“আসুন, আসুন
দীপকবাবু। আপনার পাংচুয়ালিটিকে স্যালুট না করে মশাই থাকা যায় না। সন্ধ্যে ছ’টার
অ্যাপয়েন্টমেন্ট, এখনও মিনিট পাঁচেক হাতে রয়েছে”, পাঁচুগোপালবাবু ইশারায় সামনের
চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন।
“থ্যাঙ্কস”,
ধন্যবাদটা জানালাম বসতে বলার জন্য। পাংচুয়ালিটিকে স্যালুট করার কথাটা জাস্ট
বাড়াবাড়ি, পাঁচুগোপালবাবুর সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। গতবার আমার হাতের এইচএমটির ঘড়ি
দেখে বলেছিলেন যে আমার ঘড়ির ডায়াল দেখেই বোঝা যায় আমি মানুষটা কতটা ছিমছাম।
ভদ্রলোককে বলা হয়নি অবিশ্যি যে ঘড়িটা আদতে আমার বাবার।
“চা খাবেন নাকি
দীপকবাবু”?
“তা হলে মন্দ হয়
না। তবে দুধ ছাড়া প্রেফার করব। অসুবিধে থাকলে অবশ্য দুধের চাই চালিয়ে নেব ”।
“নিধু, নীচ থেকে
দু’কাপ চা নিয়ে আয় বাবা। লেবু দিতে বলিস, কেমন”?
“মার্চ শেষ হতে
চললো, গত বছরের ক্যালেন্ডারটা এবারে সরান পাঁচুগোপালবাবু”।
“সরাব সরাব”,
কথায় কথায় পিকদানি মুখের কাছে টেনে নেওয়াটা পাঁচুগোপালবাবুর আরেকটা বিরক্তিকর
অভ্যাস, “মুশকিল হচ্ছে, মেহেনতী ফ্লাওয়ার মিলসের এই মা কালী ক্যালেন্ডারটা বিজনেসে
বেশ পজিটিভ ইনফ্লুয়েন্স এনেছে। রয় অ্যান্ড সন্সের যে অর্ডারটা পেলেম বছর
জানুয়ারিতে, সে’দিনই এই ক্যালেন্ডার ঝুলিয়েছিলাম। কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার ভাবুন, এ
বছর জানুয়ারিতে ক্যালেন্ডারটা নিধু খুলে রেখেছিল। ও মা, অমনি কোম্পানি থেকে খবর
এলো এ বছর অর্ডার রিনিউ নাও হতে পারে। অমনি ক্যালেন্ডার দেওয়ালে ফের টাঙিয়ে ছুটলাম
রয় অ্যান্ড সন্সের বড়সাহেবের অফিসে। ক্যালেন্ডারের গুণেই সম্ভবত ফের নরম হয়ে এলেন।
অবিশ্যি আপনার কন্ট্রিবিউশনও কম ছিল না। তা, এ মাসের শেষে অর্ডার রিনিউয়ালের
কনফার্মেশন আসার কথা। কনফার্মেশন এসে গেলেই, মেহেনতী ফ্লাওয়ার মিলসের নতুন
ক্যালেন্ডারটা ঝুলিয়ে দেব। এই ড্রয়ারেই রেখেছি। মা কালী থেকে শিফ্ট করে এবারে
ডাইরেক্ট নেতাজীতে এসেছে”।
“ক্যালেন্ডারের
গুণে অর্ডার”?, পাঁচুগোপালবাবু কুসংস্কারের ফিরিস্তি বেশ অসহনীয়, “সোজা ঘুষ দিয়ে
অর্ডার বের করেছেন। কৃতজ্ঞ থাকুন কোরাপশানের প্রতি”।
“কোরাপশান তো
চারদিকে দীপকবাবু। কোরাপশান আর যাই হোক ডিফারেনশিয়েটিং ফ্যাক্টর নয়। এ বাজারে
ব্যবসা করে খেতে গেলে, একটু তুকতাক গোছের উইকনেস থাকবেই। যাক গে। চা নিন”।
পাঁচুগোপালবাবু বড় বিরক্তিকর চুকচকাম আওয়াজ করে চা খান। রীতিমত অসোয়াস্তিকর।
“এ’বারে যে জন্য
আসা”, চায়ে প্রথম চুমুক দিয়েই বুঝেছি লেবু নেই, “পাঁচুগোপালবাবু। দুঃসংবাদ আছে”।
“দুঃ কেন বলছেন।
সংবাদে দুঃ সু হয়না। সবই মা তারার কৃপা”, পাঁচুগোপাল মুখের কালচে ভাবটা অবিশ্যি
ঢাকতে পারছিলেন না।
“মিস্টার
পোদ্দারের সঙ্গে গতকাল আমি দেখা করেছি”।
“পোদ্দার”?
“সাউথ ক্যালক্যাটা
ইলেক্ট্রিকালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, এর মধ্যে ভুলে গেলেন?” পাঁচুবাবু নাম মনে
রাখতে বড্ড হিমশিম খান। আমার মত কমিশন এজেন্টদের না পুষলে কবেই তলিয়ে যেতে হত
ভদ্রলোককে।
“ওহ্ হো। মনে
পড়েছে, মনে পড়েছে। তা দীপকবাবু, উনি তো বেশ মাই ডিয়ার মানুষ। গত শনিবারে হুইস্কির
বোতল দিয়ে এলাম। আমায় হেসে থ্যাংক ইউ বললেন...”।
“হুইস্কি। ও’খানেই
গোল পাকিয়েছেন”।
“সে কী? হুইস্কি
নয়”?
“লাখোটিয়ার বড়
ছেলে ওর সঙ্গে দেখা করেছিল সিঙ্গল মল্টের বোতল হাতে”।
“সিঙ্গল মল্ট”?
“সঙ্গে দেড় কিলো
কাজু”।
“দেড় কিলো? কাজু?
এ’দিকে আমি যে প্রতি টনে দশটাকা দেব বলেছিলাম”?
“ও’টা
স্ট্যান্ডার্ড রেট পাঁচুবাবু। স্ট্যান্ডার্ড। দালাই লামা এসে এ লাইনে ব্যবসা ধরলেও
টনে দশটাকা আন্ডার দ্য টেবিল না দিয়ে ম্যানেজ করতে পারবেন না”।
“আপনি বললেন মদের
বোতল দিতে। আমি একটা রিজনেবল দাম দেখে...”।
“উফ”,
পাঁচুগোপালবাবু মাঝেমধ্যেই এমন চিটে মার্কা হয়ে যান, “উপঢৌকন রাজার মেজাজে দিতে হয়
পাঁচুগোপালবাবু! ঢ্যাঁড়শ কেনার মেজাজে মদ কিনতে নেই”।
“মামলেট খাবেন
দীপকবাবু”?
“আবার মামলেট কেন”!
কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে ঝপ করে খাওয়ার কথা এনে ফেলেন পাঁচুগোপালবাবু।
“খান না। দিশি
ডিম আছে অফিসে। নিধুকে ভাজতে বলি”?
“অফিসে দিশি ডিম”?
“ফর স্পেশ্যাল
গেস্টস অনলি, আর আপনার ক্ষুরধার বিজনেস ব্রেন না থাকলে আমায় তো মেয়ের বিয়ের মেনুতে
মুড়ি মাখা রাখতে হত মশাই। হে হে হে”। কারণে অকারণে গায়ে পড়ে যাওয়াটা ভদ্রলোকের
একটা সুতীব্র গাজ্বালানো স্বভাব বটে।
“ভাজতে বলুন।
বেশি করে কাঁচালঙ্কা দিতে বলবেন”।
“ওরে নিধু, একটা
ডাবল ডিম আর একটা সিঙ্গল ডিম চট করে ভেজে নিয়ে আয়। সিঙ্গল ডিমের মামলেটে লঙ্কা
দিবি না, আর ডাবল ডিমেরটায় এক্সট্রা লঙ্কা দিবি, কেমন? ক্যুইক”।
“মামলেটটা খেয়ে
উঠবো। দত্তসাহেবের ছোটমেয়ের বার্থডে পার্টিতে যেতে হবে”।
“কমিশনার দত্ত”?
“হ্যাঁ”।
“দীপকবাবু, সাউথ
ক্যালক্যাটা ইলেক্ট্রিকালের অর্ডারটা ফস্কে গেলে যে আমি দেউলিয়া হয়ে যাবে”। এই। এই
ভদ্রলোকের আর এক রোগ। কথায় কথায় গলা শুকোনো।
“দেখুন, পোদ্দার
যে’ভাবে লাখোটিয়ার দিকে ঝুঁকেছে, তা’তে হিসেবে গোলমাল হয়েছে বইকি”।
“কিছু একটা করতেই
হবে আপনাকে। অক্টোবরে মেয়েটার বিয়ে”।
“একটা ডেস্পারেট চেষ্টা
করতে পারি। তবে, ইয়ে তা’তে আপনার খরচ বাড়বে বই কমবে না”।
“এনিথিং
দীপকবাবু। শুধু এই অর্ডারটা...”।
“প্রতি টনে ওকে
দশের জায়গায় পনেরো অফার করুন”।
“তিরিশ টাকার তো
প্রফিট ভাই দীপক। তা’তে তোমার পাঁচটাকা, আর তারপর যদি পোদ্দারকে দশের বদলে পনেরো
দিতে হয় তো...”।
“বাজে কথা রাখুন
তো। টনপ্রতি মিনিমাম পঞ্চাশ আপনার পকেটে ঢুকবে”।
“কী আর বলব ভাই,
পুলিশ আছে। লেবার অফিস আছে। হ্যাপা কি কম”?
“বেশ, তাহলে এ
বছর সাউথ ক্যালক্যাটা ইলেক্ট্রিকাল লাখোটিয়া নিক। পরের বছর না হয় আগে থেকে কিছু
একটা...”।
“না না না ভাই
দীপক, বেশ। এ’বারের মত পনেরো অফার করে দিন পোদ্দারের ব্যাটাকে”।
“আমারটা সাড়ে
সাত। এই কেসে জল আছে অনেক”।
“দিশি ডিমের
অমলেট ভাই। ডাবলটা তোমার। তারপরেও বাড়তি কমিশন চাইবে”?
“পাঁচুগোপালবাবু,
উপরি আড়াই কি আমি নিজের জন্য চাইছি? সাউথ ক্যালক্যাটা ইলেক্ট্রিকালে আরও খুচরো
পাপী কম আছে ভেবেছেন? লাখোটিয়ার গ্রিপ থেকে তাঁদের সরানো কি সহজ কথা ভেবেছেন?
সেখানেও আমায় টু পাইস ঢালতে হবে”।
“বেশ। ঠিক আছে।
কিন্তু এ অর্ডার আমার চাই”।
“ঠিক আছে। আর মামলেট
ভাজা হয়ে গেলে নিধুকে বলুন বাজার থেকে একটা উপহার প্যাক করিয়ে আনবে। কমিশনার
সাহেবের মেয়ের জন্মদিনে খালি হাতে তো যাওয়া যায় না”।
“ওরে নিধু,
মামলেটটা হলো? তোকে একবার বাজারে যেতে হবে”।
**
- “হ্যালো, পোদ্দারসাহেব”?
- “আরে দীপকবাবু, বলুন। পাঁচুবাবু কিছু জানালেন”?
- “টন প্রতি ছয়ের বদলে আপনাকে আট টাকা দেবে বলেছে”।
- “মাইরি? আপনার এলেম আছে মানতে হবে, থ্যাঙ্ক ইউ”।
- “আমার শেয়ারটা ভুলে যাবেন না সাহেব। আপনার তিরিশ পারসেন্ট”।
- “ভদ্রলোকের এক কথা”।
- “আর ইয়ে, পাঁচুগোপালবাবু যদি পরে কখনও লাখোটিয়ার কথা
জিজ্ঞেস করে বলবেন তাঁর সঙ্গে আপনার নিয়মিত যোগাযোগ হয়”।
- “হু ইজ লাখোটিয়া”?
- “সে’টা জেনে আপনার কাজ নেই। শুধু জেনে রাখুন ওই নাম ভাঙিয়েই
আপনার জন্য এক্সট্রা দু’টাকা পার টন আদায় করেছি”।
- “ আই সী। ভেরি স্মার্ট দীপকবাবু”।
- “ টু পাইস করে না খেলে এ বাজারে টিকব কী করে সাহেব”।
- “আচ্ছা একটা কথা, আগের দিন পাঁচুবাবু আমায় এক বোতল হুইস্কি
দিয়ে গেছেন। এ’দিকে আমার তো আবার সে’দিকে ঝোঁক নেই। আপনার চলে নাকি”?
- “আপনার প্রসাদ রিফিউজ করি কী করে স্যার। কাল বিকেলের দিকে
একবার আপনার অফিসে যাবো। পাঁচুগোপালবাবু কিছু অ্যাডভান্স অফার করেছেন। আমার তিরিশ
পারসেন্ট কেটে আপনার টাকা আপনাকে দিতে পারলে শান্তি। তো কালকেই বোতলটা আপনার থেকে
নিয়ে নেব’খন”।
- বেশ।
- আর ইয়ে। এর মাঝে পাঁচুগোপালবাবু একবার আপনার অফিসে স্কচের
বোতল আর দেড় কিলো কাজুসহ ঢুঁ মারতে পারেন।
- দেড় কিলো কাজু? বলেন কী!
- শিওর না। আন্দাজ করছি। যদি দেয় তাহলে রিফিউস করবেন না। বোতল
আর কাজুর তিরিশ পারসেন্ট আমি আপনার পরের ইন্সটলমেন্ট দিতে যাওয়ার সময় নিয়ে নেব।
কেমন”?
No comments:
Post a Comment