Friday, October 27, 2017
হরিহরবাবুর ডানা
Wednesday, October 25, 2017
বেরাদরি
- ব্রাদার! পেরেছি!
- এত রাত্রে...এত হাঁকডাক বিগ-বেরাদার...?
- রাত কোথায় ব্রাদার? ভোর। শুরু। আলো। নতুন। এই তো সময়। পেরে ওঠার। আমি পেরেছি।
- পেরেছ? যন্তর তৈরি?
- না হলে ডাকলাম কেন? যন্তর রেডি। তুমিই প্রথম সাবজেক্ট ব্রাদার।
- ওহ। এ যন্ত্র পারবে গো বিগবেরাদার? মন খারাপ বুঝতে?
- চটপট। তুরন্ত। এই মনখারাপ হল, হুই ডাক এলো।
- মাইরি? এ যন্তর হাঁক দেবে?
- নয়ত আর বানালাম কী! ডাকেই অ্যান্টিসেপ্টিক।
- তাতেই মনখারাপ গায়েব?
- মনখারাপ ইজ আ ফর্ম অফ এনার্জি ব্রাদার। এনার্জি গায়েব হয় না। এক ফর্ম থেকে অন্য ফর্মে কনভার্ট হয়। মনখারাপ টু মনকেমন। মনকেমন টু কবিতা। চটপট। তুরন্ত। দুরন্ত।
- কবিতা? আমি বুঝি না।
- যন্তর। বুঝিয়ে দেবে।
***
'কী রে! ভাবছিস কী? বললি না তো আমার বানানো।নাড়ু কেমন খেলি'? যন্তরের চোপায় চমকে ওঠে পিলে।
তাই তো। বিগ-বেরাদার তবে মিথ্যে বলেননি। আঁচলের খসখসে ছ্যাঁতছ্যাঁতে কবিতা টের পেয়ে বিগবেরাদারের প্রতি সামান্য গলে পড়তে ইচ্ছে হল।
Sunday, October 22, 2017
মাঝরাত্রের স্কুলবাড়ি আর দাসগুপ্তবাবু
Saturday, October 21, 2017
সকলই তোমারই
Thursday, October 19, 2017
সতীনাথ ও ঘুগনির বাটি
Friday, October 13, 2017
সৈনিক আর হারমোনিকা
১
- বিল্টুবাবু!
- কে?
- ভয় পেয়েছ?
- তুমি কে?
- আমি? আমি সৈনিক।
- তুমি আমার শোওয়ার ঘরে এলে কী করে? তুমি কি ভূত?
- ঠিক ধরেছ। আমি ভূত। মৃত সৈনিকের ভূত।
- তুমি আমার ঘরে কেন এসেছ? আমি চিৎকার করলেই মা ছুটে আসবে কিন্তু। তারপর তোমার যে কী দুরবস্থা হবে...।
- তুমি চিৎকার কেন করবে বিল্টুবাবু? তুমি কি ভয় পেয়েছ?
- ক্লাস ফোর পর্যন্ত খুব ভয় পেতাম, জানো। গতকাল ক্লাস ফাইভে যেই উঠেছি, অমনি ভয়টয় গেছে কমে।
- তাই? কী রকম ব্যাপারটা?
- ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ও ধুন্ধুমার যুদ্ধ চলছিল তো। রোজ রাত্রে পাড়া অন্ধকার। চুপটি করে বসে থাকা, এই বুঝি বোমা পড়ল। হারুদাদাদের কী হয়েছিল জানো তো?
- কী হয়েছিল?
- শত্রুদের একটা বোমা, পড়বি তো পড় এক্কেবারে হারুদাদাদের বাড়ি ছাদে। হারুদাদা, হারুদাদার মা, বাবা, হারুদাদার গরু লালি, আর আরও অনেকে; ছাই হয়ে গেছিল।
- ওহ হো।
- গোটা ক্লাস ফোর তো আমায় স্কুলেই যেতে হয়নি। যুদ্ধের জন্য।
- ওহ।
২
- জল...। একটু জল।
- চোপ্।
- আররে, মরেই তো যাচ্ছি। একটু জল দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে হে ক্যাপ্টেন?
- চারটে বুলেট খরচ করতে হয়েছে তোমার ওপর, তারপরেও এতক্ষণ তড়পে চলবে ভাবিনি।
- এই এক ঢোক জলের দাম পাঁচ নম্বর বুলেটের চেয়ে অনেক কম ক্যাপ্টেন।
- শত্রুকে জল দেব?
- পরাজিত শত্রু। মরতে বসেছে। জল দিলে বেঁচে উঠব না। দাও না ভাই ক্যাপ্টেন, এক ঢোক জল। তোমার পিঠের জলের বোতলটা দেখে থেকে কেমন মনটা আনচান করছে। তোমায় আশীর্বাদ করে যাব। বয়সে তুমি আমার চেয়ে বোধ হয় ছোট।
- এই নাও, জল। আর শোন, আমায় খবরদার ভাই বলে ডাকবে না। তোমার আশীর্বাদের মাথায় আমি লাথি মারি। এই নাও জল, হাঁ করো দেখি।
- আহ্, বাঁচালে ক্যাপ্টেন। মড়ার মুখে জল দেওয়া বড় পুণ্যির কাজ গো।
- আশা করি তোমায় বাঁচাইনি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভবলীলা সাঙ্গ হবে। আর আমার পুণ্যির লোভও নেই। যুদ্ধটা জিতলেই যথেষ্ট।
- আমাদের প্রতিরোধ তো...। শেষের দিকেই..।
- হ্যাঁ, আর দিন দুয়েক। তারপর তোমাদের রাজধানী আমাদের দখলে।
৩
- আচ্ছা বিল্টুবাবু, যুদ্ধ খুব খারাপ, তাই না?
- আমার বাবা যুদ্ধে গেছে, যুদ্ধ খারাপ কেন হবে? যুদ্ধ খারাপ হলে কি বাবা যুদ্ধে যেত?
- তাও বটে। তা যুদ্ধ তো শেষ। তোমার বাবা...।
- বাবা ফিরছে তো। সৈন্যদলের সঙ্গে। কুচকাওয়াজ করতে করতে। বিজয় নিশান উড়িয়ে। আর কয়েক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে...।
- ওহ্, আচ্ছা।
- আমিও বাবার মত একদিন যুদ্ধে যাব। পরনে ইউনিফর্ম, হাতে বন্দুক। বাবার মত ফিরব কুচকাওয়াজ করতে করতে।
- তুমি বেশ সাহসী ছেলে তো বিল্টুবাবু।
- ক্লাস ফোরে আমি খুব ভীতু ছিলাম। এখন বেশ সাহস হয়ে গেছে। কিন্তু সৈনিক, তুমি এখনও বললে না কেন এসেছ! তুমি আমার বাবাকে চিনতে?
- চিনতাম বৈকি। আমাদের কত গল্প আড্ডা হয়েছিল। তোমার বাবা বেশ বীর যোদ্ধা। আর বড় ভালো মানুষ।
- তুমি জানো আমার বাবা খুব ভালো হারমোনিকা বাজাতে পারে?
৪
- ক্যাপ্টেন!
- কই মাছের জান তোমার মাইরি। এখনও বেঁচে আছ। আর জল চাইলে পাবে না, এ'টুকু বলে দিলাম।
- তোমার পকেটে... তোমার পকেটে..।
- এ'টা? হারমোনিকা!
- শোনাবে? একটু? শোনাবে?
- নাহ্, পাঁচ নম্বর বুলেট তোমার মাথায় না গুঁজে দেওয়া পর্যন্ত তুমি বোধ হয় এমনি ভাবেই ঘ্যানঘ্যান করে যাবে।
- সমস্ত কেমন কালচে নীল হয়ে আসছে ক্যাপ্টেন।
- ওহ্, তার মানে আর দেরী নেই।
- জানো ক্যাপ্টেন, রিলোড করতে সামান্য তিন সেকেন্ড দেরী করে ফেলেছিলাম...নয়তো...।
- নয়তো তোমার বদলে এ'খানে আমার লাশ পড়ে থাকত। জানি। স্কার্মিশে এমনটাই হয়। দু'তিন সেকেন্ডের দেরীতে হিসেব এ'দিক ও'দিক।
- আচ্ছা, ক্যাপ্টেন...। দোষ কার? তোমার দেশের? না আমার দেশের?
- দেশের আবার দোষ কী? নেতাদের ইচ্ছেয় যুদ্ধ। আমরা সৈনিক, হুকুম তামিল করব। ব্যাস।
- কালচে নীল ক্যাপ্টেন। কানে ঝুনঝুনি বাজছে। আমার খোকার রিনরিনে হাসি...।
- বয়স কত তোমার খোকার?
- বারো। ওর গালে টিপলে এখনও হাসির মধুর ঝরে ক্যাপ্টেন। খোকাও হারমোনিকা বাজায়।
- বটে?
- মন কেমনের বাঁশি গো ক্যাপ্টেন। আমার আর শোনা হল না।
- সরি।
- আরে ধুস। তুমি আমায় না মারলে..আমিই তোমায়...। হুকুম। তামিল। জানোই তো। তোমার বাড়িতে..।
- প্রায় ওই বয়সেরই আমার ছেলে। নাম বিল্টু।
- আমার ছেলের নাম ইবু। হারমোনিকা অন্ত প্রাণ,বাজাবে একটু? হারমোনিকা? ক্যাপ্টেন? ইবুর কথা বড় মনে পড়ছে। চারদিকে কালচে নীল...সমস্ত আলো নিভে যাচ্ছে।
৫
- বিল্টুবাবু, তোমার বাবা অপূর্ব সুরে হারমোনিকা বাজায়। সে সুর শুনলে মনে হয় পাহাড় গলে পড়ছে। মনে হয় শিউলি টুপটাপ ঝরে পড়ছে ঘাসের নরমে। তোমার বাবার হারমোনিকায় মায়া আছে বিল্টুবাবু।
- তুমি বড় ভালোমানুষ সৈনিক। তুমি বাবার দলে ছিলে?
- আমি এখন তোমার বাবার দলে।
- তোমার নাম কি?
- ইবুর বাবা।
- ওহ।
- বিল্টুবাবু। আমি কেন এসেছি জানো?
- কেন?
- আমায় ক্ষমা করবে বিল্টুবাবু?
- মানে?
- আমায় হারমোনিকা শোনাতে গিয়ে...তোমার বাবা...।
- আমার বাবার কী হয়েছে সৈনিক?
- আমি খুব গোঁ ধরেছিলাম, আমায় একটু হারমোনিকা শোনানোর জন্য। আহা, কী অপূর্ব সুর তোমার বাবার হারমোনিকায়। কিন্তু হারমোনিকার শব্দে শত্রুপক্ষ তোমার বাবার পোজিশন জেনে যায় আর...।
- সৈনিক।
- সরি বিল্টুবাবু। আমায় ক্ষমা করবে?
- ক্লাস ফোরে থাকলে করতাম না। কিন্তু আমি এখন ক্লাস ফাইভ।
- কাঁদছ বিল্টুবাবু?
- ইবু কোন ক্লাসে পড়ে?
- ক্লাস ফাইভ। সেও হারমোনিকা বাজায় বেশ।
- তুমি ইবুর সঙ্গে দেখা করতে যাওনি?
- ইবুর কাছে ক্ষমা চাওয়ার নেই। কিছু ফেরত দেওয়ার নেই। বিল্টুবাবু, তোমার যদি কোনওদিন ইবুর সঙ্গে দেখা হয়, ওকে বলবে যে ওর বাবা মারা যাওয়ার আগের মুহূর্তে হারমোনিকা শুনতে শুনতে শুধু ইবুর কথা ভেবেছে?
- খুব কষ্ট হচ্ছে সৈনিক।
- তুমি না ক্লাস ফাইভে পড়ো?
- তবুও। বাবা। বাবার হারমোনিকা।
- সে'টাই তোমায় ফেরত দেওয়ার ছিল।
৬
পরের দিন খুব ভোরের দিকে খবরটা পেয়ে মা এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন বিল্টুকে। বিল্টুর বালিশের তলায় রাখা হারমোনিকায় তখনও বাবার গায়ের সুবাস।
Thursday, October 12, 2017
ফিরে আসার গল্প
Monday, October 9, 2017
কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি!
- দাদা গো! কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি!
- বটে?
- ঝমঝম শুনতে পাচ্ছ না?
- ঝমঝম কি? ঝিরঝির মনে হচ্ছে।
- তোমার কান গ্যাছে। এদিকে আবার শঁশঁশঁশঁ করে ঝড়!
- সামান্য ফুরফুর কানে এসেছে বটে।
- প্রলয় এলো বুঝি, এমন দিন তিনেক চললে কলকাতা বে অফ বেঙ্গলে মার্জ হয়ে যেতে পারে।
- না না। বড় জোর বেহালায় অটো উল্টোবে, আমহার্স্ট স্ট্রিটে হাঁটুজল। মেজকাকার সামান্য সর্দিজ্বর। ঠাম্মার সাধের গামছাজোড়া শুকোবে না।
- এই আন্ডারপ্লে করাটা তোমার একটা বদভ্যাস দাদা। সে'বার মোদীর ল্যান্ডস্লাইড ভিক্ট্রিকে বললে স্টেজম্যানেজ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মোহনবাগানের চার গোল খাওয়ার পর বললে ক্লোজলি ফট্ কনটেস্ট। পিসিমার কিডনি স্টোনের দুর্দান্ত ব্যথাকে মাইল্ড ডিসকমফর্ট বলে পিসেমশাইকে রিপোর্ট করলে।
- বাঙালির এই অকারণ লাফিয়ে ওঠার স্বভাবটা বড় বিশ্রী রে ছোট।
- ধুস, তোমার সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি। তার চেয়ে বরং রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের কড়াইয়ে খুন্তি নাড়া দেখি। বাবা আজ ঢাউস ইলিশ এনেছে; দেড় কিলোর।
- খোকা ইলিশ নয়, সে'টা ঠিক। তাই বলে ঢাউস? ধুস। এক কিলো সাড়ে তিনশো। অনলি।
- বাজে না বকে পড়তে বসো। গতবার ফিজিক্সে অক্কা পেয়েছিলে সে'টা মনে আছে তো? জ্যাঠা বলেছে এ'বারেও ফেল করলে তোমার কান ছিঁড়ে নেবে।
- অক্কা কি বলা চলে রে? আর পঁয়ত্রিশটা নম্বর পেলেই ফার্স্ট ক্লাস হয়ে যেত। আর জ্যাঠা অতটা কানিং নয় যে গাধা পিটিয়ে ভ্যান গঘ বানাবে।
- আমি চললাম রান্নাঘরে।
- অ্যাই ছোট শোন! অল্প এক কুচি ভাজা ইলিশ আনিস তো বাটিতে করে। টেস্ট করব। মুখ জিভ ফ্রেশ থাকলে টোটাল ইন্টারনাল রিফ্লেকশনটা ভালো ভাবে ইন্টারনালাইজ করা যাবে।
- এক কুচি ইলিশ ভাজা, তাই তো?
- এক কুচি মাত্র। মাইনর। ইনসিগনিফিকেন্ট। এই ধর, তোদের মত বাঙালিদের হিসেবে দু'টো পেটির পিস। চট করে রান্নাঘর থেকে নিয়ে আয় দেখি।
Sunday, October 8, 2017
ক্যাপ্টেন ক্ক্ব্র আর ঈশ্বর
- ক্যাপ্টেন ক্ক্ব্র, আমাদের এই মিশন ঐতিহাসিক সাফল্য লাভ করতে চলেছে।
Monday, October 2, 2017
নেশাভাং
- হ্যালো!
- হুঁ।
- বাবু, শুভ বিজয়া।
- হুঁ?
- শুভ। বিজয়া।
- শু..শুভ।
- এ'বারেও মন্টুদারা সিদ্ধিতে তামা ঘষে দিয়েছে?
- আমি ভাবলাম তোর সঙ্গে কথা বলতে নেই।
- নেই তো।
- তাহলে...ফোন করলি কেন?
- এমনি।
- আমি ফোন করব? কাল?
- না?
- কেন?
- তোর ফোন করতে নেই।
- ওহ। কিন্তু তুই ফোন করতে পারিস?
- পারি। সবসময় নয়। এই যেমন আজ, তোর জ্ঞানগম্যি যখন গুলিয়ে গেছে।
- ভাবছি...।
- তুই ভাবিস? বাবু?
- ওহ, ভাবতে নেই?
- ভাবলে কেরিয়ারের কথা আর একটু মন দিয়ে ভাবতিস। অন্তত মায়ের কথা ভাবতিস। সে যাক, এখন কী ভাবছিলিস?
- সিদ্ধির জন্য বিজয়াদশমী পর্যন্ত ওয়েট না করে যদি মাঝেমধ্যেই...।
- মাঝেমধ্যেই আমাদের কথা বলতে নেই।
- ওউক্কে। আন্টিল নেক্সট বিজয়া দশমী দেন।
- কেন এমন করিস?
- যাস না।
- আমি নেই তো। যাব কই?
- ট্রু। সরি। শুভ বিজয়া।
- সাবধানে থাকিস। কেমন?
- যাস না।
- আবার?
- সরি।
- সামনের বিজয়ার সিদ্ধির আগে আর কোনও নেশাভাঙ নয়, কেমন?
- তোর শশীকাকাকে মনে আছে?
- স্কুলের বিহারী দারোয়ান? তুই যার সঙ্গে লুকিয়ে তাস খেলতিস?
- হুঁ।
- তাঁর কী হয়েছে?
- অষ্টমীর দিন মারা গেছেন। ওর বডি নিয়ে ছপড়া এসেছি ওর তিনজন দেশোয়ালির সঙ্গে। নবমী থেকে এখানেই। এ'টা ঠিক সিদ্ধি নয়, জানিস? ভাংয়ের গুলি।
- তুই এখন কোথায় বাবু?
- শ্মশান। পাশে গঙ্গা। চাঁদ, নীলচে কালো আকাশ। শীত শীত হাওয়া। শশীকাকাকে এ পুজোয় একটা ফতুয়া কিনে দিয়েছিলাম। আই জিঙ্কসড হিম। না রে?
- ধুর বোকা।
- কী ভয় রে। কী ভয়। ভূতের নয়।
- জানি।
- আই জিঙ্কস এভ্রিওয়ান।
- একটা চড় মারব।
- হেহ্।
- বাড়ি কবে ফিরছিস?
- যবে, তবে।
- তোর সর্দি লেগেছে?
- আমায় ফোন করিস না আর।
- ছিঃ বাবু।
- করিস না।
- আচ্ছা।
- জানিস, নতুন ফতুয়াটাও চিতায় চড়িয়ে এসেছি। বড় ভালো হনুমানের গান গাইত শশীকাকা। বড় দরাজ গলা। ভাব আসলে চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়ত। ট্রু সেন্ট। জুয়া না খেললে চুরি করত না।
- আমিও খুব ভালো হনুমানের গান গাইতে পারি। তোর ল্যাজটা থাকলে বেশ টের পেতিস।
- হেহ্। তোকে সেই যে একবার একটা শাড়ি দিলাম...। জিঙ্কস সে'খানেই হল।
- ক্যাটক্যাটে লাল! জিঙ্কস হওয়াই ভালো। এখন রাখি। কেমন?
- আয়। শুভ বিজয়া।
- শুভ। শ্মশান থেকে ফিরে স্নান করিস। আর এ'দিক ও'দিক হুটহাট চলে যাওয়ার আগে মায়ের কথাটা একটু ভাবিস। কেমন?
Sunday, October 1, 2017
বিপিনবাবুর একাদশী
(এই লেখাটা ২০১৬তে 'এই সময়'য়ের জন্য লেখা, সে'বার একাদশী রোব্বারে পড়েনি)
বিপিনবাবুর জ্ঞান যখন ফিরলো তখন গোটা মুখে রোদ! গোটা গায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথার বিশ্রী দপদপ আর ঝিমঝিম মেশানো অনুভূতিটা কিছুতেই যাচ্ছে না। শরীরটা মনে হচ্ছিল আড়াইশো কিলোর এক বস্তা লোহা।
“অফিস যাবে না নাকি”? বৌয়ের স্টিলের-বাসনপত্র-আছড়ে-পড়া কণ্ঠস্বরে বিপিনবাবুর মনের মধ্যে একটা সুতীব্র ঝাঁকুনি পড়ল। ঝাঁকুনি জিনিসটা খুব দরকারি। দৈনিক অটোরিকশার ঝাঁকুনিটাকে বিপিনবাবু ফ্রি জীম বলে ধরে নেন। আজকের এই বৌয়ের ডাকের ঝাঁকুনিটা তেঁতুলজলের কাজ করল। গোটা গা থেকে সিদ্ধির ভারটা এক ধাক্কায় অনেকটা নেমে গেল।
অফিস! পুজো খতম! একাদশী ইজ হিয়ার! অফিস! অফিস! অফিস! ঢনঢনিয়ার ফাইলের রিকনসিলিয়েশন, বড়সাহেবের চাওয়া গত কোয়ার্টারের রিভিউ স্টেটমেন্ট; একে একে সমস্ত পড়ে থাকা কাজ মাথায় হুড়মুড় করে এসে বুকের ভিতরের ঝিমঝিমে সিদ্ধি তন্দ্রাটা ঘুচিয়ে দিল। বমিবমি ভাব অবশ্য কম হল না।
ছয় গেলাস সিদ্ধি,
তারপর চার পিস পান্তুয়া,
তারপর দলের মেহেন্দির গানের তালে ধুনুচি নাচ। একটানা। ঠাকুর না ভাসানো পর্যন্ত।
সেই থেকে বুকের ভিতরটা এমন হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় হয়ে গেলো। রাতের মাটন রেজালা আর রুমালি রুটিতেও সবিশেষ মন দেওয়া হয়নি। নেশা এমনই জবরদস্ত উঠেছিল যে রুমালি রুটিতে মাখাবার জন্য মাঝেমাঝেই জ্যাম আর ধনেপাতা বাটা চেয়ে বসছিলেন। নেহাত গিন্নী সামাল দিয়ে বের করেছে। তবে বিজয়া দশমীর ডিনার এদিক ওদিক হলেও, পুজোর বাকি দিনগুলো বিপিনবাবু মন্দ খেয়েছেন, তেমন কথা পরম শত্রুও বলবে না। জলখাবারে পাঁচ দিনই থেকেছে লুচি, সাথে কখনও বেগুন ভাজা , কখনও আলু ভাজা, কখনও আলুর দম, কখনও নারকোল কুচি দেওয়া ছোলার ডাল। সঙ্গে পায়েস (রকমফেরে) এবং দু’রকমের মিষ্টি। দুপুরের খাওয়া হয়েছে বাড়িতে। থেকেছে দু’রকম মাছ; অসময়ে ইলিশ থেকে শুরু করে মৌড়লা বা ট্যাঙরা বা লইঠ্যা বা বোয়াল বা কাঁকড়া বা চিংড়ী। সাথে চিকেন বা মাটন। মুর্গি বলতে অবশ্য দেশীই বোঝেন বিপিনবাবু, তাঁর মতে ব্রয়লারের ভাজা পিস দিয়ে ভাল টেনিস বল বানানো যেতে পারে। ডিনার কেটেছে রেস্তোরাঁ হপিং করে। বিপিনবাবু প্যান্ডেল হপিঙয়ে বিশ্বাস করেন না। তিনি পুজো বলতে পাড়ার পুজো মণ্ডপ বোঝেন, তার বাইরে সমস্তটাই অন্ধকার। পাড়ার মণ্ডপ আর খাওয়াদাওয়া। চাইনিজ টু মুঘলাই ডিনারের মাঝে টুকিটাকি রোল ফুচকায় ডাইভারসন থাকে অবশ্য থাকেই।
“অমন ড্যাবা চোখে বসে আছো যে এখনও? এ’দিকে সাড়ে সাতটা বাজতে চললো যে! খবরদার বাজার না করে যদি বাড়ি থেকে বেরিয়েছ”। ফের বৌয়ের গলায় স্টিলের-বাসনপত্র-আছড়ে-পড়া হুমকি। ফের চমকে উঠে নিজের খোঁচা দাড়ির গাল চুলকে ফেলেন বিপিনবাবু।
অফিস! পুজো শেষ! সামান্য ভূমিকম্প অনুভূত হল কি? দু’সেকেন্ড তেমনটাই মনে হলেও বিপিনবাবু বুঝলেন তিনি নিজেই সামান্য দুলে উঠেছিলেন। ফের বড়সাহেব, ফের ইয়ে করো,উয়ো করো। পুজোর সমস্ত নবাবী খতম।
“ইয়ে, বাজার ফেরতা আজ কচুরি আনব”? ফতুয়াটা গলাতে গলাতে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন বিপিনবাবু।
“পুজোয় গজানো আড়াই হাতের ল্যাজটা এবার কাটো। পাঁচ দিন ধরে লুচি গিলে আজ আবার কচুরি? লক্ষ্মীপুজোর আগেই নিমতলায় যাওয়ার ইচ্ছে নাকি? ভালো করে দাঁড়াতে পারছেন না আবার কচুরি খাবেন। কচুরি আনলে আজ তোমারই একদিন কি আমারই একদিন। অনেক আদেখলামো আর জমিদারি সহ্য করেছি পুজোর এ কয়দিন। এবারে আমি যেমন বলব তেমনটি খাওয়া! আর জেলুসিল চাইলেও পাবে না, বলে রাখলাম”!
“ওহ। আচ্ছা বেশ। আজ জলখাবারে তাহলে...”।
“ছাতু”!
“ছা...ছা...”?
“ছাতু! নাম শোনোনি বাপের জন্মে মনে হচ্ছে”?
“ছাতু খাওয়াবে জলখাবারে, আর বাপ তুলে কথাও বলবে”?
“এক হপ্তার মধ্যে যদি তেলেভাজা কিছু খাওয়ার নাম শুনেছি, তাহলে আমি চোদ্দ-পুরুষ তুলে কথা বলব। পুলিশে কমপ্লেইন করব”।
“আচ্ছা বেশ। ছাতু”।
“নুন লেবু লঙ্কাকুচি পেঁয়াজকুচি দিয়ে গুলে দেব। অমৃতের চেয়ে কম নয়”।
“ছাতু! অমৃতসমান হতেও পারে গো, তাই বলে লুচি তো নয়”!
“গা জ্বালিও না তো! গা জ্বালিও না। চটপট বাজার করে এনে উদ্ধার করো”।
“মাছ আছে কি? না কি আনতে হবে”?
“চারাপোনা এনো। আমি পাতলা ঝোল করে দেব। সাথে ভাত আর শসা মুলো কুচোনো স্যালাড। আজ তোমার টিফিনে”।
“চা...চা...চার...”।
“আবার গোঙায় ধরলো দেখি। চারাপোনার ঝোল”!
“সঙ্গে মুলো”?
“পেট ক্লেন্স করতে হবে না! ওই ডিজেলে ভাজা চপ রোল যে’ভাবে কিলো কিলো খেয়েছ”!
“সকালে ছাতু আর দুপুরে চারাপোনার ঝোল আর ভাত। ওহ্!ক্লেন্সিং! বটে”!
“আর একটু কুমড়ো এনো বুঝলে! রাতে কুমড়োর ঝাল ছাড়া ছক্কা আর দু’টো রুটি” ।
"ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা! ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা! ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা"!
"ও মা! অমন নামতা পড়া শুরু করলে কেন"?
বিপিনবাবু বিড়বিড় করেই চললেন; “ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা!ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”!
অটোওলা খুচরো চাইলে তিনি ফস করে বলে বসলেনঃ “ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”। অটোওলা আর ঘাঁটাতে সাহস না পেয়ে নিজে সুড়সুড় করে খুচরো বার করে ব্যাপারটা সামাল দিলেন।
অফিসের বড়সাহেব জিজ্ঞেস করলেন “হাউ ডু ইউ ডু”। বিপিনবাবু অম্লানবদনে বলে ফেললেন; “ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”! বড়সাহেব চশমা কপালে তুলে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
পিসতুতো ভাই ফোন করে বিজয়ার প্রণাম জানালে, বিপিনবাবু বললেন “ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”!পিসতুতো ভাই “ক্রস কনেকশনের যুগ ফিরে এসেছে” বলে লাইন কেটে দিলেন।
অফিস ফেরতা রাতে খেতে বসে বিপিনবাবু যথারীতি গিন্নীকে বললেন “কই দাও! ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”!
গিন্নী থালায় সাজিয়ে দিলেন ফুলকো ডিমের কচুরি আর কিমা ঘুগনি। পাশে ঘরে বানানো নারকোলের সন্দেশ।
ফের সেই ঝাঁকুনি অনুভব করলেন বিপিনবাবু; ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কার তাল কেটে এ কী এলাহি ব্যাপার! আজ একাদশী যে! আজ যে ছাতু-মুলো দিবস।
“এ কী গো! আমার পেট ক্লেন্স করার কথা যে! কুমড়োর ছক্কা দিয়ে! এ’সব কী”? বিপিনবাবু বিহ্বল বোধ করছিলেন।
“সেই যে প্রথম বিয়ের পর, প্রথম বিজয়ার রাতে কী বলেছিলে খেয়াল আছে”?
“ক্..কী? কী বলেছি?”
“বলেছিলে যে শাস্ত্রে আছে মেয়েদের বরের সাথে বিজয়া কোলাকুলিতেই সারা উচিৎ। গোপনে”।
“অ। ওহ! আচ্ছা! হ্যাঁ। তাই তো”।
“সকাল থেকে চারাপোনা ছাতু শুনে সেই যে নামতা পড়া শুরু করেছ, তখনই বুঝেছি গণ্ডগোল। তোমার পেট সাফ করতে গিয়ে আমাদের বিজয়ার কোলাকুলিটাই না নষ্ট করে ফেলি”।
“হেহ্! হেহ্ হে”!
“অমন হাঁ করে ড্যাবা চোখে বসে না থেকো কচুরিগুলো গিলে আমায় উদ্ধার করো দেখি। ও হ্যাঁ! কাল তো সিদ্ধিতে ডুবে ছিলে তাই বলা হয়নি। বিজয়ার শুভেচ্ছা জানালাম। মন থেকে। আর খেয়ে ওঠো, তারপর প্রণামটা সেরে নেব’খন। আরও কচুরি দেব। গরমাগরম। ভাজছি কিন্তু”।
গিন্নীর হাতের খুন্তিটাকে যেন জগজ্জননীর ত্রিশূল বলে মনে হল বিপিনবাবুর! দেবীর তৃতীয় নয়ন সদা সজাগ থাকে, ভক্তের যন্ত্রণাকে ভুলেও অবহেলায় রাখেন না তিনি। বিপিনবাবু তক্ষুনি “ভালোবাসি গো, বিজয়ার শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ রইল’ বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চোখ ভরা ছলছল আর মুখভরা কচুরির গ্রাসে তাঁর মুখ দিয়ে কেবল বেরোল “বিববাব বুবেব্বা বো বাবীর্বাব বইবো”।
হট্টগোলের পৃথিবীতে এক জোড়া মানুষ হৃদয় উজাড় করে রান্নাঘর আলো করে পড়ে রইলেন। আফটার অল, অষ্টমী সন্ধ্যে ইজ আ স্টেট অফ মাইন্ড।