মঙ্গলবার, বেলা এগারোটা।
-আসুন অমুবাবু। আসুন। আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।
-আপনার অফিসটার কিন্তু বেশ দুরবস্থা আগরওয়াল সাহেব।
-আমার দাদুর বাবা নাইনটিন হান্ড্রেড অ্যান্ড সেভেনে বড়বাজারের এই অফিসটা নেন। তখনও মোহনবাগান শিল্ড জেতেনি।
-কলকাতার ফুটবলের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে যদি নিজের অফিসের রক্ষণাবেক্ষণ করতে চান, তাহলে বলতেই হয় নিখুঁত কন্ডিশনে আছে।
-অমুবাবু, আপনি অ্যাকাডেমিক্সের লোক। প্রফেসর মানুষ। আপনার কাছে এ অফিস ঘুপচি লাগতে পারে। কিন্তু আমাদের ডিল স্ট্রাইক করার জন্য এমন পরিবেশে কোন অসুবিধে হয় না। পার্ক স্ট্রিটে রেস্তরাঁতে খেতে যান ঠিক আছে, কিন্তু রিয়েল এস্টেট এজেন্টের জন্য আপনাকে কষ্ট করে এই বড়বাজারে ঘুপচিতে আসতেই হবে। হে:, আর শুধু রিয়েল এস্টেট কেন, এখানে কোন দালালিটা হয় না বলুন ।
-যাক। কাজের কথায় আসুন।
-আরে কাজ টাজ হবে। আগে বলুন কী নেবেন। চা কফি কোক্ এনিথিং। স্পেশ্যাল দার্জিলিং টি আছে বুঝলেন...।
-কফি। ব্ল্যাক।
-হরিশ। এক ব্ল্যাক কফি আউর এক নিম্বু পানি ভিজওয়া দো। তুরন্ত। আর বলুন অমুবাবু, খবর কী।
-বাড়িটা বিক্রি আমি করবো না আগরওয়ালজী।
-হুম। মুস্কিল এইটা অমুবাবু, যে বাড়িটাকে আমার বায়না করা হয়ে গেছে। আপনার দাদা অভিবাবুকে আমি গুনে গুনে আড়াই কোটি অ্যাডভান্স দিয়েছি।
-পুরো বাড়ি নয়, বাড়িটার তিন ভাগের দু’ভাগের জন্য আপনি বায়না করেছেন। অ্যাডভান্সটা দিয়েছেন দাদাকে। একভাগ এখনও আমার নামেই আছে, বেচবো কি না সেটা...।
-গ্রাউন্ড ফ্লোর আর দুই তলা আপনার দাদার। সেটা উনি বেচে দিচ্ছেন। মাঝের ফ্লোরটার অবস্থা এমনিতেই খারাপ কারণ আপনি মেইন্টেনেন্সে কোনদিন মন দেননি অমুবাবু। আপনার বাবা আমার লইয়ার ছিলেন, আপনি আমার ছেলের বয়েসি। আপনার এই জেদকে সহ্য করে আমি আপনাকে ফাইভ পারসেন্ট বেশি রেট অফার করেছি। প্লাস বালিগঞ্জের মত জায়গায় একটা দু'হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। আর ইউ আউট অফ ইওর মাইন্ড মিস্টার অমু? আপনার দাদা আপনার ওপর কত বিরক্ত জানেন?
-জানি।
-সো?
-সো কিছুই না আগরওয়ালবাবু। বাড়িটা বিক্রি করা যাবে না।
-অমুবাবু। আমি শান্ত ভদ্র মানুষ। গুণ্ডা পোষা এজেন্ট আমি নই। কিন্তু আপনি জেনে রাখুন ওই বাড়ির পিছনে আমার অনেক খরচ হয়েছে। আপনার দাদা আমায় কমিট করেছেন পুরোটা। আপনিও না বলেননি। অনেক প্ল্যান করে আমায় ওখানে ইনভেস্ট করতে হয়েছে। আর এখন বেগরা দিচ্ছেন? এটা প্লেন ধান্দাবাজি অমুবাবু।
-আমি না বলার প্রশ্ন আসছে কেন। আমি কী আপনাকে আমার শেয়ার বেচবো বলে হ্যাঁ করেছিলাম?
-শুনুন অমুবাবু। উইথ অল ডিউ রেসপেক্ট। ওই বাড়ির দোতলা আমার, গ্রাউন্ডফ্লোর আমার। একতলায় যাতে আপনি টিকতে না পারেন সে ব্যবস্থা আমি এক সপ্তাহের মধ্যে করে ফেলতে পারি।
-এই যে বললেন আপনার পোষা গুণ্ডা নেই?
-গুণ্ডা নিয়ে চুনোপুঁটিরা ব্যবসা করে অমুবাবু। উই হ্যাভ বেটার টেকনিক্স।
-বুঝলাম। কিন্তু সে টেকনিক কি ভূতের সাথে খাটাতে পারবেন আগরওয়ালজী?
-হোয়াট ননসেন্স।
-ও বাড়ির একতলা বেচা বারণ। ভূতের বারণ।
-আপনি কী আমার সাথে অসভ্যতা করতে এসেছেন অমুবাবু?
-না। মোদ্দা কথাটা জানিয়ে দিতে এসেছি। ও বাড়ি বেচা যাবেনা, আমি বেচলে আমার অমঙ্গল। আর আপনিও পার পাবেন না।
-কার ভূত অমুবাবু?
-আপনি তাকে ভালো মত চিনতেন ভালো করে। আফটার অল পাঁচ বছর আগে মারা যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত তিনি আপনাদের উকিল ছিলেন।
-আপনার বাবা বিপিনবাবুর ভূত মানা করেছে ও বাড়ি বিক্রি করতে?
-এগজ্যাক্টলি।
-আপনাকে ইচ্ছে করছে...।
-মারতে ইচ্ছে করছে?
-অমুবাবু, প্লীজ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না।
-আমি সিরিয়াস আগরওয়ালবাবু। আমার বাবা, মানে বাবার ভূত এতটাই সিরিয়াস যে সে আমায় ফলো করে এসেছে।
-হোয়াট আটার নন-সেন্স ইজ দিস অমুবাবু...।
-পিছনের জানলার দিকে তাকান আগরওয়াল সাহেব। তাকিয়ে দেখুন..।
- ও...বিপিনবাবু্?...ও...ও...ও...আ...আ...আ...আ..ভূ...আ...আ...সেভ মি অমুবাবু...আ...আ...আ...!!!
শুক্রবার, সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা
- অমু আপনাকে কী এক মন গড়া ভুতের কাহিনী বললো আর সেটা আপনি বিশ্বাস করে নিলেন আগরওয়ালজী?
- ওই ভূত আমি নিজের চোখে দেখেছি অভিবাবু। আমার চেয়ারের পিছনের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আপনার বাবা।
- আমার বাবা আজ থেকে পাঁচ বছর আগেই মারা গেছেন মিস্টার আগরওয়াল।আমি আজ পর্যন্ত বাবাকে একবারের জন্য স্বপ্নেও দেখলাম না। ওদিকে ওই অমু একটা পাগল, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই সে বলে চলেছে যে বাবার আত্মা নাকি ওর সাথে থাকে। কিন্তু ও বরাবরই ক্ষ্যাপার দলে; এসব অসুস্থতা ওর সাজে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনি? ছিঃ। ভূতের ভয়ে আপনি বলছেন আপনি এ বাড়ি কিনবেন না?
- আমি নিজের চোখে দেখেছি অভিবাবু। ফর নট লেস দ্যান সিক্সটি সেকেন্ড্স। উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার অফিসে, সেই উকিলের পোশাক, সেই চশমা, সেই ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। শুধু মুখের হাসিটা হাড়-হিম করা। আমি তিন দিন নার্সিং হোমে কাটিয়েছি। দু’ঘণ্টা আগে জাস্ট নার্সিং হোম থেকে বের হয়েছি। সেখান থেকে সোজা আপনার কাছে এলাম।
- মাই গড!
- ইট্স ট্রু। আপনি বিশ্বাস করবেন কী না সেটা আপনার ব্যাপার। তবে শুনে রাখুন এ বাড়ি আমি নেব না। আর ভূতের খবরটা বাজারে ভালোই রটেছে। অন্য কেউ নেবে বলেও মনে হয় না।
- যত পাগলের কারবার। অমু নিজেও ডুবতই, এবার মনে হচ্ছে আমায় নিয়ে ডুববে। আগরওয়ালজী প্লীজ, আমি রিকুয়েস্ট করছি, আপনি না হয় টেন পারসেন্ট কম দেবেন...।
- আই অ্যাম সরি অভিবাবু। ও বাড়ি আমি নিতে পারবো না।
- তবে আপনি আগাম দেওয়া টাকাটাও আর ফেরত পাচ্ছেন না কিন্তু। সে’রকমই কথা ছিল? মনে আছে তো?
- আমি সোজা কথার মানুষ। বায়নার আড়াই কোটি বড় লোকসান হবে আমার। তবে বিশ কোটি দিয়ে ভূতুড়ে বাড়ি কিনতে আমি পারবো না।
- এটা পাগলামো আগরওয়ালবাবু।
- অভিবাবু, আমি আজ আসি ।
শুক্রবার, সন্ধ্যে সাতটা
- কাজটা ঠিক হল রে দাদা?
- খুব বেশি ভাবছিস তুই অভি।
- না মানে...আড়াই কোটি টাকার পরিমাণটা কম নয়। সেটা ঠকিয়ে নেওয়া...।
- ব্যবসার অবস্থা তো বুঝতে পারছিস। টাকাটার আমাদের দরকার ছিল রে। আর আগরওয়ালের কাছে আড়াই কোটি নস্যি। চিন্তা করিস না।
- বাবার মেকআপটা ভালোই নিয়েছিলি। অবিশ্যি চেহারাটা তুই এমনিতেও বাবার মতই পেয়েছিস। তবু বলতেই হবে ফ্রেঞ্চ কাটটা নিখুঁত হয়েছিল।
- থিয়েটারের শখটা এতদিনে কাজে এলো বল অমু।
- কিন্তু দাদা, তুই ঠিক সময়ে ওর জানালার বেয়ে উঠে এলি কী করে।
- পাইপ বেয়ে ওঠাটা রিস্কি হয়ে যাচ্ছিল। ধরা পড়ার ভয় ছিল। তবে ভয় কেটে যায় হরিশ হাতে চলে আসায়।
- হরিশ?
- আগরওয়ালের অফিসে তোকে কফি এনে দিলে যে। পিওন কাম প্যান্ট্রি বয়। ওকে হাত করতে হয়েছিল। এক লাখ খরচ হয়েছে সেখানে।
- বলিস কী! আমি তো কিছুই জানতাম না।
- তোকে এত কিছু বলে তোর মাথাটা গুলিয়ে দিতে চাইনি রে অমু। তো এই হরিশ একটা মই রেখে দিয়েছিল জানালার নিচেই। উঠে আসতে অসুবিধে হয়নি।
- আগরওয়ালের দাঁত কপাটি লেগে সে একাকার কাণ্ড। আমি ভাবলাম বুঝি ওখানেই না হার্ট অ্যাটাক করে উলটে পড়ে।
- যাক। তেমন কিছু হয়নি। বেচারি হসপিটাল থেকে রিলিজ হয়েই সোজা এখানে চলে এসেছে বাড়িটা নেবে না জানাতে। ভাব। কী সাঙ্ঘাতিক ট্রমা!
- তাই ভাবছিলাম। ঠিক করলাম কী না কাজটা।
- ওসব চিন্তা ছাড় এখন। আড়াই কোটি টাকা একটা বড় ব্যাপার। একটু নিশ্চিন্তে হাত পা ছড়িয়ে বসতে দে দেখি। ওই দেখ। কলিং বেল আবার। দেখ তো অমু কে এলো।
শুক্রবার, সন্ধ্যে সাতটা বেজে পনেরো মিনিট
অমু – দাদা, আগরওয়ালবাবু এসেছেন আবার!
অভি – আরে আগরওয়ালবাবু, এত জলদি ফেরত এলেন। মোবাইল টোবাইল কিছু ফেলে গেছেন নাকি? নাকি পাগলামি ছেড়ে বাড়িটা আবার কিনতে মনস্থ করেছেন?
আগরওয়াল – হে:, না না অভিবাবু। কিছু ফেলে যাইনি। আর এই বাড়িটাও আর কেনার কথা ভাবছি না। একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম। সেটাই বলতে এলাম। আমার ভূত দেখাটাকেই তো পাগলামি বলছেন, তাই না অভিবাবু?
অভি – অফ কোর্স। আজকালকার যুগে দাঁড়িয়ে ভূত-টুতের দোহাই দিয়ে আপনি ব্যবসা চালাচ্ছেন?
আগরওয়াল – সরি অভিবাবু। ভূত আছে।
অভি – আপনাকে সুস্থ দেখাচ্ছে না আগরওয়ালজী। আপনি আজ আসুন। সবে হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছেন...।
আগরওয়াল – ইউ আর রাইট অভিবাবু। আমি আজ হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছি। তবে ঠিক সুস্থ হয়ে আর বেরনো হল না...।
অভি – সুস্থ হয়ে বেরোনো হল না মানে?
আগরওয়াল – মানে এই ঘণ্টা তিনেক আগের একটা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। হাসপাতাল থেকে জীবিত অবস্থায় বেরোতে পারলাম না।
অভি- কী ইয়ার্কি হচ্ছে আগরওয়াল, আপনি কী ভেবেছেনটা কী... এনাকে বের করে দে অমু।
আগরওয়াল – একি। আমার দু’টো হাত আপনাদের দুজনের ঘাড়ে পড়তেই আপনাদের মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে কেন? ও কী! দু’ভাই মিলে অমন জিভ বার করে লুটোপুটি খাচ্ছেন কেন...ও অভিবাবু...ও অমুবাবু...মরে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে নাকি? আমার হাতের ছোঁয়া কী খুব ঠাণ্ডা? কী ব্যাপার সোনারা? অমন করে না। অমন করে না। আজ থেকে আমরা তিন জনে এক সঙ্গে এই বাড়িতে থাকবো, কেমন?এবার শান্ত হয়ে পাশাপাশি শোও দেখি বাবুরা।