ভরত আর তার পুত্র বচ্চা। বয়েসে বাচ্চার আদত নামও বচ্চা, বচ্চা মিশ্রা।
কবে, কীভাবে মোতিহারি ছেড়ে কলকাতা এসেছিল ভরতের বাবা, তা ভরত জানেন না। তিনি ধর্মতলার ভালো নাম জানেন না। বৌটা মারা গেছে না গেছে; সে'টাও গুলিয়ে ফেলেছেন বহু আগেই। তিনি শুধু জানেন তিনি বচ্চা মিশ্রার পিতা। তিনি শুধু জানেন রাতে রুটির খিদে পায়। রাত বড় বেআব্রু করে দেয়, তার বড় দেমাক; দুপুরের মত শুখা পাউরুটিতে বশ মানতে চায় না।
রাত ও ছ'বছরের বচ্চা মিশ্রা এক সাথে রুটি চায়। চেল্লায়। সে চেল্লানি শোনে দু'জন। ভরত ও তাজিন মিয়াঁ। তাজিন মিয়াঁর রুটি সবজি তড়কার দোকান, দোকানের মুখেই উনুন। গনগনে।
রাতের পেটের মত, বচ্চা মিশ্রার আকুতির মত; "বাবা, রোটি"।
তাজিন মিয়াঁর উনুনের তাপ মিইয়ে এলে দিন কাবার হয়, রাত ঘন হয়। ভরত সূর্যের ওপর নিচ বোঝে না, স্ট্রিট ল্যাম্পের জ্বলা নেভা টের পায় না। তার ভোর তাজিন মিয়াঁর উনুনের নরম আগুনে ঢিপঢিপে শুরু। ভরতের দিন সে উনুনের আঁচের শেষ বিন্দুর সাথে মিলিয়ে যায়।
দোকানের লাগোয়া ফুটপাথে বচ্চাকে বুকে ঠেসে শুয়ে থাকে ভরত। বুকে। ঠেসে। ঠেসে রাখলে যদি খিদে কম বাড়ে। যদি।
"বাবা, রোটি। রোটি"।
উনুনের গরম অদৃশ্য কম্বল হয়ে বাপ ছেলের গায়ে ছড়িয়ে থাকে। শীতে, গরমেও। রাত বাড়ার সঙ্গে পথ নিরিবিলি হয়ে আসে।
উনুন উষ্ণতার কম্বল গা থেকে নামতে আরম্ভ করলেই ভরত টের পায়। টের পায় এবার তাজিন মিয়াঁর দোকান বন্ধ হবে। বাড়তি রুটি দু'চারখানা বাপ ছেলের মাথার কাছে রেখে যাবেন তাজিন। তার সঙ্গে কখনও বাড়তি আলু চোখা। কখনও বা বচ্চা মিশ্রার মাথায় হাতবুলুনি। অথবা কখনও পাতে সামান্য আচারের মত গজগজ "রোজ রোজ ইধর কাহে শোতা রে!"।
ভরত কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়তে জানে না, ভরত প্রত্যুত্তর জানে না। ভরত শুধু জানে বচ্চা মিশ্রার উচিত বাপের চেয়ে অন্তত দু'গ্রাস রুটি বেশ খাওয়া। এ'টুকুই ভরতের কলকাতা চেনা।
No comments:
Post a Comment