মেসবাড়ি থেকে কলেজ বাসে তিনটে স্টপেজ।
সকাল এগারোটা থেকে ফার্স্ট ক্লাস। অরূপ অবশ্য হেঁটেই যায়।
হাঁটার জন্য কলকাতা অতি চমৎকার জায়গা।
একটু আগেভাগে স্নান সেরে নিতে হয়। একটা বাথরুম, পনেরোটা মানুষ;
একটু হুড়মুড় থাকেই। সব থেকে বেশি সময় লাগে অজয়দার, তবে
অজয়দা কলেজটলেজ বিশেষ যায় না। সকলে বেরিয়ে গেলে তারপর স্নান সারে সে। অজয়দা বলে
স্নান হল সাধনা; দু’রাউন্ড সাবান, একটু টপ্পা আর
দু’দিনে একবার শ্যাম্পু না মিশলে স্নান জমে না। অরূপ একবার বোকার মত
প্রশ্ন করে ফেলেছিল “প্রতি স্নানে দু’রাউন্ড সাবান?
কিন্তু এই দু’মাসে যে তোমায় একটাও নতুন সাবান আনতে
দেখিনি”। অজয়দা খুব চটে গেছিল “গুরুজনকে সম্মান করতে পারিস না?
ইডিয়ট! পালটা প্রশ্ন? মেসে অ্যানার্কি ঢোকাবার তাল করছিস”?
রীতিমত ঘাবড়ে গেছিল অরূপ। অজয়দার টপ্পাপ্রীতি নিয়ে আর প্রশ্ন করা হয়ে
ওঠেনি। অজয়দার রাগ অবশ্য বেশিক্ষণ টেকেনি কারণ ওর নিয়মিত জলখাবার হচ্ছে মেস লাগোয়া
মন্টুদার দোকান থেকে আনা এক ভাঁড় চা, অরূপের বাড়ি থেকে নিয়মিত সাপ্লাই আসা
মায়ের হাতে বানানো দু’পিস গজা আর একটা গোল্ডফ্লেক। কাজেই অরূপের ওপর
বেশিদিন রাগ করে থাকলে অজয়দাকে গজাNone হয়ে বসে থাকতে হবে। পাশের বেডের
বল্টুদা ফিসফিসিয়ে বলেছিল অজয়দা বলে স্নান আর ধ্যান গোপনে করা উচিৎ। বল্টুদার
বিশ্বাস আর দু’চার বছর এগজ্যাম ড্রপ দিয়ে মেসে কাটিয়ে দিতে
পারলেই অজয়দা পরমহংস হয়ে যাবে। তখন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অজয়দার জন্য এক পিস
রাসমণি আর একটা বিবেকানন্দ খুঁজতে হবে।
যা হোক। শহরে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে অরূপের
বড় ভালো লাগে। মেসবাড়ি সরু গলি ধরে কিছুটা এগোলেই হ্যারিসন রোড। রাস্তার এক ধার
দিয়ে ঠাসা নিমন্ত্রণ-পত্র ছাপানোর দোকান। অন্তত সতেরোটা দোকান তো হবেই। হ্যারিসন
রোডটা যে’খানে গিয়ে কলেজ স্ট্রিট মোড়ে মিশছে তার ঠিক কিছুটা আগেই দেলখোশা।
অরূপ যখন দেলখোশা পেরোয় তখন রেস্টুরেন্ট সবে খুলব খুলব করছে, সাফসাফাই
চলছে পুরো দমে। দেলখোশা অরূপের বেশ পছন্দ হয়েছে, সমস্ত কিছু কেমন
সাত-পুরনো। কাউন্টারে বসা ম্যানেজার থেকে শুরু করে, ওয়েটার থেকে
আসবাব, মেঝে, দেওয়াল সমস্ত কিছু। পুরনো। অরূপের স্থির
বিশ্বাস ওই পুরনো গন্ধটা সরিয়ে নিলেই দেলখোশার কাটলেটের অর্ধেক হয়ে যাবে।
দেলখোশা থেকেই গিজগিজ করছে বইয়ের
দোকান। চারিদিকে বই। বেশির ভাগ অবশ্য পড়ার বই। কিন্তু এত বইয়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে
যেতে দিব্যি লাগে অরূপের। অদ্ভুত ব্যাপার, মাঝেমধ্যে অরূপ হাঁক শুনতে পায় কোনও না
কোনও দোকান থেকে “এইযে ভাই, এ’দিকে!
সব রকমের গাইড বই আছে”। অরূপ বিরক্ত হয়, তাকে দেখে কি
খুব গাইড বই গিলে বমি করা ছেলে মনে হয়? মাঝেমধ্যে পরীক্ষায় যে অরূপ ধেড়িয়ে বসে
না তা নয়, তবু গাইডবইয়ের সামনে নতজানু হয়নি কোনওদিন। ছোটমামা বলে নম্বরটম্বর সব
বাতেলা। নম্বরের জন্য ল্যাজ গুটিয়ে নেওয়ার কোনও মানে হয় না।
অরূপের মূল আগ্রহ টিফিনের দোকানগুলো
নিয়ে। ক্যালক্যাটা ইউনিভার্সিটির সামনে খান দুই। মেডিকাল কলেজের সামনে খান তিনেক।
টোস্ট, বাটার টোস্ট, ডিম টোস্ট, বাপুজি কেক,
মামলেট, পোচ, ঘুগনি পাউরুটি, চা, চার
থেকে ছ’রকমের বিস্কুট; কত কী। এই সবকিছু মেলানো সুবাসের
মণ্ডটা বুকে সেধোতেই মনে হয় “আহ্, আজকের দিনটা
দিব্যি যাবে”। রোজ, রোজ এমনটাই মনে হয়। মেডিকাল কলেজের
উল্টোদিকে সারি সারি ওষুধ আর মেডিকাল সরঞ্জামের দোকান। এ’খান থেকে রঙটা
পালটে যেতে আরম্ভ করে। খানিক পর থেকে একের পর এক বাথরুম ফিটিংসের দোকান। এর ফাঁকেই
অবশ্য অরূপ দেখে নিয়েছে একটা ভালো কনফেকশনারির দোকান। বৌবাজার মোড়ের ঠিক আগে একটা
মন্দির। তার পাশ দিয়ে একটা গলি ঢুকে গেছে যে’টা অজয়দার ভাষায়
“আমার টপ্পাবোধ আর এই গলির হালহকিকত; এই দুই নিয়ে
বিশেষ খোঁজখবর করতে যেও না হে অরূপকুমার, সে সত্য ধারণ করার ক্ষমতা তোমার মত
সিলেবাস ঘাঁটা বান্দার নেই”।
কলেজে ঢোকার মুখে একটা টেলিফোন বুথ।
অরূপ রোজ সকালে একটা ফোন করে মাকে। রোজ একই কথার সিরিজ। অরূপ খাবার খেয়েছে কিনা।
জামাকাপড় সময়মত কাচছে কিনা। রোজ মশারি টাঙিয়ে শুচ্ছে কিনা। অরূপ মাঝেমধ্যে ভাবে
জিজ্ঞেস করবে তাঁর নামে বাড়িতে কোনও চিঠি এসেছে কিনা। কিন্তু তার কোনও মানে হয় না।
স্নান, খাওয়া, শরীর,
পড়াশুনোর খবর মাকে জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখে অরূপ। তারপর সোজা
ক্লাসরুম।
1 comment:
জানি খুব বাজে স্বভাব, তাও না বলে থাকতে পারলাম না... 'উচিত' বানান 'ৎ' দিয়ে নয়... আসলে উচিত শব্দটা দেখলেই আমার শঙ্খ ঘোষের একটা লাইন মাথায় ঘোরে... 'চিৎ হওয়া উচিত নয়'...
Post a Comment