুম করলে সুপারনোভা-টোভা ব্যাপারগুলো স্পষ্ট হবে।
-অর্থাৎ অবিকল আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের মডেল। তাই তো
-তফাৎ সামান্য আছে। সেটা পরে বলছি। ওই যে ফ্যাকাসে নীল রঙের গ্যালাক্সিটা দেখছেন...
-ওটাই আমাদেরটা গ্যালাক্সিটাতাই না?
-ঠিক। অবিকল ওরকমই। শুধু বহু সহস্র কোটি গুণ ছোট। ওইটেয় জুম ইন করুন এবার। জুম ইন জুম আউটের বোতামটা ডানদিকে পাবেন। হ্যাঁ। ওইটা। এবার জুম ইন করুন অনুমানবাবু।
-সৌরমণ্ডলটা?
-দেড় হাজার পারসেন্ট জুম করুনসব চেয়ে ভালো ভিউ পাবেন। এবার আমি রিমোটে আপনার মাইক্রোস্কোপের ভিউ নিয়ে গিয়ে ফেলছি সোলার সিস্টেমের ওপর।
-আরিব্বাস। দুরন্ত। সূর্য...আর এই যে সমস্ত গ্রহ। নীল দানাটাই তো...
-পৃথিবী। আরও খানিক জুম ইন করুন।
-সেনসেশনাল ডক্টর দাস। অবিকল। ফিজিক্সের নিয়মগুলো...
-আমাদের দুনিয়ায় যেমনএখানেও একই রকম। অবভিয়াসলি গ্র্যাভিটি একই ভাবে রয়েছে। অবিকল।
-আচ্ছাডক্টর দাসওখানে কী...
-কী অনুমানবাবু...
-না মানে ওই আপনার মডেল পৃথিবীতে কী...
-এটা একটা জবরদস্ত ভাবে ওয়ার্কিং মডেল অনুমানবাবু। মডেলটা তৈরি করা পর্যন্ত আমার সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ভূমিকা ছিল। এখন আর নেই।এই মডেল পৃথিবীতে ইভোলিউশন নিজস্ব গতিতেই শুরু হয়েছে।
-অপূর্ব স্যার। এ বছরের বিশ্বের সেরা বৈজ্ঞানিকের শিরোপা যে আপনার পকেটেই যাচ্ছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। আচ্ছাআপনার এই মডেলের পৃথিবীতে কী আমাদের মত মানুষরা অলরেডি...
-আসেনি। আসবে। ইন ফ্যাক্ট আমার এই মডেল পৃথিবী ইভোলিউশন আর প্রযুক্তির দিক থেকে আমাদেরও ছাড়িয়ে যাবে তুরন্ত।
-সেটা কী করে হবে মিস্টার দাস?
-দেখুন। টাইম ডাইমেনসনে এই মডেল একটু স্বতন্ত্র আমাদের দুনিয়ার থেকে। আমাদের মোটামুটি তিরিশ সেকেন্ড মানে ওই মডেল পৃথিবীর এক বছর।
-বলেন কী।
-হুঁ। এবং এর মানে কী জানেন অনুমানবাবু? ওখানে ইভোলিউশনের গতি আমাদের চেয়ে অনেক বেশী দ্রুত। স্বাভাবিক ভাবেই ওখানে মানুষ ও সভ্যতা একবার দানা বাঁধলে প্রযুক্তিগত প্রগতিও ঘটবে আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে। অর্থাৎ হয়ত আজ থেকে বছর দশেক পর থেকে এই মডেলকে পর্যবেক্ষণ করে আমরা প্রযুক্তিগত শিক্ষাও নিতে পারব কারণ ততদিনে আমার সৃষ্টি মডেল পৃথিবীর মানুষরা আমাদের চেয়েও অনেক বেশি এগিয়ে যাবে।
-রুদ্ধশ্বাস ব্যাপার ডক্টর। আচ্ছা আপনি বলছিলেন সামান্য তফাৎ থাকবে এই আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে এই মডেল পৃথিবীর। সেটা কিরকম?
-তফাৎ কিছুই থাকার কথা ছিল না। তবে তফাৎটা আমি ইঞ্জেক্ট করব। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে সেটুকু অধিকার আমার আছে আশা করি। 
-কী রকম?
-আচ্ছা অনুমানবাবু। আমাদের দুনিয়ার এ জীবনকে আপনার বড্ড বেশি ইউসুয়াল মনে হয় না। এক গতে বাঁধা? সক্কলের নির্দিষ্ট জীবন। নির্দিষ্ট ভাবে বেঁচে থাকা। সক্কলের এক। আপনার আমার সবার এক। সকলের একে অপরের প্রতি অনুভূতি একই রকম সৌহার্দ্যপূর্ণভীষণ পানসে লাগে না?
-সেটাই তো আইডিয়াল ডক্টর।
-আমরা সেভাবেই কন্ডিশন্‌ড। তাই তেমন লাগে। আমরা ব্যথা পাই না...
-অফ কোর্স পাই। চোট আঘাত...
-চোট আঘাতের ব্যথার কথা বলছি না...হৃদয়ের ব্যথা? হার্টের প্রবলেম?
-হৃদয়ের ব্যথা? করোনারি থ্রম্বোসিস গোছের কিছু কী?
-ফিজিক্যালি ব্যাপারটা ভাববেন না অনুমানবাবু। মনের কথা ভাবুন। মনের ব্যথা।
-মনের ব্যথা? যেটার সঙ্গে শারীরিক কোন বেদনা জড়িতে নেই?
-মনের ব্যথা নিয়ে আমি যথেষ্ট রিসার্চ করেছি একসময়। টেবিলের কোনে রাখা ওই বেগুনী রঙের শিশিটা দেখতে পারছেন? ওতে যে সলিউশনটা আছেসেটা জিভের ডগায় ঠেকালেই আমাদের ক্রোমোজোমে একটা তীব্র পরিবর্তন ঘটবেতাতে আমাদের মনঅর্থাৎ মগজের একটা অংশ শারীরিক অনুভূতির বাইরে যে সব ব্যথাতাদের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠবে।
-শারীরিক আঘাতের বাইরের ব্যথা? সেটা কীরকম?
-এই ধরুন আপনার জীবনসঙ্গিনী যদি আপনাকে ছেড়ে চলে যায়। আপনার কষ্ট হবে?
-জীবনসঙ্গিনী চলে গেলে তো আর আমার শরীরে কোন চোট লাগবে না। জীবনযাত্রা পালটে যাবেসেটা অ্যাডজাস্ট করতে সময় লাগবে। কিন্তু চোট কেন লাগবে? কেউ আমার সঙ্গে থাকতে না চাইলে থাকবে না। এতে খারাপ কী আছে।
-প্রিসাইসলি। আমরা কেউ বুঝতে পারি না যে মানসিক চোট ব্যাপারটা কী। কিন্তু আমার তৈরি পৃথিবীর লোকেরা সেটা বুঝবে। যেমন আমি বুঝি।
-আপনি বোঝেন?
-হ্যাঁ। ওই সলিউশন আমি নিজের ওপর টেস্ট করেছি। কেউ আমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করলে আমার এখন মনে ব্যথা লাগে অনুমানবাবু।
-শারীরিক চোট ছাড়া ব্যথা ডক্টর?
-হ্যাঁ। ব্যথা লাগে হৃদয়ে। মনঃকষ্ট।
-আমার কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে ডক্টর।
-অন্যের ভালো দেখলে আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠেসেটাও অদ্ভুত একটা ব্যথামনে হয় আমারও যদি অমনটি ভালো হত। কোন কাজের প্রতিদান না পেলেবুকের ভিতর কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে আমার অনুমানবাবু। কখনো কারোর সঙ্গ না পেয়ে মনের ভীতর ককিয়ে ব্যথা আসে।
-অনুভূতিটা ঠিক কেমন?
-আপনি চেষ্টা করলেও বুঝতে পারবেন না কারণ আপনার ডি-এন-এ সেই ভাবে প্রস্তুত নয়
-কিন্তু শুনে মনে হচ্ছে যে অনুভূতিটা খুব একটা আনন্দের নয়।
-আনন্দকে অত সহজে মেপে নেবেন না অনুমানবাবু। হৃদয়ের ব্যথা বোঝবার পর থেকেই আমার সামনে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য যে সে অনুভূতি বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার একটিও সঙ্গী এ পৃথিবীতে নেই। মনের ব্যথাকে কাল্টিভেট করে আমি সঙ্গীতের রস আবিষ্কার করেছি। কবিতার ছন্দ হাতড়ে পেয়েছি।
-সঙ্গীত? কবিতাডক্টর দাস আমায় মাফ করবেন। এ শব্দগুলো আমি কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। মনের ব্যথার মাধ্যমে আপনি এগুলো আবিষ্কার করেছেনএগুলো কীএকটু বুঝিয়ে বলতে পারবেন?
-অনুমানবাবুযে হৃদয় ব্যথায় চুবনি খায়নিযে মন দুঃখ কপচায়নিতাকে সঙ্গীত কবিতার মর্ম বোঝানো অসম্ভব। শুধু জেনে রাখুন এ অনুভূতিগুলো অপার্থিব এবং আমাদের এই সাদা কালো গ্রহে এদের কথা কেউ জানবে না। কিন্তু আমার সৃষ্ট পৃথিবীতে মানুষ গান গাইবে অনুমানবাবুকবিতা লিখবে।
-হাউ? কী ভাবে?
-মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ের ইভোলিউশনের স্তর পেরিয়ে এলেসুপার ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে পৃথিবীর কিছু আপেল গাছের ফলে আমি আমার ওই বেগুনী শিশির সলিউশন মিশিয়ে দেব। আর সেই আপেল কয়েকজন মানুষ খেলেই তাঁদের ডি-এন-এতে কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়ে তাঁদের অন্তরে হৃদয়-ব্যথার রসের সঞ্চার হবে। এ ব্যাপারটা আগামী মাসের প্রথম হপ্তাতেই ঘটে যাবে বলে আশা করছি। আমার এই মডেল পৃথিবীর মানুষ স্রেফ খেয়ে দেয়ে প্রযুক্তি ঘেঁটে মারা যাবে না অনুমানবাবু। তারা গান গাইবেকবিতার ছন্দে ভেসে যাবে। হয়তো হৃদয়ের ভুল ইমোশনে তাড়িত হয়ে তারা প্রচুর ভুল করবে। অকারণে যুদ্ধ করবে,নিজেরাই নিজেদের টুঁটি টিপে ধরবে বোকার মত। কিন্তু তবু তার মাঝেই সে স্বরলিপি বাঁধবেসে ছবি আঁকবে। প্রেমে ধাক্কা খেয়ে অদ্ভুত সব ছন্দে পদ্য কষবে। আমার এই পৃথিবী অনেক বেশী রঙিন হবে অনুমানবাবু।
-ডক্টরআপনি যা যা বললেনতা হয়তো এ দুনিয়ায় কারোর মগজেই সহজ-গ্রাহ্য হবে না। আপনাকে আরও প্রশ্নে জড়িয়ে আর আমাদের লাভ নেই। শেষ প্রশ্নএকটা অন্য স্তরেএকটা অন্য জগতে যেটা কিনা আপনার হাতেই তৈরিসেখানে মানুষের নতুন করে যাত্রা শুরু হতে চলেছে। আর একভাবে ভাবলে আপনিই তাঁদের ঈশ্বর। কেমন লাগছে?
-থ্রিলিং। থ্রিলিং। মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠছি। আর আমার চোখের সামনে নব-মানবসভ্যতা দুদ্দাড় গতিতে মডেল পৃথিবীতে বেড়ে উঠবেভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে অনুমানবাবু। ইয়ে,আমি এতটাই এক্সাইটেড যে মডেল পৃথিবীতে প্রথম যে পূর্ণ-বিকশিত মানুষ আমার নজরে আসবে তার একটা নামও ঠিক করে রেখেছি আমি।
-নাম? কী নাম?
-সে যদি ছেলে হয় তার নাম দেব অ্যাডাম। মেয়ে হলে নাম দেব ইভ। কেমনজমবে না?

Friday, May 8, 2015

সলমানি

– জেল হয়েছে। পাঁচ বছর। জব্বর জাস্টিস। কী বলেন ফেলুবাবু?
– লাল মোহনে ভালো, মগনে নয়।তেমনই জাস্টিস ব্যাপারটা জেলে ভালো, সেলেব-প্যারোলে নয়। দ্যাখা যাক।
-খুড়ো, ফুটপাথে শুয়ে থাকাটা অন্যায়; তাই না?
– আলবৎ! হাতে দামী গাড়ির স্টিয়ারিং আর পেটে দামী স্কচ থাকলে বুঝতিস ন্যাপলা; ফুটপাথে হিউমান স্পীড ব্রেকার কি বিরক্তিকর।
– এমন ম্যাদা মেরে আছেন কেন মশাই?
– মিরাকিউরল ফেল মেরে গেল অবিনাশবাবু।
– সেই আজব বড়ি? কেন?
– মিরাকিউরল মারণ রোগ সারাতে পারে। কিন্তু চেষ্টা করে দেখলাম; মাতালের ফুটপাথ প্রেম আর অন্ধ ভক্তের উন্মাদ ভক্তি ঘোচাতে পারে না।
গাড়ী?
রাস্তায় চালাবো?
নেক্সট ইজ হোয়াট?
জামায় বোতাম আঁটবো?
‘নায়ক’ সিনেমায় মদ্যপ অরিন্দম বলেছিলেনঃ “আই উইল গো টু দ্য টপ। টু দ্য টপ। টু দ্য টপ”।
**
কয়েক পেগে ভেসে তিনি বললেনঃ “আই উইল গো টু দ্য ফুটপাথ। টু দ্য ফুটপাথ। টু দ্য ফুটপাথ।”
“তুমি জানো এমন দামী স্কচ দুনিয়ায় খুব বেশি নেই?”, মলসন খানের পা টলছিল, কিন্তু কথা থামছিল না,”তুমি জানো এর দু’ফোঁটা পাথরে পড়লে পাথরে প্রাণ সঞ্চার হয়? জানো কি”
এত রাত্রে রাস্তায় মলসনের কথা শোনার জন্য কেউ ছিলেন না। তবু মলসন বলে যাচ্ছিলেন; তার বলতে ভালো লাগছিলো। লোকের ভিড়ে কথা বলতে তার এতটা ভালো লাগে না, বলার সুযোগটুকুও পান না।
মলসনের মাথাটা এতটাই ঝিমঝিম করছিল যে সোজা চুমুক দিয়েছিলেন বোতলে। হঠাৎ কি খেয়াল হল বোতল থেকে কয়েক ফোঁটা ছড়িয়ে দিলেন ফুটপাথে। আচমকা মনে হল যেন ফুটপাথটা নড়ে উঠলো। কেঁপে উঠলেন মলসন। মনে হল আজ বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে বোতল হাতে।
বোতলটা মলসন ছুঁড়ে ফেলার আগে ফুটপাথটা কারপেটের মত ভেসে উঠলে, মলসন তখন টলমলে। ফুটপাথের কারপেটটা তারপর ঝটাপট ভাঁজ হয়ে একটা পুঁটুলি হয়ে গেল। পুঁটুলির ভেতরে মলসনের দম বন্ধ হয়ে আসছিল; নিজের উন্মত্ত ক্লস্ট্রোফোবিয়াকে গাল পাড়তে ইচ্ছে হল তার। ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে পড়ছিলেন মলসন; মনে হল পরনের জামাটাকে খুলে ফেলা দরকার। তখনই মলসন টের পেলেন, তার পরনে জামা তো নেই; কখনও থাকেনা। সানগ্লাস আর সাজানো বাইসেপ-ট্রাইসেপগুলো খুলতে পারলেন না মলসন; জ্ঞান হারাবার আগে শুধু নিজের চুলটা আঙুল চালিয়ে ঠিক করে নিলেন তিনি।

Tuesday, May 5, 2015

বাড়ি

মঙ্গলবার, বেলা এগারোটা।

-আসুন অমুবাবু। আসুন। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।  
-আপনার অফিসটার কিন্তু বেশ দুরবস্থা আগরওয়াল সাহেব।
-আমার দাদুর বাবা নাইনটিন হান্ড্রেড অ্যান্ড সেভেনে বড়বাজারের এই অফিসটা নেন। তখনও মোহনবাগান শিল্ড জেতেনি।
-কলকাতার ফুটবলের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে যদি নিজের অফিসের রক্ষণাবেক্ষণ করতে চান, তাহলে বলতেই হয় নিখুঁত কন্ডিশনে আছে।
-অমুবাবু, আপনি অ্যাকাডেমিক্‌সের লোক। প্রফেসর মানুষ। আপনার কাছে এ অফিস ঘুপচি লাগতে পারে। কিন্তু আমাদের ডিল স্ট্রাইক করার জন্য এমন পরিবেশে কোন অসুবিধে হয় না। পার্ক স্ট্রিটে রেস্তরাঁতে খেতে যান ঠিক আছে, কিন্তু রিয়েল এস্টেট এজেন্টের জন্য আপনাকে কষ্ট করে এই বড়বাজারে ঘুপচিতে আসতেই হবে। হে:, আর শুধু রিয়েল এস্টেট কেন, এখানে কোন দালালিটা হয় না বলুন ।
-যাক। কাজের কথায় আসুন।
-আরে কাজ টাজ হবে। আগে বলুন কী নেবেন। চা কফি কোক্‌ এনিথিং। স্পেশ্যাল দার্জিলিং টি আছে বুঝলেন...।
-কফি। ব্ল্যাক।
-হরিশ। এক ব্ল্যাক কফি আউর এক নিম্বু পানি ভিজওয়া দো। তুরন্ত। আর বলুন অমুবাবু, খবর কী।
-বাড়িটা বিক্রি আমি করবো না আগরওয়ালজী।
-হুম। মুস্কিল এইটা অমুবাবু, যে বাড়িটাকে আমার বায়না করা হয়ে গেছে। আপনার দাদা অভিবাবুকে আমি গুনে গুনে আড়াই কোটি অ্যাডভান্স দিয়েছি।
-পুরো বাড়ি নয়, বাড়িটার তিন ভাগের দু’ভাগের জন্য আপনি বায়না করেছেন। অ্যাডভান্সটা দিয়েছেন দাদাকে। একভাগ এখনও আমার নামেই আছে, বেচবো কি না সেটা...।
-গ্রাউন্ড ফ্লোর আর দুই তলা আপনার দাদার। সেটা উনি বেচে দিচ্ছেন। মাঝের ফ্লোরটার অবস্থা এমনিতেই খারাপ কারণ আপনি মেইন্টেনেন্সে কোনদিন মন দেননি অমুবাবু। আপনার বাবা আমার লইয়ার ছিলেন, আপনি আমার ছেলের বয়েসি। আপনার এই জেদকে সহ্য করে আমি আপনাকে ফাইভ পারসেন্ট বেশি রেট অফার করেছি। প্লাস বালিগঞ্জের মত জায়গায় একটা দু'হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। আর ইউ আউট অফ ইওর মাইন্ড মিস্টার অমু? আপনার দাদা আপনার ওপর কত বিরক্ত জানেন?
-জানি।
-সো?
-সো কিছুই না আগরওয়ালবাবু। বাড়িটা বিক্রি করা যাবে না।
-অমুবাবু। আমি শান্ত ভদ্র মানুষ। গুণ্ডা পোষা এজেন্ট আমি নই। কিন্তু আপনি জেনে রাখুন ওই বাড়ির পিছনে আমার অনেক খরচ হয়েছে। আপনার দাদা আমায় কমিট করেছেন পুরোটা। আপনিও না বলেননি। অনেক প্ল্যান করে আমায় ওখানে ইনভেস্ট করতে হয়েছে। আর এখন বেগরা দিচ্ছেন? এটা প্লেন ধান্দাবাজি অমুবাবু।
-আমি না বলার প্রশ্ন আসছে কেন। আমি কী আপনাকে আমার শেয়ার বেচবো বলে হ্যাঁ করেছিলাম?
-শুনুন অমুবাবু। উইথ অল ডিউ রেসপেক্ট। ওই বাড়ির দোতলা আমার, গ্রাউন্ডফ্লোর আমার। একতলায় যাতে আপনি টিকতে না পারেন সে ব্যবস্থা আমি এক সপ্তাহের মধ্যে করে ফেলতে পারি।
-এই যে বললেন আপনার পোষা গুণ্ডা নেই?
-গুণ্ডা নিয়ে চুনোপুঁটিরা ব্যবসা করে অমুবাবু। উই হ্যাভ বেটার টেকনিক্‌স।
-বুঝলাম। কিন্তু সে টেকনিক কি ভূতের সাথে খাটাতে পারবেন আগরওয়ালজী?
-হোয়াট ননসেন্স।
-ও বাড়ির একতলা বেচা বারণ। ভূতের বারণ।
-আপনি কী আমার সাথে অসভ্যতা করতে এসেছেন অমুবাবু?
-না। মোদ্দা কথাটা জানিয়ে দিতে এসেছি। ও বাড়ি বেচা যাবেনা, আমি বেচলে আমার অমঙ্গল। আর আপনিও পার পাবেন না।
-কার ভূত অমুবাবু?
-আপনি তাকে ভালো মত চিনতেন ভালো করে। আফটার অল পাঁচ বছর আগে মারা যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত তিনি আপনাদের উকিল ছিলেন।
-আপনার বাবা বিপিনবাবুর ভূত মানা করেছে ও বাড়ি বিক্রি করতে?
-এগজ্যাক্টলি।
-আপনাকে ইচ্ছে করছে...।
-মারতে ইচ্ছে করছে?
-অমুবাবু, প্লীজ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না।
-আমি সিরিয়াস আগরওয়ালবাবু। আমার বাবা, মানে বাবার ভূত এতটাই সিরিয়াস যে সে আমায় ফলো করে এসেছে।
-হোয়াট আটার নন-সেন্স ইজ দিস অমুবাবু...।
-পিছনের জানলার দিকে তাকান আগরওয়াল সাহেব। তাকিয়ে দেখুন..।
-  ও...বিপিনবাবু্‌?...ও...ও...ও...আ...আ...আ...আ..ভূ...আ...আ...সেভ মি অমুবাবু...আ...আ...আ...!!!


শুক্রবার, সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা

- অমু আপনাকে কী এক মন গড়া ভুতের কাহিনী বললো আর সেটা আপনি বিশ্বাস করে নিলেন আগরওয়ালজী?
- ওই ভূত আমি নিজের চোখে দেখেছি অভিবাবু। আমার চেয়ারের পিছনের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আপনার বাবা।
- আমার বাবা আজ থেকে পাঁচ বছর আগেই মারা গেছেন মিস্টার আগরওয়াল।আমি আজ পর্যন্ত বাবাকে একবারের জন্য স্বপ্নেও দেখলাম না। ওদিকে ওই অমু একটা পাগল, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই সে বলে চলেছে যে বাবার আত্মা নাকি ওর সাথে থাকে। কিন্তু ও বরাবরই ক্ষ্যাপার দলে; এসব অসুস্থতা ওর সাজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনি? ছিঃ। ভূতের ভয়ে আপনি বলছেন আপনি এ বাড়ি কিনবেন না?
- আমি নিজের চোখে দেখেছি অভিবাবু। ফর নট লেস দ্যান সিক্সটি সেকেন্ড্‌স। উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার অফিসে, সেই উকিলের পোশাক, সেই চশমা, সেই ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। শুধু মুখের হাসিটা হাড়-হিম করা। আমি তিন দিন নার্সিং হোমে কাটিয়েছি। দু’ঘণ্টা আগে জাস্ট নার্সিং হোম থেকে বের হয়েছি। সেখান থেকে সোজা আপনার কাছে এলাম। 
- মাই গড!
- ইট্‌স ট্রু। আপনি বিশ্বাস করবেন কী না সেটা আপনার ব্যাপার। তবে শুনে রাখুন এ বাড়ি আমি নেব না। আর ভূতের খবরটা বাজারে ভালোই রটেছে। অন্য কেউ নেবে বলেও মনে হয় না।
- যত পাগলের কারবার। অমু নিজেও ডুবতই, এবার মনে হচ্ছে আমায় নিয়ে ডুববে। আগরওয়ালজী প্লীজ, আমি রিকুয়েস্ট করছি, আপনি না হয় টেন পারসেন্ট কম দেবেন...।
- আই অ্যাম সরি অভিবাবু। ও বাড়ি আমি নিতে পারবো না।
- তবে আপনি আগাম দেওয়া টাকাটাও আর ফেরত পাচ্ছেন না কিন্তু। সে’রকমই কথা ছিল? মনে আছে তো?
- আমি সোজা কথার মানুষ। বায়নার আড়াই কোটি বড় লোকসান হবে আমার। তবে বিশ কোটি দিয়ে ভূতুড়ে বাড়ি কিনতে আমি পারবো না।
- এটা পাগলামো আগরওয়ালবাবু।
- অভিবাবু, আমি আজ আসি ।


শুক্রবার, সন্ধ্যে সাতটা

- কাজটা ঠিক হল রে দাদা?
- খুব বেশি ভাবছিস  তুই অভি।
- না মানে...আড়াই কোটি টাকার পরিমাণটা কম নয়। সেটা ঠকিয়ে নেওয়া...।
- ব্যবসার অবস্থা তো বুঝতে পারছিস। টাকাটার আমাদের দরকার ছিল রে। আর আগরওয়ালের কাছে আড়াই কোটি নস্যি। চিন্তা করিস না। 
- বাবার মেকআপটা ভালোই নিয়েছিলি। অবিশ্যি চেহারাটা তুই এমনিতেও বাবার মতই পেয়েছিস। তবু বলতেই হবে ফ্রেঞ্চ কাটটা নিখুঁত হয়েছিল।
- থিয়েটারের শখটা এতদিনে কাজে এলো বল অমু।
- কিন্তু দাদা, তুই ঠিক সময়ে ওর জানালার বেয়ে উঠে এলি কী করে।
- পাইপ বেয়ে ওঠাটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছিল। ধরা পড়ার ভয় ছিল। তবে ভয় কেটে যায় হরিশ হাতে চলে আসায়।
- হরিশ?
- আগরওয়ালের অফিসে তোকে কফি এনে দিলে যে। পিওন কাম প্যান্ট্রি বয়। ওকে হাত করতে হয়েছিল। এক লাখ খরচ হয়েছে সেখানে।
- বলিস কী! আমি তো কিছুই জানতাম না। 
- তোকে এত কিছু বলে তোর মাথাটা গুলিয়ে দিতে চাইনি রে অমু। তো এই হরিশ একটা মই রেখে দিয়েছিল জানালার নিচেই। উঠে আসতে অসুবিধে হয়নি।
- আগরওয়ালের দাঁত কপাটি লেগে সে একাকার কাণ্ড। আমি ভাবলাম বুঝি ওখানেই না হার্ট অ্যাটাক করে উলটে পড়ে।
- যাক। তেমন কিছু হয়নি। বেচারি হসপিটাল থেকে রিলিজ হয়েই সোজা এখানে চলে এসেছে বাড়িটা নেবে না জানাতে। ভাব। কী সাঙ্ঘাতিক ট্রমা!
- তাই ভাবছিলাম। ঠিক করলাম কী না কাজটা।
- ওসব চিন্তা ছাড় এখন। আড়াই কোটি টাকা একটা বড় ব্যাপার। একটু নিশ্চিন্তে হাত পা ছড়িয়ে বসতে দে দেখি। ওই দেখ। কলিং বেল আবার। দেখ তো অমু কে এলো।

শুক্রবার, সন্ধ্যে সাতটা বেজে পনেরো মিনিট

অমু – দাদা, আগরওয়ালবাবু এসেছেন আবার!
অভি – আরে আগরওয়ালবাবু, এত জলদি ফেরত এলেন। মোবাইল টোবাইল কিছু ফেলে গেছেন নাকি? নাকি পাগলামি ছেড়ে বাড়িটা আবার কিনতে মনস্থ করেছেন?
আগরওয়াল – হে:, না না অভিবাবু। কিছু ফেলে যাইনি। আর এই বাড়িটাও আর কেনার কথা ভাবছি না। একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। সেটাই বলতে এলাম। আমার ভূত দেখাটাকেই তো পাগলামি বলছেন, তাই না অভিবাবু?
অভি – অফ কোর্স। আজকালকার যুগে দাঁড়িয়ে ভূত-টুতের দোহাই দিয়ে আপনি ব্যবসা চালাচ্ছেন? 
আগরওয়াল – সরি অভিবাবু। ভূত আছে। 
অভি – আপনাকে সুস্থ দেখাচ্ছে না আগরওয়ালজী। আপনি আজ আসুন। সবে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছেন...।
আগরওয়াল – ইউ আর রাইট অভিবাবু। আমি আজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছি। তবে ঠিক সুস্থ হয়ে আর বেরনো হল না...।
অভি – সুস্থ হয়ে বেরোনো হল না মানে?
আগরওয়াল – মানে এই ঘণ্টা তিনেক আগের একটা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। হাসপাতাল থেকে জীবিত অবস্থায় বেরোতে পারলাম না।
অভি- কী ইয়ার্কি হচ্ছে আগরওয়াল, আপনি কী ভেবেছেনটা কী... এনাকে বের করে দে অমু।
আগরওয়াল – একি। আমার দু’টো হাত আপনাদের দুজনের ঘাড়ে পড়তেই আপনাদের মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে কেন? ও কী! দু’ভাই মিলে অমন জিভ বার করে লুটোপুটি খাচ্ছেন কেন...ও অভিবাবু...ও অমুবাবু...মরে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে নাকি? আমার হাতের ছোঁয়া কী খুব ঠাণ্ডা? কী ব্যাপার সোনারা? অমন করে না। অমন করে না। আজ থেকে আমরা তিন জনে এক সঙ্গে এই বাড়িতে থাকবো, কেমন?এবার শান্ত হয়ে পাশাপাশি শোও দেখি বাবুরা।