- তুমি অঙ্কে কেমন ছিলে গো? কেমন একটা হুট্ করে প্রেম করে ফেললাম ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে। আমার
ভারী ইচ্ছে ছিল কিন্তু, যে আমার বর অঙ্কে চাবুক হবে।
- অঙ্কে অতি ধুরন্ধর আমি।
- মাধ্যমিকে কত?
- সাতচল্লিশ।
- ধুস্। এই ভালো তুমি অঙ্কে?
- মার্ক্স দিয়ে অঙ্কের জ্ঞান মাপিস তুই?
- ঠিক তা নয়। তবে তাই বলে মাধ্যমিকে সাতচল্লিশ?
- সিট পড়েছিল গ্রামের দিকের একটা হাইস্কুলে। তিন তলায়, জানলার পাশে। জানালার ওপারে গঙ্গা। একটা
পেল্লায় নিম গাছ। লাল শান বাঁধানো ঘাট।স্ট্যাটিসটিকালি আমার প্রফিট ছিল জানালার
ওপারে কন্সেন্ট্রেট করায়।
- প্রফিট?
- হৃদয়ের পুষ্টি। অমন তিরিতিরে কালচে গভীর নদী। অমন দুপুরের
মিহি হাওয়া। সেদিকে নজর না দিয়ে এক মনে ফুলস্কেপ পাতায় জ্যামিতি করে যাব? সেটা একটা স্ট্যাটিসটিকাল ব্লান্ডার হত না?
- যতসব গাঁজাখুরি। প্রফিট না ছাই। অঙ্কে তুমি কাঁচা ছিলে সে
আমি বেশ বুঝেছি। অঙ্কে ভালো হলে হায়ার-সেকেন্ডারিতে সায়েন্স নিয়ে পড়তে। তারপর
জয়েন্ট আইআইটি। এদ্দিনে বড় কোন সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে।
বিয়ের পর আমি থাকতাম মেলবোর্নে। ফেসবুকে ঝকঝকে সব ফটো আপলোড করতাম।
- এই তো মুস্কিল বাঙালিদের নিয়ে। এগ্জ্যামে নম্বর আর থ্যাবড়া
চাকরির বাইরে ভাবতেই পারে না। পরীক্ষার খাতায় ফর্মুলা উগড়ে অঙ্ক করে গান্ডেপিন্ডে নম্বর বাগানো; তারপর ধ্যাপস চাকরি। তাহলেই
কেউ অঙ্কে ভালো হয়ে যায় নাকি? এদিকে আমি ক্যামন ক্যালকুলেট
করে অঙ্কের হিসেবে জীবনটাকে সাজিয়ে নিচ্ছি বল দেখি?
- বটে? তুমি জীবনকে অঙ্কের হিসেবে
সাজিয়ে নিচ্ছ?
- আলবাত। উইথ ম্যাথেম্যাটিকাল প্রিসিশন্।
- বোঝাও।
- তুই বুঝবি না।
- তুমি বুঝে যদি গালভরা গপ্প ঝাড়তে পারো তাহলে আমিও পারবো।
তুমিও লিটারেচার, আমিও।
- ভুলে যাস না তুই স্টুডেন্ট আমি টিচার।
- প্রাইভেট টিউটর। আর প্রেমিক। প্রেমিক নিজের জীবন কী ভাবে
গুছিয়ে নিচ্ছে সেটা প্রেমিকা জানবে না তা কী করে হয়? এবার শুনি কী ভাবে তুমি অঙ্কের সাহায্য নিয়ে লাইফ ম্যানেজ করছ।
- ফিবোনাচি সিকুয়েন্স শুনেছিস?
- সেটা কী?
- নম্বরের সিকুয়েন্স। যেখানে প্রতিটি তৃতীয় সংখ্যা সিকুয়েন্সের
আগের দু’টো সংখ্যার যোগফল। যেমন শূন্য আর এক জুড়ে এক। এক আর এক জুড়ে দুই। এক আর দুই জুড়ে তিন। এমনি ভাবে সিকুয়েন্স
চলে শূন্য, এক, এক, দুই, তিন, পাঁচ...
- আট, তেরো...উম্...একুশ...তারপর...চৌত্রিশ...এমনি
করে?
- বাহঃ। গুড গার্ল। এবার এই সিকুয়েন্সের সংখ্যাগুলোর মাপে যদি
বর্গক্ষেত্র এঁকে চলি একের পর এক, প্রত্যেকটা
বর্গক্ষেত্র খাপে খাপ পঞ্চুর বাপ হয়ে এঁটে যাবে। আর সেই স্কোয়ারগুলোর পেটে বরাবর
সুন্দর একটা স্পাইরাল বয়ে যাবে। কী বুঝলি?
- কাঁচকলা।
- খাতাকলম দে।
- ভিক্টোরিয়ার বাগানে বসে খাতা কলম?
- তুই আমার অঙ্ক প্রেম কে ইন্সাল্ট করেছিস। অপমানিত হলে আমি
প্রেম-ট্রেম পাত্তা দিই না। খাতা দে।
- নাও।
- এই দ্যাখ। এবার বুঝলি ? ফিবোনাচির স্পাইরাল?
- কিন্তু এর সাথে তোমার জীবন সাজানোর কী সম্পর্ক?
- বুড়ি, মাথা
ঠাণ্ডা করে শুনে যা। ফিবোনাচি স্পাইরালে যা কিছু বয়ে চলে, তা
আপনা থেকেই সুন্দর হয়ে যায়।
- মানে?
- বলছি। ফিবো্নাচি সিকুয়েন্সের যে কোন পর পর দু’টো সংখ্যার
অনুপাত এক দশমিক এক ছয় আটের দিকে ধেয়ে চলে। সংখ্যা গুলো যত বাড়ে, অনুপাত তত ওয়ান পয়েন্ট সিক্স ওয়ান এইটের
দিকে এগিয়ে আসে। কারণ পারফেকশন সেখানেই। সে ভাবেই উদ্ভিদের সৌন্দর্য লিপ্সা এগিয়ে
চলে। সেভাবেই সুর্যমুখীর বুকের বীজেরা নিজেদের সাজিয়ে নেয়। সেই জন্যেই এই এক দশমিক
ছয় এক আটয়ের অনুপাত কে গোল্ডেন রেশিও বলা হয়।
- মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে গো মাধ্যমিকে সাতচল্লিশ পাওয়া
রামানুজমের খপ্পরে পড়ে।
- ইউ পেটি বেঙ্গলি। সেই মাধ্যমিক জড়িয়ে থেকে গেলি। শোন। জীবন
সাজিয়ে নেওয়ার জন্য গোল্ডেন রেশিওর চেয়ে বড় প্যারামিটার আর হতে পারে না।
- বেশ। তো তুমি এই গোল্ডেন প্যারামিটারে নিজের জীবন অঙ্কের
নিখুঁত প্যাটার্নে সাজিয়ে নিচ্ছ, তাই তো?
- এগজ্যাক্ট্লি।
- কিন্তু কী করে?
- আমার জন্মদিন কবে?
- তেইশে নভেম্বর।
- স্যুইট, এই যে
তোর সিলি ব্যাপারগুলো মনে রাখার দিকে ঝোঁক। এবার তারিখটা ভালো করে ভাব। নভেম্বর
তেইশ। নভেম্বর এগারো নম্বর মাস। তেইশ তারিখ।
- নভেম্বর এগারো, তারিখ তেইশ। এক, এক, দুই,
তিন। ফিবোনাচি!
- এই জন্যেই তোকে এত ভালোবাসি রে বুড়ি। থেকে থেকে তোর মাথাটা চাবুকের
মত খেলে যায়। ইন ফ্যাক্ট নভেম্বর তেইশকে ফিবো্নাচি ডে সেই জন্যেই বলা হয়। সেই যে
সিকুয়েন্সে শুরু করেছি, সেটাকেই খেলিয়ে যাচ্ছি। লক্ষ
গোল্ডেন রেশিওতে থাকা। তাই নিজের অঙ্কের ঝালটা দুনিয়াকে টের পেতে দিলাম না।
- তুমি পার বটে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কথা বলতে।
- আদৌ না। সবটাই অ্যানালিসিসের কঠিন জমিতে দাঁড়িয়ে বলা। তোরা
পাড়ায় এলি যখন আমি ক্লাস নাইনে।
- আমি সবে সেভেন।
- করেক্ট। তখন থেকেই আমার তোকে ভালো লাগতো বুড়ি। প্রেম-ট্রেম
রিয়ালাইজ করিনি। তবে ভালো লাগতো। পরে অবশ্য বুঝেছি ভালো লাগার চোরা কারণটা।
- কী কারণ গো?
- ওই যে। ফাইবোনচি। গোল্ডেন রেশিও।
- সে কী! কী ভাবে?
- তোর জন্মদিন কবে?
- এগারোই ফেব্রুয়ারি। দাঁড়াও দাঁড়াও। এগারো। মানে এক এক, ফেব্রুয়ারী মানে দুই। এক এক দুই। ফিবোনাচি!
হে হে! এসব ঢপ তুমি এইমাত্র ভেবে ভেবে দিচ্ছ বল? নিজেকে
অঙ্কে বীরপুরুষ বলে প্রমাণ করতে?
- কর তুই অবিশ্বাস। আচ্ছা, তোদের বাড়ির অ্যাড্রেসটা?
- পঞ্চান্ন নম্বর নিধুরাম মল্লিক লেন।
- হুম। বাড়ির সংখ্যা উননব্বইয়ের এ। পঞ্চান্ন আর উননব্বুই।
গোল্ডেন রেশিওতে আছে। ফাইবোনচি শুন্য, এক থেকে শুরু হলে যথাক্রমে সিকুয়েন্সের দশ আর এগারো নম্বর সংখ্যা হবে পঞ্চান্ন
আর উননব্বুই। এরপরও বলছিস তুই আমি গোল্ডেন স্পাইরালে নেই?
- বাপ রে বাপ। তোমার মাথায় অঙ্ক আছে কী না জানি না, ছিঁট তো আছেই।
- শোন বুড়ি। সেই থেকে তোকে ভালো লাগত। আর এদিকে তোর পুলিশ
বাপের ভয়ে কাছে ঘেঁষার সাহস হত না। তখন থেকেই ভেবেছিলাম, তোর কাছে আসার এক মাত্র রাস্তা হচ্ছে তোকে
টিউশানি পড়ানো।
- কী ধান্দাবাজ ছেলে গো তুমি।
- ধান্দাটাও অঙ্ক মেপে করি। আমি যদি অঙ্কে গাদাগাদা নম্বর
নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে কোডিং করতাম, তাহলে কী আর তোকে লিটারেচার পড়াতে আসতে পারতাম? এমন
ভিক্টোরিয়ার বসে প্রেম করতে পারতাম?
- পয়েন্ট। বুঝলাম। যে তুমি আমার প্রেমে নিজের দাপুটে
ইঞ্জিনিয়ারিং কেরিয়ার জলে ভাসিয়েছ।
- প্রিসাইস্লি বুড়ি। ইট্স ট্রু।
- আরো আছে?
- কী?
- এই ফিবোনাচি স্পাইরাল। আমাদের মধ্যে?
- প্রপোজ তো ফিবনচি মেনে এমন দিনে করেছি যে তোর না বলার উপায়ই
ছিল না। গোল্ডেন রেশিওর গুণেই তুই চট করে আমার মত একটা এলেবেলের প্রেমে পড়ে গেলি।
- ফিবো্নাচি মেনে প্রপোজ করেছিলে?
- আলবাত। ডেট্টা মনে কর।
- তুমি আমায় প্রপোজ করেছিলে মিনিবাসে। কানে ফিস্ফিস্ করে।
পাঁচই অগস্ট।
- বছরটা মনে কর।
- দু’হাজার তেরোতে।
- রাইট। পাঁচই অগস্ট তেরো শালের। পাঁচ আট তেরো।
- ফিবোনাচি!!! এবার তোমার গাঁজাখুরিতেও হাততালি দিতে ইচ্ছে
করছে।
- সে তুই যাই ভাব। ফিবো্নাচি স্পাইরালে ভালোবাসছি রে। স্বর্গ
তৈরি করছি। শুধু একটা জায়গায় স্পাইরালটা এসে আটকে আছে।
- কোথায়?
- চুমুতে।
- চুমুতে ফিবোনাচি?
- দেখ বুড়ি। আজ পর্যন্ত আমি দু’শো বত্রিশটা চুমু ইনিশিয়েট
করেছি। তুই একশো চুয়াল্লিশটা। টোটাল তিনশো ছিয়াত্তর। অর্থাৎ ট্যালি হচ্ছে টু
থার্টি টু, হান্ড্রেড ফর্টিফোর, থ্রি হান্ড্রেড সেভেন্টি সিক্স।
- উঃ ম্যাগো। এসব হিসেব রাখো নাকি তুমি?
- সাধে কী আর তোকে আমার পকেট নোটবুক দেখতে দিই না?
- ছিঃ, এসব কেউ হিসেব রাখে? যাক্। আর তাছাড়া এই নম্বরে তো ফাইবোনচি নেই। তাহলে বলছো কেন।
- সেদিন মনে আছে তোকে বলেছিলাম পৃথিবীর সেরা চুমুটা তোর জন্য
অপেক্ষা করে আছে? তুই চাস না, সেই সেরা চুমুটা?
- এই, ওসব কথা থাক। লজ্জার ব্যাপার।
কী বলতে যে কী বলে দিই আমি। তাছাড়া সেরা চুমুটা এতদিন দাওনি কেন যদি দেওয়ার
ক্ষমতাই ছিলই তো?
- দিইনি। ফিবো্নাচি মুহূর্তের অপেক্ষা করছিলাম।
- মানে?
- মানে আমি আর একটা চুমু ইনিশিয়েট করলে চুমু ট্যালি দাঁড়াবে;
তুই একশো চুয়াল্লিশ, আমি দু’শো তেত্রিশ, টোট্যাল তিনশো সাতাত্তর। পারফেক্ট ফিবোনাচি সিকুয়েন্সে। গোল্ডেন রেশিওতে
মাখামাখি বুড়ি। এখন না বলিস না।
- তাই বলে ভিক্টোরিয়ার বাগানে? ছিঃ! একদম না। পরে কোনদিন বাড়িতে...।
- বুড়ি। লগ্ন বয়ে যাবে যে।
- ফিবো্নাচি চুমুর লগ্ন?
- এখন চারটে সতেরো। এক মিনিটের মাথায় চারটে আঠেরো বাজবে রে।
সিক্সটিন হান্ড্রেড এইটিন হাওয়ার্স। এক ছয় এক আটের মুহূর্ত। গোল্ডেন রেশিয়োও অর্থাৎ
এক দশমিক ছয় এক আটের মুহূর্ত। গোল্ডেন রেশিওকে পায়ে ঠেলিস না বুড়ি।
- বিকেল চারটে আঠেরো তো কালকেও বাজবে গো।
- কিন্তু বুড়ি। আজ যদি তুই সোনার মুহূর্ত পায়ে ঠেলিস, কাল যদি সোনা বিট্রে করে? সিকুয়েন্স বিগড়ে যায়?
- হায় ভগবান, সামান্য
একটা চুমুর জন্য তুমি এত হিসেব কষে গুল দিয়ে গেলে?
- চুমু সামান্য নয়। ভিক্টোরিয়ার বাগানে চুমু রেখে যাওয়াটা
একটা পবিত্র ট্র্যাডিশন। আর প্রেম, অঙ্ক আর কবিতা সামান্য গুলে গুলজারের দাবী রাখে বইকি। চারটে আঠেরো বুড়ি।
- পাগল কোথাকার!