দোতলার জানালা দিয়ে দেখা যায় এক ফালি গলি যা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভেসে ভেসে হ্যারিসন রোডে গিয়ে মিশছে।
রাত পৌনে তিনটে। ঠিক এই সময় বেড়ালটা এসে বসে মেসবাড়ির দরজাটার সামনে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ওর ছায়া চারগুণ হয়ে গলিতে ছড়িয়ে পড়ে। নিবিষ্টমনে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সাদায় বিস্কুট মেশানো বেড়ালটা। স্থিতধী, অবিচল। লেজটা একটা নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেলে পাকানো থাকে, ডগাটা মাঝেমধ্যে নড়ে ওঠে শুধু। নড়ে ওঠাটা বোধহয় চিন্তার বাড়তি কিলবিল।
দোতলার ঘরের পূবের দিকের দুটো বেডের মাঝে যে জানালা, সে'টা দেড় মানুষ সমান - মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। উপরে দু'টো, নীচে দু'টো বেঢপ সাইজের পাল্লা।
তার শিকে মাথা ঠেকিয়ে অরূপ একমনে বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকে। রুমের বাকি তিনজনের মধ্যে একজন ঘুমিয়ে কাদা, অন্য দু'জন অজয়দার ট্যুয়েন্টি নাইনের মজলিসে। অজয়দার রুম থেকে মাঝেমধ্যেই টেবিল চাপড়ানো আস্ফালন আর খিস্তির রিলে ভেসে আসছে।
অন্য রুম থেকে মিহি এফ এমের সুর ভেসে আসছে। আলটপকা হিন্দী গান। দু'টো শিকের মাঝে নাক আর একটা গাল চেপটে বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকে অরূপ।
রাতের কলকাতার একটা নেশা আছে, সে নেশার গন্ধ এ জানালার ফিল্টার দিয়ে অরূপের বুকে এসে পড়ে রোজরাতে।
ক্রমশ অরূপের দৃষ্টি স্থির হয়ে আসে। গলি, ল্যাম্পপোস্ট, বেড়াল, বেড়ালের ছায়া, হ্যারিসন রোড সমস্ত মিলেমিশে থেবড়ে যায়।
সেই থেবড়ে যাওয়া আবছায়া থেকে মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে পাড়া, পাড়ার ক্লাব, স্কুলের মাঠ, ঝিমলি, বাড়ি, বাড়ির ছাদ, ঠাকুমার পান ছেঁচা, মা। মা।
অরূপ বড় হতে হতে একটা সহজ ব্যাপার ঠাউরেছে যে মা আর যাই হোক পারফেক্ট নয়। আর সে জানাটা যত বাড়ছে, মায়ের প্রতি কান্না তত জমা হয়। সেই কদ্দিন আগে মানুষটা বিয়ে করে সব ছেড়েছুড়ে চলে আসে। মা হারমোনিয়াম ছেড়েছে। জেন্ডার ইকুয়ালিটি নিজের হাতে বঁটিতে কুচিয়েছে। মা সত্যিই ভীতু ; পরিবারের সুনাম বদনামের ভয়, বাবার শরীরের ভালোমন্দর ভয়, অরূপের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা। মায়ের অব্যবহারের হারমোনিয়ামের বাক্সের জন্য বাড়ির কার্পেট এরিয়া কমে যাচ্ছে বলে বাবা মাঝেসাঝে বিরক্তি প্রকাশ করেন। মা সমস্ত বিরক্তি শুষে নিতে পারে। মা পারফেক্ট হলে গান হারাতে দিত না। ইম্পার্ফেকশন বড় মায়াবী। অরূপের বুকে "মা মা" ডাক কুণ্ডলী পাকায়।
- "অরূ, তোর কাছে লোটাকম্বল দেখেছিলাম না"? বল্টেদার ডাকে সম্বিৎ ফেরে। বিড়ালটা যেন অরূপের কনসেন্ট্রেশনের জোরেই আটকা পড়েছিল। অরূপের দৃষ্টির ফোকাস সরতেই সেও লেজ গুটিয়ে হাওয়া।
- "সঞ্জীব তোমার মেলোড্রামাটিক লাগে বলেছিলে না? আজ এই অসময়ে"?
- "অফ কোর্স। মেলো বলে মেলো। মেগা মেলো। আসলে বালিশটা ঠিক সাফিশিয়েন্টলি মোটা নয়। ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে। তোর লোটাকম্বলের যা থিকনেস দেখেছি...পারফেক্ট গ্যাটিস হয়ে যাবে"।
- "বইয়ের তাক। নীচের শেল্ফ। হানিফের অ্যাকাউন্টেন্সি বইটার নীচে"।
- "থ্যাঙ্কস, কালই ফেরত পেয়ে যাবি"।
- "তোমার বালিশ আমি কাল রোদে দিয়ে দেব"।
- "হেহ্, গুড নাইট"।
1 comment:
এরপর আর আগায় নি কেন। ক্যারেক্টারগুলো বেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাকি পর্ব গুলো কষ্ট হলেও লিখে ফেলুন। গল্পের শেষটা না জানলে, জল খেয়েও পিপাসা না মেটার মতো অস্বস্তি থেকে যায়।
Post a Comment