- ঢেউ বেড়েছে দেখছি।
- রাতে সাড়ে দশটার পর জোয়ার।
- আই সী। ডিনারের পর একটু ইচ্ছে হলো ঘুরে যাওয়ার। বীচের এ’দিকটা বেশ নিরিবিলি।
- হুঁ।
- আপনার লাইটারটা পেতে পারি? আমারটা আবার হোটেলে ফেলে এসেছি।
- আসুন।
- থ্যাঙ্কস। দেখি, আপনার মাদুরেই একটু বসি।
- মোস্ট ওয়েলকাম।
- কদ্দিন হল এসেছেন?
- গতকালই। আপনি?
- গত পরশুর জগন্নাথে ঢুকেছি। আগামী পরশুর জগন্নাথে রিটার্ন। উঠেছি ভিক্টোরিয়াতে। আপনি কোথায় উঠলেন?
- নীলাচলে।
- আপনিও কলকাতা থেকে?
- পুরী মানেই সেভেনটি পার্সেন্ট কলকাতা। সেফ বেট। গড়িয়া।
- আই সী। আমি বালিগঞ্জ। ব্রড স্ট্রিটের কাছেই বাড়ি। আমার নাম...।
- মোহন দত্ত।
- স্ট্রেঞ্জ। হ্যাভ উই মেট বিফোর? কিন্তু আপনাকে তো আগে কোথাও দেখেছি বলে তো...।
- বার্ন্স অ্যান্ড রবিন্সের ম্যানেজিং ডায়রেক্টর হয়ে রিটায়ার করেছেন বছর দুই হলো। স্ত্রী গত হয়েছেন বছর দেড়েক। এক ছেলে বাঙ্গালোরে আইটিতে, অন্য ছেলে রিসার্চ করতে আমেরিকা। এখানে এসেছেন ছোট মেয়ে ছন্দার পরিবারের সঙ্গে।
- আপনি ঠিক কে বলুন তো মশাই?
- এইটি নাইনে একটা ভয়ানক মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে বসেছিলেন। বেঁচে যাওয়াটা একরকম মিরাকেল ছিল।
- এই, আপনি কে?
- আপনার বড় মেয়ে মউয়ের ব্যাপারটা আনফরচুনেট মিস্টার দত্ত। ক্যান্সার, তাও অত অল্প বয়সে।
- ইয়ার্কি পেয়েছেন? ইস দিস সাম কাইন্ড অফ আ জোক?
- পেট গরমের সঙ্গে সঙ্গে মাথা গরম করে কোনও লাভ আছে কি? অবশ্য গলদ আজ লাঞ্চের চিংড়িতেই ছিল।
- রিডিকুলাস। সোজাসুজি বলুন এবার আপনি কে।
- আচ্ছা নিজেকে এথেইস্ট বলে দাবী করেন তা'তে ক্ষতি নেই কিন্তু গোপনে তারাপীঠের মাদুলিটা কেন বয়ে বেড়ান বলুন তো? অবশ্য বাঁচোয়া এই যে বাড়ির বাইরে কেউ সে কথা জানে না।
- আপনি কি আমায় ব্ল্যাকমেল করতে এখানে এসেছেন?
- ব্ল্যাকমেল করেছিলেন আপনি, দীপক হালদারকে। নয়তো অত সহজে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে যাওয়ার মত কোয়ালিটি আপনার ছিল না।
- আপনার নামটা কি? কে লাগিয়েছে আপনাকে আমার পিছনে?
- একটা সিগারেট হবে? লাইটারের ঋণ আছে আপনার।
- আসুন। কিন্তু এ'সব বদমায়েশির মানেটা কী একটু বুঝিয়ে বলবেন?
- বদমায়েশি? আদত বদমায়েশি কী জানেন মিস্টার ফিলান্থ্রোপিস্ট দত্ত? আড়াল পেয়ে অন্যের গামছা বা তোয়ালেতে নিজের নাক মোছা। যে'টা আপনি সুযোগ পেলেই করে থাকেন। এবং গতকাল রাত্রেই করেছেন আপনার জামাইয়ের ব্যবহারের জন্য বের করা ধবধবে তোয়ালেতে।
- শাট আপ! শাট আপ!
- কথাগুলো মিথ্যে নয় মিস্টার দত্ত। আর অত উত্তেজিত হবেন না প্লীজ। হাই ব্লাড প্রেশার। আর আপনি ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারে রীতিমত কেয়ারলেস। গতকাল রাত্রে ভুলেছেন। আজ দুপুরেও।
- মাইরি। আপনি কে? তান্ত্রিক টান্ত্রিক কিছু?
- আমি বিপুল রায়। কর্পোরেশনের ক্লার্ক।
- এ'সব কেন তাহলে?
- আজ বিকেলে একটা পেট খারাপের ওষুধ কিনেছিলেন, সে'টা দোকানেই ফেলে চলে এসেছেন। কোনও মানে হয়?
- ভাবছি...। আপনাকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ কিনা।
- লাভ নেই।
- কিন্তু এতসব আপনি জানলেন কী করে? মাদুলির ব্যাপারটা, বা ওষুধ ভুলে যাওয়ার ব্যাপারটা তো আর কেউ...।
- মিস্টার দত্ত। সমস্ত জানি। আপনার সব কিছু। বড়বাথরুমে বসে হ্যান্ডশাওয়ার তাক করে বাথরুমের দেওয়ালে আপনি কাল্পনিক ছবি এঁকে যান ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আপনার আদৌ কন্সটিপেশন নেই।
- আমার কেমন অসোয়াস্তি হচ্ছে। মানে...এ'টা...যাকে বলে...। আচ্ছা, আপনি কি ভূত?
- তাহলে অন্তত আমার যন্ত্রণাটা কম হত মিস্টার দত্ত।
- আপনার যন্ত্রণা?
- গত পঁচিশ বছর ধরে আপনার সমস্ত কিছু আমি টের পাই।
- টের পান মানে?
- টের পাই। আপনি গোটাদিন যা যা করেন, তা সমস্তটাই আমি টের পাই। আপনার পিঠে চুলকানি হলেও টের পাই। আপনি হাই তুললেও। আপনি সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেও।
- রিডিকুলাস।
- ইয়েট, আপনি কোনও অভিযোগ উড়িয়ে দিতে পারছেন না।
- আমার কেমন কেমন লাগছে।
- গত শুক্রুবার দাড়ি কাটতে গিয়ে আপনার থুঁতনির বাঁ দিকটা কেটে গেছিল। সামান্যই। অন্য কারুর নজরে আসেনি।
- এ'বার গড়গড় করে বলে যাওয়া বন্ধ করুন প্লীজ। অসোয়াস্তি হচ্ছে মশায়। সমুদ্দুরের হাওয়াতেও ঘেমে উঠছি। এ'টা কী করে পসিব্ল... ।
- আমিও জানি না। শুধু বুঝি ব্যাপারটা গোলমেলে। বহুদিন ভেবেছি আপনার মুখোমুখি হই। কিন্তু সাহসে কুলোয়নি। কিন্তু কুকুরদের দিকে অকারণে ঢিল ছোঁড়া আমি বরদাস্ত করি না। সেদিনই ঠিক করে ফেললাম আপনার মুখোমুখি হওয়া দরকার। তাই পুরী এলাম, কলকাতার চেয়ে এ'টাই বেটার সেটআপ। অবিশ্যি এত সহজে দেখা হবে ভাবিনি।
- বিশ্বাস করুন মিস্টার রায়, সেদিন সত্যিই আমি ছেলেমানুষি করে ফেলেছিলাম মিস্টার অরোরার কুকুরটার দিকে ঢিল ছুঁড়ে। আমি এমন নই। কিন্তু কুকুরটা এমন হাড় বজ্জাত যে রোজ শুধু আমার বাগানে এসেই...। তাই একটু...ইয়ে। তবে সে'টা আড়ালেই মেরেছিলাম।
- আপনার কোনও কিছুই আমার কাছে আড়ালে থাকে না মিস্টার দত্ত।
- কী মুশকিল। আমার বুকের ভিতরের ধুকুরপুকুর বেড়ে চলেছে। শরীরটা কেমন আনচান করছে।
- রেড ওয়াইন চলবে নাকি?
- আপনার কাছে আছে?
- একটু আড়ালে রেখেছিলাম। রাতের বীচ, বুঝতেই পারছেন। পুলিশি আপদ আসতেই পারে।
- কর্পোরেশনের ক্লার্কের কাছে ওয়াইন?
- বড় নাক উঁচু আপনি। টু পাইস আমারও আছে। আর তাছাড়া একা মানুষ।
- শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। মানে ঘটনাটা এতই অদ্ভুত...অবিশ্বাস্য...।
- অবিশ্বাস্য? আপনার স্ত্রী আপনাকে সোহাগ করে নিয়মিত কান মুলতেন, তবে অতি গোপনে। সে'টা আমি জানলাম কী করে? আপনার লাখ তিরিশেক টাকা যে কালো সে'টা আপনার ছেলে মেয়েও জানে না। আমি টের পেলাম কী করে? আপনার ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিংয়ের পাসওয়ার্ড বলে দেব? গতকাল বীচে আপনার একটি হাঁটুর বয়েসি মেয়ের দিকে আপনি কালোচশমার আড়াল থেকে কুনজর দিচ্ছিলেন। সে'টা আমি কী করে জানলাম?
- থামুন। প্লীজ থামুন। আমার বুক চিনচিন করছে। শুনুন মিস্টার...। কী যেন...।
- বিপুল রায়।
- হ্যাঁ, বিপুলবাবু আমি আপনাকে প্রচুর টাকা দেব। মিউনিসিপালিটি থেকে রিটায়ার করলে আপনি যা পেতেন তার দশগুণ দেব। শুধু আপনাকে কলকাতা ছাড়তে হবে। প্লীজ।
- প্লাস্টিকের গেলাস এনেছিলাম লুকিয়ে। একটা এক্সট্রাও আছে। দাঁড়ান, ওয়াইন ঢেলে নিই।
- আন্সার মি গডড্যামিট! বলুন আমায়, আপনার কত টাকা চাই...আপনাকে আমার সামনে থেকে বিদেয় হতে হবে। অন্তত আশেপাশে থাকা চলবে না। যা চাইবেন আপনি তাই পাবেন।
- আসুন। সস্তা ওয়াইন, তবে সমুদ্রের হাওয়ায় মেজাজ খুশ হয়ে যাবে মোহনবাবু।
- থ্যাঙ্কস।
- এঞ্জয়।
- আপনি আমার কথা শুনবেন না বিপুলবাবু?
- ওয়াইনটা কেমন লাগছে? এমন দরদর করে ঘামছেন কেন বলুন তো?
- ওয়াইনটা বেশ। তবে ইয়ে, আপনি সোজা কথা না শুনলে আঙুল প্রয়োজনে আমি বেঁকাতেও পার।
- খুব ঘেন্না হচ্ছে আমাকে, তাই না?
- বছর কুড়ি আগের আমি হলে এখুনি রক্তারক্তি হত।
- স্যাডলি, আমরা বছর কুড়ি আগে নয়, আজ দেখা করছি। তবে একটা মজার কথা কী জানেন মিস্টার দত্ত? আপনার প্রতি আমারও প্রবল ঘেন্না রয়েছে।
- ঘেন্না? আমার প্রতি? কেন? কালো টাকা আছে বলে? এ বয়সে মেয়ে দেখেছি বলে?
- ও'সব মাইনর ভাইসেস। আমার আপনাকে সহ্য হয় না খুচরো সব কারণে।
- কী'রকম?
- আপনি বড় দৃষ্টিকটু ভাবে গা মোছেন। গামছাটারও কষ্ট হয় বোধ হয়। আপনি মশা মেরে সে বেচারির ডেড বডিকে অমন নির্মম ভাবে আঙ্গুলে পেষাই করে ময়লার মত ঝেড়ে ফেলেন কেন? আমার গা ঘিনঘিন করে ওঠে। রসগোল্লার রস চিপে খান। এমন আরও কত কিছু। মোদ্দা হচ্ছে আপনি যে ঘৃণা আজ আমায় করছেন, সেই ঘৃণা আমি আপনার সম্বন্ধে পুষে রেখেছি বহুবছর ধরে। আপনি ঘৃণায় আঙুল বাঁকাতে চাইছিলেন, আমি ঘৃণায় আঙুল বাঁকিয়ে ফেলেছি। আপনার ছোট ছোট অভ্যাসগুলোর ভার রোজ আমায় বইতে হচ্ছিল। আর পারা যাচ্ছে না।
- কী করেছেন আপনি? আমার এত শরীর খারাপ লাগছে কেন? এই ওয়াইনে কি কিছু...।
- ওয়াইনে কোনও গলদ নেই মিস্টার দত্ত। আপনার প্রেশার এমনিতেই বাড়াবাড়ি রকমের বেশির দিকে। এ'দিকে ওষুধের ব্যাপারেও আপনি প্রবলে ভাবে ভুলো। কাল রাত থেকে ওষুধ ভুলে আছেন। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আপনার প্রেশার এমনিতেই অনেক...। তা ছাড়া... ।
- টেক মি টু আ ডক্টর...আমার শরীরটা খুব...।
- মেয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট নিয়ে চলেছেন, ট্রাইসাইক্লিক আর এমওআই, দু'ধরণের অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট। তার ওপর অবহেলায় হাই প্রেশারটা বেড়ে চলেছে। তার ওপর আজকের এই মোলাকাত। ডিনারে চীজের প্রাচুর্য। আর এর ওপরে রেডওয়াইন। ডাক্তার মণ্ডল আমার প্রতিবেশী, উনিই একবার বুঝিয়েছিলেন।
- আহ, বুকে বড্ড ব্যথা। কী...বলতে চাইছেন?
- আপনার খুচরো বদভ্যাসগুলো আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। তাই রেডওয়াইনটা আপনাকে খাইয়েই দিলাম। ওইসব অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট গেলা হাইপ্রেশারে ভোগা দেহে, চীজটীজ খেয়ে রেডওয়াইন খেলে একটা গোলমেলে ব্যাপার হওয়ার চান্স থাকে। আমিও চান্সই নিয়েছিলাম একটা। কাজে লেগে গেল বোধ হয়।
- কী...কীসের চান্স?
- চীজ রিয়্যাকশন বলে একটা ব্যাপার আছে। যে যাত্রা বেঁচে গেলে গুগলে সার্চ করে দেখতে পারতেন। এখন সে'টাই বোধ করছেন।
- দম...দম বন্ধ হয়ে আসছে বিপুলবাবু, হেল্প মি...।
- আমি আসি বুঝলেন। মাদুরটা রইলো। এ'দিকে বড় কেউ আসে না। হেল্প পাবেন বলে মনে হয় না। আর সানরাইজটা বোধ হয় মিস করবেন। গুডনাইট।
No comments:
Post a Comment