শিরশিরে একটা স্পর্শ, পিঠের নিচের দিকটায়, মেরুদণ্ড ঘেঁষে - কয়েক সেকেন্ডের জন্য অনুভূত হয়েছিল।
আর তারপরই নেমে আসে যন্ত্রণার অমোঘ ভার। দম বন্ধ করা ব্যথা ওর চিৎকারটুকুও গিলে ফেলেছিল। হাফ শার্টের পিঠের জুড়ে তাজা রক্তের উষ্ণতা।
আমহার্স্ট স্ট্রিটের এ অঞ্চলটা নিরিবিলি। আলো কম। দূরের ল্যাম্পপোস্ট থেকে ভেসে আসা ঘোলাটে আলোয় তৈরি করা আবছায়ায় ধুপ্ করে লুটিয়ে পড়ল অমূল্য।
আর তখনই পিছন থেকে যে পাথুরে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, তাকে কফিহাউসের উদ্দাম গমগমের মধ্যেও নিশ্চিন্তে চিনে নিতে পারবে অমূল্য; বিপিনদা। কবি বিপিন দত্ত।
- চিন্তা করিস না অমূল্য, তোর হাতে এখনও মিনিট পাঁচেক সময় আছে।
- বি..ব...বিপিনদা...তুমি? তুমি?
- কবিশ্রেষ্ঠ শ্রী অমূল্য চক্কোত্তি। কবিদের এত সহজে অবিশ্বাসী হতে নেই।
- তুমি...তুমি..উন্মাদ।
- উন্মাদ। তবে ট্রেটর তো নই রে অমূল্য। কবিতাকে বেচে খাইনি।
- ক...কী বলছ?
- তুই ভুলে গেছিস, আমি ভুলিনি। আমাদের দিনের পর দিন আলোচনা চলেছে। কবিতা নিয়ে। কবিতার প্রতি ভালোবাসা নিয়ে। কবিতা ছাড়া কোনও আনুগত্য থাকার কথা ছিল না আমাদের। কিন্তু তুই ছোটা শুরু করলি অন্যদিকে। বড় পাবলিশার। বড় দাদারা। বড় দিদিরা। পুরস্কার।
- আমি সাহিত্য পু..পুরস্কার পেয়েছি বলে...।
- পেয়ে অন্তত তোর মুখোশটা খুলে গেছে। তুই যে আদতে একটা ঢ্যামনা বিজনেসম্যান সে'টা স্পষ্ট হয়ে গেছে। তুই কবিতা লিখতে চাস না। তুই সেলিব্রেটি হতে চাস। তোর ওই ফেমাস দাদা দিদিদের মত তুই ম্যানুফ্যাকচারিং শিখতে চেয়েছিলিস। শোম্যানশিপ। কবিতা ম্যানুফ্যাকচারিং নয় অমূল্য। তোকে শেখানোর চেষ্টা করেছিলাম। তুই শিখলি না। আমার পত্রিকায় লেখা না দিয়ে বড় নাম দেখে লেখা পাঠালি। ভালোই হল। বড় পুরস্কার পেলি। দশটা লোকে তোর কথা জানল। তাই আমিও ভাবলাম তোকে একটা গিফ্ট দিই। কনগ্র্যাচুলেশনস।
- আজ...আজ বুঝলাম..।
- কী? কী বুঝলি?
- রে..রেড..রেড ওয়াইন তোমার...তোমার..বুঝলাম তোমার রেড ওয়াইন টক লাগে কেন।
অমূল্যর আরও দু'মিনিট বাঁচার কথা ছিল। কিন্তু ওর শ্লেষ সহ্য করতে পারল না বোধ হয় বিপিন দত্ত। ওর পিঠ থেকে ছুরি খুবলে বের করে দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ বারের জন্য বিঁধিয়ে দিল বিপিনদা, তবে এবার বুকে।
এক সময় অমূল্যকে বড় স্নেহ করতেন বিপিন। ছেলেটার রক্তাক্ত লাশটার দিকে তাকিয়ে সামান্য মায়া হল। শেষকৃত্যর দায় অনুভব করলেন বিপিন দত্ত। নিজের কাঁধের ঝোলা হাতড়ে একগুচ্ছ কাগজ বের করলেন তিনি; গত দশবছর ধরে জমানো বড় প্রকাশকদের অসংখ্য প্রত্যাখ্যানের চিঠি আর বিভিন্ন পুরস্কারের জন্য গোপনে পাঠানো মনোনয়নের ব্যর্থ কপি।
লাইটারে সে কাগজের গোছায় আগুন ধরিয়ে অমূল্যর মুখাগ্নি করলেন বিপিন দত্ত। আর ঠিক তখনই তাঁর আগামী কবিতার প্রথম লাইনটা মাথায় এলো;
"না পাওয়া পুরস্কারের প্রতি কবির লোভ থাকতে নেই..."।
No comments:
Post a Comment