১।
আলু দেওয়া মাংসের পাতলা ঝোল দিয়ে কষে ভাত মেখে দুপুরের খাওয়াটা একটু মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেছিল। গড়িয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সাড়ে সাতটার ম্যাচ, সাড়ে ছ’টায় সংবর্ধনা দেওয়া হবে ইমরান-শচীনদের। বালিগঞ্জ থেকে পাঁচটায় বেরোলেই যথেষ্ট। পাশবালিশ বুকে টেনে যখন লম্বা হয়েছি তখন বাইরে চড়া রোদ, জানালার পর্দা না টেনে দু’চোখের পাতা এক করার উপায় ছিল না।
বাঙালির মানিব্যাগ; বাসের টিকিট আর ট্রেনের মান্থলিতেই সে’খানে লক্ষ্মীবাস। সেই মানিব্যাগই আজ ভোল পাল্টে ফেলেছে। আজ সে স্রেফ এক পেটমোটা পকেট পোঁটলা নয়, সে আজ তিলিস্মি খাজানা। মানিব্যাগ খুলে ইডেনের সি-ওয়ান ব্লকের টিকিটটা ফের বার করলাম। দাঁতে টুথপিক চালানোর তালে তালে টিকিটটা খানিক উলটে পালটে দেখে মানিব্যাগে ওয়াপস রাখলাম। বালিশের তলায় টিকিটে ডাগর মানিব্যাগটা রেখে মাথা ঠেকাতেই ঝিমঝিমে ভাব নেমে এলো গা জুড়ে; সহজেই।
তন্দ্রা কেটে গেল বিকেল পৌনে চারটে নাগাদ। দম বন্ধ করা গুমোট অসোয়াস্তি। চোখ সয়ে আসতেই বাজটা পড়ল; বুকে। পর্দা সরিয়ে দেখলাম আকাশ মিশকালো। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে হুমকি। হুড়মুড় করে নেমে এলো বলে।
২।
নামতে কসুর করেনি। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ যখন ময়দান চিরে ট্যাক্সি এগোচ্ছে, তখন চারপাশ বৃষ্টিতে ঝাপসা। ইডেনের আউটফিল্ডের সাথে নিরুপা রায়ের কর্নিয়ার তুলনা সহজেই চলে; একবার ভিজলে আর নিস্তার নেই। পনেরো না হোক, অন্তত বারো ওভারের ম্যাচ কি হবে না?
৩।
বাবা চাইতেন অঙ্কে টপাটপ লেটার।
মা চাইতেন বৃন্দাবনি সারঙে মন বসুক।
দাদু অনেক বেশি প্র্যাক্টিকাল ছিলেন। ছিয়ানব্বুইয়ে তখন মিঁয়াদাদ একা কুম্ভ হয়ে শেষ কয়েক ওভার পাকিস্তানের হয়ে লড়ছিলেন বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে, দাদু বলেছিলেন “ভাই, আর কিছু হোক না হোক, এ জীবনে একটিবারের জন্য বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ অন্তত দেখো; নইলে জীবন বৃথা”।
সিকিউরিটি চেক পেরিয়ে যখন ঢুকছি তখন শুধু পরনের টিশার্টই ভিজে সপসপে নয়। দাদু ক্রিকেট ভালোবাসতো, জবরদস্ত। আমি দাদুকে ভালবাসতাম, জবরদস্ত। হিসাব বরাবর।
ততক্ষণে ইডেনের গমগম জবরদস্ত হয়ে ঝরঝরিয়ে নেমে আসছে মুখে কানে বুকে।
আজ আমি ন্যাশনালিস্ট।
৪।
কুড়ি টাকায় চারটে জলের প্যাকেট। কিনতেই হল। জলের বোতলের অধিকার ‘কালচার্ড’ খেলা পাগল কলকাতা খুইয়েছে সেই কবেই। “জিতেগা ভাই জিতেগা” জীবনে কী পাব না’র সুরে গাইতে গাইতে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে এলাম ব্লক সি ওয়ানে। সিট নম্বর এক হাজার পাঁচশো আটষট্টি। ফ্লাড লাইটে দেখলাম বুক জল করা ঝিরঝির চলেছে একটানা।
“ওই যে সাদা ত্রিপল দেখছেন, সৌরভ লান্ড্ন্ থেকে আনিয়েছে, হাওয়া গলবে না তো জল। আর বাড়তি দু’টো সুপার সপার। টোটাল চারটে। ওই যে। লংঅন লংঅফে একটা করে। আর মিডউইকেটের দিকে একজোড়া। স্টিভ ওয়কে নাজেহাল করা ছেলে। ও ঠিক সামলে নেবে। খালি আকাশটা একটু ধরলেই হল। গুগ্ল বলছে সাতটা থেকে বৃষ্টি থামবে। থামবেই। খেলা হবেই”, পাশে বসা কাকা’র গলায় কনফিডেন্স।
মাঠ ভরতে শুরু করেছে। ছেষট্টি হাজার “ই-ন-ডি-ইয়াআআ, ই-ন-ডি-ইয়া” দানায় দানায় জমতে শুরু করেছে।
ভেজা আউটফিল্ডের ভয় বুক থেকে নেমে যেতে সময় নিল না। পিচ আউটফিল্ডের যতটুকু কমতি, মুঠো মুঠো গ্যালারি আস্ফালনে সে ঘাটতি মিটিয়ে দেওয়ার দম রাখে ইডেন গার্ডেন্স। এবার ঝিরঝিরটা থামলে হয়।
৫।
গুগ্ল বলেছিল সাতটায়। বৃষ্টি থামল পৌনে সাতটায়। পিচ থেকে কভার সরতেই “হোওওওওওওও” আছড়ে পড়লো স্টেডিয়াম জুড়ে। মাঠে তখন ভদ্রলোক ফিল্ড সেট করার ব্যস্ততায় দেখভালে নেমে পড়েছেন। আর এক প্রস্থ হইহই জুড়ল যখন দু’টো টিম যখন সদ্য উন্মোচিত আউটফিল্ডে নামলো গা ঘামাতে। ‘কান্ট্রি রোড্স’ থেকে ‘ও মধু’, ইডেনের স্পেকট্রাম যে কতটা চওড়া তা এই গানের রেঞ্জেই মালুম হয়।
সাজের শেষ অধ্যায়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করার যে মনোরম ব্যস্ততা, সে’টুকু তখন মাঠ জুড়ে। হাজারে হাজারে কণ্ঠস্বর তালে তাল দিয়ে গলা ফাটালে যে কী মোৎজার্টীয় মনঝিমঝিম তৈরি হয়, তার ডেমনস্ট্রেশন ইডেনের চেয়ে ভালো আর কে দিতে পারে?
৬।
সংবর্ধনা-টনা ভালো জিনিস।
মুখ্যমন্ত্রীর বিসিসিআই-আইসিসিআই ভূমিকা ছাপিয়ে যে’টা ইডেনোচিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সে’টা হচ্ছে “সবাই ভালো আছেন তো?”।
ভালো থাকার জন্য ইডেন গার্ডেনের চেয়ে বড় দাবী বোধ হয় আর নেই। বাসের ভিড়ের ভয়, এগজ্যামের নম্বরের ভয়, প্রেম ভেঙে যাওয়ার ভয়, প্রমোশন নষ্ট হওয়ার ভয়; সমস্ত মিলেমিশে তাজমহলসম মণ্ড তৈরি হয়। সে মণ্ড সহজেই কয়েক ঘণ্টার জন্য গায়েব করে দিতে পারে ইডেন্দ্রজাল।
ইমরানের জ্বলজ্বল বোধ হয় চাঁদে বসানো টেলিস্কোপে চোখ রাখলেও টের পাওয়া যাবে। পাকিস্তান ও পাকিস্তানি দলের হয়ে ইডেনকে যখন “থ্যাঙ্ক ইউ” জানালেন, তখন আশপাশ থেকে যে কত “গুরুদেব” মার্কা সেলাম উড়ে এলো, তার হিসেব রাখা ভার।
অমিতাভজি বচ্চনের কণ্ঠে “আমি তোমাদের জমাইবাবু” শুনে শুনে হদ্দ হয়ে গেলাম। আমার দাদু টু আমি, সক্কলেই ভদ্রলোকের শালা। তবে ওই; ভদ্রলোকের ভোকাল কর্ডের নাম বোধ হয় রজনীকান্ত।
কিন্তু সমস্ত সুর ছাপিয়ে গেল যখন তিনি উদয় হলেন। সমস্ত অঙ্ক গুলিয়ে ভালবাসা ছোপালো সন্ধ্যে।
সন্ধ্যে হল, সন্ধ্যে হল
এখন ইডেন ভরছে যারা
তাদের মনে শান্তি আসুক
শান্তি আনুক সন্ধ্যেতারা
এখন ইডেন ভরছে যারা
তাদের মনে শান্তি আসুক
শান্তি আনুক সন্ধ্যেতারা
সন্ধ্যেতারার স্থির আশ্বাসে যখন তিনি মঞ্চে উঠে এসে হাত নাড়লেন; কলকাতা তখন স্মৃতি অফ জয়।
শুরুতেই গলা গেল চিরে।
“সাচিইইইইইইইইইইইইইইইন, সাআআআচিন
সাচিইইইইইইইইইইইইইইইন, সাআআআচিন
সাচিইইইইইইইইইইইইইইইন, সাআআআচিন”।
সাচিইইইইইইইইইইইইইইইন, সাআআআচিন
সাচিইইইইইইইইইইইইইইইন, সাআআআচিন”।
একটানা। অনবরত। শুনলে ভীমসেন যোশি মগ্ন হয়ে হাঁটু ঠুকে তাল দিতেন। দিতেনই। নিশ্চিত।
টস্ আটটা দশে। খেলা শুরু হবে সাড়ে আটটায়। আঠেরো ওভারের ম্যাচ। নাই মামার চেয়ে আঠেরো ওভার ভালো। বিলিতি ত্রিপলের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠলো।
৭।
টসে জিতলেন ধোনি। ঝামেলা মিটল।
“ব্যাটাচ্ছেলের কপাল সোনা দিয়ে বাঁধানো। বুঝলেন?” পাশের কাকার গলায় চাপা ন্যাটওয়েস্ট অভিমান।
এরপর। জাতীয় সঙ্গীত।
জমজমাট কেস। শফকত আমানত আলি গাইবেন পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত আর অমিতজি বচ্চন গাইবেন জনগনমন। কেতার অভাব নেই।
“পাক সরজমিন”এর সুর আমার অত্যন্ত প্রিয়। কিন্তু শফকত ঠিক টেম্পোটায় খেললেন না বোধ হয়। অথবা ওটাই কেতা। তেমনই বাড়তি কেতায় জনগনমন মাঠ জুড়ে ভাসিয়ে দিলেন অমিতাভজি।
সেই কয়েক মিনিট ঠায় সজারু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। “তব শুভ নামে”তে রীতিমত কম্প। মিথ্যে বলব না; তখনই দাঁড়িয়ে এই হ্যাশট্যাগটা মাথায় এসেছিল #দিলদিলজনগনমন।
আসল আড়মোড়া ইডেন ভাঙলে এরপর।
৮।
জায়ান্ট স্ক্রিনে অশ্বিনের স্পিন দেখেই পাশের কাকা বলে দিলেন “না ভাইটি, এ বারেও গেল। বল যে প্রোট্র্যাক্টর বসিয়ে পঁয়তাল্লিশে পাক খাচ্ছে। পরের ইনিংসে একশো করতে দম বেড়িয়ে যাবে । ধোনি জব্বর কেস খেলে”।
তবু শরজিল জেএনইউ বিপ্লবীদের মুখে ছাই দিয়ে বেশ টুকুরটুকুর করে যাচ্ছিলেন। এক সময় ইলশেগুঁড়ি মোমেন্টামে উইকেট পড়াও আরম্ভ হল।
বুমরার রানআপের সাথে দুলকি মেপে অবিরত “ইন্ডিয়ায়ায়ায়া ইন্ডিয়া” ঢেউ হয়ে নেমে আসছিল পিচে। আমি যেখানে ছিলাম, সেই ব্লক থেকে নেহরাকে উদ্দীপ্ত করার জন্য সবিশেষ উৎসাহ নিয়ে “শচীনশচীন” চিল্লানিও হল।
৯।
দাদু বলতেন “পারস্পেক্টিভ উল্টেপাল্টে দেখতে শেখো”। প্রথম সাইকেল ব্যালান্স করতে পারার সময় একটা বুক ঠাণ্ডা করা অনুভূতি তৈরি হত; সত্যিই ব্যালান্সটা আমার আয়ত্তাধীন তো? ব্যালান্স আমায় আয়ত্ত করছে না তো? ব্যালান্স আমায় শিখে যায়নি তো? আমার এই শেখাটা আদতে মিথ্যে নয় তো?
“জিতেগা ভাই জিতেগা”র সুরে গলা মেলাতে মেলাতে,
আলগা অসতর্ক এক মুহূর্তে ছ্যাঁত করা একটা ভয় বুকে গোঁত্তা মারে!
আমরা এই বাইশজনের খেলা দেখতে এসেছি? নাকি বাইশজন এক চমৎকার কন্সপিরেসিতে বাষট্টি হাজার পারফর্মার জড়ো করে দিব্যি উপভোগ করছে? আসলি এরিনা এই গ্যালারিটাই নয়তো? বাইশ গজ বক্স সিট নয়তো?
“ভাইটি, উইকেট পড়ল! অথচ লাফালে না! শরীর খারাপ লাগছে নাকি?” কাকার আওয়াজে সম্বিতের চাকা ঘুরিয়ে দিলো।
১০।
ইডেন সমস্ত আনন্দবিন্দু শুষে উচ্ছ্বাস মেঘ বুনে চলে অবিরত। গামলা ভর্তি দানা দানা আলোর স্তূপ। শব্দের গমগমে মোহাচ্ছন্নতা কান বেয়ে বুকে নামে না; সিধে বুকের অন্তরে তৈরি হয় ও বনবন করে ঘুরে চলে। মেক্সিকান ঢেউগুলো যেন অদৃশ্য সন্তুরের তারের ভাইব্রেশনে বাঁধা।
কিচি অন্য কোথাও অপরিচিত কোন খাটে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে।
দাদুর না থাকা বাড়ির প্রতিটি ইটের জন্য গা সওয়া হয়ে এসেছে।
সঞ্জীব আর বুলেট লিখবেন না।
মা আর নিয়ম করে সন্ধ্যেবেলা হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধতে বসেন না।
সমস্ত বেহিসেবগুলো যেন অন্ত্যমিলের খাপেখাপে পড়ে মিলিয়ে মিশিয়ে যায়।
আর পাঁচটা স্টেডিয়াম বা ভিড় মাত্রই যা পারে না; সে’টা ইডেন পারে।
অনুভূতি শুষে নিয়ে মগজ নিউট্রালাইজ করে দিয়ে আনন্দ রোপণ করা। ইডেন পারে।
আনন্দ ফসল ঘরে তুলতে পারা; ইডেন যেমনটি পারে; তেমনটি আর কেউ পারে না।
কলকাতা শহরে নবান্ন মেজাজ একটি সহজ বিন্দুতেই রয়েছে; ক্রিকেটে রয়েছে।
ইডেন খেলা ভেস্তেছে। গ্যালারিতে আগুন জ্বেলেছে। ইনিংস ব্রেকে বাথরুমে ঢুকলে পেচ্ছাপে গোড়ালি ডুবে যায় আজও। কিন্তু ওই; ইডেন স্কেলে বসানো নিখুঁত চায়ের কাপে চুমুক ক্রিকেট নয়। তেমনটা হতে পারেনি কোনদিন; হতে পারবেও না।
ইডেন কী? “একদিন দেখা করবে? আগের মত? দাস কেবিন? এই শেষ বার। প্রমিস”য়ের আকুতিটুকু। হয়তো।
ডেফিনিশনে নিয়ম থাকে। ডেফিনিশন দিয়ে ইডেনদের হিসেব করা যায় না।
১১।
সুইসাইড নোটে ‘তোমরা ভালো থেকো আমি চললাম’ বা ‘এ দায় কারুর নয়’ গোছের কথা লেখা কী বোরিং।
তাই ভেবে সদ্য লেখা চিরকুটটা দলা পাকিয়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেললেন সমরবাবু।
নতুন করে লেখা শুরু করলেন;
অনু,
সমস্ত প্ল্যান মাফিক চলছিল। সমস্তই। জীবন ইডেন গার্ডেন্স। উচ্ছল। প্রাণবন্ত। হুজুগে। প্রেমের পাকিস্তানকে ব্যাট করতে পাঠিয়ে শুরুতেই শায়েস্তা করে ফেলেছিলাম। এরপর টুকটুক ব্যাটিংয়ে সে পাতি টার্গেট চেজ করে বিয়ের পিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। ওই যেমনটা থাকে আর কী। কেক-ওয়াক। হাতের মোয়া গোছের।
গড়বড় করে দিলে টপাটপ তিনটে বাজে উইকেট, থুড়ি তিনটে খুব অসভ্য গোছের ঝগড়া। আচমকা সন্দেহের জুজুতে কাঁপিয়ে দিয়েছিল পিলে-পিচ। অকারণ স্পিনের ভয় আর অকারণ সন্দেহর খোঁচা;একইরকম বিষাক্ত।
তখন। ঠিক তখনই আমার বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর কথা ছিল। কাঁধে হাত রেখে বলার কথা ছিল ‘ধুর বোকা,তোমার রাগ আমার লক্ষ্মী। ঝগড়াকে ডরাই ভেবেছ? সব ধুইয়ে মুছিয়ে দেব। সমস্ত সইয়ে নেব। যেওনা প্লীজ। তুমি গেলে সব শেষ। থাকো। থাকো।
বলা হল না। হল না। ভেসে যাওয়া আটকানো হল না। আমার বিরাট কোহলি হওয়া হল না।
চলি। প্রেসেন্টেশন সেরিমনিতে যদি আসো, তাহলে ওই সবুজ সিল্ক চাপিয়ে এসো। প্লীজ। কেমন?হালকা লিপস্টিক আর কাজল, এর বেশি কিছু হলেই মাখিয়ে একাকার করে ফেলো।
ইতি সমর।
চিঠিটা বারতিনেক পড়ে নিশ্চিন্ত হলেন সমরবাবু।
পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে গত মাসের স্পোর্টসস্টারটা বের করে সে’টাকে হাত পাখার মত করে ধরে হাওয়া করতে শুরু করলেন; আচ্ছা লোডশেডিংয়ের খপ্পরে পড়া গেছে — ধুস।
১২।
যখন ঘোর কাটলো, তখন সদ্য আর্সালানের সামনে নেমেছি ট্যাক্সি থেকে। ভারত বনাম পাকিস্তান; বিশ্বকাপ; ইডেন — ভারতের জয়। বাকেটলিস্টে অসংখ্য টিক পড়ে গেছে এক সন্ধ্যেতেই। ট্যাক্সিতে ওঠার সময় হিসেব কষেছিলাম সোয়া বারোটার মুখেও যদি আর্সালানে ঢুকতে পারি, তাহলেও সেলিব্রেশনটা ব্যাঘ্রশাবকের মত করা যাবে। কিন্তু চৌরঙ্গী টু পার্কস্ট্রিট যে খতরনাক ট্র্যাফিক জ্যামে পড়তে হবে অত রাত্রে; সে’টা কল্পনার অতীত ছিল।
আর্সালানের সামনে যখন পৌঁছলাম তখন রাত পৌনে একটা। আর্সালানের সামনে তখন সিকি মাইল লম্বা লাইন; ইডেন ফেরতা জনগণের। হুল্লোড়।
কলকাতাকে জিডিপি দিয়ে মাপতে যাওয়া আর রবীন্দ্রনাথকে দাড়ির দৈর্ঘ্য দিয়ে বিচার করা একই জাতের ভুল।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে যখন মন্দিরে বসার একটু জায়গা পেলাম তখন সপাট ভাসিয়ে দেওয়া অর্ডার “একটা মাটন স্পেশ্যাল বিরিয়ানি, সাথে চিকেন চাপ”।
” মাটন বিরিয়ানি শেষ স্যার”।
“অমন করে বলবেন না প্লীজ। বিরাটের দিনে এমন বিরাট কেস দেবেন না। পাখি বিরিয়ানি খেতে বলবেন না”।
প্রার্থনায় জোর থাকে। থাকেই। যে’ভাবে আমার জন্য ওয়েটারবাবুটি হাঁড়ি কাছিয়ে পাঁঠার বিরিয়ানি জোগাড় করে আনলেন তাতে মনে হল যেন ইডেনে হাফসেঞ্চুরিটা আমিই ছেড়ে এসেছি।
টেবিল আলো করে বিরিয়ানি ও চাপ। পাশে ঘেমো গায়ে থামস আপ। মনে মনে তখন হল্লা চলছে “জিতেগা ভাই জিতেগা আরসালান জিতেগা”।
ক্লান্তি শরীর মন জুড়ে। গোটা আরসালান তখন ইডেন ফেরতা ভিড়ে হুহু করছে। মাঠের সুবাস, বৃষ্টি বিকেলের ছোঁয়া আর বিরিয়ানির খোশবু মিলে আর্সালন তখন ঈশ্বরের বাগান। ডায়ে বাঁয়ে আগে পিছে সর্বত্র তখন কোহলি স্তুতি। বিরিয়ানির পোটেনশিয়াল এনার্জি তখন রিনিঝিনি মেজাজে কোহলি ধোনি স্তুতির কাইনেটিকে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে।
আর্সালানের ধুকপুকে নলেনে আদরের মত মিশে গেছিল শ্রীশ্রী ইডেন গার্ডেন্স।
No comments:
Post a Comment