রবিবার বিকেল নাগাদ অল্প জ্বরজ্বর বোধ
করেন অনিল মুন্সী। চোখের সামনে গল্পের বইয়ের তাকটা আবছা হতে শুরু করে। সন্ধেবেলা
কফির স্বাদ পানসে হয়ে যায়। মনের মধ্যে থেকে “ম্যা হু ঝুম ঝুম
ঝুমরু”র গুনগুন মিলিয়ে গিয়ে ‘অমুক কোটেশন’ ‘তমুক ফাইল’
ভাসতে শুরু করে।
অল্প অম্বল বুকের কাছে ভাসতে থাকে।
এমপিথ্রিতে নির্মলা মিশ্রের “এমন একটা ঝিনুক” শুনে মনে হয়
বড়বাবু শুধচ্ছেন “স্টেটমেন্টগুলো তৈরি হয়নি এখনও”?
রবিবার সন্ধে হলেই ভাজাপোড়া খাওয়ার
ইচ্ছেটা বিলকুল গায়েব হয়ে যায়। ইচ্ছে করে শুধু ছাতুর সরবত খেতে, তাও
পেঁয়াজ লঙ্কা কুচি ছাড়া। জোর করে বিট্টুর থেকে ধার করে চাচা চৌধুরীর কমিক্স পড়ার
চেষ্টা করেও লাভ হয় না, ক্রমশ মনে হয় গ্র্যাভিটি বেড়ে চলেছে। বিপুল
জ্যেঠুর শ্রাদ্ধে একটা পকেট গীতা পেয়েছিলেন বছর তিনেক আগে। রবিবার রাত এলেই সেই
পকেট গীতা উলটেপালটে দেখে সময় কাটান অনিলবাবু।
ও’দিকে তখন
ব্যালকনিতে হুড়মুড়িয়ে পায়চারি করে চলেছেন বিশ্বনাথ মল্লিক। একের পর এক সিগারেট
নিকেশ হয়ে ফিল্টারগুলো জমা হচ্ছে ব্যালকনিতে রাখা আধমরা পাতাবাহার গাছের টবে। কাল
সান্যালেরই একদিন কী তাঁরই একদিন।
সে’দিনের ছোকরা
তাঁকে বিজনেস শেখাবে? আগামীকালের অকশনেই বোঝা যাবে কত ধানে কত চাল।
অনিল মুন্সীর থেকে গতবছরের স্টেটমেন্টগুলো ভালো করে বুঝে নিয়েই কাল ছুটতে হবে
অকশনে।
রবিবার দিনটা একটা নষ্টের দিন। কত কাজ
করে ফেলা যেত সকাল থেকে। কত হিসেবেকিতেব সেরে ফেলা যেত। তা নয়, কথায়
কথায় মানুষের ছুটি চাই। ছুটি মানেই অকাজ। হপ্তায় সাত সাতটা দিন অথচ মানুষ স্রেফ ছ’দিন
টাকা কামিয়ে সন্তুষ্ট। কী জঘন্য অপচয়। রবিবারের অযৌক্তিক ছুটির জন্যেই সান্যালের
ব্যাটার মুখে ঝামা ঘষতে একদিন দেরী হয়ে গেল। ইশ, ভাবলেই গা
চিড়বিড় করে উঠছে। এখন সবে রাত দশটা, আরও অন্তত দশ ঘণ্টার আগে অফিস যাওয়া
যাবে না।
খাবারে স্বাদ নেই, বিছানার
নরম গদি যেন ঘামাচির কারখানা। উফ, কখন যে সকাল ছ’টার অ্যালার্মটা
বাজবে। কখন যে সুখলাল গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের করে গেটের সামনে এসে হর্ন বাজাবে।
তারপর সান্যালেরই একদিন কী তাঁরই
একদিন।
ও’দিকে তখন সুখলাল
বাড়ির ছোট্ট বারান্দায় মাদুর পেতে শুয়ে। বস্তিতে লোডশেডিং,ঘরের ভিতর অসহ্য
গুমোট ভাব। বারান্দায় মশারি টাঙিয়ে শুলে সামান্য স্বস্তি। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে তাই
বাইরে এসে শুয়েছে সুখলাল।
রবিবারটা বড় ভালো লাগে সুখলালের। বউয়ের
সঙ্গে বসে ঠোঙা বানানো যায় গোটাদিন, দু’জনে বানালে ডবল
ঠোঙা; ডবল টাকা। ছেলেমেয়ে দু’টো আশেপাশে ঘুরঘুর করে। দুপুরে এক
সঙ্গে খাওয়া। বিকেলে ঠোঙার বস্তা কাঁধে বউকে যেতে হয় না বনিয়ার কাছে, সে
নিজেই নিয়ে যায়। এ’টা শুধু রবিবারই হয়।
এত ভালো কাটে সপ্তাহের এই দিনটা।
গোটাদিন পুষ্পা পাশে থাকে। খবরের কাগজ, আঠা আর বউয়ের মাথায় দেওয়া নারকোল তেল
মেশানো সুবাস সুখলালকে ঘিরে থাকে। তবে ড্রাইভারির কাজে পয়সা বেশি। দু’জনে
মিলে গোটা মাস জুড়ে ঠোঙা বানালেও ড্রাইভারির মত টাকা নেই।
রবিবার শেষ হলেই মনে হয় পুষ্পা যেন
আবার এক হপ্তা দূরে চলে গেল, পাশের রেললাইন থেকে মালগাড়ির
ঝুপুরঝুপুর বুকের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। পরের মুহূর্তেই আবার মনে পড়ে মল্লিকবাবুর
দেওয়া বাড়তি মাইনে। পুজোর বখশিশ। বছরে তিন সেট জামা প্যান্ট। বিপদের সময় দেওয়া
ধারের টাকা। ছেলেমেয়েগুলোর স্কুল। পুষ্পার সোনার কানের দুলের শখ।
রোববারের মড়া ঘুম হয়ে নেমে আসে
সুখলালের চোখে।
1 comment:
Chomotkar...Relative sukh
Post a Comment