Saturday, July 15, 2017

স্মাইল জেনারেটর

মামুলি সব জিনিসকে নামের তুকতাকে দুরন্ত করে উপহার দেওয়াটা বুবাইয়ের ছোটমামার একটা পুরনো অভ্যাস। মামার ভাষায় ‘একটু ক্লাস মিশিয়ে দিতে পারলেই, কিপটেমোতেও ঝলক আনা সম্ভব’।
ব্যালকনিতে ছোট্ট দু’টো সাদা টব রাখা আছে। দু’টোতেই নয়নতারা। মামা গত জন্মদিনে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন “এই নে, এক জোড়া স্মাইল জেনারেটর দিলাম, যখনই মেজাজে কিছু গড়বড় মনে হবে, এ’দের কাছে এসে সাবমিট করবি”। পয়লা বৈশাখে দিয়েছিলেন কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে পঞ্চাশ টাকায় কেনা পুজোবার্ষিকী আনন্দমেলা; “এই নে। তখনও পুজো সংখ্যা জ্যান্ত ছিল। কই মাছের মত বঁটির নীচেও ল্যাটরপ্যাটর করার দম ছিল। অন্ধ্রের চালানি কেরোসিন মাখানো চীজ তো রইলই। আগে এ’টা পড়ে দ্যাখ”। গত পুজোর সময় দিয়েছিলেন ডাংগুলি যে’টা বাবা কোনও দিন বুবাইকে ব্যবহার করতে দেয়নি চোট লাগার ভয়ে। বাবা বলেন “মন্টুটা একটা ওয়ার্থলেস, অন্তত একটা চাকরী যদি মন দিয়ে করতে পারত”। মন্টু ছোটমামার ডাকনাম, বুবাইয়ের ডাকনাম যেমন বুবাই। ছোটমামা বাবাকে আড়ালে ট্রিগোনোমেট্রি বলে ডাকেন।
ছোটমামা অনেক চাকরী ধরেছেন ছেড়েছেন। বাবার জোগাড় করে দেওয়া দু’টো চাকরী সহ। একটা বাবার উকিল সমাদ্দারবাবুর অফিসে হিসেব দেখার। অন্যটা বাবার এক ক্লায়েন্টের ফ্যাক্টরিতে লেজারবাবুর কাজ। প্রথমটায় মামা তিন মাস টিকে ছিল, পরেরটায় তিন দিন। দ্বিতীয় চাকরীটা ছাড়ার পর মামা যখন বাড়িতে এসেছিলেন তখন বাবা মামাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন “রাস্কেল ছোকরা, ব্যাড ইনফ্লুয়েন্স অন বুবাই” বলে। দিন চারেক পর অবশ্য নিজে গিয়ে ডেকে এনেছিলেন ছোটমামাকে, কারণ মামা বাবার তাসের আড্ডার পার্টনার।
“তোর বাবা মানুষটা মন্দ না, নেহাত নিয়ম মেনে মেনে লোকটা নুন তেল ঝাল ছাড়া মাখা আলুসেদ্ধর মত হয়ে গেছে, তাই বলে তো কাউকে ডিসমিস করে দেওয়া যায় না”, মন্টুমামা এ কথাও বলেছেন কতবার।
ছোটমামার দেওয়া নয়নতারার গাছ দু’টো সত্যি বেশ মন ভালো করা, রোজ ফুলে ঢাকা থাকে। রোজ বিকেলে বুবাই এসে ওদের গায়ে অল্প জল ছিটিয়ে যায়।


ছোটমামা শহর ছেড়েছেন চার মাস মত হয়েছে, দুম করে শেষে সুরাটের একটা মিলে চাকরী নিলেন। “প্রেম করাটা ট্যাক্সিং হয়ে গেল রে বুবাই”।
বাবা ব্রীজ ছেড়েছেন তিন মাস। ব্যালকনিতে বেতের চেয়ার আর টেবিল পেতেছেন, নয়নতারা ঘেঁষে; ঝাড়ে দেড় ঘণ্টা পেশেন্স খেলেন রোজ বিকেলে।
ছোটমামার বিয়েতে অবশ্য খুব মজা হয়েছিল। বিয়ে হয়েছিল মামাদের দেশের বাড়ি বাঁকুড়ায়। বাবা আর বুবাই গিয়ে দিন দশেক ছিল। এত লম্বা ছুটি বাবা কতদিন যে নেয়নি। কলকাতা থেকে বাবা ব্যালকনিত থেকে নয়নতারার একটা টব বয়ে নিয়ে গেছিল। টবের গায়ে একটা চিরকুট।
চিরকুটে বাবা যত্ন করে লিখেছিল;
“ভায়া ওয়ার্থলেস,
ভালো থেকো, বৌটিকে ভালো রেখো। মেয়েটা বড় ভালো, তোমায় মানুষ করার চেষ্টা করেছে। তোমার দিদি যাওয়ার আগে বলে গেছিল ওর হাতের বালাজোড়া তোমার বৌকে দিতে। সে সুদিন যে আদৌ আসবে সে’টা ভাবিনি। যা হোক, আমার আর বুবাইয়ের তরফ থেকেও কিছু দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি।
বাপ ব্যাটার জন্য একটা স্মাইল জেনারেটরেই যথেষ্ট। এ’টা রইলো তোমার জন্য। 
ইতি
ট্রিগোনোমেট্রি চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়”।