এই যে বেঁচেবর্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
এই যে চায়ের কাপে নিজের পছন্দ মত পরিমাণে চিনি মিশিয়ে নিচ্ছি।
খবরের কাগজের পাতা উলটে চুকচুক করে চলেছি।
বসের মুখ গোমড়া হলেই মাথা চুলকে হদ্দ হচ্ছি।
এই যে প্রতিবেশীর পর্দার রঙ ক্যাটক্যাটে বলে মনখারাপ করছি।
এই যে সভ্যতায় গা এলিয়ে মৌজ করতে পারা। টেবিল চাপড়ে রেগে উঠতে পারা। এই যে মনের মধ্যে হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড়ে তৈরি হলে শীতের রাতের মিয়ানো বেড়ালের মত কাঠের পেটির আস্তানা খোঁজা। সন্ধে সাতটা পঞ্চাশের আপ ব্যান্ডেল লোকালের জানালার প্রতি এই যে প্রপঞ্চময় মায়া।
সব মিলে ইংরেজিতে যাকে বলে 'মাচ্ কভেটেড' এই মানবজীবন।
এই মানবজীবনের কচুপাতায় চকমকে মুক্তোর দানার মত যদি কোনও পাওনা থাকে তবে তা হল একটা নতুন গানকে দুম করে ভালোবাসতে পারা।
সুর মানেই প্রশান্ত মহাসাগর এ থিওরি আদ্যোপান্ত বাতেলা। আবার অমুক সুরে দুনিয়া মজছে বলেই আমিও ভেসে বেড়াবো তেমন নিউটনি আইনও খাটে না।
একটা নতুন গানকে আচমকা 'প্রিয়' বলে চিনতে পারা, এ'টাই সুপারপাওয়ার, এতেই নির্বাণ। একদম অচেনা অজানা কোনও সুর; প্রথম শোনা এক ঝাঁক কথার সিঁড়ি বেয়ে ছাতে উঠে পায়চারী করতে করতে গান হয়েছে। তার সামনে এসে ঝপাৎ করে বলতে পারা "যাক্, দেখা হলো তাহলে। খবর সব ঠিকঠাক"?
গানও তো মানুষ গোছেরই। তাদেরও ভালো মন্দ, পছন্দ অপছন্দ, ঠিক বেঠিক, শাড়ি ফতুয়া, কান্না গোপন চুমু, কবিতা বোধ খিস্তি; সবটুকুই রয়েছে। কথার আদর, সুরের স্নেহ আর কণ্ঠস্বরের মেরুদণ্ডে তাদের স্পষ্ট হয়ে ওঠা।
এই সবকিছু মিলে কিছু গান দুম করে এসে কড়া নাড়ে। "কউন হ্যায়" হাঁক পাড়বার আগেই খেয়াল হয় 'দরজাটা কোথায়"?
তারপর খানিক খোঁজখবরে হদিশ মেলে গোপন কুঠুরির। সে কুঠুরির গায়ে নক্সা করা সেগুন কাঠের দরজা। কুঠুরিটা যে আছে সে খবরই এদ্দিন জানা ছিল না। হঠাৎ একটা বেমক্কা গান এসে নিদান দেয় "ইয়ে দরওয়াজা খোলিয়ে জনাব"। পিতলের ছিটকিনি নামিয়ে দরজা খুলে দিতেই গানের সুর, কথা, কন্ঠ হুশহাশ সে কুঠুরিতে রোদ নিয়ে ঢুকে পড়ে।
মনের তলে দিব্যি কত কিছু জমা থাকে; কত মাদুর পাতা মন খারাপ, কত আতরে ভেজা তুলোর মত ব্যথা, কত বৃষ্টি ধোয়া রাস্তার মত ভালো লাগা, কত দেশলাই বাক্সে ঠেসে ভরে রাখা সুপারনোভা সাইজের অভিমান; একেকটা নতুন গান ভালোবেসে এক একটা নতুন গল্প তৈরি করে যায়।
'অলির কথা শুনে বকুল হাসে' প্রথম শুনেছিলাম দাদুর ফিলিপ্সের রেডিওতে। সে গানে আজও শীতের রাত্রির গন্ধ লেগে আছে। মায়ের গলায় প্রথম শোনা 'এমনই বরষা ছিল সেদিন'; হাতে গরম মনখারাপি সুর। ক্লাস নাইনের একটা বিকেলে, এক স্কুলের বন্ধুর চিলেকোঠার ঘরে প্রথম শুনেছিলাম 'তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনও'; বিকেলের গন্ধে আজও বেমক্কা বুক ছ্যাঁত করে ওঠে। বা সোজাসুজি সে ভদ্রলোকের কণ্ঠে শোনা "বন্ধুরা, বিশ্বাস করুন আমি মানুষটা হিংসুটে নই মোটেও। তবু আমার ভীষণ মন খারাপ হয় এই ভেবে যে এই লাইন দু'টো আমার লেখা নয় - 'ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো'"; প্রেসিডেন্সির ডিরোজিও হল, বছরটা সম্ভবত ২০০২।
অথবা মাঝরাতের ছাতের অবকাশে আর গোল্ডফ্লেকিও সুবাস মিশিয়ে শোনা 'তেরে খত্ আজ ম্যায় গঙ্গা মে বহা আয়া হুঁ, আগ বেহতে হুয়ে পানি মে লগা আয়া হুঁ'।
মোদ্দা কথা হলো কিছু কিছু গান শুনেই 'আরে, এ'টা তো আমার' বলে জড়িয়ে ধরতে পারা; এই ক্ষমতাটুকু যদ্দিন আমাদের আছে তদ্দিন যুদ্ধটুদ্ধ থাকা সত্ত্বেও মানুষামি ঘুচবে না।
পুনশ্চ - চন্দ্রাণীদেবীর 'তোমাকে বুঝি না প্রিয়' গানটা শুনে যে দুম করে ভালো লাগা (যুক্তি জানি না, গানের কতটুকুই বা বুঝি), তার পরিপ্রেক্ষিতে এই বেমক্কা র্যান্ডম র্যান্ট
No comments:
Post a Comment