"একটা আট", কণ্ডাক্টরের দিকে দশটাকার নোটটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন অনিল মুন্সী।
অফিস ফেরতা বাসে জানালার সিট বড় একটা পাওয়া যায় না। আজ পয়লা জানুয়ারী বলে হয়ত এতটা ফাঁকা। পার্ক স্ট্রিটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ ঝলমল নজরে পড়ল।
আজ বোধ হয় শীত একটু কম। হাফ সোয়েটারে দিব্যি চলে যাচ্ছে। এমনকি বাসের জানলার কাঁচের ফাঁক দিয়ে আসা সামান্য ফুরফুরে সন্ধ্যের হাওয়াটাও মন্দ লাগছিল না অনিলবাবুর। বাসে না থাকলে একটা সিগারেট ধরান যেত।
কাঁধের ব্যাগ থেকে মা তারা ট্রেডার্সের দেওয়া ক্যালেণ্ডারটা বার করলেন। বাসে ভীড় কম, খুলে দেখাই যায়। গার্ডার খুলে মেলে ধরলেন। এর বরাবর ভালো আর বড় ক্যালেণ্ডার বানায়; প্রায় আধ মানুষ লম্বা। দেওয়াল ঝলমল করে। দত্ত অ্যান্ড বসু ফার্মের বড় ক্লায়েন্ট এই মা তারা ট্রেডার্স। প্রত্যেক বছর হেডক্লার্ক হিসেবে এদের থেকে একটা এক্সেকিউটিভ ডায়েরী আর ক্যালেণ্ডার প্রাপ্তি ঘটে অনিলবাবুর।
ক্যালেণ্ডারটা খুলে মন জুড়িয়ে গেল। পিছনের সিটের দুই ভদ্রলোকও যে মন দিয়ে ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকিয়েছিল সেটা বেশ টের পাচ্ছিলেন তিনি।
তাজমহল। যাওয়া হয়নি। কিন্তু ছবিতে পরিচয় কম না। ক্যালেণ্ডারটায় প্রাণ ছিল। ঝকঝকে নীল আকাশ, তার নিচে মন কেমন করা সাদায় সাদা ইমারৎ। অপরূপ।
- মিতুল?
- কোথায় আছ?
- বাসে। আর আধ ঘণ্টা মত।
- ঘরে ঢোকার পথে একটু আলু...।
- আগ্রা যাবে?
- আগ্রা?
- আজই। রাত এগারোটায় আজমের এক্সপ্রেস ছাড়ে। সেবার পিন্টুরা গেল না?
- পাগল নাকি? বলা নেই, কওয়া নেই...।
- আমি তুমি আর বাবু তো। ম্যানেজ হয়ে যাবে। কাল শনি, রবি ছুটি। সোম মঙ্গল সি-এল মেরে দেব। প্লীজ। চট করে স্যুটকেস গুছিয়ে নাও। বাবুটার জন্যও সারপ্রাইজ হবে। পুরী ছাড়া তো আর...।
- টাকা পয়সারও তো ব্যাপার আছে না কী? এ মাসের শেষে ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম দিতে হবে তো?
ফুস মন্তরের মত কাজ হল।
অনিল মুন্সীর বড় রাগ হল। অভিমান হল। দুঃখ হল। এভাবেই টাকার চিন্তায় প্রেমিকরা খুন হয়। ভালবাসার লেজ কাটা যায়। এভাবেই।
টাকা? টাকার চিন্তায় এমন ভালোবাসার হুজুগ ফিরিয়ে দেবে? ইন্স্যুরেন্সই সব? যাবই না শালা। কাড়িকাড়ি আলু নিয়ে বাড়ি ঢুকব আর মোচ্ছব করব। আলু ভাতে, আলুর দম, আলু পোস্ত আর আলু ভাজা। আলু খেয়েই তাজমহলের দুঃখ ভোলাতে হবে।
পিছনের ভদ্রলোকের দিকে ফিরে ক্যালেন্ডারটা অফার করলেন অনিলবাবু; "পছন্দ? নেবেন নাকী?"।
***
- পাঁচ কিলো আলু? এটা কোন আনার ধরণ হল?
- ইচ্ছে হল তাই।
- এখন এত আলু বাড়িতে রেখে গেলে পচবে না?
- পচবে? যাচ্ছটা কোথায় ? রাণাঘাট?
- এই যে বললে আগ্রা। তাজমহল। এই যে স্যুটকেস। চারদিনের তো ব্যাপার। বেশি কিছু নিতে হয়নি।
- গেলেই হল? টাকা? ইন্স্যুরেন্স?
- সোনার চেয়ে বড় ইন্স্যুরেন্স কী? বালাটা দেখছ? তিনবার আগ্রা যাওয়া হয়ে যাবে। আর দু'টো প্রিমিয়াম দেওয়া হয়ে যাব। আমরা তো মাত্র একবার আগ্রা যাব আর একবার প্রিমিয়ামের টাকা দেব।
- হক কথা।
- বাবুর জন্য দারুণ সারপ্রাইজ হবে।
- বাবুর বাবাও ওভারহোয়েল্ম্ড। বাবু কোথায়?
- টিউশনে। এই এল বলে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। বাবুর সময় লাগবে। সাড়ে ন'টার মধ্যে বেরোতে হবে। টিকিটও তো কাটতে হবে।
- জেনারেলে বসে বসে যেতে হবে কিন্তু।
- তাজমহলের জন্য তো। খুব পারব।
- হোটেল খুঁজে পাওয়ার ঝক্কিও কম না। পিক্ সিজন।
- কোই পরওয়া নহি।
- বেশ। বাড়তি সোয়েটার মাফলার রেখ। আগ্রা তো আর কলকাতা নয়। শীতের কামড় থাকবে বলেই বিশ্বাস।
***
- কী সারপ্রাইজ বলছিলে বাবা?
- বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম অ্যান্ড ভিক্টোরিয়া। কাল গোটা দিন। ঝকঝকে নীল আকাশ, তার নিচে সাদা ইমারৎ। যাদুই ব্যাপার।
- সে তো কতবার গেছি।
- এবারে স্পেশ্যাল। টিফিন কেরিয়ারে লুচির সাথে কী থাকবে জানিস?
- আলুর দম?
- সে তো বটেই। আর কী?
- আরও কিছু থাকবে?
- অফ কোউর্স। লুচি উইথ আলুর দম ,আলু ভাজা অ্যান্ড আলু পোস্ত।
- থ্রি ইন ওয়ান?
- থ্রি ইন ওয়ান।
- এটা কোন সারপ্রাইজ হল?
***
অনিলবাবুর একটা অদ্ভুত শখ আছে। ডিমের খোসায় ওয়ার্ল্ড ম্যাপ আঁকা, চালের দানার সই করা; এইসব। জাস্ট শখ। ভালো লাগা। ভালো লাগাটুকুই তো ভালোবাসা।
মিতুলের কালো ব্লাউজের পিঠের দিকে অল্প একটু ছেঁড়া। সেদিনে রাত্রে, সেই ব্লাউজের ছেঁড়া অংশের ফাঁকে রেনল্ডস ডটপেন দিয়ে তাজমহল আঁকলেন অনিল মুন্সী।
কলমের ডগার অল্প সুড়সুড়িতে শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ছিল মিতুলের পিঠে। মিতুলের উপুড় থুতনি বেয়ে জল গড়িয়ে নেমে আসছিল বালিশের সাদা নীল ওয়াড়ে।
অফিস ফেরতা বাসে জানালার সিট বড় একটা পাওয়া যায় না। আজ পয়লা জানুয়ারী বলে হয়ত এতটা ফাঁকা। পার্ক স্ট্রিটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ ঝলমল নজরে পড়ল।
আজ বোধ হয় শীত একটু কম। হাফ সোয়েটারে দিব্যি চলে যাচ্ছে। এমনকি বাসের জানলার কাঁচের ফাঁক দিয়ে আসা সামান্য ফুরফুরে সন্ধ্যের হাওয়াটাও মন্দ লাগছিল না অনিলবাবুর। বাসে না থাকলে একটা সিগারেট ধরান যেত।
কাঁধের ব্যাগ থেকে মা তারা ট্রেডার্সের দেওয়া ক্যালেণ্ডারটা বার করলেন। বাসে ভীড় কম, খুলে দেখাই যায়। গার্ডার খুলে মেলে ধরলেন। এর বরাবর ভালো আর বড় ক্যালেণ্ডার বানায়; প্রায় আধ মানুষ লম্বা। দেওয়াল ঝলমল করে। দত্ত অ্যান্ড বসু ফার্মের বড় ক্লায়েন্ট এই মা তারা ট্রেডার্স। প্রত্যেক বছর হেডক্লার্ক হিসেবে এদের থেকে একটা এক্সেকিউটিভ ডায়েরী আর ক্যালেণ্ডার প্রাপ্তি ঘটে অনিলবাবুর।
ক্যালেণ্ডারটা খুলে মন জুড়িয়ে গেল। পিছনের সিটের দুই ভদ্রলোকও যে মন দিয়ে ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকিয়েছিল সেটা বেশ টের পাচ্ছিলেন তিনি।
তাজমহল। যাওয়া হয়নি। কিন্তু ছবিতে পরিচয় কম না। ক্যালেণ্ডারটায় প্রাণ ছিল। ঝকঝকে নীল আকাশ, তার নিচে মন কেমন করা সাদায় সাদা ইমারৎ। অপরূপ।
- মিতুল?
- কোথায় আছ?
- বাসে। আর আধ ঘণ্টা মত।
- ঘরে ঢোকার পথে একটু আলু...।
- আগ্রা যাবে?
- আগ্রা?
- আজই। রাত এগারোটায় আজমের এক্সপ্রেস ছাড়ে। সেবার পিন্টুরা গেল না?
- পাগল নাকি? বলা নেই, কওয়া নেই...।
- আমি তুমি আর বাবু তো। ম্যানেজ হয়ে যাবে। কাল শনি, রবি ছুটি। সোম মঙ্গল সি-এল মেরে দেব। প্লীজ। চট করে স্যুটকেস গুছিয়ে নাও। বাবুটার জন্যও সারপ্রাইজ হবে। পুরী ছাড়া তো আর...।
- টাকা পয়সারও তো ব্যাপার আছে না কী? এ মাসের শেষে ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম দিতে হবে তো?
ফুস মন্তরের মত কাজ হল।
অনিল মুন্সীর বড় রাগ হল। অভিমান হল। দুঃখ হল। এভাবেই টাকার চিন্তায় প্রেমিকরা খুন হয়। ভালবাসার লেজ কাটা যায়। এভাবেই।
টাকা? টাকার চিন্তায় এমন ভালোবাসার হুজুগ ফিরিয়ে দেবে? ইন্স্যুরেন্সই সব? যাবই না শালা। কাড়িকাড়ি আলু নিয়ে বাড়ি ঢুকব আর মোচ্ছব করব। আলু ভাতে, আলুর দম, আলু পোস্ত আর আলু ভাজা। আলু খেয়েই তাজমহলের দুঃখ ভোলাতে হবে।
পিছনের ভদ্রলোকের দিকে ফিরে ক্যালেন্ডারটা অফার করলেন অনিলবাবু; "পছন্দ? নেবেন নাকী?"।
***
- পাঁচ কিলো আলু? এটা কোন আনার ধরণ হল?
- ইচ্ছে হল তাই।
- এখন এত আলু বাড়িতে রেখে গেলে পচবে না?
- পচবে? যাচ্ছটা কোথায় ? রাণাঘাট?
- এই যে বললে আগ্রা। তাজমহল। এই যে স্যুটকেস। চারদিনের তো ব্যাপার। বেশি কিছু নিতে হয়নি।
- গেলেই হল? টাকা? ইন্স্যুরেন্স?
- সোনার চেয়ে বড় ইন্স্যুরেন্স কী? বালাটা দেখছ? তিনবার আগ্রা যাওয়া হয়ে যাবে। আর দু'টো প্রিমিয়াম দেওয়া হয়ে যাব। আমরা তো মাত্র একবার আগ্রা যাব আর একবার প্রিমিয়ামের টাকা দেব।
- হক কথা।
- বাবুর জন্য দারুণ সারপ্রাইজ হবে।
- বাবুর বাবাও ওভারহোয়েল্ম্ড। বাবু কোথায়?
- টিউশনে। এই এল বলে। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। বাবুর সময় লাগবে। সাড়ে ন'টার মধ্যে বেরোতে হবে। টিকিটও তো কাটতে হবে।
- জেনারেলে বসে বসে যেতে হবে কিন্তু।
- তাজমহলের জন্য তো। খুব পারব।
- হোটেল খুঁজে পাওয়ার ঝক্কিও কম না। পিক্ সিজন।
- কোই পরওয়া নহি।
- বেশ। বাড়তি সোয়েটার মাফলার রেখ। আগ্রা তো আর কলকাতা নয়। শীতের কামড় থাকবে বলেই বিশ্বাস।
***
- কী সারপ্রাইজ বলছিলে বাবা?
- বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম অ্যান্ড ভিক্টোরিয়া। কাল গোটা দিন। ঝকঝকে নীল আকাশ, তার নিচে সাদা ইমারৎ। যাদুই ব্যাপার।
- সে তো কতবার গেছি।
- এবারে স্পেশ্যাল। টিফিন কেরিয়ারে লুচির সাথে কী থাকবে জানিস?
- আলুর দম?
- সে তো বটেই। আর কী?
- আরও কিছু থাকবে?
- অফ কোউর্স। লুচি উইথ আলুর দম ,আলু ভাজা অ্যান্ড আলু পোস্ত।
- থ্রি ইন ওয়ান?
- থ্রি ইন ওয়ান।
- এটা কোন সারপ্রাইজ হল?
***
অনিলবাবুর একটা অদ্ভুত শখ আছে। ডিমের খোসায় ওয়ার্ল্ড ম্যাপ আঁকা, চালের দানার সই করা; এইসব। জাস্ট শখ। ভালো লাগা। ভালো লাগাটুকুই তো ভালোবাসা।
মিতুলের কালো ব্লাউজের পিঠের দিকে অল্প একটু ছেঁড়া। সেদিনে রাত্রে, সেই ব্লাউজের ছেঁড়া অংশের ফাঁকে রেনল্ডস ডটপেন দিয়ে তাজমহল আঁকলেন অনিল মুন্সী।
কলমের ডগার অল্প সুড়সুড়িতে শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ছিল মিতুলের পিঠে। মিতুলের উপুড় থুতনি বেয়ে জল গড়িয়ে নেমে আসছিল বালিশের সাদা নীল ওয়াড়ে।
3 comments:
Chomotkar ekta upponyas guti guti egiye aschilo, bujli, hotath majkhan theke shesh hoye kelo kore diye help.
অনবদ্য। কত কিছু যে মনে পড়িয়ে দিল। সেলাম!!
Khub bhalo! :)
Post a Comment