Tuesday, May 24, 2016

দীপু, দাদু ও নজরুল

শহরে সোঁদা গন্ধ বইয়ের মলাটের মাঝে থাকে। এখানে ছাতের সিমেন্ট-মেঝের শ্যাওলায় বৃষ্টি মিশে যে সুবাস গুঁড়ো হয়ে বাতাসে ওড়ে; তাকে চিনেতে হয়, জাপটে ধরতে হয়।

বৃষ্টিভেজা রাতের গামছায় গা মুছে নেমে আসা ভোরের ছাদে; দীপুকুমার উঠতেন দাদুর হাত ধরে। 
ছাদের উত্তর কোণে  খান চারেক টবে নয়নতারার ভিড়; তাদের পাপড়িতে টুপটুপে জল। ফ্যাকাসে খয়েরী আকাশ টলটল করতো। দাদুর ধবধবে ফতুয়ার ওপর বাটিক ছাপার পাতলা চাদর জড়ানো, ধুতি লুঙ্গির মত করে পরা। দাদুর চোখে নরম হাসি; চিরকালের। মানুষটা বকতে শেখেননি, টেবিল চাপড়াতে শেখেননি। নয়নতারাদের গালে এমনভাবে হাত বুলিয়ে দিতেন; তাদেরও আরাম হত বুঝি। তখনও দীপুবাবু হাফ প্যান্টে, তখনও দীপুবাবুর হাত দাদুর হাতে। 

ভোর ঘাসের মত জড়িয়ে ধরতো তাদের দু'জনকে; ভালোবাসা ঝিরঝির করতো ভোরের বৃষ্টিমাখা মিহি হাওয়ার তালে তালে। দাদু বলতেন এ সময়টা ভৈরবীর, ছাতের পাঁচিলে ঠুকতেন দাদ্‌রা। 
"দাদুভাই, একদিন যখন অনেক বড় হবে তখন দেখবে; নজরুল হিসেবের বাইরে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। এই ধর চায়ের কাপের পাশে বা ভাঁজ করে রাখা গল্পের বইয়ের শিয়রে। সেদিন আর অঙ্ক কষে তাকে পাশে সরিয়ে রাখতে পারবে না। সে'দিন সাবমিশন। বুঝলে দীপুবাবু? সে'দিন ভালোবাসা"। 

দীপু ঠাহর করতে পারতো না। সে অপেক্ষায় রইত। এই বুঝি দাদু গুণগুণ শুরু করবেন; 

"তুমি আমার সকালবেলার সুর
হৃদয় অলস–উদাস–করা অশ্রু ভারাতুর"।

ভোরের নীলচে আলো ঘন হয়ে আসতো। কিচিরমিচির ভেসে আসতো ইতিউতি। দাদু দীপুর হাত ছেড়ে দিয়ে হাত রাখতেন দীপুর কাঁধে। 

নজরুল ভোরের পোস্টকার্ডে ঘষঘষ করে ঠিকানা লিখতে শুরু করতেন। দাদু এগিয়ে যেতেন। 

"ভোরের তারার মত তোমার সজল চাওয়ায়,
ভালোবাসার চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায়
রাত্রি–শেষের চাঁদ তুমি গো বিদায়–বিধুর"।

ভৈরবীর সমঝদার হবে দীপু? তাহলেই হয়েছে। সে বয়েসেই তার বারবার মনে হত এ গান রাতের, দাদু যেন সে গানকে হাত ধরে ভোরের ছাদে টেনে এনেছেন। 

"শিশির–নাওয়া শুভ্র–শুচি পূজারিণীর তুল।
অরুণ তুমি, তরুণ তুমি, করুণ তারও চেয়ে
হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ–লোকের মেয়ে
তুমি ইন্দ্র–সভার মৌন–বীণা নীরব নূপুর"। 

"বিষাদ-লোকের মেয়ে"; দীপুর মনে মনে আউড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো বারবার। দীপু ভোরের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা রাতের গল্পটুকু শুষে নেওয়ার চেষ্টা করতো। বারবার।

দাদুর ভোর নিয়ে চলে গেছেন। দীপু রাতের পরতে পরতে বেড়েছে। চিনেছে। রাতের বৃষ্টির ছলছল ছুঁয়ে দেখেছে। কিন্তু সমস্ত ছাড়িয়ে নজরুল হিসেবের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, ঠিক যেমন ভাবে দাদু বলেছিলো। স্নেহে, অতর্কিতে। 
স্কুল পেরিয়ে যেদিন কলেজ-ছোঁয়ানো-চুমু জড়িয়ে ছিলে মেঘলা আকাশ আর ছাদের অন্ধকারে;  কোথা থেকে যেন নজরুল আগলে ধরেছিলেন কিচিকে। কিচির চোখ ভরিয়ে এসেছিলেন নজরুল, দীপুর বুকে ছ্যাঁত ছুঁইয়ে ঝুপ করে নেমে এসেছিলে "বিষাদ-লোকের-মেয়ে"।    

দীপু নয়নতারার পাপড়ি উপচে পড়া টলটলে বৃষ্টি দানা দেখেছিল। দীপু কিচির কাঁপুনিতে সোঁদা গন্ধ খুঁজে পেয়েছিল। 


No comments: