১।
- ভাই, অ্যাই ভাই!
- উঁ।
- অ্যাইই ভাই। ওঠ না।
- না।
- আয়। আয় না।
- না!
- ছাতে এক ছুটে যাব, এক ছুটে ফেরত। আয় না ভাই।
- ঘুমোব!
- রোব্বারে দুপুরে কেউ ঘুমোয়?
- মা বলেছে। তুইও ঘুমো।
- মা তোকে হিস্ট্রি বইতে লুকিয়ে রোজ সন্ধেবেলা নন্টেফন্টে পড়তে বলে?
- দিদি। বিকেলে যাব। এখন না।
- তাহলে দেখতে পাবি না।
- কী?
- সে’টা গেলেই দেখতে পাবি।
- দরকার নেই আমার দেখে।
- স্কোয়াশের সরবত বানাবো ছাদ থেকে ঘুরে এসে। ফ্রিজের জল। তা’তে আবার বরফ।
- ছুট্টে যাব আর ছুট্টে চলে আসব?
- চ’।
২।
- অনিন্দ্য।
- ইয়েস স্যর।
- প্রেজেন্টেশন রেডি?
- মোটামুটি।
- মাত্র ঘণ্টা দুই বাকি, এখনও মোটামুটি?
- আসলে স্যর ডেটায় এত গ্যাপ...।
- এক্সকিউজ অ্যান্ড এক্সকিউজ! মাই গড অনিন্দ্য। তুমি এত বড় অ্যাসাইনমেন্ট যে কী ভাবে ম্যানেজ করবে...। লুক। আই ওয়ান্ট দ্য প্রেজেন্টেশন মেইলড টু মি ইন থার্টি মিনিটস।
- ইয়েস স্যার।
৩।
- ভাই, এই দ্যাখ!
- এ’টা কী? ম্যাগোহ্!
- ন্যাকামো করিস না। এর নাম জনার্দন।
- জনার্দনকে পেলি কোথায়?
- কার্নিশে পড়েছিল। ওই দিকের। আম গাছটার ডাল ভেঙে পড়েছে হয় তো।
- এ’টা কাকের বাচ্চা না?
- তোকে যদি বিট্টু না বলে মানুষের বাচ্চা বলি শুনতে ভালো লাগবে?
- দিদি, মা দেখলে কিন্তু...।
- সদ্য ডিম ফুটে বেরিয়েছে হয়ত। জনার্দনকে এখন ছেড়ে দিলে মরে যাবে। বিড়ালে খাবে। তার চেয়ে এই চিলেকোঠার ঘরেই থাক। জুতোর বাক্সটা কাজে লেগে গেল।
- মা জানতে পারলে...।
- তুই বলবি?
- আমার পড়তে বসে কমিক্সের বই পড়ার ব্যাপারটা...।
- আমি মাকে বলব না।
- জনার্দন খাবে কী?
- কেন্নো দিলাম, দিব্যি খেয়ে নিল। তুই বিকেলে মাঠের ওদিক থেকে বেশ কিছুটা কেন্নো ধরে আনতে পারবি? চমনবাহারের খালি ডিবে দিয়ে দেব’খন।
- আমার ঘেন্না লাগে।
- তুই এত ন্যাকা কেন?
- আমি আজ তিন গ্লাস অরেঞ্জ স্কোয়াশ খাবো কিন্তু।
৪।
দীপার চিঠি। অন্তত খান চল্লিশেক। অনিন্দ্য মাঝেমধ্যে উলটেপালটে পড়ে। একমাত্র দীপার চিঠি পড়ার সময় অনিন্দ্য সিগারেট খায়। বেশ একটা ইয়ে লাগে। দীপাকে দিদি অঙ্ক শেখাত।
ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত পাড়ায় ছিল দীপারা।
ওঁর বাবার জামশেদপুরে ট্রান্সফার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত গোলমাল হয়ে গেল। এখন অবশ্য ফেসবুকে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হয়। টুকরোটাকরা হোয়াটস্যাপে মেসেজ। তবে এই চিঠিগুলোর কথা দীপাকে মনে করালে ও হয়ত লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাবে।
দীপার বর ভারী অমায়িক, শুভেন্দুদা। আমেরিকা থেকে আসার সময় অনিন্দ্যর জন্য দামী স্কচ নিয়ে এসেছিল; “তুমি নাকি দীপাকে প্রথম ব্যাটম্যান পড়িয়েছিলে? তার জন্য একটা গোটা ব্রিউয়ারি তোমার প্রাপ্য”।
কী বাজে ঠাট্টা। দীপা অবশ্য হেসে গড়িয়ে পড়েছিল।
সেই মদ এক চুমুক খেয়ে দিদিকে ফোন করেছিল অনিন্দ্য। ঘণ্টাখানেক ধরে দিদি ফোনের ওপার থেকে সঞ্জীবের রম্যরচনা পড়েছিল।
দিদির গায়ে দুপুরের গন্ধ।
অনিন্দ্য মদটাকে ঠিক গ্রিপ করতে পারেনি। সেই প্রথম ও শেষ চুমুক।
৫।
- দিদি, খাবি না?
- তুই যা না ভাই। বলেছি তো খাব না।
- জনার্দনের বাঁচার কোনও চান্স ছিল না। বাবা বলল তো।
- ও আমার জন্য মরেছে। কেন যে ওকে কার্নিশ থেকে তুলে আনতে গেলাম। ওখানে থাকলে হয়ত ওর মা ওকে দেখতে পেত, তুলে নিয়ে যেত। ধুস।
- দিদি। আচ্ছা, তুই না হয় খাস না। কিন্তু কাঁদিস না। প্লীজ।
- ভাই, তুই প্লীজ যা না।
- কাল আমার অঙ্ক পরীক্ষা।
- ফের ভয় পাচ্ছিস?
- তোকে কাঁদতে দেখে আরও নার্ভাস লাগছে।
- ভালো ভাবে প্র্যাক্টিস করিয়েছি তো তোকে এ’বার। তুই এত হাবা কেন?
- ফেল করলে বাবা খুব...।
- অনেক প্র্যাক্টিস করেছিস। এরপর ফেল করলে তোর কিছু করার নেই।
- তবু। বাবা আমায় নিয়ে খুব চিন্তা করে। মাও করে হয়ত। এত খারাপ নম্বর পাই...।
- ভাই।
- কী?
- ভয় করছে? শিব্রাম পড়বি? ভয় দুম করে কেটে যাবে।
- আমার কমিক্স ছাড়া কিছু পড়তে ইচ্ছে করে না।
- আমি পড়ি? তুই শুনে যা, কেমন?
- ভয়ে কমে যাবে?
- তুই অঙ্ক পরীক্ষার কান মুলে দিতে পারবি। দাঁড়া, শিব্রামটা নিয়ে আসি।
৬।
দিদির গায়ে দুপুরের গন্ধ। দিদির যে কোনও গল্পে পুজো ছুটির প্ল্যানের চনমন। দিদি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে মনে হয় সামনেই গরমের ছুটি। বাবার দু’কাঁধে দুই ভাই বোনে থুতনি রেখে জব্বর ঘোরার প্ল্যান। ট্রেনের আপার বার্থটা কে নেবে, টিফিন কেরিয়ারে লুচির সঙ্গে আলুর দম না ছক্কা, কতগুলো গল্পের বই ব্যাগে নিলে ওজন বাড়াবাড়ি হবে না; এমন কত কী।
দিদি অঙ্কে একই ভুল বার বার করলে রেগে যেত। কাউকে কটু কথা বললে দুঃখ পেত। বেড়াল কুকুরকে অবজ্ঞা করলে ওর মুখ কালো হয়ে যেত। ভয় পেলে দিদি জড়িয়ে ধরত। দিদি গল্পের বই পড়লে মনে হত হাওয়ায় একটা মাদুরে ভাসতে ভাসতে সিনেমা দেখা চলছে।
মায়ের বায়পসি রিপোর্ট পেয়ে দিদিকে ফোন করেছিল অনিন্দ্য।
টেলিফোনের ও’পার থেকে অনিন্দ্যর হ্যালো শুনেই আঁচ করেছিল দিদি।
- এ’বার মাকে বলে দিই তুই হিস্ট্রি বইয়ের মধ্যে নন্টে ফন্টের বই লুকিয়ে পড়ায় ফাঁকি দিতিস?
- হুঁ।
- ভাই...।
- উঁ?
- জনার্দনকে মনে পড়ে?
- হুঁ।
- কষ্ট হচ্ছে?
- হুঁ। তোর?
- খুব।
- তোর বেশি কষ্ট রে দিদি।
- কেন? তোর কম?
- কমই তো।
- কেন?
- আমার তবু তুই রইলি।
- ভাই, তোর মনে আছে জনার্দন মারা যাওয়ার পর মায়ের কান্না?
- হুঁ।
***
মা টের পেলেন অনিন্দ্য দিদিকে ফোনে সঞ্জীব পড়ে শোনাচ্ছে। আহা রে, এখনও কমিক্স পড়া ছেলেটাকে কী সব রিপোর্ট আনতে হাসপাতালে ছুটতে হয়।
মা রিপোর্ট আঁচ করতে পারেন।
ভাই বোন একে অপরের বন্ধু হতে পেরেছে, তাই চিন্তা কম। অনিন্দ্যর জন্য কড়া মিষ্টি দিয়ে এক গেলাস অরেঞ্জ স্কোয়াশ না বানালেই নয়; ছেলেটা এক হাজারটা অঙ্ক পরীক্ষার ভয় এক সঙ্গে পেয়ে বসেছে।
1 comment:
Ki mayamoi lekha
Post a Comment