Wednesday, March 29, 2017

হিজ মাসটার্স

- এই যে। এ'বার সিলিং থেকে নেমে আসুন। দেরী হয়ে যাচ্ছে যে।
- আপনি না গেলে আমি নীচে নামছি না।
- ছেলেমানুষি করলে কি হয় স্যার? আপনার জন্যেই আসা। আপনাকে না নিয়ে যাই কী করে। আর ভেসে বেড়াবেন না। নেমে আসুন।
- মিথ্যে কথা। আমি মরিনি।
- রক্তমাংসের বডি নিয়ে এর আগে কোনওদিন ভাসতে পেরেছেন?
- নিজের অজান্তেই লেভিটেশন শিখে গেছি হয়তো। আপনি আসতে পারেন। আমি ভাসি মরি, নিজেরটা নিজে বুঝে নেব।
- কী মুশকিল। লাশ দেখেও ধন্ধ কাটছে না?
- ও বডি আমার নাও হতে পারে।
- বটে? ইয়ার্কি হচ্ছে? দিব্যি বুকে ছুরি হজম করে অক্কা পেলেন। মেঝেতে জ্বলজ্বল করছে আপনার ভুষো কালী মাখানো বডির রক্তে চপচপ বুক। এখন নিজের বডিকে ডিনাই করছেন?
- বেশ করেছি। আপনি আসুন।
- আত্মা ক্লীয়ার করতে এসে এ কী ঝামেলা। নামবেন না কি আপনাকে আনপ্রসেসড স্টেটে রেখে চলে যাব?
- আপনার আইকার্ড আছে?
- মানে?
- মানে এই যে আত্মা কলেকশনে এসেছেন, আপনার কাছে আইডেন্টিটি কার্ড আছে? বা সুপারিশের চিঠি? যার তার কাছে নিজেকে হ্যান্ডওভার করব কেন? আছে? আইকার্ড?
- আলবাত আছে। আগে নামুন, তারপর দেখাব।
- আগে দেখান তারপরে নামব।
- আগে নামুন।
- আগে দেখান।
- আচ্ছা ঘ্যাঁতা মাইরি আপনি।
- আগে দেখান।
- এই যে। এই দেখুন আইকার্ড। আর এই হল সুপারিশের চিঠি। আর এ'টাও জেনে রাখুন যে আমি ছাড়া আপনার হিল্লে হবে না। কাজেই সুড়সুড় করে নেমে আসুন দেখি!

আইডেন্টিটি কার্ডটা ঘরের আঁধারেও জ্বলজ্বল করছিল।  তা'তে লেখা নামটা সিলিং থেকেও স্পষ্ট পড়তে পারলেন ভাসমান ওথেলোবাবু; "শ্রী উৎপল দত্তের কণ্ঠস্বর"। সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো সুপারিশের চিঠির অমোঘ টানে ছাত থেকে হুড়মুড়িয়ে নেমে এলেন ভদ্রলোক।

বিনু মা ও বাবা

বিনুর মা চিরকালই অ্যানালিটিকাল।
মুখ শুকনো কেন?
নিশ্চই দুপুরে ঠিক করে খাসনি।
নিশ্চই বড্ড চাপ পড়ছে আজকাল।
এক গ্লাস হরলিক্স যদি অন্তত রোজ নিয়ম করে...।
নিজের প্রতি একটু যত্নশীল না হলে চলবে কী করে?

ও'দিকে বিনুর বাবা চিরকালই অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড।
মুখ শুকনো কেন?
মামাদের নেকু ধাত পেয়েছে। সবসময় ম্যাদা মেরে আছে, নিনকম্পুপ।

বিনুর মা চিরকালই নরম।
একটু লেবুর সরবত খাবি বাবা? এই গরমে যা দৌড়ঝাঁপ করতে হয় তোকে অফিসে।

বিনুর বাবা চিরকালই মর্মভেদী। বিনুকে দেখলেই হারানো জিনিসের কথা মনে পড়ে।
খেলার পাতাটা কোথায় রে রাস্কেল? আমার চশমার খাপ খুঁজে বের কর। ক্যুইক।

বিনুর মা অবশ্য চিরকালই বিনুর বাবার ছাদফাটানো গর্জনে অভ্যস্ত।
শুধু মাঝেমধ্যে সে কণ্ঠ ভিজে তুলোর মত হয়ে আসে;
"গতকাল থেকে বিনুর বোধ হয় মন কেমন! খোঁজ নাও। ও চিরকালই মা ন্যাওটা, আর হ্যাঁ...." ভিজেতুলো থেকে সেই গলা চট করে কামানের গোলা লেভেলে উঠে যায়, "ব্যাটাচ্ছেলেকে ফাইনাল ওয়ার্নিং দিয়ে দিও। ফের যদি স্পোর্টস সেকশন হাতে বাথরুমে যেতে দেখি, তাহলে ওকে আমি কমোডে কবর দেব"।

Tuesday, March 28, 2017

বুর্জোয়া গরীব

দেখুন। পয়সাকড়ির বড় অভাব। বেশ কিছুদিন ধরে নিজেকে ক্রমশ গরীব গরীব মনে হচ্ছে। আর এই মনে হওয়াটা উত্তরোত্তর বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। দিস এভার গ্রোয়িং সেন্স অফ পকেটখালিনেস্‌, বুঝলেন, মাঝেমধ্যেই পেট খালি করে দিচ্ছে।
আহ্‌। পয়সার অভাবে না খেয়ে আছি তা নয়। মাঝেমধ্যেই চপকাটলেট জুটছে। হাটারির চাউমিন। আরসালানের বিরিয়ানি। কিন্তু অভাবের ডেফিনিশনটা এইবেলা ফ্লেক্সিবল না করলে চলছে না। এ যুগে দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া-অভাবকে অস্বীকার করার কোনও মানে হয় না। স্যালারি, ইনক্রিমেন্ট, বোনাস, মিউচুয়াল ফান্ড; সব চটকেও হচ্ছে না। অনটন প্রতিনিয়ত টনটন করে চলেছে।  
ফ্লুরিজ্‌কে নাক সিঁটকে “ওভারপ্রাইসড” না বলে কোনও উপায় থাকছে না। তিনশো টাকার ওমলেট। প্লাস ট্যাক্স বোধ হয়। শেষ সেই দু’হাজার তেরোয় খেয়েছিলাম। এখন ট্র্যাডিশনের ভাঁওতা দিয়ে লোকজনকে বসন্ত কেবিনে ডাকতে হয়। বুর্জোয়াগরীবদের বন্ধুরাও বুর্জোয়াগরীবই হয়। অতএব কেউ আমায় বড় একটা ফ্লুরিজে খাওয়াতে ডাকে না। ফ্লুরিজে গিয়ে ডাচ করতে হলেও চুঁচুড়া হয়ে যেতে হবে। এইসব খুচখাচ দুঃখ বড় প্রবল হয়ে দাঁড়াচ্ছে আজকাল।
তারপর ধরুন কোনও পেল্লায় শপিং মলের লিকার শপে ঢুকলাম। সমস্ত ঝকমকে ব্র্যান্ড। সিঙ্গল মল্ট। দামী ওয়াইন। ইত্যাদি। আমার দৌড় ওই ওল্ডমঙ্ক। বুর্জোয়াগরীব। ইউজার ম্যানুয়ালে ভাঙার ইন্সট্রাকশন আছে কিন্তু মচকানোর কোনও রেফারেন্স নেই। অতএব ওল্ডমঙ্কটুকুও গিলতে হবে “ট্র্যাডিশন আর ঐতিহ্য” বলে বুক বাজিয়ে। পকেটের সঙ্গে গলা কাটলেও সিঙ্গল মল্টের বোতল ছুঁয়ে দেখার ধক্‌ নেই। আর ধক্‌ দেখাতে গেলে একটানা দেড়মাস রাতে মাছ ভাতের বদলে এক ছিপি সিঙ্গল মল্টে চারটে রুটি চুবিয়ে চুবিয়ে খেতে হবে।
টরেন্টের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুনে আমার বুক ফেটে যায় আমি এত গরীব। রিয়েলি। বিশ্বাস করুন।
ইলিশের সিজন এলে ভয় লাগে। ফেসবুকে স্বাদে ভেসে যাওয়ার কথা লিখতেই হবে, পীয়ার প্রেশার। অথচ এ’দিকে হপ্তায় দু’দিন এক কিলো সাইজের আসল পদ্মার ইলিশ কিনতে হলে সিটিসির অর্ধেক মাছের বাজারে হরির লুঠ হিসেবে ফেলে আসতে হবে। অতএব পাতে স্রেফ ডায়মন্ড হারবারের বিস্বাদ খোকা ইলিশ, আর ফেসবুকে বাতেলা; ইলিশ ইজ লাভ (লাল রঙের হার্টসাইন সহ)।
টাকা নেই স্যার। অরিজিনাল স্ক্রিনগার্ড বা ফোনকভার কিনবো, সে দুঃসাহস আমার নেই। আমাদের মত বুর্জোয়া-গরীবদের সে বারফাট্টাই থাকতে নেই। গড়িয়াহাটের ফুটপাথ ছিল তাই ফোনের জামাকাপড় জুটছে। টাকা নেই।
“এয়ারইন্ডিয়া বাপের জন্মে টাইমে থাকে না” বলে যে সামান্য দুঃখ করব তার উপায় নেই। ছ’মাসে ন’মাসে কখনও হয়তো অফিসের ঘাড় ভেঙে ফ্লাইটে চড়ার সুযোগ আসে। এবং একবার প্লেনে উড়তে পারলে আগামী দেড় বছর সুটকেস থেকে এয়ারলাইনের ট্যাগ ছেঁড়া হয়ে ওঠে না। “বম্বে মেল কত নম্বরে” খোঁজ করেই কেত শেষ হবে। এর বেশি আর স্টেপআউট এই মাইনেতে হয় না।
তাছাড়া আমি নিশ্চিত ইউরোপ অপূর্ব জায়গা। একবার ঘুরে আসতে পারলে ধন্য হয়ে যাব। অথচ দাড়ি চুলকে লোকজনকে বলতে হয় “ক্যাশ্মের টু কন্যাকুমারী, কী নেই আমাদের দেশে”? ব্যাঙ্কে ছড়ানোর মত পয়সা থাকলে লোলেগাঁও ছেড়ে সুইজারল্যান্ড যাবো, বিশ্বাস করুন। খুব যেতে চাই। যদ্দিন টাকা না আসে তদ্দিন অবশ্য পুরুলিয়াতে বসে জিওর ফোরজি কনেকশনে মাসাইমারার ভিডিও দেখা ছাড়া বিশেষ উপায় নেই।
সবচেয়ে বড় কথা। বুর্জোয়াগরীব না হলে সঞ্জীব সঞ্জীব হাওয়া তুলে ছাতে গিয়ে প্রেম করতে হত না। এস্পারওস্পার হত ফাইন ডাইনিঙে। দামী পারফিউমে। গেঞ্জি পাজামা পরে বাড়ি কাঁপিয়ে ঘোষণা করতে হত না “তোমার বার্থডে স্পেশ্যাল চিকেনটা যা কষিয়েছি না! জিভে লেগে থাকবে টু থাউজ্যান্ড নাইনটিন পর্যন্ত। আর ইয়ে, গিফটে কথোপকথনের সেটটা পছন্দ হয়েছে তো? পূর্ণেন্দুবাবু তোমারই জন্য লিখে গেছিলেন বোধ হয়”। পূর্ণেন্দুবাবুর থেকে বাইশ ক্যারাটের রেফারেন্স দেওয়াটা বেশি অভিপ্রেত। বিশ্বাস করুন। কিন্তু ওই। বুর্জোয়াগরীব মানুষ, সাহিত্যপ্রেমের বাব্‌লর‍্যাপে নিজেকে মুড়ে না রেখে উপায় আছে?  

Sunday, March 26, 2017

ফেসবুক, জিন্দেগী ও ভ্যারেণ্ডা

আদত জীবন ফেসবুকের মত হলে সুবিধে হত।

স্ক্রোল করতে পারাটা খুব দরকারি। কেউ মিউচুয়াল ফান্ড বা পলিটিক্স নিয়ে ভালো ভালো কথা বললে স্ক্রল করে এগিয়ে যাওয়া যেত।

"আর খবরটবর বলুন"বলিয়েদের আনফলো করে রাখলে তাঁদের সঙ্গে মোলাকাতের আর সুযোগ থাকত না।

বৌ গুম থাকলে নিশ্চিন্তে জিজ্ঞেস করে ফেলতাম "হোয়াট ইজ অন ইওর মাইন্ড"?

বর্ষাকালে প্রকাশিত পুজোবার্ষিকী দেখলেই নির্দ্বিধায় স্প্যাম বলে রিপোর্ট করতাম।

বাজারে প্রথম হিমসাগর দেখলেই টুপ করে একটা চকচকে হার্ট শেপের বুদবুদ আমার সামনে ভেসে উঠত।

স্যান্ডো গেঞ্জি ঢলা পাজামায় মোড়া আলো করে বসে শ্যামাসঙ্গীত গাইব, প্রাইভেট পোস্টে। ক্লোজ ফ্রেন্ডস অনলি।
পাবলিক পোস্টে চিবিয়ে চিবিয়ে পলিটিকাল জ্ঞান ঝেড়ে দু'চারজনকে মোরন বলবো।

সো অন অ্যান্ড সো ফোর্থ।

হিমালয় ডাকেগা তো লগ অফ করেগা। নয়তো ভ্যারেণ্ডা ভাজতা রহেগা।

লিপির মনের ভিতরে

- হ্যালো।
- হ্যালো! লিপি!
- উঁ। বলো। কী ব্যাপার, এত রাত্রে?
- জানি এত রাত্রে তোমায় ফোন করাটা ঠিক নয়..তবে ইয়ে...খুব আর্জেন্ট একটা কথা ছিল।
- কাল বললে হয় না অতনু? লাঞ্চে অফিস থেকে কল করে নেব।
- কিন্তু লিপি...ব্যাপারটা খুব ক্রিটিকাল। এখুনি না জানালে...।
- বলো। শুনি।
- একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেছে লিপি। সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড।
- কী ব্যাপার? কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড?
- খুব ঠাণ্ডা মাথায় শোন! কেমন?
- আরে ব্যাপারটা কী বলবে তো! রাতদুপুরে এত ধানাইপানাই  ভালো লাগে না।
- তুমি বুঝতে পারছ না। খবরটা জানার পর তোমার মাথা ঠাণ্ডা রাখাটা খুব জরুরী।
- কী খবর অতনু?
- খবরটা হল। আসলে...মানে যাকে বলে...ইয়ে...।
- কী ইয়ে?
- ব্যাপারটা হল গিয়ে..তুমি আসলে আমার প্রেমে পড়ে গেছ।
- হোয়াট?
- তুমি। লিপি দত্ত। আমায়। অর্থাৎ অতনু ঘোষকে। ভালোবাসো।
- হোয়াট?
- স্পষ্ট। জলের মত। তবে ঘাবড়ে যেও না। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
- আমি তোমায় ভালোবাসি?
- আমি জানি তুমি অবাক হচ্ছ। আসলে তুমি বুঝতে পারছ না যে তুমি আমায় ভালোবাসো। কিন্তু মনের গভীরে...অল্প গভীরে নয়...একদম তলার দিকে...তোমার মনে আমার জন্য কিলো কিলো প্রেম জমে রয়েছে।
- ইয়ার্কি হচ্ছে? তুমি তিন বার প্রপোজ করার বাঁদরামো করেছ আগে। সহ্য করেছি। কিন্তু এ'সব কী হচ্ছে?
- সাবকনশাস লিপি। সব সাবকনশাসের খেল। খুব জটিল ব্যাপার।
- শোনো। আমি তোমায় ভালোবাসি না।
- অত হুড়মুড় করে ফেলো না...সিচুয়েশনটা বোঝো...। এই যে আমার প্রতি ভালোবাসা তোমার অন্তরে ফল্গুধারের মত বয়ে চলেছে...।
- শাট আপ অতনু। শাট। আপ। আমি অরিজিৎকে ভালোবাসি। আগামী সপ্তাহে আমাদের বিয়ের পাকাকথা।  আর আদতে তুমি জ্বলেপুড়ে পাগল হয়ে যাচ্ছ...।
- জেলাস? আমি? তুমি জানো রীতা আমায় নিয়মিত ঢলঢলে মেল করছে? সুনন্দা আমায় হার্টসাইন দিয়ে রোজ ভোরে হোয়্যাটস্যাপে পিং করে? সেই আমি জেলাস হব? প্রেমট্রেম আমি নিজেই অ্যাভয়েড করি। আমার ব্যস্ততার মধ্যে রোম্যান্সের সময় কই? তোমার প্রপোজ করেছি বটে আগে। তবে সে'টা এক ধরণের সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্ট বলতে পারো।
- তুমি একটা অসহ্য মানুষ অতনু। এই রাত্রে এত বাজে কথা শুনতে ভালো লাগছে না। ফোন কাটছি।
- প্লীজ না। আই মীন, তোমার কষ্ট হবে এমন দুম করে কথা বন্ধ করলে। ভালোবাসার নেচারটাই এ'রকম! তোমার কিছু করার নেই লিপি।
- উফ! বাবা গো!
- ব্যাপারটা অনেকদিন ধরে পুষে রেখেছিলে। বলা ভালো, বুকে পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিলে। ভালো হলো আজ খোলতাই আলোচনা হয়ে গেল। তোমার মনের ভার খানিকটা লাঘব হলো।
- আমি। আমি তোমায় ভালোবাসি? তোমার মত একটা ঘ্যানঘ্যানে ছেলেকে?
- অবাক লাগছে,  তাই না? জানতে পেরে আমি নিজেই অবাক হয়েছি। যাক গে, এখন যখন জানাজানি হয়েই গেছে তখন আর আলোচনায় দ্বিধা কেন। তবে আমি আবার দুম করে 'আমিও ভালোবাসি' বলে ফেলত পারব না, কেমন? প্রেমট্রেম এখনই তেমন ভেবে উঠতে পারিনি। তাছাড়া আমি বরাবরের লাজুক। কাজেই এখনই তোমায় হলফ করে বলতে পারছি না যে আমরা মিউচুয়ালি প্রেম করবই। তবে চান্স যে নেই তা নয়। আর চান্স যেহেতু আছে, সেহেতু তুমি তোমার ওই সাজানো প্রেমিক অরিজিৎকে বলে দিত পারো যে বিয়েটা আপাতত ক্যান্সেল।
- অরিজিৎ সাজানো? হোয়াট ননসেন্স?
- ও মা! এই সহজ ডিফেন্স মেকানিজমটা ধরতে পারোনি? তুমি আমার প্রেমে পাগল অথচ বলতে পারছ না। একটা প্রেশার রিলীজ ভাল্ভ দরকার তো। অরিজিৎ হচ্ছে তাই। ও'সব নিয়ে ভেবো না।
- তুমি উন্মাদ! আমি তোমায় ভালোবাসি না।
- আহ্হা! আ ক্লাসিক কেস অফ সেল্ফ ডিনায়াল!
- অসহ্য। তা তুমি কী করে জানলে? যে আমি মনে মনে তোমায় ভালোবাসি?
- জলের মত সহজ তো। আমায় পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তোমার এতটাই যে পোষা হুলোর নাম দিলে সিলি।
- তো?
- সিলিকে যখন বাড়ি এনেছিলে তখন আমি নর্থ বেঙ্গলে ছিলাম। অফিসের ট্যুরে শিলিগুড়িতে। তখনও তোমার অবচেতনে ছিলাম আমি আর মন জুড়ে ছিল শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ির শিলি নিয়েই তুমি সিলি নাম ভেবেছ। সাবকনশাসলি।
- উফফ! মাগো!
- তারপর এই অরিজিৎ।
- অরিজিৎ কী করল?
- ওই নামের ছেলেই কেন পছন্দ করলে জানো? কারণ তোমার অন্তর আমায় পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। মনে মনে তুমি আমার কাছে হেরে যাচ্ছিলে। তুমি ভাবছিলে যে আমি তোমায় ভালোবাসায় হারিয়ে দিলাম। তুমি হারের স্বীকারোক্তি হিসেবে আমায় গোপন মেসেজ দিতে চাইলে; অতনুরই জিত। অর্থাৎ অ'রই জিত। তাই অরিজিৎকে বেছে নিলে।
- হোয়াই ডোন্ট ইউ ডাই?
- তোমায় এমন অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে? ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি তোমায় সহজে ছেড়ে দেব না লিপি। হ্যালো? হ্যালো? এ কী! যাহ্। লাইন কেটে গেল যে।

Friday, March 24, 2017

অনির্বাণ আর কলিংবেল

কলিং বেলের স্যুইচটার দিকে বড় মায়া নিয়ে তাকিয়েছিল অনির্বাণ। বছর সাতেক আগে স্যুইচটা ছিল ধবধবে সাদা, বুকে লাল রঙের ঘণ্টি আঁকা। নতুন ফ্ল্যাটের সমস্ত ইলেক্ট্রিকাল জিনিসপত্র চাঁদনির বাজার থেকে কিনেছিল অনির্বাণ, মিতার সঙ্গে। এর টিংটং কর্কশ নয় একদমই, বরং বেড়ালের মত আদুরে।  এখন সে কলিং বেল হলেদেটে, তার বুকের ঘণ্টি আবছা। তবে টিংটংটা আগের মতই পশমি নরম।

সেই কলিং বেলটা। গত তিন বছর ধরে রাতের ঠিক এ সময়টা এসে বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করে অনির্বাণ। এই, রাত তিনটে নাগাদ। মিনিট দুয়েকের মাথায় মিতা উঠে আসে। এলোমেলো আঁচল আর কপালে উড়ে আসা চুল। মিতা, জুঁই গন্ধের মিতা। কলেজ পালানো দুপুরের মিতা। রেজিস্ট্রি বিয়ের দুপুর আলো করা হাসির মিতা। ঘাসে গা এলিয়ে দেওয়া আলস্যের মিতা। সে রোজ এসে দরজা খোলে।

অনির্বাণ বুঝতে পারে যে মিতা তাঁর উপস্থিতি টের পায়, অনুভব করতে পারে। অথচ মিতার চোখে আজও ভয় দেখেনি অনির্বাণ,  এই তিন বছরে একবারও না। রাত আদরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলে, ক্রমশ মিতার চোখের ছলছলে অনির্বাণের অস্থিরতা কাটে। রাতের বাতাসে মিলিয়ে যেতে মিনিট তিনেক সময় নেয় অনির্বাণ, সেই মিলিয়ে যাওয়াও ছুঁতে পারে বোধ হয় মিতা।

শুধু আজকেই কেমন সমস্ত গুলিয়ে গেল। অনির্বাণ মিলিয়ে যেতে পারছিল না। মিনিট দশেক হয়ে গেল, সে নিজে যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল রাতের আবছায়ায়। কী হল? মিতা কি এখনও অনুভব করতে পারছে তাকে?

পরক্ষণেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো অনির্বাণের। টের পেল যে প্রথমবার মিতা সোজা তার চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে। ওর নীল সাদা ছাপার শাড়ি মেঘ মেঘ হয়ে অন্ধকারে মিশে, ওর কোমর ছাপানো চুল বাতাস নিয়ে ছেলেখেলা করছে।

এক পশলা বৃষ্টির মত রাতের বাতাসে শীত ছড়িয়ে ঝরে পড়ার আগে অনির্বাণ খেয়াল করল যে কলিং বেল বাজানোর পর মিতা যথারীতি বাইরে বেরিয়ে এলেও, সদর দরজাটা খোলা হয়নি আদৌ।

টিভির রিমোট

টিভির রিমোট বড় সংবেদনশীল বস্তু।

এ জিনিস যার হাতেই থাক তাকে ফেরেব্বাজ বলে মনে হয়। সামনে চলন্ত টিভি থাকলেই পাশে বসা রিমোট হাতে মানুষটার প্রতি অবিশ্বাস দৃঢ় হয়। হবেই। এই বুঝি চ্যানেল পালটে দিলো, এই বুঝি চ্যানেল পালটে দিল। রিমোট হারানোর সঙ্গে সঙ্গে জীবনে নেমে আসে একটা হাত কামড়ানো অস্বস্তি।

হয়তো আপনার মনে হল নিউজচ্যানেল ট্যু নিউজচ্যানের খেউর শুনে মন ভালো করবেন, অথচ রিমোটওলা মন দিয়ে ডিসকভারিতে পোলারবিয়ারের গ্যাস অম্বলের ধাত নিয়ে একটা অনুষ্ঠান দেখে চলেছেন। আপনাদের ইতিউতি কথা হচ্ছে বটে কিন্তু রিমোটওলার মন রয়েছে টিভিতে আর আপনার মনে ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে স্লোগান "রিমোটওলা হাড়বজ্জাতের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও"।

একটা ঘরে যদি বুদ্ধ (গৌতম), গান্ধী (মোহনদাস), একটা কেবল-সহ টেলিভিশন, একটা রিমোট আর একটা বন্দুক রেখে দেওয়া হয়, তাহলে বাহাত্তর ঘণ্টার মাথায় একটা লাশ পাওয়া যাবে। যাবেই। কেউ মন দিয়ে গবেষণা করলে জানতে পারবেন যে টেলিভিশন রিমোট আবিষ্কারের সঙ্গে গোটা বিশ্বে ডিভোর্সের সংখ্যা হুড়মুড় করে বেড়ে গেছে।

এই টেলিভিশনের রিমোটের জন্যই ছোটমামাও প্রায় তেত্রিশ বার ডিভোর্সের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছিলেন। ইন ফ্যাক্ট গত শনিবার মামাকে নিখিল তান্ত্রিকের ডেরা থেকে বেরোনোর সময় পাকড়াও করে জানাতে পারলাম যে নিখিল নাকি মামাকে আশ্বাস দিয়েছে যে গোপনে মামীর রিমোট ছাড়ানোর টোটকা তার জানা আছে। এ'দিকে মামীকে যে আমিই প্রতি বিস্যুদবার বিকেলে নিখিলের কাছে নিয়ে আসি সে গোপন খবরের আঁচ মামা পায়নি দেখলাম। নিখিলের ব্যবসায় টার্নওভারের প্রতি কমিটমেন্ট দেখেও ভালো লাগলো।

আমার বহুদিনের শখ ছিল একটা এলইডির। নিখিলেরই কল্যাণে ছোটমামার এলইডি আমার একলার সংসারের শোওয়ার ঘরে প্রতিষ্ঠিত হল অস্ট্রেলিয়া সিরিজের সেকেন্ড টেস্টের আগেই।

ইউটিউব এসে মামাবাড়ির সম্পর্কের একটা ঠ্যাং কফিন থেকে হিঁচড়ে বের করতে পেরেছে। আর হায়ার সেকেন্ডারি ফেল নিখিলের পকেটে টু পাইস যাওয়াটা একটা বাড়তি তৃপ্তির কারণ তো বটেই।

Wednesday, March 22, 2017

এফ আই আর

এফআইআর দিব্যি স্বাস্থ্যকর জিনিস। এ'তে চাপাতি নেই। গায়ে অ্যাসিড ছোঁড়া নেই। গুণ্ডা লাগিয়ে বেধড়ক পিটুনি নেই। এফআইআর হচ্ছে যা'কে বলে ইম্প্রুভমেন্ট।

আমাদের উচিৎ এফআইআরের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা।

অমুকে আমার বই থেকে আমায় না বলে পেজমার্ক সরিয়ে নিয়েছে। এফআইআর।
তমুকে প্যারামাউন্টের ডাব সরবতের গেলাস 'নাপসন্দ' বলেছে। এফআইআর।
ইস্টবেঙ্গল পেনাল্টি পেলে মোহনবাগানের এফআইআর।
বিরিয়ানির আলুর সাইজ ছোট পেলে এফআইআর।

এটিএমের মত হাফ মাইল অন্তর এফআইআর সংগ্রহ কাউন্টার থাকবে। রাগ হলেই সুট্ করে সে'খানে ঢুকে পড়ে এফআই আর করে দেব। রাগ নরম হয়ে আসবে। বেগুনী খেতে ইচ্ছে করবে।

এফআইআরের নেশা ছড়িয়ে দেওয়া হোক। এফআইআর করলে জিও সিম ফ্রী দেওয়া হোক।
সরকার বাহাদুর বছরের সেরা এফআইআর করিয়েকে
এফআইআরভূষণে সম্মানিত করুক।
মোড়ে মোড়ে মাইকে গজল বাজুক "FIR লে আয়া দিল.."।

এ'সব করে যদি চাপাতি বোমা ঠুসে দেওয়া হুজ্জুতিটা সামান্য কমে, সে'টাই হবে এ পুওরর ম্যান'স জায়ান্ট লীপ।

ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার

আপ ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার। বর্ধমান থেকে উঠতো ঝুড়িতে শিঙাড়া আর অ্যালুমিনিয়ামের বালতিতে গরম ডিম সেদ্ধ। সে শিঙাড়ার ভার্টেক্সের নিমকি পরত বাড়তি মজবুত, ভিতরে সাদাসিধে হলদে আলুর তরকারি। সেই শিঙাড়া দু'টো।

আর ডিম সেদ্ধ এক পিস। আধ ফালি করে মধ্যিখানে বিটনুন ছড়ানো। আর ভিড় ট্রেনকামরার হাওয়া গায়ে লাগলে ডিমসেদ্ধর স্বাদ দশগুণ বেড়ে যায়।

তখন শিঙাড়া মিলতো শালপাতার দোনায়,  ডিমসেদ্ধ থাকত চৌকো করে কাটা খবরের কাগজের পাতায়।
তখন মামাবাড়ি থেকে ফেরা। মনের ভিতর সে কী প্রবল হুহু। বাবা শিঙাড়া ডিমসেদ্ধতে ইনভেস্ট করতেন মনখারাপ ডায়লুট করতে। মনবভার যদি খুব বেশি হত আর ট্রেন যদি বুকস্টলের ধারেকাছে দাঁড়াত, তাহলে জুটত মেগাবোনাস; নারায়াণ দেবনাথ অথবা ডায়মন্ড কমিক্সের অরণ্যদেব বা চাচা চৌধুরী। কিন্তু ডিমের কামড় শিঙাড়ার মুচমুচ আর কমিক্সের ফুরফুরেও কতবার দিদাদাদুর জন্য মনকেমন কাটেনি।

দাদুর চশমা, বুকপকেটের ডটপেন। দিদার সিঁদুর ল্যাপটানো চিরুনি। দাদুর ক্রিকেটের গল্প, দিদার মাখা আম দুধ মুড়ি। ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জারের ঝুপুর ঝুপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে'সব মনে ধাক্কা মারতো। আমি নন্টেফন্টের সুতো আর ডিমসেদ্ধর ছুঁচ দিয়ে নিজেকে এঁটে রাখতাম।

এখনও ময়ূরাক্ষীর ঝুপুরঝাপুর এখন ক্রমাগত বুকে গোঁত্তা মারে,  বিশেষত রাতের দিকে। শিঙাড়া ডিমসেদ্ধর গন্ধ ফেরত আসে। একটু মন দিলে সাবু আর রাকার ঝগড়াঝাঁটিও শুনতে পাওয়া যায় স্পষ্ট।

এখন একটানা শুধু ভীড় ট্রেনের মত দমবন্ধ ভাব।
এখন আর কোত্থাও ফেরত যাওয়ার নেই।

Sunday, March 19, 2017

নয়নতারা ও খোকা


আমি ভালো ফটোগ্রাফ তুলতে পারি না। ফোকাস বুঝি না। কাছে ঘেঁষলে ঝাপসা হয়ে যায়। দূরে দাঁড়ালে ফ্রেম এলোমেলো হয়ে পড়ে। আলো ঠাহর করতে পারি না। কোন রঙের ঘাড়ে কোন রঙ চাপালে দৃষ্টিনন্দন হবে, সে বোধও তেমন নেই।

আমি ভালো ছবি তুলতে পারলে বোঝাতে পারতাম এই নয়নতারাগুলো কী সুন্দর। আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে অন্য কারুর রাখা টব আলো করে আছে। ছাদ আলো করে আছে। বিকেল আলো করে আছে। গোলাপি রঙের নয়নতারা আকছার দেখা যায়, তবে এই রঙটা বড় একটা দেখি না। যদি আর একটু স্থির ভাবে মোবাইল ক্যামেরাটা ধরতে পারতাম তাহলে নয়নতারার পাপড়িগুলো স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ত।
তবু।

আরও বছর তিরিশ পর গুগল ইমেজেস স্ক্রোল করতে করতে এই ছবিটাই দেখে বিকেলের গন্ধ পাব। নয়নতারাগুলোকে স্পষ্ট মনে পড়বে।

নয়নতারা, আলো আলো একটা মেয়ে। ফিক্‌ হাসির মেয়ে। বিকেলের মেয়ে। অল্পবিস্তর সিজোফ্রেনিয়ার ওজন কি সকলেই বয়ে চলে না? এই মেয়েটার সঙ্গে আমার বেশ কিছুদিনের আলাপ। খানিক ভালোবাসাবাসিও আছে। আমার আস্তিনে ওর আঙুলের টান আছে। এমনকি আমার মেসবাড়ির পুরনো গন্ধ মিশে আছে খানিকটা। আমার পরিচিত কলকাতার গন্ধ। টিউশনি সন্ধ্যের আঁচ। দিল্লীর শীতের রাতের ধোঁয়া ওঠা পরোটার ওম। বিহারের রাত্রির ঝকঝকে তারা মাখানো আকাশের গল্প। সমস্ত মিলে আমি নয়নতারাকে চিনি। তার সঙ্গে অল্পস্বল্প কথাবার্তাও হয়। নয়নতারা আমার ভুল, বেঠিক, বিদঘুটে সমস্ত কিছু দেখতে পারে। কিন্তু ঠেলে সরিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায় না। সে মেয়ে জ্বরের খাটে এসে চুপটি করে বসে থাকে।
একরত্তি মেয়ে হলে কী হবে, নয়নতারা কান্না দেখতে পায়। সমস্ত লেখা পড়তে পারে। ছাতের আবডালে হুমড়ি খেয়ে সামনে এসে পড়ে। অবিশ্যি খুকির সামনে নতজানু হতে নেই।

যা হোক। একদিকে নয়নতারা। অন্যদিকে আকাশ ভরা টলটলে মেঘ। বাপ আর ব্যাটা রাস্তায় বেমক্কা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তক্ষুনি, দু’চার ফোঁটা। আর তার মধ্যে থেকে খান দুই ফোঁটা খোকার গায়ে।

প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা। আরও কত অজস্র ভিজে সপসপ মুহূর্ত পড়ে আছে। কাকভিজে হয়ে ফুটবল নিয় হুড়োহুড়ি করবে, মনের মধ্যে একরাশ আকুলিবিকুলি নিয়ে কোনও একদিন ইচ্ছে করে এন্তার ভিজবে হাতের ছাতা না খুলে, বৃষ্টির রাতে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে প্রথম অতুলপ্রসাদ আবিষ্কার করবে, অফিসের মুখে ঝমঝম বৃষ্টি পেয়ে বিরক্তিতে পায়চারি করবে, ভালবাসবে, চিঠি লিখবে।

কিন্তু ভায়া বালিশেন্দ্র, প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে নামার সময় বাবা সঙ্গে ছিল। ভুলে, বেঠিকে, বিদঘুটেমোতে ঠাসা সেই ভদ্রলোক যে ভালো ছবি তুলতে পারে না। ফোকাস বোঝে না, আলো ঠাহর করতে পারে না।

তবু। মুহূর্তটার গন্ধ কি এ ছবিতে থাকবে না? অনেক বছর পরে? যখন ভুল, বেঠিক, বিদঘুটে সমস্ত উবে যাবে? নয়নতারার ছবিটার মত আলো আলো হয়ে থেকে যাবে না?     

Friday, March 17, 2017

পাঁচুগোপালবাবুর চা আর মামলেট

“আসুন, আসুন দীপকবাবু। আপনার পাংচুয়ালিটিকে স্যালুট না করে মশাই থাকা যায় না। সন্ধ্যে ছ’টার অ্যাপয়েন্টমেন্ট, এখনও মিনিট পাঁচেক হাতে রয়েছে”, পাঁচুগোপালবাবু ইশারায় সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন।
“থ্যাঙ্কস”, ধন্যবাদটা জানালাম বসতে বলার জন্য। পাংচুয়ালিটিকে স্যালুট করার কথাটা জাস্ট বাড়াবাড়ি, পাঁচুগোপালবাবুর সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। গতবার আমার হাতের এইচএমটির ঘড়ি দেখে বলেছিলেন যে আমার ঘড়ির ডায়াল দেখেই বোঝা যায় আমি মানুষটা কতটা ছিমছাম। ভদ্রলোককে বলা হয়নি অবিশ্যি যে ঘড়িটা আদতে আমার বাবার।
“চা খাবেন নাকি দীপকবাবু”?
“তা হলে মন্দ হয় না। তবে দুধ ছাড়া প্রেফার করব। অসুবিধে থাকলে অবশ্য দুধের চাই চালিয়ে নেব ”।
“নিধু, নীচ থেকে দু’কাপ চা নিয়ে আয় বাবা। লেবু দিতে বলিস, কেমন”?
“মার্চ শেষ হতে চললো, গত বছরের ক্যালেন্ডারটা এবারে সরান পাঁচুগোপালবাবু”।
“সরাব সরাব”, কথায় কথায় পিকদানি মুখের কাছে টেনে নেওয়াটা পাঁচুগোপালবাবুর আরেকটা বিরক্তিকর অভ্যাস, “মুশকিল হচ্ছে, মেহেনতী ফ্লাওয়ার মিলসের এই মা কালী ক্যালেন্ডারটা বিজনেসে বেশ পজিটিভ ইনফ্লুয়েন্স এনেছে। রয় অ্যান্ড সন্সের যে অর্ডারটা পেলেম বছর জানুয়ারিতে, সে’দিনই এই ক্যালেন্ডার ঝুলিয়েছিলাম। কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ভাবুন, এ বছর জানুয়ারিতে ক্যালেন্ডারটা নিধু খুলে রেখেছিল। ও মা, অমনি কোম্পানি থেকে খবর এলো এ বছর অর্ডার রিনিউ নাও হতে পারে। অমনি ক্যালেন্ডার দেওয়ালে ফের টাঙিয়ে ছুটলাম রয় অ্যান্ড সন্সের বড়সাহেবের অফিসে। ক্যালেন্ডারের গুণেই সম্ভবত ফের নরম হয়ে এলেন। অবিশ্যি আপনার কন্ট্রিবিউশনও কম ছিল না। তা, এ মাসের শেষে অর্ডার রিনিউয়ালের কনফার্মেশন আসার কথা। কনফার্মেশন এসে গেলেই, মেহেনতী ফ্লাওয়ার মিলসের নতুন ক্যালেন্ডারটা ঝুলিয়ে দেব। এই ড্রয়ারেই রেখেছি। মা কালী থেকে শিফ্‌ট করে এবারে ডাইরেক্ট নেতাজীতে এসেছে”।
“ক্যালেন্ডারের গুণে অর্ডার”?, পাঁচুগোপালবাবু কুসংস্কারের ফিরিস্তি বেশ অসহনীয়, “সোজা ঘুষ দিয়ে অর্ডার বের করেছেন। কৃতজ্ঞ থাকুন কোরাপশানের প্রতি”।  
“কোরাপশান তো চারদিকে দীপকবাবু। কোরাপশান আর যাই হোক ডিফারেনশিয়েটিং ফ্যাক্টর নয়। এ বাজারে ব্যবসা করে খেতে গেলে, একটু তুকতাক গোছের উইকনেস থাকবেই। যাক গে। চা নিন”। পাঁচুগোপালবাবু বড় বিরক্তিকর চুকচকাম আওয়াজ করে চা খান। রীতিমত অসোয়াস্তিকর।
“এ’বারে যে জন্য আসা”, চায়ে প্রথম চুমুক দিয়েই বুঝেছি লেবু নেই, “পাঁচুগোপালবাবু। দুঃসংবাদ আছে”।
“দুঃ কেন বলছেন। সংবাদে দুঃ সু হয়না। সবই মা তারার কৃপা”, পাঁচুগোপাল মুখের কালচে ভাবটা অবিশ্যি ঢাকতে পারছিলেন না।
“মিস্টার পোদ্দারের সঙ্গে গতকাল আমি দেখা করেছি”।
“পোদ্দার”?
“সাউথ ক্যালক্যাটা ইলেক্ট্রিকালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, এর মধ্যে ভুলে গেলেন?” পাঁচুবাবু নাম মনে রাখতে বড্ড হিমশিম খান। আমার মত কমিশন এজেন্টদের না পুষলে কবেই তলিয়ে যেতে হত ভদ্রলোককে।
“ওহ্‌ হো। মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। তা দীপকবাবু, উনি তো বেশ মাই ডিয়ার মানুষ। গত শনিবারে হুইস্কির বোতল দিয়ে এলাম। আমায় হেসে থ্যাংক ইউ বললেন...”।
“হুইস্কি। ও’খানেই গোল পাকিয়েছেন”।
“সে কী? হুইস্কি নয়”?
“লাখোটিয়ার বড় ছেলে ওর সঙ্গে দেখা করেছিল সিঙ্গল মল্টের বোতল হাতে”।
“সিঙ্গল মল্ট”?
“সঙ্গে দেড় কিলো কাজু”।
“দেড় কিলো? কাজু? এ’দিকে আমি যে প্রতি টনে দশটাকা দেব বলেছিলাম”?
“ও’টা স্ট্যান্ডার্ড রেট পাঁচুবাবু। স্ট্যান্ডার্ড। দালাই লামা এসে এ লাইনে ব্যবসা ধরলেও টনে দশটাকা আন্ডার দ্য টেবিল না দিয়ে ম্যানেজ করতে পারবেন না”।
“আপনি বললেন মদের বোতল দিতে। আমি একটা রিজনেবল দাম দেখে...”।
“উফ”, পাঁচুগোপালবাবু মাঝেমধ্যেই এমন চিটে মার্কা হয়ে যান, “উপঢৌকন রাজার মেজাজে দিতে হয় পাঁচুগোপালবাবু! ঢ্যাঁড়শ কেনার মেজাজে মদ কিনতে নেই”।
“মামলেট খাবেন দীপকবাবু”?
“আবার মামলেট কেন”! কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে ঝপ করে খাওয়ার কথা এনে ফেলেন পাঁচুগোপালবাবু।
“খান না। দিশি ডিম আছে অফিসে। নিধুকে ভাজতে বলি”?
“অফিসে দিশি ডিম”?
“ফর স্পেশ্যাল গেস্টস অনলি, আর আপনার ক্ষুরধার বিজনেস ব্রেন না থাকলে আমায় তো মেয়ের বিয়ের মেনুতে মুড়ি মাখা রাখতে হত মশাই। হে হে হে”। কারণে অকারণে গায়ে পড়ে যাওয়াটা ভদ্রলোকের একটা সুতীব্র গাজ্বালানো স্বভাব বটে।
“ভাজতে বলুন। বেশি করে কাঁচালঙ্কা দিতে বলবেন”।
“ওরে নিধু, একটা ডাবল ডিম আর একটা সিঙ্গল ডিম চট করে ভেজে নিয়ে আয়। সিঙ্গল ডিমের মামলেটে লঙ্কা দিবি না, আর ডাবল ডিমেরটায় এক্সট্রা লঙ্কা দিবি, কেমন? ক্যুইক”।
“মামলেটটা খেয়ে উঠবো। দত্তসাহেবের ছোটমেয়ের বার্থডে পার্টিতে যেতে হবে”।
“কমিশনার দত্ত”?
“হ্যাঁ”।
“দীপকবাবু, সাউথ ক্যালক্যাটা ইলেক্ট্রিকালের অর্ডারটা ফস্কে গেলে যে আমি দেউলিয়া হয়ে যাবে”। এই। এই ভদ্রলোকের আর এক রোগ। কথায় কথায় গলা শুকোনো।
“দেখুন, পোদ্দার যে’ভাবে লাখোটিয়ার দিকে ঝুঁকেছে, তা’তে হিসেবে গোলমাল হয়েছে বইকি”।
“কিছু একটা করতেই হবে আপনাকে। অক্টোবরে মেয়েটার বিয়ে”।
“একটা ডেস্পারেট চেষ্টা করতে পারি। তবে, ইয়ে তা’তে আপনার খরচ বাড়বে বই কমবে না”।
“এনিথিং দীপকবাবু। শুধু এই অর্ডারটা...”।
“প্রতি টনে ওকে দশের জায়গায় পনেরো অফার করুন”।
“তিরিশ টাকার তো প্রফিট ভাই দীপক। তা’তে তোমার পাঁচটাকা, আর তারপর যদি পোদ্দারকে দশের বদলে পনেরো দিতে হয় তো...”।
“বাজে কথা রাখুন তো। টনপ্রতি মিনিমাম পঞ্চাশ আপনার পকেটে ঢুকবে”।
“কী আর বলব ভাই, পুলিশ আছে। লেবার অফিস আছে। হ্যাপা কি কম”?
“বেশ, তাহলে এ বছর সাউথ ক্যালক্যাটা ইলেক্ট্রিকাল লাখোটিয়া নিক। পরের বছর না হয় আগে থেকে কিছু একটা...”।
“না না না ভাই দীপক, বেশ। এ’বারের মত পনেরো অফার করে দিন পোদ্দারের ব্যাটাকে”।
“আমারটা সাড়ে সাত। এই কেসে জল আছে অনেক”।
“দিশি ডিমের অমলেট ভাই। ডাবলটা তোমার। তারপরেও বাড়তি কমিশন চাইবে”?
“পাঁচুগোপালবাবু, উপরি আড়াই কি আমি নিজের জন্য চাইছি? সাউথ ক্যালক্যাটা ইলেক্ট্রিকালে আরও খুচরো পাপী কম আছে ভেবেছেন? লাখোটিয়ার গ্রিপ থেকে তাঁদের সরানো কি সহজ কথা ভেবেছেন? সেখানেও আমায় টু পাইস ঢালতে হবে”।
“বেশ। ঠিক আছে। কিন্তু এ অর্ডার আমার চাই”।
“ঠিক আছে। আর মামলেট ভাজা হয়ে গেলে নিধুকে বলুন বাজার থেকে একটা উপহার প্যাক করিয়ে আনবে। কমিশনার সাহেবের মেয়ের জন্মদিনে খালি হাতে তো যাওয়া যায় না”।
“ওরে নিধু, মামলেটটা হলো? তোকে একবার বাজারে যেতে হবে”।

**
-   “হ্যালো, পোদ্দারসাহেব”?
-   “আরে দীপকবাবু, বলুন। পাঁচুবাবু কিছু জানালেন”?
-   “টন প্রতি ছয়ের বদলে আপনাকে আট টাকা দেবে বলেছে”।
-   “মাইরি? আপনার এলেম আছে মানতে হবে, থ্যাঙ্ক ইউ”।
-   “আমার শেয়ারটা ভুলে যাবেন না সাহেব। আপনার তিরিশ পারসেন্ট”।
-   “ভদ্রলোকের এক কথা”।
-   “আর ইয়ে, পাঁচুগোপালবাবু যদি পরে কখনও লাখোটিয়ার কথা জিজ্ঞেস করে বলবেন তাঁর সঙ্গে আপনার নিয়মিত যোগাযোগ হয়”।
-   “হু ইজ লাখোটিয়া”?
-   “সে’টা জেনে আপনার কাজ নেই। শুধু জেনে রাখুন ওই নাম ভাঙিয়েই আপনার জন্য এক্সট্রা দু’টাকা পার টন আদায় করেছি”।
-   “ আই সী। ভেরি স্মার্ট দীপকবাবু”।
-   “ টু পাইস করে না খেলে এ বাজারে টিকব কী করে সাহেব”।
-   “আচ্ছা একটা কথা, আগের দিন পাঁচুবাবু আমায় এক বোতল হুইস্কি দিয়ে গেছেন। এ’দিকে আমার তো আবার সে’দিকে ঝোঁক নেই। আপনার চলে নাকি”?
-   “আপনার প্রসাদ রিফিউজ করি কী করে স্যার। কাল বিকেলের দিকে একবার আপনার অফিসে যাবো। পাঁচুগোপালবাবু কিছু অ্যাডভান্স অফার করেছেন। আমার তিরিশ পারসেন্ট কেটে আপনার টাকা আপনাকে দিতে পারলে শান্তি। তো কালকেই বোতলটা আপনার থেকে নিয়ে নেব’খন”।
-   বেশ।
-   আর ইয়ে। এর মাঝে পাঁচুগোপালবাবু একবার আপনার অফিসে স্কচের বোতল আর দেড় কিলো কাজুসহ ঢুঁ মারতে পারেন।
-   দেড় কিলো কাজু? বলেন কী!
-   শিওর না। আন্দাজ করছি। যদি দেয় তাহলে রিফিউস করবেন না। বোতল আর কাজুর তিরিশ পারসেন্ট আমি আপনার পরের ইন্সটলমেন্ট দিতে যাওয়ার সময় নিয়ে নেব। কেমন”?