Thursday, September 29, 2016

ক্যাপ্টেন ও খোকা

- খোকা।
- উম।
- তোমার জন্য কী এনেছি দেখো।
- উম।
- দেখবে না?
- না।
- এ'দিকে দেখই না একবার।
- কই। কী এনেছ?
- গুড বয়। এই দেখ। ইয়াব্বড় লাল এরোপ্লেন। এ'টা এই রিমোট দিয়ে ওড়ানো যায়।
- উম।
- তুমি নেবে না?
- মা বারণ করে। কারুর থেকে কিছু নিতে।
- আমি কিন্তু তোমার মাকে বলে এসেছি।
- থ্যাঙ্ক ইউ।
- তোমার ভালো লেগেছে?
- হুঁ।
- এ'টা তোমার টেডি খোকা?
- ও টেডি নয়। ওর নাম গুবলু। আর ওর পাশে...।
- ওই মিকি মাউস?
- ও মিকি নয়। ওর নাম অভ্র। আমার দেওয়া নাম।
- বাহ। দারুণ নাম তো।
- তোমার নাম কী?
- আমি? আমি ক্যাপ্টেন রয়।
- তুমিই...।
- হুঁ। তোমায় কে বলেছে?
- মা। মা আমায় সব বলে।
- তোমার মা খুব ভালো।
- মা আমায় আইস্ক্রিম খেতে দেয়না।
- ওহ। তোমার আইসক্রিম খুব ভালো লাগে?
- বাটার স্কচ। বাবা আমায় খেতে দিত।
- খোকা।
- আমার বাবা খারাপ লোক ছিল?
- না খোকা।
- তুমি খারাপ লোক?
- সরি।
- সবাই বাবাকে খারাপ বলে।
- মা কী বলে?
- মা বলে বাবারা ভালো হয়।
- তোমার বাবা খুউব ভালো ছিলেন।
- বাবা আইসক্রিম খেতে দিত। বইতে মলাট দিত। আমায় সিন্ড্রেলার গল্প বলত।
- বাবা গল্প বলত?
- সিন্ড্রেলা, পিনোকিও, মহাভারত, টিপু সুলতান...।
- বাহ।
- মা ভালো গল্প বলে না। মা গান করে। বাবা বাজে গাইত।
- ওহ।
- আমার গল্প বেশি ভালো লাগে। বাবা...।
- সরি খোকা।
- তুমি কেন মারলে বাবাকে?
- আমাদের যুদ্ধ হচ্ছিল। আমি মারা যেতে পারতাম। আমার একটা মেয়ে আছে খোকা। তার নাম টুসি।
- টুসিকে আইসক্রিম খেতে দাও?
- স্ট্রবেরি।
- গল্প?
- হুঁ। তবে তোমার বাবার মত অত গল্প জানি না।
- বাবা মিশরের গল্প জানত। ফ্যারাও, পিরামিড।
- খোকা।
- ক্যাপ্টেন কাকু...।
- হুঁ?
- কেন মারামারি করছিলে?
- বড়রা করে। বড়দের করতে হয়।
- আমার বাবা বড় না হলে কী ভালো হত। ভোর বেলা বাবার সাথে আমি আর লুসি বাগানে যেতাম।
- লুসি কে?
- পাগ। তুমি লুসিকে সরি বলবে?
- খোকা। সরি। লুসিকেও বলব। কেমন?
- আমার খুব। খুব। কষ্ট হয়।
- সরি। খোকা।
- বাবা যুদ্ধে কেন যে গেল।
- যেতে হয়। তোমার বাবা গেছিলেন। আমায় যেতে হয়
- কাকু। আমার প্লেন চাই না।
- আচ্ছা। বেশ। তুমি আমার ওপর খুউব রেগে?
- খুউব।
- সরি।
- বাবা খারাপ ছিল না কাকু। গড প্রমিস। বাবা ঘুড়ি ওড়াতে পারত।
- খোকা। তুমি যখন বড় হবে, তখন মনে রাখবে যে আমি তোমায় সরি বলেছি?
- আমি বড় হলেও টুসিকে মারব না।
- বড় হোস খোকা। কেমন? আজ আসি।

***

- ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন ব্যানার্জি! ইয়েস! তুমি পেরেছ! ওদের জেনারেল তোমার বুলেটেই খতম হয়েছে। যুদ্ধ ঘুরে গেছে।
- হুঁ!
- আমরাই জিতছি ক্যাপ্টেন!
- হুঁ!
- ক্যাপ্টেন তুমি দৈত্যবধ করেছ। কে জানে কত নারকীয় হত্যাকাণ্ড ওই জেনারেল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঘটিয়েছে। কত অসহায় মানুষকে জবাই করেছে ও।
- হুঁ।
- তুমি এত বিমর্ষ কেন ক্যাপ্টেন? গোটা দেশ উৎসবে ভেসে যেতে বসেছে। আর যার মধ্যমণি হয়ে থাকার কথা, এ উল্লাস যার নামে, সে কিনা এই অন্ধকার ঘরে ঘাপটি মেরে বসে?
- শত্রুপক্ষের খুনে জেনারেলকে মারতেই হত। নয়তো আমরা ভেসে যেতাম হয়ত। কিন্তু...।
- কিন্তু কী?
- মৃত্যু তো মৃত্যুই। তাই না স্যর? মারকুটে শত্রুকে মেরে ফেলে স্বস্তিতে জিরোনো যায়, কিন্তু উল্লাস? ঘরে বসে টেবিল চাপড়ে যারা যুদ্ধের সুবাস পেতে চায় তারা আনন্দ করুক, উৎসবে হুল্লোড়ে ডুবে যাক। কিন্তু আই অ্যাম আ সোলজার স্যর। মরণভয়ে পালটা মারতে হয়, মারি। দেশের জন্য। দশের জন্য। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে উৎসব?  সংবর্ধনা? মৃত মেজরের ওয়ালেট আমার কাছে। তাতে যে খোকাটির ছবি তার বয়স আমার মেয়ের মতই। সে দেশে গিয়ে খোকার সাথে একবার দেখা করা যায় স্যর? সেই খোকা! সেই খোকার আজ বড় কষ্ট। সে কিনা এখনও বড় হয়নি,কাজেই  সে এখনও আমাদের শত্রু নয়। যায় না? দেখা করা?

Tuesday, September 27, 2016

সঞ্জীববাবু আর ভূত

সন্ধ্যে ৬টা ১০।
ড্রয়ার খুলে কবিতার ডায়েরীটা বের করলেন সঞ্জীববাবু।
 
 
রাত ১টা ১০।
গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে পকেট থেকে রিভলভার বের করে হাতের মুঠোয় ধরে সামান্য আশ্বস্ত বোধ করলেন গোকুল চৌধুরী।
 
 
রাত ১টা ১৭।
চার নম্বর পাতা ছিঁড়ে চার নম্বর নৌকোটা বানিয়ে খানিক জিরিয়ে নিলেন সঞ্জীববাবু।
 
 
রাত ১টা ৪২।
রাতের এ দিকটায় বাতাসের ছ্যাঁতছ্যাঁতে শীতটা বাড়ে, গায়ের আলোয়ানটা শক্ত করে জড়িয়ে পায়চারীর গতি বাড়ালেন গোকুল চৌধুরী।
 
 
রাত ১টা ৫৭।
ডায়েরীটা পকেটে পুরে নিশ্চুপে ছাতের পাইপ বেয়ে বাড়ির পিছনের উঠোনে নেমে এলেন সঞ্জীব হালদার।
 
 
রাত ২টো ১২।
দূর থেকে হ্যারিকেনের আলোর দুলুনি চোখে পড়তেই গোকুলবাবুর হাতটা আপনা থেকে চলে গেল বাঁ পকেটে রাখা রিভলভারের বাটে।
 
 
রাত ২টো ১৭।
"ডায়েরীটা কই? একদম ওপর চালাকি নয়"।
 
 
রাত ২টো ২২।
গুলিটা লেগেছে পায়ে, শিশিরভেজা ঘাস কাদায় লুটোপুটি যাচ্ছিলেন সঞ্জীববাবু, তাঁর কানে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে শুধু শোনা যাচ্ছিল "ওই চারটে কবিতা কই? কই ওই চারটে কবিতা?"।
 
 
রাত ২টো ৩৫, ১২ সেকেন্ড।
 
"চারটে কবিতা...চারটে কবিতা...ভেসে গেছে..."।
"সঞ্জীববাবু! আপনি কবি নন, ও চারটেয় এত লোভ"?
"অ-কবির কবিতা! আহ। তার মায়া"।
"যন্ত্রণা হচ্ছে?"
"হাঁটুর নিচে ঠিক। বড্ড"।
"আর আমারটা? সঞ্জীববাবু? আমার যন্ত্রণাটা?"।
"কবিতাগুলো আমার"।
"মানুষটা আমার"।
"মানুষ?"।
"নয়?"।
"ভূত। ভূতের ভয়। ভূতের কবিতা। আহ। যন্ত্রণা"।
"ভয় পান? তাঁকে?"।
"ভূতের ভয়। বললাম তো। বন্দুকে ভয় তেমন নেই গোকুলবাবু"।
"ওই কবিতাগুলো আমার চাই"।
"কেন? আপনি কি কবি?"।
"না, ভূতের বর।ভূত যার কবিতা তার"।
"ও। সে কবিতার কথা...জানলেন কী করে? সেও জানে না যে। আমার কবিতার ডায়েরীর খোঁজ কেউ জানে না"।
"ভূতেরা সব জানে। জোনাকিরা তাঁদের চোখ হয়ে উড়ে বেড়ায়, হুঁ হুঁ বাবা। ওপরচালাকি নয়"।
"ও কবিতায় কাঁচকলা আছে"।
"বাঙাল ভূত। ইলিশে কাঁচকলা ফেলে খায়"।
"কবিতা দেবেন? তাঁকে?"।
" না ভাসিয়ে দেব"।
"ওহ। ভেসেছে। তারা ভেসে গেছে"।
"ফের ধান্দাবাজি, এ'বার বাকি পাঁচটা বুকে ঠুকব"।
"কবিতার ওপর রাগ? আপনি উন্মাদ গোকুলবাবু"!
"অ-কবির কবিতার লোভের প্রতি রাগ। সে আমার"।
"আপনারই তো"।
"কবিতা ওয়াপিস দিন"।
"হয় না। সেগুলো তাঁর নয়"।
"মিথ্যে"।
"ভাসিয়েছি। চারটে কাগজের নৌকা। ওই দিকে"।
 
 
রাত তিনটে পাঁচ।
সঞ্জীববাবুর রক্ত নদীতে মেলানোর আগেই ডুবেছিল চারটে কাগুজে নৌকা। গঙ্গা ছাড়া সে কবিতাদের উপায়ন্তর ছিল না।
 
 
তখন ঘড়ির টিকটিক ছিল না।
 
- আপনি কবিতা লেখেন?
- পাগল?
- আপনি বরাবরই এমন? গা ঘিনঘিনে ন্যাকা? মেয়েলি?
- উফ!
- নাম দিয়ে যাই? 
- কার?
- আপনার না লেখা কবিতার।
- ধ্যের।
- কান মুলে শোনাব? না ভদ্রভাবে শুনবেন?
- ক..কান?
- এক নম্বর, এক ফালি মেঘ। দুই, এক ফোঁটা জল। তিন, রঙ ধনুকের একটি কণা!চার, একটি নিমেষ।
- এ তো...!
- চুপ! একটা জবরদস্ত ডায়েরী কিনবেন। কেমন? চামড়ার বাঁধাই, লাল বর্ডার, সোনালীতে লেখা পার্সোনাল ডায়েরী। কেমন? প্রথম চার পাতার মাথায় চারটে কবিতার নাম। মনে থাকবে?
- ধুস। যত্তসব। আমি আসি। আসি?
- আসুন। আমি আসি?
- আলবাত।
 
সন্ধ্যে ৬টা দশ।
ড্রয়ার খুলে কবিতার ডায়েরীটা বের করলেন সঞ্জীববাবু। চার পাতায় মাথায় চারটে লাইন।চারটে না-লেখা কবিতার নাম। চার পাতা জুড়ে রকমারি নৌকা আঁকা। সঞ্জীববাবু আঁকতে বড় ভালোবাসেন। সঞ্জীববাবু শুধু নৌকো আঁকতে পারেন। ডায়েরী খুললেই নূপুরের মিহি রিনরিন, খুব নরম; কান পাতলে তবেই অল্প চুইয়ে আসে।
 
রাত তিনটে পাঁচ।
ভূতের স্বপ্নে সে’দিন অজস্র নৌকোডুবি।
হুড়মুড়িয়ে সোজা ছাদে। নূপুরের মিহি রিনরিন। ছাতের উঁচু পাঁচিলের এ’দিকে নয়নতারার টবগুলো, পাঁচিলের ওপর থুঁতনি, ও পাশে গঙ্গা। আঁচলে, চুলে, সমস্ত এলোমেলো। নদীর অন্ধকারে চোখ নামালেন ভূত। 
 
 
***
 
সে দৃশ্যটাই ভাবতে ভাবতে সময় যখন অন্যমনা, 
সেই সময়ের শরিক হতেই আমার এমন কাঙালপনা। 
তোমার চোখেই আলোকবর্ষ করবে যখন গান রচনা,  
তখন তোমার রাত্রি ছুঁতেই আমার গানের ... কাঙালপনা। 

Monday, September 26, 2016

তানসেন ও আউরাঙ্গজেব

"পেয়ার মুঝসে যো কিয়া তুমনে তো কেয়া পাওগি"র সুরে জানপ্রাণ লড়িয়ে মোড়া আলো করে বসেছিলেন মিয়াঁ তানসেন।

তার স্যান্ডো গেঞ্জিতে ট্যাংরা টেস্ট করা ঝোলের ছিটে। তার পায়জামা আল্ট্রা ঢলঢলে। তানসেনের কোলে আমতেল দিয়ে মাখা মুড়ির বাটি। তানসেনের গলায় দরদ;
"মেরি হালাত কি আঁধি মে বিখর যাওগিইইই...ইইই"।

"ইইইশ, ছ্যাহ্"!
মুড়ি বাটি চলকে ওঠে,
তানসেনের সুর কেঁপে যায় ব্যালকনি কাঁপানো হুঙ্কারে।

তানবাবুর গাইবার কথা ছিল;
"খোয়াব ক্যিউ দেখু উয়ো জিস্পে মে শরমিন্দা হুঁ,
ম্যায় যো শরমিন্দা হুঁ, তো অউর তুম ভি শরমাওগিইইই..ইইই"।

কিন্তু আউরাঙ্গজেবি ধমক অতি বিষম বস্তু। কথায় কথায় ধ মুণ্ড আলাদা হয়ে যায়, কথায় কথায় বন্দী। কথা ও সুর মিয়াঁর গলার কাছটায় থেবড়ে বসে রইলে, উঁকিঝুঁকি দেওয়ার সাহস করলে না।

"এ'টা গান হচ্ছে?", আউরঙ্গজেব তেলে-বেগুনে-কেরোসিনে,  "কর্পোরেশনে বলে কয়ে একটা গান গেয়ে কুকুর তাড়ানোর চাকরী জুটিয়ে নিলেই হয়"!

তানসেন অভিমানী।  মুড়ি বিস্বাদ হয়ে এলো, সাউথ ফেসিং ব্যালকনিটাকে মন হলে অফিসটাইমের বজবজ লোকালের ভেন্ডর কম্পার্টমেন্ট। কিন্তু তানবাবু পান্নালালের শিফ্ট করার আগেই  পা টিপে এগিয়ে এলেন তিনি। অ্যানাক্রনিসমের স্কেল ডিঙিয়ে মোড়ার পাশে ঘেষে এসে দাঁড়ালেন আউরাঙ্গজেব স্বয়ং।

নিখুঁত মখমলি সুরে ব্যালকনির মেজাজ জলসার জৌলুসে বাঁধলেন আউরাঙ্গজেব;

"কিউ মেরে সাথ কোই অউর পরেশান রহে
মেরি দুনিয়া হ্যায় তো জো ভিরান তো ভিরান রহে"।

সুরের ধর্মই ওই। এক চাঁই পাথররের মত পাহাড় চূড়া থেকে দিক মেপে গড়িয়ে দিলেই হল।

ট্যাংরার ঝোলে বড়ির বড়াইয়ের মত জেগে উঠলেন মিয়াঁ তানসেন;

"এক ম্যায় কেয়া অভি আয়েঙ্গে দিওয়ানে কিতনে
অভি গুঞ্জেঙ্গে মহব্বতকে তরানে কিতনে
জিন্দেগি তুমকো সুনায়েঙ্গে ফসানে কিতনে..."

আউরাঙ্গজেব তখন মোড়ার পাশে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে। তাঁর লাল পেড়ে হলুদ শাড়ির সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে মুড়িমাখার আধখালি বাটি।

আউরঙ্গজেবের পায়ের আলতার কাঁচা লালে ভূতের ভয়, জানেন মিয়াঁ তানসেন। গলার কাঁপুনিতে তুলির শেষ টান দেন তিনি;

" কিউ সমঝতি হো মুঝে ভুল নহি পাওগি?
পেয়ার মুঝসে যো কিয়া তুমনে তো কেয়া পাওগি?"।

Sunday, September 25, 2016

ভাবনা

- ভাবুন...।
- ভাবব?
- ভাববেন না?
- ভাবান।
- ভাবুন..আপনি মারা গেছেন।
- ভাগ।
- ভাগছেন কোথায়? শুনুন।
- ভাগব না। বেশ। বলুন।
- ভাবুন আপনি মারা গেছেন।
- ভাবলাম।
- ভাবুন আপনার চারিদিকে একটা হালকা নীলা আলো।
- ভাবলাম।
- ভাবুন আপনার কানে গুনগুন করছেন পান্নালাল।
- ভাবব?
- ভাববেন। অবশ্যই। যেথা আছে শুধু ভালোবাসাবাসি সেথা যেতে প্রাণ চায় মা।
- ভেবে চললাম। বেশ। সকলই ফুরায়ে যায় মা।
- ভাবুন আরও ভাবুন। চারিদিকে ছাতিমের সুবাস। চোখে নীল ঝিমিঝিম ভাব। কানের মেঝেতে মাদুর পেতে পান্নালাল হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছেন। অনেক কেঁদেছি, কাঁদিতে পারি না।
- ভাবনার ভার বাড়ছে। বুক ফেটে ভেঙে যায় মা।
- ভাবুন আচমকা সেই নীল আলোর ঝিমুনি কাটিয়ে তাঁকে দেখা গেলো।
- ভাবায় ধন্ধ। তিনি?
- ভাবুন। নীল আঁচলের খসখস। ছোট কালো টিপ। সরু গোল ফ্রেমের চশমা। তাঁর বাঁ হাতের কবজিতে হাতঘড়ি মিনিট পাঁচেক এগিয়ে।
- ভাবনা স্পষ্ট হল।
- ভেবে চলুন।
- ভেবে চললাম।
- ভাবনা ভেদ করে তিনি আপনার পাশে এসে দাঁড়ালেন, তাঁর নাকছাবিতে একটা খুনে ব্যাপার ছিল।
- ভাবনায়। ভাবনায়।
- ভাবনায় তিনি এসে দাঁড়াতেই কানের মেঝে থেকে পান্নলালবাবু উঠে চলে গেলেন। হারমোনিয়াম পড়ে রইলে যে কে সেই।
- ভাববার বিষয়।
- ভাবনা হাতড়ে দেখুন। এক থালা নীল আলোর মধ্যে আপনি দাঁড়িয়ে,  পাশে ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে তিনি সপ্রতিভ।
- ভাবনার পরের ধাপ?
- ভাবনা পেরিয়ে আপনার কানে নেমে আসা তাঁর ঠোঁটজোড়া। ফিসফিস; এবার অন্তত আমার নারায়ণ দেবনাথ সমগ্র তিনখানা ফেরত দিন। বছর পার হতে চললো!
- ভাবুন কাণ্ডখানা! এখনও ভোলেননি?
- ভেবে লাভ নেই। আপনি মারা গেলেও ভুলবো না। কেমন?

গোকুলবাবুর পুজো

পুজো এলেই গোকুলবাবুর নার্ভাসনেসটা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। তিন দাগ ওষুধ বাড়িয়েও হাঁটুর ঠোকাঠুকি বা হাতের কাঁপুনি কমানো যায় না।

পাড়ার চাঁদা, পারিবারিক জামাকাপড় কেনার ধুম, রাস্তায় বাঁশ, চারদিকে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানের হিড়িক; সবমিলে পুজোর হপ্তাখানেক আগে থেকেই গোকুলবাবুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

পুজো এলেই বুকের ধড়ফড়ানিতে মরে যেতে ইচ্ছে করে গোকুলবাবুর।

**

গিন্নীর পাহাড় পছন্দ। মেয়ের সমুদ্র। ছেলের পছন্দ কলকাতার প্যান্ডেল-হপিং আর রেঁস্তোরার সামনে গিয়ে লাইন দিয়ে "কতদূর আর কতদূর বলো মা" গাওয়া।
গোকুলবাবু জানেন দু'জনের চোপা খাওয়ার চেয়ে তিনজনের রাগ হজম করাতে অন্তত পলিটিকাল ঝামেলাটা এড়ানো যায়। তার সাথে খরচও কমে। অতএব পুজোয় বাড়তি অফিসের কাজের জন্য আবেদন করেন গোকুলবাবু। প্রত্যেকবারই পেয়ে যান কিছু না কিছু, কারণ ওভারটাইমের টাকা দিতেই হবে তেমন কোনও দাবী রাখেন না তিনি।

**

- এত রাত্রে আপনি অফিসে বসে?
- আপনি কে স্যার?
- আগে আমার প্রশ্নের জবাব।
- কেন দেব?
- আপনার পকেটে রিভলভার আছে?
- না। আপনার কাছে আছে?
- থাকতেও পারে।
- মানে?
- মানে আপনার পকেটে শিওরলি নেই। আমার পকেটে রিভলভার থাকলেও থাকতে পারে। তাহলে কার ভয় পাওয়া উচিৎ গোকুলবাবু? প্রশ্নের উত্তর আগে কে দেবে?
- আমার।
- গুড। হিসেব বোঝেন।
- আমি আকাউন্ট্যান্ট।
- এত রাত পর্যন্ত অফিসে কেন?
- অফিসের কাজ এগিয়ে রাখছি। কারণ পাড়ায় আজ রাতে জলসা।
- জানি। বকুলবাগান সার্বজনীন আয়োজিত কিশোর নাইট।
- আপনিও ও পাড়ার?
- আপাতত আছি।
- আপনার নামটা স্যার?
- রিভলভার সম্ভবত আমার কাছে। কাজেই প্রশ্নও আমিই করব।
- ওকে।
- পুজোয় ভয় কেন আপনার? দুর্গায় অ্যালার্জি?
- এ মা না! জগজ্জননী উনি। আমি এথেইস্ট নই।
- তবে?
- বাড়াবাড়ি সহ্য হয় না।
- যেমন?
- এই। শহরের এই ওভার দ্য টপ আদেখলাপনা। মনে হয় মরে যাই।
- ইউ ডোন্ট লাইক ক্যালক্যাটা?
- তেমন ভাবে নয় কখনই। ভিড়, পলিউশন, অটোর লাইন, বাতেলা! আর পুজো এলে মনে হয় হিমালয়ে চলে যাই।
- যাবেন?
- কোথায়?
- হিমালয়। বড্ড নিরিবিলি,  আমার অপছন্দ। এদিকে আপনার ক্যালক্যাটা অপছন্দ অথচ আমার এ জায়গাটা তুমুল লাগে।
- তুমুল লাগে? নাহ। আপনার যা ভাষার ডায়রেকশন, শহুরে কুল লাইফ আপনার সইবে।
- যাবেন? হিমালয়?
- তার সাথে আপনার কলকাতায় থেকে যাওয়ার সম্পর্ক কোথায়?
- রিভলভার কার কাছে থাকলেও থাকতে পারে?
- ওহ। সরি। আমার দিক থেকে প্রশ্ন নয়।
- যাবেন? হিমালয়?

**

মহিষাসুর কোহিনূর নয়, মোনালিসা নয়। তবু কে বা কারা যেন বকুলবাগান সার্বজনীনের প্যান্ডলের পেল্লায় সিক্স প্যাকিও অসুরকে সরিয়ে হাড়গিলে ব্যাজারমুখো এক মুর্তি বসিয়ে গেছে সে'টা একটা রহস্য। এ'টা ধর্মানুভূতিতে আঘাত নাকি শহরের নিরাপত্তা শিকেয় উঠেছে? নাকি নিচু জাতির অসুরকে মাসকুলার না দেখিয়ে প্যাকাটি চেহারায় দেখানোটা কোনও উচ্চশ্রেণীর ষড়যন্ত্র?  যে কোন মুহূর্তে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে।

সবাই চিন্তায়। সবাই স্তম্ভিত। খবরের কাগজের প্রথম পাতা থেকে কাস্মীর আর টেস্ট ক্রিকেট গায়েব হয়ে স্রেফ পালটে যাওয়া মহিষাসুর।  খোদ সরকারও ভেবড়ে একাকার। বোমা পেটো এ'সব ম্যানেজ দিতে কলকাতা ওস্তাদ। কিন্তু মহিষাসুরের মূর্তি বদল? স্ক্যান্ডেলের ঠাকুরদা!

সে বছরের পুজোটাই মাঠে মারা গেল। সবাই গুম হয় নিউজ চ্যানেল খুলে বাড়িতে বসে রইলে, চারদিকে একটা কী হয় কী হয় ভাব। শহরের রাস্তায় রাস্তায় বাড়তি পুলিশ।

শুধু মেডিকাল কলেজের একদল ডাক্তারের সময় রইলো না অসুরচুরির গড়বড়ে মন দেওয়ার। হাজার বিদ্যা ফলিয়েও তাঁরা গোকুলবাবুর আচমকা গজিয়ে ওঠা বাইসেপ-ট্রাইসেপ-সিক্স প্যাকের রহস্য উদ্ধার করতে পারলেন না। আরও বড় মেডিকাল মিস্ট্রি হল গোকুলবাবুর গায়ের চামড়ার দুধে আলতা রঙ গায়েব হয়ে এক নতুন হালকা সবুজ জেল্লা দেখা দিয়েছে, এ'দিকে তার শরীর নিরোগ। চিফ মিনিস্টার নিজে গোকুলবাবুকে দেখে গেলেন, ঠিক করা হলো এর শেষ দেখে ছাড়া হবে। আমেরিকা থেকে একটা মেডিকাল টীম আনানোর সুপারিশকে গ্রীন সিগন্যাল দিয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী।

Friday, September 23, 2016

মেজদার রাগ

বিকেল থেকে মেজদাকে নিয়ে হইহইরইরই কাণ্ড।

কী ব্যাপার?  মেজদার রাগ কমছে না।
কেন রাগ? ব্যাপারটা সে'খানেই। রাগের কারণ কেউ জানে না, মেজদাও না।

মোদ্দা কথাটা হল মেজদার রাগ কিছুতেই কমছে না। ওর চোখমুখ আগুনে লাল, মাথার চুল এতটাই উষ্কখুষ্ক যে হাজার চিরুনির র‍্যাফ নামিয়েও বাগে আনা যাবে না। মেজদা শুধু দরদর করে ঘেমে চলেছে আর হুড়মুড় করে পায়াচারী করে চলেছে। কণ্ঠস্বর মেজাজের উত্তাপে জড়ানো, কাঁপা কাঁপা।

বাবার হোমিওপ্যাথি, বড়দাদুর নার্ভের ওষুধ, মায়ের তৈরি লেবু সরবত, বড়দার আবৃত্তি, এমনি তুনুপিসির মাথায় বরফ ঘষার আইডিয়াতেও সে ভীমরাগ বশে এলো না। বরং মেজদার পায়চারীর স্পীড উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। ওদিকে প্রেশার বোধ হয় সিলিং ছাড়িয়ে ছাদে গিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে।

মেজদার অজানা ওজনদার রাগের খবর পাড়াময় হতে সময় লাগেনি, ঘনঘন ওকে দেখতে লোক আসছে। বাবলামামা পরের বার ইলেকশনে দাঁড়াবে, সে এসে খোঁজখবর নিয়ে গেলো। তিন্নি কলেজে ওঠার পর থেকেই খুব উড়ে বেড়াচ্ছে, সে এসেছিলো মেজদার লাগামহীন রাগে চোবানো মুখের পাশে পাউট করা মুখ রেখে ছবি তুলবে বলে। আরও কতজন। সবাই চোখ কপালে তুলে মেজদাকে দেখে যাচ্ছে, আর যে যার মত টোটকা উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি অঘোর কাকা নিজের সেলুন বন্ধ করে এসে মেজদাকে দেখে একটা স্পেশ্যাল মাদুলি দিয়ে গেলো।

কিন্তু কোনও কিছুতেই কিছু নয়। মেজদা নিজের রাগের কড়াইতে ক্রমশ ভাজা ভাজা হয়ে পড়ছিল। ভাবগতিক দেখে বাবা হাসপাতাল আর আনন্দবাজারের অফিসে ফোন করে খবর দিয়ে রাখল। ব্যাপারটা কোনদিকে গড়াবে কিছুই বলা যাচ্ছিল না।

তবে অ্যাম্বুলেন্স বা সাংবাদিক আসার আগে ইউরেকা ঘটালো ছোটকা। "দেখি শেষ চেষ্টা করে" বলে হঠ করে মেজদার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে মেজদাকে ফেসবুক আর ট্যুইটার থেকে লগ-আউট করিয়ে দিল।

কাজ হলে মন্ত্রের মত। মেজদার মুখে গন্ধরাজের সুবাস মাখানো হাসিটা ফিরে এলো, সে জানালে তার আচমকা খুব ছানার জিলিপি খেতে ইচ্ছে করছে।

খুব সম্ভবত "আনন্দবাজারের ফিফ্থ পেজটা মিস হলো" বলে বাবা সামান্য চুকচুক শব্দ করেছিলেন।

সঞ্জীববাবুর বিয়ে

- এ বিয়ে হবে না।
- কী বলছেন বাবা?
- তুমি বুঝছো না। আমার মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে হতে পারে না। কাজেই তোমার মুখে এই বাবা ডাকটা শুনলেই মনে হচ্ছে তোমার দু'চোখে  কাসুন্দি ছিটিয়ে দিই।
- কিন্তু আমি যে...।
- শর্মিষ্ঠাকে ভালোবাসো। ও'ও তোমাকে ভালোবাসে। জানি।
- কাজেই দুনিয়ার...।
- কোন শক্তিই তোমাদের আলাদা করতে পারবেন না। কপুর হলেও না। জানি।
- আমি অব্রাহ্মণ বলে আপনি এমন হাবভাব দেখাচ্ছেন?
- আমরা অমন আহাম্মক নই।
- সরকারি চাকরী করি না বলে?
- ধুর ধুর। চাকরী ইজ চাকরী।
- তবে?  ফিনান্সিয়াল ব্যাকগ্রাউন্ড উইক ভেবেছেন?
- তুমি এত বদ? তুমি এইসব ভাবো?
- তবে বিয়ে হবে না কেন?
- কারণ আমরা এখানকার নই বলে।
- বাবা...।
- শাট আপ। রাস্কেল।
- কাকু... আমরাও এখানকার নই। মানে, আমার দাদু বরিশালের।
- না না, বুঝছো না। আমরা এখানকার নই। আমরা এলিয়েন। আমরা হোমোস্যাপিয়েন নই। আমরা মম্ভলুক।
- হে হে হে।
- ওরে কে আছিস এক বাটি কাসুন্দি আন।
- না মানে...আমি সে'ভাবে হাসতে চাইনি।
- শর্মিষ্ঠার জন্মের সাড়ে সাত বছর আগে আমরা এখানে চলে আসি।
- হে হে হে।
- হারামজাদা।
- সরি...কিন্তু বাবা...।
- তস্য হারামজাদা।
- কিন্তু কাকু,  এ যে গল্প কথা।
- গল্প? মুভিরুকা গ্রহের মম্ভলুক প্রজাতির ট্র‍্যাডিশন জানো? বিয়ের পত মম্ভলুকি বৌ মম্ভলুকি পুরুষের দু'হাত খেয়ে ফেলে।
- আজ্ঞে?
- দু'টো হাত। চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। সে'টাই কালচার। আইনও বটেন। প্রাচীন সময়ে এনেস্থিসিয়া ছাড়া ঘটত ব্যাপারটা। আজকাল এনেস্থিসিয়া ব্যবহার করে হয়। কিন্তু বিয়ে হয়েছে কী বর জগন্নাথ। আর সে'টা না মানলে..।
- না মানলে?
- না মানলে হাত কাটা যাবে না। শুধু সে গ্রহের সরকার বাহাদুর সেই বর আর বৌয়ের মাথা দু'টো কচাত করে নামিয়ে দেবেন।
- ওহ। হে...হে...।
- কী! হাসি শুকিয়ে আসছে? হেহে। সাধে কি আমি আর শর্মিষ্ঠার মা বিয়ের আগে পালিয়ে এসেছি?
- এ'সব গল্প...।
- হাত দু'টো পৃথিবীতে এসেও বাঁচানো গেল না চাঁদু।
- আরে...এই তো। আপনার এক হাতে চায়ের কাপ আর অন্য হাত আপনার গালে।
- আর্টিফিশিয়াল। সায়েন্সের কামাল। তবে ক্যারম খেলতে পারি না। আঙুলের ছাপ দিতে পারি না। ভাত মাখতে পারি না। কাতুকুতু দিতে পারি না।
- কি...কিন্তু হাত গেল কেন?
- মম্ভলুক ইন্সটিঙ্কট যাবে কোথায়? শর্মিষ্ঠার মা এড়িয়ে থাকতে পারেনি। শর্মিষ্ঠাও পারবে না।
- ও মানে..।
- বিয়ে। সম্ভব নয়।
- কী সব বাজে কথা যে বললেন..।
- কাসুন্দির বাটিটা কেউ দিয়ে গেলি না রে!
- কাসুন্দি অ্যাসিড যা কিছু দিন। হাতের কোপ্তা বানান। এ বিয়ে আমি করবই।
- বেসিক্যালি তুমি আমার কথাগুলো বিশ্বাস করছ না।
- এ'টা কোন বিশ্বাস করার গল্প হলো?
- যে আমার গল্প চোখ বড়বড় করে শোনে না, বিশ্বাস করে না, তার মত আনইমাজিনেটিভ ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেব?
- কী মুশকিল।

**

সঞ্জীববাবুর বড় দুঃখ গো।
ক্যারম খেলতে পারেন না।
কাতুকুতু দিতে পারেন না।
ঝোল দিয়ে ভালো করে ভাত মাখতে পারেন না।

আর এই অদ্ভুত রোগে সেই যে ধরেছে, আর ছাড়ার নাম নেই; যে কোন আষাঢ়ে গল্প সহজেই বিশ্বাস করে নেওয়ার রোগ। এমন বিশ্বাসী মন নিয়ে আর যাই হোক পৃথিবীতে বাস করা চলে না।

Wednesday, September 21, 2016

সেনাপতির বিকেল

সেনাপতি ভালো-না-লাগার বালি খুঁড়ে চোখের জল টেনে আনছিলেন বারবার। তাঁবুর জানলা দিয়ে বিকেলের নরম রোদ এসে গোটা গায়ে ছড়িয়ে পড়ছে। হাওয়ায় ধুলো আর শীত মেশানো শিরশির। সেনাপতির ঠোঁট এবং গালের চামড়া ফেটে একাকার! যুদ্ধের চোট আঘাতে অবশ্য গাল ঠোঁটের চামড়া ফাটার হিসেব রাখাটা হাস্যকর।

সেনাপতির ঘাম শুকিয়ে গেছিল। শ্বাসের অস্বাভাবিক দ্রুততাও শান্ত হয়ে এসেছিল। কনুইয়ের আঘাতের যন্ত্রণাটা বৈদ্যের লাগিয়ে দেওয়া প্রলেপে ক্রমশ নুইয়ে আসছিল। সেনাপতির তাঁবুটা শিবিরের একদম শেষপ্রান্তে। যুদ্ধব্যস্ততার শব্দগুলো খুব একটা আসে না এ'দিকে। বেশ খানিকটা নিরিবিলি,যুদ্ধক্ষেত্রের খুনোখুনি হুড়মুড় ছাড়িয়ে এসে এমন নিরিবিলি বড় আরামদায়ক।

একটু তন্দ্রাভাব এসেছিল বোধ হয়, সে'টা কাটতেই সেনাপতি টের পেলেন যে আকাশে সন্ধ্যের আবছায়ার রঙ লাগতে শুরু করেছে। 

আজকের যুদ্ধে বড় আঘাত হানা গেছে, দুশমনের কবজি মুচড়ে দেওয়া গেছে খানিক। এমন নিশ্চিন্দির বিকেলে মদের পেয়ালা নিয়ে গা এলিয়ে দেওয়াটাই রীতি। কিন্তু আজ কিছুতেই শিয়রের কাছে রাখা সুরাপাত্রের দিকে সেনাপতির মন এগোচ্ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এখনও পোশাক পালটানো হয়নি, গায়ে ধুলো,বালি, মাটি আর রক্ত। স্নানের দরকার,কিন্তু শরীরকে অস্বাভাবিক ভারি মনে হচ্ছে। তাঁবুর বিছানায় অবশ হয়ে এলিয়ে রইলেন সেনাপতি,  তাঁর চোখ জুড়ে শুধু  সন্ধ্যে আকাশের নীলচে কালো আভা।
অথচ এ মুহূর্তটা আদতে ছিল মহারাজের শিবিরে গিয়ে অভিবাদন গ্রহনের। এ সন্ধ্যেটা আনন্দোৎসবের, যুদ্ধের দৌড়ে আজ তার সেনাবাহিনী এক ধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে গেছে।গত দু'দিনের যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি দু'পক্ষেরই যথেষ্ট হয়েছে, কিন্তু বাজি যে এখন তাঁর সৈন্যদলের পক্ষেই, এ কথা স্পষ্ট ঠাহর করতে পারছেন তিনি।
 
স্পষ্টতই এ যুদ্ধ অনিবার্য ছিল; আর যাই হোক, অকারণ রক্তব্যবসায়ি তাঁর মহারাজ নন। তাঁরা শোষকের জাত নন। কিন্তু এই শয়তানদের দলকে যুদ্ধের আশ্রয় না নিয়ে রোখা সম্ভব ছিল না, এবং এ যুদ্ধ চন্দ্রমল্লিকার গায়ে হাত বুলোনোর মত সহজও ছিল না কোনও মতেই। মজবুত প্রতিপক্ষ যখন শয়তানির আশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তখন তাদের বশে আনা চাট্টিখানি কথা নয়।

কিন্তু আজকের দিন সমস্ত ঘুরিয়ে দিয়েছে। শয়তানের দলকে প্রায় সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরা গেছে। রাজা শুধু প্রভু নন, সেনাপতি তাঁর বন্ধুস্থানীয়ও বটে। রাজার বাৎসল্যে জান কবুল করা যায়, আজ বিকেলটা তো রাজশিবিরেই কাটানোর কথা সেনাপতির। মদের ফোয়ারা বইবে, এন্তার বাহবা কুড়োবেন সেনাপতি ; আজকের নায়ক যে তাঁর ক্ষুরধার মস্তিষ্কই।

কিন্তু আজ কনুইয়ের চোট পেরিয়ে যে যন্ত্রণার চোরাস্রোত সেনাপতির বুক বেয়ে গলায় উঠে এসে ধাক্কা মারছে, তা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারছেন না সহস্র যুদ্ধের অবিসংবাদী নেতা।

এমন বিষণ্ণতা এর আগে কোনওদিন অনুভূত হয়নি। যুদ্ধজয়ের শেষ চালটুকুর হিসেবনিকেশ আজ করে নেওয়ার কথা। সেনাপতির অভিজ্ঞতার দিব্যদৃষ্টিতে আজ শেষ কামড়ের পরিকল্পনা করে নেওয়ার কথা। কিন্তু আজ সেনাপতির চোখ ও মন জুড়ে শুধু আকাশের সাঁঝবর্ণ অবসাদ।
সেনাপতি ভালো-না-লাগার বালি খুঁড়ে চোখের জল টেনে আনছিলেন বারবার।


"মহারাজ নিজের শিবিরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন সেনাপতি"।

দূতের কণ্ঠস্বর তাঁর মনে বিশেষ দাগ কাটল না। সে বোধ হয় ভাবল সেনাপতি অসুস্থ, তাই নিঃশব্দে বিদায় নিলে।

আকাশ ততক্ষণে রাত্রির কালোয় নিকষ। 
সেনাপতির চোখ জুড়ে সে অন্ধকারটুকুই শুধু, বুকের ভিতর মন কেমন। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসতেই আকাশের অন্ধকার ছিঁড়ে সেনাপতির চোখে ভেসে উঠলো সর্ষে ক্ষেত লাগোয়া ছোট্ট কুঁড়ে। সেখানে নিকোনো দাওয়ায় পাতা চারপাইতে বাবা। বাবা আফিঙে আলুথালু। রান্নাঘর থেকে মায়ের সুবাস মাখানো গরম ডাল রুটির 'আয় বাবা আয়'; সেনাপতির মনে হচ্ছিল এ সমস্তই যেন ছোঁয়া যায়।

যেন আর শত্রুজয় নেই, উনুনের ধোঁয়া আছে।
যেন আর দায়িত্বে মশগুল ক্ষত্রিয়বোধ নেই, স্রেফ একটা গেঁয়ো সন্ধ্যে আছে।
যেন তরবারির আবশ্যক প্রতিঘাতটুকু নেই, শীতের রাতে উঠোনে জ্বালানো প্রাণজুড়নো আগুনটুকু আছে।
যেন রাজ্যরক্ষা নেই, অন্যমনস্কতায় আঙুলের ফাঁকে গাঁদাফুলের পাপড়ি ঘষা লালচে হলুদ দাগ আছে।
ব্যূহরচনা নেই, বাড়ির বিছানায় লেপের ওম আছে।
সত্যের জয়গাথা লেখার দায়িত্ব নেই কিন্তু খড়ের চালার ফোঁকর দিয়ে গড়িয়ে নামা চাঁদের আলো আছে।

দেশপ্রেমের জোয়ার নেই, কিন্তু ফুলিয়ার মিঠে দু'চোখে 'কব ওয়াপিস আওগে?'র আকুতি আছে।
দেশ, রাজা, রাজ্য, সম্মান, আদর্শ; সব নরম হয়ে মিলেমিশে যাচ্ছিল সেনাপতির চোখে বুকের ঘোলাটে অন্ধকারে। চোখের ছলছলে অনভ্যস্ত সেনাপতি। অথচ ফুলিয়ার কান্না-চাপা দেওয়া ঠোঁট কামড়ানো যন্ত্রণার ছবিটুকু বারবার সেনাপতির মনে ভেসে উঠছিলো।

ফুলিয়া। গোলাপি শাড়ি, হলুদ স্বপ্নের ফুলিয়া। ঠিক ভুল অঙ্কের বাইরের ফুলিয়া। আঁকার খাতার ফুলিয়া। দুপুর রোদের কুয়োপাড়ে পা ছড়িয়ে গল্প ফাঁদা বাচাল ফুলিয়া।

আহ। ফুলিয়া।

সত্য, দেশ, যুদ্ধ। সব পড়ে রইলো এক দিকে। আর ফুলিয়ার কান্না রইলো অন্যদিলে। সমস্ত ভাসিয়ে দিলে।ফুলিয়া।

যুদ্ধের ঠিকটুকুই শেষ কথা হয়ে থাকবে? ফুলিয়ার হয়ে ভুল করে বুক চিতিয়ে দাঁড়াবে কে? 

ফুলিয়া। "ফিরে এসো"র ফুলিয়া। "রাত্রে আটটা রুটির কম যদি খেয়েছ তো আমি মরব"র ফুলিয়া। "তুমি না ফিরলে আমি থাকবা না"র ফুলিয়া। ফুলিয়া।


কাপুরুষতা? হোক। এ যুদ্ধ তাঁর নয়, ফুলিয়া তাঁর।  সাহসীর রূপকথা যে ইতিহাসের শেষ কথা, সে ইতিহাস তাঁর নয়। একটা তলোয়ারের ঝনাৎহীন বিকেলের জন্য সর্বস্বান্ত হতে চাইছিলেন সেনাপতি।  সে গল্পে মহাভারত লেখা হবে না। কিন্তু। ফুলিয়ার গায়ে গা ঠেকিয়ে সাদামাটা সংসারের চালডালতেলনুন হিসেব করে আরও বছর তিরিশেক বেঁচে থাকা যাবে'খন।
**
যুদ্ধে প্রাণ দিতে সাহস লাগে। দুনিয়া সে সাহসকে সেলাম করে। স্মৃতিসৌধ তৈরি করে, নতজানু হয় সে শহিদদের স্মৃতির প্রতি। মন্দের বিরুদ্ধে ভালোর হয়ে আজীবন জানকবুল করে প্রতিবাদ করে যাওয়ার সাহস আরও দুর্বার। তা নিয়ে অমরত্বের কবিতা লেখে মানুষ ও ইতিহাস।

কিন্তু কাপুরুষত্বের কলঙ্কে ডুব দিয়ে সাধারণ হতে চাওয়ায় যে অন্ধকার, তার ভার ঈশ্বর সৃষ্ট দুনিয়া কোনও মতেই বইতে পারে না।


"ফুলিয়া, আমি ফিরে এসেছি! দরজা খোল! খোল দরজা"।

আচমকা সেই দুপুরের নিরবিলির ভাঙা মুহূর্তে সেনাপতির কণ্ঠস্বর শুনে হুড়মুড়ে বিহ্বলতায় গুঁড়োগুঁড়ো হয়েছিল ফুলিয়া। 

সেই ডাক শুনে সদর দরজার দিকে ছুটে যাওয়ার সময়ও ফুলিয়া খবর পায়নি যে তাদের গাঁ থেকে দেড়শো ক্রোশ দূরে রাজ্যের যুদ্ধশিবিরে; কাপুরুষ বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি বীরেন্দ্র নারায়ণকে সে সকালেই সত্যের উপাসক রাজার হুকুমে ফাঁসিতে লটকানো হয়েছে।