বিকেল নামলেই মন খারাপ হয় মোহন সামন্তর। অফিসের চেয়ার ছেড়ে উঠতে হবে ভেবে।
সন্ধ্যের শেষ দিকে গিয়ে আবার মন খারাপ জাঁকিয়ে বসে মনে। ট্রামের সিট ছেড়ে উঠতে হবে বলে।
রাতের দিকে টিভির সামনের সোফা থেকে উঠে যেতে তার গায়ে জ্বর আসে।
আর সকালে বিছানা ছাড়বার সময় মনে হয়ে মরে যেতে।
অফিসে ভালো লাগে না সামন্তবাবুর। ট্রামের ডেলি প্যাসেঞ্জারিতে ঘেন্না হয়। টিভির যত প্রোগ্রাম অখাদ্য লাগে, বিশেষত খবর আর সিরিয়াল। আর সকালে বাজার যেতে তো একদমই ইচ্ছে করে না।
এক জায়গা থেকে না নড়া। এটাই তার হবি, ভালো লাগা, প্যাশন, জুনুন, নেশা, আগ্রহ, আহ্লাদ। অফিসের চেয়ার, ট্রামের সিট, ড্রয়িং রুমের সোফা আর বেডরুমের খাট; মোহন সামন্তের ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ। মোহন সামন্ত হৃদয়-ঋষি।
কলকাতার অন্তরে হিমালয় ইঞ্জেক্ট করতে চেষ্টার কসুর করেননি সামন্তবাবু। নীলাকেও ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন পার্কের বেঞ্চে তিন ঘণ্টার বেশি বসতে চাইত না বলে। প্রমোশন হেলায় হারান, কথায় কথায় চেয়ার ছেড়ে বড়সাহেবের রুমের দিকে ছুটে যেতে পারেন না বলে।
সেদিন হঠাৎ নীলার সাথে দেখা হয়েছিল। ট্রামে। বছর সতেরো তো হবেই; এদ্দিন পর দেখা। নীলাকে ভারী সুখী দেখাচ্ছিল। কপালে ইয়া বড় সিঁদুর। হালকা সবুজ তাঁতের শাড়ি। আরও ফর্সা হয়ে গেছে। চেহারায় অবিশ্যি বয়েস বিশেষ জড়ো হয়নি, মুখশ্রী আগের চেয়েও ঝলমলে। সঙ্গে বোধ হয় ওর ছেলে ছিল; রাজপুত্রের মত চেহারা। বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠল। বড় সাধ হয়েছিল ভিড়ের ঠেকে নীলাকে ডাকতে। কিন্তু পরে খেয়াল হল নীলা দাঁড়িয়ে, তাক ডাকলে বসার সিট অফার করে নিজেকে দাঁড়াতে হবে। বুকের ভিতরে ভালোবাসাটা গুমরে রইল, ছলছলে চোখ নিয়ে ট্রামের জানালার বাইরে তাকালেন মোহন সামন্ত।
সাধে কি কলকাতার কবিতার অভাব হয় না?
No comments:
Post a Comment