-আপনিই ডক্টর ভগবান দাস?
-আজ্ঞে হ্যাঁ। বলুন।
-আমি দৈনিক দিবাকর থেকে আসছি। আমি সাংবাদিক। অনুমান রায়।
-ওহ। আপনিই ফোন করেছিলেন গতকাল।
-হ্যাঁ। আমিই করেছিলাম ফোন।
-ভেতরে আসুন। ইয়ে...ড্রয়িং রুমে বসে তাহলে কাজ নেই। আপনি তো আমার সেই মডেল দেখতে এসেছেন। তাই তো?
-হ্যাঁ।
-তাহলে সোজা চলুন ল্যাবরেটরিতে যাই।
**
-এটাই আপনার ল্যাবরেটরি ডক্টর দাস?
-হুঁ। সাবধানে আসবেন প্লীজ। এত ঘুপচি ঘরটা। দিনের বেলাতেও অন্ধকার। বাতিটাও পাল্টানোর সময় এসেছে।
-আরও সফিস্টিকেটেড একটা সেটআপ এক্সপেক্ট করেছিলাম কিন্তু।
-ব্যবস্থাপনার অবিশ্যি ঘাটতি নেই এখানে। তবে কী মিস্টার রায়, সৃষ্টি ব্যাপারটাই একান্তই হৃদয় দিয়ে হওয়া দরকার। টেকনোলজি দিয়ে গতি পরিবর্তন সম্ভব, দিগন্ত পরিবর্তন নয়। এদিকে আসুন। এই টেবিলটার দিকে। আপনার পায়ের কাছে অনেকগুলো শিশি বোতল পড়ে আছে। সাবধানে আসবেন।
-এইটে আপনার মডেল?
-হ্যাঁ, এই কাঁচের বাক্সে যে কালো ধোঁয়াশা মত দেখতে পারছেন। সেটাই আমার মডেল।
-না মানে ঠিক বুঝলাম না। আমাদেরই এই ব্রহ্মাণ্ডের মতই একটা সমার্থক দুনিয়া আপনি তৈরি করতে চলেছেন তাই তো? খালি সাইজে বহু গুণ ছোট।
-বহু বহু বহু গুণ ছোট। কতটা ছোট সেটা সংখ্যায় বোঝাতে গেলে আপনাকে হোঁচট খেতে হবে। আপনার পাঠকরাও ঠাহর করতে পারবেন না। আর এই মডেলটা কে বুঝতে আপনাকে এইখানে একটা চোখ রাখতে হবে। এটা মাইক্রোস্কোপ যেটা এই মডেলটাকে সবিস্তারে দেখতে ও বুঝতে সাহায্য করে।
-এইখানে চোখ রাখবো কী?
-হ্যাঁ। দাঁড়ান। ফোকাসটা একটু অ্যাডজাস্ট করে দিই। দেখতে পারছেন অনুমানবাবু?
-হ্যাঁ। এবারে স্পষ্ট। ওই যে। ওই তারাদের ক্লাস্টারগুলো...
-বিভিন্ন গ্যালাক্সি। জুম করলে সুপারনোভা-টোভা ব্যাপারগুলো স্পষ্ট হবে।
-অর্থাৎ অবিকল আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের মডেল। তাই তো।
-তফাৎ সামান্য আছে। সেটা পরে বলছি। ওই যে ফ্যাকাসে নীল রঙের গ্যালাক্সিটা দেখছেন...
-ওটাই আমাদেরটা গ্যালাক্সিটা, তাই না?
-ঠিক। অবিকল ওরকমই। শুধু বহু সহস্র কোটি গুণ ছোট। ওইটেয় জুম ইন করুন এবার। জুম ইন জুম আউটের বোতামটা ডানদিকে পাবেন। হ্যাঁ। ওইটা। এবার জুম ইন করুন অনুমানবাবু।
-সৌরমণ্ডলটা?
-দেড় হাজার পারসেন্ট জুম করুন, সব চেয়ে ভালো ভিউ পাবেন। এবার আমি রিমোটে আপনার মাইক্রোস্কোপের ভিউ নিয়ে গিয়ে ফেলছি সোলার সিস্টেমের ওপর।
-আরিব্বাস। দুরন্ত। সূর্য...আর এই যে সমস্ত গ্রহ। নীল দানাটাই তো...
-পৃথিবী। আরও খানিক জুম ইন করুন।
-সেনসেশনাল ডক্টর দাস। অবিকল। ফিজিক্সের নিয়মগুলো...
-আমাদের দুনিয়ায় যেমন, এখানেও একই রকম। অবভিয়াসলি গ্র্যাভিটি একই ভাবে রয়েছে। অবিকল।
-আচ্ছা, ডক্টর দাস, ওখানে কী...
-কী অনুমানবাবু...
-না মানে ওই আপনার মডেল পৃথিবীতে কী...
-এটা একটা জবরদস্ত ভাবে ওয়ার্কিং মডেল অনুমানবাবু। মডেলটা তৈরি করা পর্যন্ত আমার সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ভূমিকা ছিল। এখন আর নেই।এই মডেল পৃথিবীতে ইভোলিউশন নিজস্ব গতিতেই শুরু হয়েছে।
-অপূর্ব স্যার। এ বছরের বিশ্বের সেরা বৈজ্ঞানিকের শিরোপা যে আপনার পকেটেই যাচ্ছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। আচ্ছা, আপনার এই মডেলের পৃথিবীতে কী আমাদের মত মানুষরা অলরেডি...
-আসেনি। আসবে। ইন ফ্যাক্ট আমার এই মডেল পৃথিবী ইভোলিউশন আর প্রযুক্তির দিক থেকে আমাদেরও ছাড়িয়ে যাবে তুরন্ত।
-সেটা কী করে হবে মিস্টার দাস?
-দেখুন। টাইম ডাইমেনসনে এই মডেল একটু স্বতন্ত্র আমাদের দুনিয়ার থেকে। আমাদের মোটামুটি তিরিশ সেকেন্ড মানে ওই মডেল পৃথিবীর এক বছর।
-বলেন কী।
-হুঁ। এবং এর মানে কী জানেন অনুমানবাবু? ওখানে ইভোলিউশনের গতি আমাদের চেয়ে অনেক বেশী দ্রুত। স্বাভাবিক ভাবেই ওখানে মানুষ ও সভ্যতা একবার দানা বাঁধলে প্রযুক্তিগত প্রগতিও ঘটবে আমাদের চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে। অর্থাৎ হয়ত আজ থেকে বছর দশেক পর থেকে এই মডেলকে পর্যবেক্ষণ করে আমরা প্রযুক্তিগত শিক্ষাও নিতে পারব কারণ ততদিনে আমার সৃষ্টি মডেল পৃথিবীর মানুষরা আমাদের চেয়েও অনেক বেশি এগিয়ে যাবে।
-রুদ্ধশ্বাস ব্যাপার ডক্টর। আচ্ছা আপনি বলছিলেন সামান্য তফাৎ থাকবে এই আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে এই মডেল পৃথিবীর। সেটা কিরকম?
-তফাৎ কিছুই থাকার কথা ছিল না। তবে তফাৎটা আমি ইঞ্জেক্ট করব। সৃষ্টিকর্তা হিসেবে সেটুকু অধিকার আমার আছে আশা করি।
-কী রকম?
-আচ্ছা অনুমানবাবু। আমাদের দুনিয়ার এ জীবনকে আপনার বড্ড বেশি ইউসুয়াল মনে হয় না। এক গতে বাঁধা? সক্কলের নির্দিষ্ট জীবন। নির্দিষ্ট ভাবে বেঁচে থাকা। সক্কলের এক। আপনার আমার সবার এক। সকলের একে অপরের প্রতি অনুভূতি একই রকম সৌহার্দ্যপূর্ণ।ভীষণ পানসে লাগে না?
-সেটাই তো আইডিয়াল ডক্টর।
-আমরা সেভাবেই কন্ডিশন্ড। তাই তেমন লাগে। আমরা ব্যথা পাই না...
-অফ কোর্স পাই। চোট আঘাত...
-চোট আঘাতের ব্যথার কথা বলছি না...হৃদয়ের ব্যথা? হার্টের প্রবলেম?
-হৃদয়ের ব্যথা? করোনারি থ্রম্বোসিস গোছের কিছু কী?
-ফিজিক্যালি ব্যাপারটা ভাববেন না অনুমানবাবু। মনের কথা ভাবুন। মনের ব্যথা।
-মনের ব্যথা? যেটার সঙ্গে শারীরিক কোন বেদনা জড়িতে নেই?
-মনের ব্যথা নিয়ে আমি যথেষ্ট রিসার্চ করেছি একসময়। টেবিলের কোনে রাখা ওই বেগুনী রঙের শিশিটা দেখতে পারছেন? ওতে যে সলিউশনটা আছে, সেটা জিভের ডগায় ঠেকালেই আমাদের ক্রোমোজোমে একটা তীব্র পরিবর্তন ঘটবে, তাতে আমাদের মন, অর্থাৎ মগজের একটা অংশ শারীরিক অনুভূতির বাইরে যে সব ব্যথা, তাদের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠবে।
-শারীরিক আঘাতের বাইরের ব্যথা? সেটা কীরকম?
-এই ধরুন আপনার জীবনসঙ্গিনী যদি আপনাকে ছেড়ে চলে যায়। আপনার কষ্ট হবে?
-জীবনসঙ্গিনী চলে গেলে তো আর আমার শরীরে কোন চোট লাগবে না। জীবনযাত্রা পালটে যাবে, সেটা অ্যাডজাস্ট করতে সময় লাগবে। কিন্তু চোট কেন লাগবে? কেউ আমার সঙ্গে থাকতে না চাইলে থাকবে না। এতে খারাপ কী আছে।
-প্রিসাইসলি। আমরা কেউ বুঝতে পারি না যে মানসিক চোট ব্যাপারটা কী। কিন্তু আমার তৈরি পৃথিবীর লোকেরা সেটা বুঝবে। যেমন আমি বুঝি।
-আপনি বোঝেন?
-হ্যাঁ। ওই সলিউশন আমি নিজের ওপর টেস্ট করেছি। কেউ আমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করলে আমার এখন মনে ব্যথা লাগে অনুমানবাবু।
-শারীরিক চোট ছাড়া ব্যথা ডক্টর?
-হ্যাঁ। ব্যথা লাগে হৃদয়ে। মনঃকষ্ট।
-আমার কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে ডক্টর।
-অন্যের ভালো দেখলে আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে, সেটাও অদ্ভুত একটা ব্যথা।মনে হয় আমারও যদি অমনটি ভালো হত। কোন কাজের প্রতিদান না পেলে, বুকের ভিতর কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে আমার অনুমানবাবু। কখনো কারোর সঙ্গ না পেয়ে মনের ভীতর ককিয়ে ব্যথা আসে।
-অনুভূতিটা ঠিক কেমন?
-আপনি চেষ্টা করলেও বুঝতে পারবেন না কারণ আপনার ডি-এন-এ সেই ভাবে প্রস্তুত নয়।
-কিন্তু শুনে মনে হচ্ছে যে অনুভূতিটা খুব একটা আনন্দের নয়।
-আনন্দকে অত সহজে মেপে নেবেন না অনুমানবাবু। হৃদয়ের ব্যথা বোঝবার পর থেকেই আমার সামনে নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য যে সে অনুভূতি বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার একটিও সঙ্গী এ পৃথিবীতে নেই। মনের ব্যথাকে কাল্টিভেট করে আমি সঙ্গীতের রস আবিষ্কার করেছি। কবিতার ছন্দ হাতড়ে পেয়েছি।
-সঙ্গীত? কবিতা? ডক্টর দাস আমায় মাফ করবেন। এ শব্দগুলো আমি কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। মনের ব্যথার মাধ্যমে আপনি এগুলো আবিষ্কার করেছেন? এগুলো কী? একটু বুঝিয়ে বলতে পারবেন?
-অনুমানবাবু, যে হৃদয় ব্যথায় চুবনি খায়নি, যে মন দুঃখ কপচায়নি; তাকে সঙ্গীত কবিতার মর্ম বোঝানো অসম্ভব। শুধু জেনে রাখুন এ অনুভূতিগুলো অপার্থিব এবং আমাদের এই সাদা কালো গ্রহে এদের কথা কেউ জানবে না। কিন্তু আমার সৃষ্ট পৃথিবীতে মানুষ গান গাইবে অনুমানবাবু, কবিতা লিখবে।
-হাউ? কী ভাবে?
-মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ের ইভোলিউশনের স্তর পেরিয়ে এলে, সুপার ন্যানো টেকনোলজির সাহায্যে পৃথিবীর কিছু আপেল গাছের ফলে আমি আমার ওই বেগুনী শিশির সলিউশন মিশিয়ে দেব। আর সেই আপেল কয়েকজন মানুষ খেলেই তাঁদের ডি-এন-এ’তে কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়ে তাঁদের অন্তরে হৃদয়-ব্যথার রসের সঞ্চার হবে। এ ব্যাপারটা আগামী মাসের প্রথম হপ্তাতেই ঘটে যাবে বলে আশা করছি। আমার এই মডেল পৃথিবীর মানুষ স্রেফ খেয়ে দেয়ে প্রযুক্তি ঘেঁটে মারা যাবে না অনুমানবাবু। তারা গান গাইবে, কবিতার ছন্দে ভেসে যাবে। হয়তো হৃদয়ের ভুল ইমোশনে তাড়িত হয়ে তারা প্রচুর ভুল করবে। অকারণে যুদ্ধ করবে,নিজেরাই নিজেদের টুঁটি টিপে ধরবে বোকার মত। কিন্তু তবু তার মাঝেই সে স্বরলিপি বাঁধবে, সে ছবি আঁকবে। প্রেমে ধাক্কা খেয়ে অদ্ভুত সব ছন্দে পদ্য কষবে। আমার এই পৃথিবী অনেক বেশী রঙিন হবে অনুমানবাবু।
-ডক্টর, আপনি যা যা বললেন, তা হয়তো এ দুনিয়ায় কারোর মগজেই সহজ-গ্রাহ্য হবে না। আপনাকে আরও প্রশ্নে জড়িয়ে আর আমাদের লাভ নেই। শেষ প্রশ্ন, একটা অন্য স্তরে, একটা অন্য জগতে যেটা কিনা আপনার হাতেই তৈরি, সেখানে মানুষের নতুন করে যাত্রা শুরু হতে চলেছে। আর একভাবে ভাবলে আপনিই তাঁদের ঈশ্বর। কেমন লাগছে?
-থ্রিলিং। থ্রিলিং। মাঝে মাঝে লাফিয়ে উঠছি। আর আমার চোখের সামনে নব-মানবসভ্যতা দুদ্দাড় গতিতে মডেল পৃথিবীতে বেড়ে উঠবে, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে অনুমানবাবু। ইয়ে,আমি এতটাই এক্সাইটেড যে মডেল পৃথিবীতে প্রথম যে পূর্ণ-বিকশিত মানুষ আমার নজরে আসবে তার একটা নামও ঠিক করে রেখেছি আমি।
-নাম? কী নাম?
-সে যদি ছেলে হয় তার নাম দেব অ্যাডাম। মেয়ে হলে নাম দেব ইভ। কেমন, জমবে না?
2 comments:
বাহ, বাহ। ভালো লাগল খুব
কী সাঙ্ঘাতিক কল্পনা, মশাই! রীতিমতো গায়ে কাঁটাটাটা দিয়ে একাকার কান্ড ঘটে গেল!
Post a Comment