Friday, October 27, 2017

হরিহরবাবুর ডানা



১। 

- গোবিন্দদা! বড্ড বিপদে পড়ে এলাম এত রাত্রে। 
- হরিহর নাকি?
- হ্যাঁ। 
- তা কী ব্যাপার? তোমার গলা শুনতে পাচ্ছি দেখতে পাচ্ছি না কেন?
- কারণ আমি আকাশে! উড়ছি। এই দেখুন। 
- উড়ছ? সে কী ! সত্যিই ভাসছ তো দেখছি। 
- দিব্যি ছাতে গিয়ে পায়চারি করছিলাম। আচমকা কথা নেই বার্তা নেই দুই বগলের নিচ দিয়ে দু'টো ডানা বেরিয়ে এলো। চমকে গিয়ে যেই ঝটপট করেছি অমনি ভেসে উঠলাম আকাশে। সেই থেকে উড়ছি। 
- তা সমস্যাটা কোথায়?
- মানুষ হয়ে উড়ব গোবিন্দদা? 
- তা ঠিক। তবে...। 
- তবে কী গোবিন্দদা?
- বুঝে গেছি হরিহর! কোনও চিন্তা নেই। 
- কী বুঝলেন?
- এ'টা স্বপ্ন। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ উড়তে পারে না। 
- কার স্বপ্ন? 
- আমার। আমি আসলে জানালার ধারে বসে বিড়ি খাচ্ছি না। ঘুমিয়ে আছি। স্রেফ স্বপ্নে এমনটা মনে হচ্ছে। 
- বলছেন? আমি রিয়েলি উড়ছি না?
- মানুষ তো। উড়বে কী করে?

২। 
- পঞ্চা! আজ স্কুল ছুটি!
- গরম গরম রুটি রে বিশু। 
- কিন্তু ইয়ে, নোটিশ ঠিক পড়লাম তো?
- আলবাত! আর তা ছাড়া হেডস্যার নিজে আমায় বললেন তো। হরিহর কাকা আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষ কি উড়তে পারে? তা'হলে নিশ্চয়ই এ'টা স্বপ্ন। কার স্বপ্ন এ'টা নাকি এখনও বোঝা যায়নি। অনেকে দাবী করছে এ স্বপ্ন তাঁদের। কিন্তু যা হোক, স্বপ্নই যখন; তখন স্কুল খুলে রেখে কী হবে! 
- স্বপ্ন হলেও। ফুটবল খেলতে তো ক্ষতি নেই রে পঞ্চা। চ' ভাই। 

৩। 

- কী মুশকিল বলো হাবিলদার! স্বপ্নেও ডিউটিতে আসতে হলো! 
- যা বলেছেন দারোগা স্যার। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মালদহের হরিহর পুরকায়স্থ আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে ডানা ঝাপটিয়ে। খবরের কাগজে পর্যন্ত পড়লাম যে হরিহরের উড়ে চলাই প্রমাণ করছে যে আমরা সবাই স্বপ্নের মধ্যে আছি। তবুও সকালে উঠে বাজারে যেতে হল। মাগুর মাছ কিনে আনতে হল। ডিউটিতে আসতে হল। 
- সব ব্যাগার খাটুনি। কোন ব্যাটা যে স্বপ্ন দেখছে কে জানে। দেশ শুদ্ধু লোককে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। যাক গে, হাজতের দরজা খুলে দাও। কেউ তো আর আদত আসামী নয়। সব স্বপ্ন। 
- যো হুকুম। 

৪। 

- প্রধানমন্ত্রীজী!
- অমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন কেন বলুন তো স্পীকারদা?
- এ আমি কী দেখছি! আপনি লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে পার্লামেন্টে এসেছেন?
- আরে ধুর। এ'তো স্বপ্ন। দেখেননি আকাশে ওই হরিহর নামের লোকটা কেমন পতপত করে উড়ছে?
- কিন্তু তাই বলে...পার্লামেন্টে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে?
- গামছা পরে এলেও ক্ষতি হত না স্যার। সবটাই তো স্বপ্ন। 
- দু'দিনে জিডিপি ডকে উঠেছে! সে খেয়াল করেছেন? বিরোধীরা আপনার কলার টেনে ধরবে বলে বসে আছে। 
- যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। প্রধানমন্ত্রীর কলার ধরবে, ধর এবার স্যান্ডো গেঞ্জির কলার। ন্যাকামো। যাক গে, জিডিপি নিয়ে চাপ নেব কেন? এ'টা তো স্রেফ স্বপ্ন। 
- লোকে না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে!
- স্বপ্নে বিরিয়ানি খেয়েই বা হবে। হরিহরবাবু উড়ছেন। 
- সীমান্তে সেনাবাহিনী ঘুমোচ্ছে। 
- আমিই বলেছি। পরের স্বপ্নে জেগে কুচকাওয়াজ করে কী লাভ? আমি সেনাপ্রধানকে বলেছি স্বপ্ন না ভাঙা পর্যন্ত সেনাবাহিনীর ছুটি। 

৫। 

কবিতার খাতাটা নদীর বুকে ছুঁড়ে ফেললেন কবি। একটানা স্বপ্নবাসে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলেন। 
যুদ্ধ নেই। 
মতান্তর নেই। 
মন কষাকষি নেই। 
কফি হাউস বন্ধ। 

শুধু অপেক্ষা। স্বপ্ন শেষ হওয়ার অপেক্ষা। উড়ন্ত মানুষটার নেমে আসার অপেক্ষা। 

৬। 

খবরের কাগজের পাঁচের পাতার নিচের দিকে 'চাকরী গেল ঈশ্বরের' হেডলাইন দেখে বেশ ভেবড়ে গেলেন মনোজবাবু। ইভোলিউশনারি চমক দিতে গিয়ে নাকি ভদ্রলোকের চাকরী গেছে, ভাবা যায়? আর সে খবর বেরিয়েছে কলকাতার খবরের কাগজে। ভাবা যায়?  

তবে ভেবে না ওঠার কোনও কারণ নেই। স্বপ্নে কী না হয়। মানুষ ওড়ে, ঈশ্বরের চাকরী যায়। হতেই পারে। 

Wednesday, October 25, 2017

বেরাদরি

- ব্রাদার! পেরেছি!

- এত রাত্রে...এত হাঁকডাক বিগ-বেরাদার...?

- রাত কোথায় ব্রাদার? ভোর। শুরু। আলো। নতুন। এই তো সময়। পেরে ওঠার। আমি পেরেছি।

- পেরেছ? যন্তর তৈরি?

- না হলে ডাকলাম কেন? যন্তর রেডি। তুমিই প্রথম সাবজেক্ট ব্রাদার।

- ওহ। এ যন্ত্র পারবে গো বিগবেরাদার? মন খারাপ বুঝতে?

- চটপট। তুরন্ত। এই মনখারাপ হল, হুই ডাক এলো।

- মাইরি? এ যন্তর হাঁক দেবে?

- নয়ত আর বানালাম কী! ডাকেই অ্যান্টিসেপ্টিক।

- তাতেই মনখারাপ গায়েব?

- মনখারাপ ইজ আ ফর্ম অফ এনার্জি ব্রাদার। এনার্জি গায়েব হয় না। এক ফর্ম থেকে অন্য ফর্মে কনভার্ট হয়। মনখারাপ টু মনকেমন। মনকেমন টু কবিতা। চটপট। তুরন্ত। দুরন্ত।

- কবিতা? আমি বুঝি না।

- যন্তর। বুঝিয়ে দেবে।

***

'কী রে! ভাবছিস কী? বললি না তো আমার বানানো।নাড়ু কেমন খেলি'? যন্তরের চোপায় চমকে ওঠে পিলে।

তাই তো। বিগ-বেরাদার তবে মিথ্যে বলেননি। আঁচলের খসখসে ছ্যাঁতছ্যাঁতে কবিতা টের পেয়ে বিগবেরাদারের প্রতি সামান্য গলে পড়তে ইচ্ছে হল।

Sunday, October 22, 2017

মাঝরাত্রের স্কুলবাড়ি আর দাসগুপ্তবাবু



- আসুন মিস্টার দাসগুপ্তা। ওয়েলকাম। ওয়েলকাম টু দ্য ফার্স্ট ডে অফ স্কুল।

- ধন্যবাদ। কিন্তু মানে...আমি ঠিক...।

- বুঝতে পারছেন না? ন্যাচরালি, ন্যাচরালি। ক্লাসরুমে নিয়ে যাওয়ার আগে তাই দেখা করতে এলাম..। আমি এ'খানকার হেডমাস্টার। ইয়ে, শিক্ষক বলতেও আমিই..।

- কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না...এত রাত্রে আমি এই সাতপুরনো ভাঙাচোরা স্কুলবাড়িতে কী করছি? এলামই বা কী করে? 

- ভূতের স্কুল তো পোড়ো স্কুলবাড়িতেই হবে।

- কী? আমি মৃত? 

- অফ কোর্স। আপনি মৃত! আমি বা এ'খানের সমস্ত ছাত্ররা, সবাই...।

- আমি মারা গেছি?

- নিঃসন্দেহে। শুধু মড়ারা এই স্কুলবাড়িটা দেখতে পায়।

- আমি মারা গেছি! ব্যারাকপুরের অরিন্দম দাসগুপ্ত মারা গেছে! 

- আপনি মারা গেছেন! অরিন্দম দাসগুপ্ত মারা যাবেন কেন? তিনি এই মাত্র ইয়ারবাড খুঁজে না পেয়ে "ধ্যারশ্লা" বলে ফের শুতে গেলেন।

- আমিই তো অরিন্দম দাসগুপ্ত।

- মিস্টার দাসগুপ্তা। রিল্যাক্স। ইউ আর নট হিম। ইউ আর জাস্ট আ ডেড ড্রীম অফ মিস্টার দাসগুপ্তা। আপনি দাসগুপ্তবাবুর সদ্য মৃত স্বপ্ন। এ'টা মড়া স্বপ্নদের স্কুল মিস্টার দাসগুপ্ত। 

- ওহ...আমি তাহলে...।

- আচমকা ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়ে মাকে চমকে দেবেন ভেবেছিলেন। আজ সন্ধেবেলা পৌঁঁছনোর কথা ছিল। ভেবেছিলেন মাকে জড়িয়ে ধরবেন। পাড়ায় হাঁটতে বেরোবেন। দত্তবাজার থেকে ট্যাংরা কিনে এনে মাকে বলবেন ঝাল করতে। রাতে মায়ের পাশ ঘেঁষে শুয়ে কত গল্প। পুরনো পাশবালিশের কাচা ওয়াড়ের সুবাস। শোওয়ার ঘরের জানালার পাশে গন্ধরাজ গাছ। যেই গাছের আশেপাশে দত্তবাড়ির মিতুল ঘোরাঘুরি করত। সে'সব ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে আপনার ঘুমিয়ে পড়ার কথা ছিল। আপনি সেই স্বপ্নের মিস্টার দাসগুপ্ত,  আপনি মারা গেছেন। মারা গেছেন।

- তা'হলে...।

- যা হয়। মিস্টার দাসগুপ্তার মিসেস ভ্যাকেশন প্ল্যান করে ফেলেছিলেন। প্লাস ফিরে এসেই অফিসের রিভিউ।  দেশের বাড়িমুখো স্বপ্নের মিস্টার দাসগুপ্তা হ্যাড টু ডাই। দেশের বাড়ির স্বপ্নের মিস্টার দাসগুপ্তা বা আপনি না মরলে আদত দাসগুপ্ত ছিন্নভিন্ন হতেন। এই কিছুক্ষণ আগেই আদত দাসগুপ্ত দেশের বাড়ি ফেরার টিকিট ক্যান্সেল করেছেন।

- অর্থাৎ সে টিকিট ক্যান্সেল করে আদত দাসগুপ্ত আমায় খুন করেছেন। আর আমি ওর মৃত স্বপ্নের ভূত।

- প্রিসাইসলি। তবে মনখারাপ করবেন না। আপনার ক্লাসে অসংখ্য মৃত স্বপ্নের ভূত, ইন ফ্যাক্ট ব্যারাকপুরের অরিন্দম দাসগুপ্তর প্রচুর মড়া স্বপ্ন আপনার ক্লাসমেট হতে চলেছে। ওদের সঙ্গে আলাপ হলে আপনার ভালো লাগবে।

- ইয়ে, আপনার পরিচয়টা হেডমাস্টার স্যার? ক্লাসও তো আপনিই নেবেন?

- ক্লাস আমিই নেব। আমার ডাকনাম সুগা।

- সুগা?

- পুরো নাম সুমনবাবুর গান! 

- ওহ! যাক। ক্লাসরুমটা কোনদিকে সুগাবাবু?

- আসুন আমার সঙ্গে। আর হ্যাঁ, মিতুলদেবীর একটা মড়াস্বপ্ন আপনারই ক্লাসে রয়েছেন, "অরিন্দম একদিন অন্তত জোর গলায় বলবে 'তুই অন্য কাউকে বিয়ে করবি না' " গোছের একটা স্বপ্ন। মরে কাঠ হয়ে ছিল। আমি এই ক্লাসে ভর্তি করিয়ে নিয়েছি। আপনার ইন্টারেস্টিং লাগতে পারে, তাই বললাম। এ'বার চটপট আসুন দেখি, ক্লাস শুরু হতে দেরী হচ্ছে।

Saturday, October 21, 2017

সকলই তোমারই


- মন্টুদা! 
- উঁ।
- ও মন্টুদা! 
- কী! ঘ্যানঘ্যান করছিস কেন।
- এ'বারে ভাসাতে হবে তো।
- মনে সুরটা এখনও ফ্লোট করছে রে..।
- সুর?
- আমার মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
- সুর বোধ হয় না মন্টুদা, বিলু বলল গাঁজার ডোজটা একটু কড়া হয়ে গেছিল নাকি...। আর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ঠাণ্ডায়, গঙ্গার ভেজা হাওয়া তো।
- গঞ্জিকা বল। ভক্তিভাব থাক।
- ভাসাতে হবে যে এ'বার।
- রংমশালগুলো কই?
- মিঠুদা ফুলবেলপাতার ঝুড়ির সঙ্গে তুবড়ি রংমশালের পেটিটাও জলে দিয়ে দিয়েছে।
- আহাম্মক।
- ঠিক।
- তবে মিঠু কবিতা লেখে ভাই। মিঠুকে আহাম্মক বললে ধর্মে সইবে না।
- স্কাউন্ড্রেল বলো। ম্লেচ্ছ খিস্তি হিন্দু শাস্ত্রে ইন্টিগ্রেট করা নেই বোধ হয়। এ'বার চলো, তুমি না এলে ভাসান লীড করার কেউ নেই।
- মন রে এমএস এক্সেল জানো না...মন রে...।
- ক্লার্কপ্রসাদী মন্টুদা?
- হেহ্, তুই বুঝিস। আরে ভাসাতে যাব! ভাসালে তো ভেসেই গেল। মা দু'চার মিনিট প্ল্যাটফর্মে ওয়েট করছেন,  করুন। সী অফ করতে এসে অত লাফালাফি করলে হয় না। আমরা পান্নালালের জাত, মিউজিক ইজ আওয়ার ধর্ম। চাই না মা গো রাজা হতে, রাজা হওয়ার সাধ নাই মা গো, দু'বেলা যেন পাই মা খেতে।
- আহা, তোমার গলায় মায়া আছে মন্টুদা। চোখে জল আসে।
- একটান দিবি নাকি?
- আমার আবার সয় না।
- শিবের চ্যালাগিরি না করে মায়ের পেয়ারের ছেলে হওয়া যায় না। সয় না আবার কী?নে টান।
- কড়া! 


- কেমন?
- মন্দ না। মন্টুদা, ভাসাবে না?
- কালো মেয়ের পায়ের তলায়, দেখে যা আলোর নাচন!
- আহা! আর দু'টান দাও দেখি।
- মায়ের রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব যার হাতে মরণ বাঁচন।
- দেখে যা আলোর নাচন। আহা, মন্টুদা, আমায় দীক্ষা দাও।
- আমি দীক্ষা দেব রে? আমি কে? সকলই তোমারই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি...।
- মায়ের মেসেজ ট্রান্সমিট করে দিও। তাহলেই হবে।
- কয়েকটানেই বেশ ফ্লোট করছিস।
- প্লাস গায়ে কাঁটা। 
- গুড বয়। নে, কল্কেটা দে।
- আর দু'টান।
- মায়ের একটা মেসেজ এসছে, তোর জন্য।
- কমিউনিকেট গুরুদেব।
- কালীপুজোর ভাসানে গাঁজা টানার বান্দা তো তুমি নও চাঁদু! 
- ইচ্ছে। ইচ্ছে।
- ইচ্ছে? তা ইচ্ছে কি গতকাল লাল পেড়ে গরদের শাড়ি পরে মণ্ডপে এসেছিল? 
- গরদ দেখলে? জ্বলজ্বলে বিলিতি বর দেখলে না? গরদের ডান পাশ আলো করা?
- পান্নালালে ইন্ডাক্ট না হতে পেরেই তোদের জেনারেশন ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল। ফলপ্রসাদ সাজানোর সময় তোর দিকে এক জোড়া ছলছলে চোখ ঠায় তাকিয়ে রইল সে'টা ক্যাপচার করতে পারলি না। ক্রিমিনাল। 
- আসলে...। ইয়ে, আর দু'টান যদি...!
- কত রাত হল দেখেছিস! এখন না ভাসালেই নয়। চল, ক্যুইক! এ'বার কালী তোমায় ভাসাবো, বলো, এ'বার কালী তোমায় ভাসাবো! 

Thursday, October 19, 2017

সতীনাথ ও ঘুগনির বাটি

স্টিলের প্লেটে এক বাটি ঘুগনি আর দু'টুকরো পাউরুটি। ঘুগনিটা সামান্য আলুনি, তবে ধোঁয়া ওঠা গরম; তাই দিব্যি। পাউরুটি চুবিয়ে প্রথম কামড় দিতেই মনঃপ্রাণ জুড়ে সে কী আরাম। বুদ্ধি করে দোকানির থেকে সামান্য পেঁয়াজ-লঙ্কা কুচি চেয়ে নিয়েছিলেন সতীনাথ। আর প্লেটের কোনে ছোট্ট এক ঢিপি ফাউ বিট নুন। দোকানি বলতে বছর সাতেকের একটা ছেলে, যে একটানা বাসন মেজে যাচ্ছিল। খালি গায়ে কালো হাফ প্যান্ট পরে দিব্যি সামাল দিয়ে যাচ্ছে। বাপ নাকি বিড়ি খেতে গেছে। চটপটে আর শশব্যস্ত বাচ্চা ছেলেটা হাল ধরে রেখেছে।  

স্বাদে গলে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। আহ, কদ্দিন পর সামান্য ঘুগনি আর পাউরুটি। এর সঙ্গে একটা ডিম সেদ্ধ পেলেই সতীনাথের চোখে জল আসত। কত দিন পর। 

নীল রঙ করা কাঠের বেঞ্চিতে যে আরও একজন বসে রয়েছে সে'টা খেয়াল হল মিনিট খানেক পর। ততক্ষণে আরও দু'টো পাউরুটি চেয়ে নিয়েছে সতীনাথ। পরনে সাদা ফতুয়া আর সবুজ-নীল লুঙ্গি। গালে খোঁচা দাড়ি, ঝিমনো ঢুলঢুলে চোখ।

সুট করে প্লেট নামিয়ে রেখে সরে পড়তে চেয়েছিলেন সতীনাথ। লাভ হল না। হাত টেনে ধরলেন সাদা ফতুয়া। 

- আধ বাটি ঘুগনি পড়ে রইল যে, খেয়ে যাও!
- না মানে...আমি আসি। 
- যেতে চাইলেই কী যাওয়া যায় সতীনাথ?
- আপনি...কে...কে বলুন তো?
- ঘুগনি ঠাণ্ডা হচ্ছে যে ভাই। 
- আমি আসি...। 
- কোথায় যাবে?
- তা'তে আপনার কী? আপনি কে?
- আহ্‌, হুড়মুড় কেন। আর এক বাটি ঘুগনি বলি? তোমার জন্য?
- আমায় যেতে দিন ওস্তাদ। 
- এই যে বললে চিনতে পারনি? 
- আসলে...আসলে...আমায় যেতেই হবে।
- যাবে তো বটেই। তোমাকে নিতেই তো এসেছি আমি। 
- না মানে...ফেরত যাওয়ার কথা বলছি না। আমায় একটু টালিগঞ্জে যেতে হবে। 
- সতীনাথ। তুমি জান সে'টা হওয়ার নয়। বছরে একটি বার একদিনের জন্য ছাড়। সে ছাড় আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়েছে। এ'বার ফেরত যাওয়া। 
- ওস্তাদ। ওস্তাদ। এমন করে বোলো না। গতকাল...গতকাল...। 
- তোমার খোকার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তুমি আইসক্রীমওলা সেজে ওকে আইসক্রীম বিক্রি করেছ। বছরের এই দিনটা ভূতেরা সাপের পাঁচ পা দেখে। আর দেখবে নাই বা কেন। এক দিনের জন্য এই দুনিয়ায় এসে মানবদেহ ধারণ করা যায়। ভূতদেরও শখ আহ্লাদ থাকবেই। সে জন্য আমি তোমায় দোষ দিই নি। তুমি যখন মারা গেলে তখন খোকার বয়স কতই বা...। 
- দু'বছর দেড় মাস। 
- রাইট। পাঁচ বছর পর শখ হওয়াটা ভুল নয়। কিন্তু পরলোকের নিয়ম অমান্য করবে হে? এমন বেহেড বেআক্কেলে কাজ করবে? ভূতচতুর্দশী খতম হওয়ার পরেও তুমি আমাদের স্পেসে ফিরে গেলে না? ধর্মে সইবে? তুমি জানো না এর ফলাফল কী? এখনও গ্রেস পিরিয়ড আছে। চুপচাপ ফিরে চলো। নয়ত কেলেঙ্কারি ঘটবে আর তখন আমার কিছু করার থাকবে না। 
- ওস্তাদ! প্লীজ। আর একটা দিন। আর এক দিনের জন্য খোকাকে দেখব। 
- দেখে?
- আজ্ঞে?
- দেখে কী হবে সতীনাথ? তোমাদের দুনিয়া আলাদা! আর তুমি তো জানো। ভূতচতুর্দশীর গ্রেস পিরিয়ড পেরিয়ে গেলেও এ'দিকে পড়ে থাকার পরিণতি ভয়ানক। অতৃপ্ত আত্মা হয়ে এ দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ানো। অসম্ভব যন্ত্রণা। ছটফট। ফিরে চলো সতীনাথ। খোকা ভালো আছে। এমনিতেও মা ন্যাওটা ছিল চিরকাল। আর তাছাড়া এখন ও যাকে বাবা বলে চিনেছে সে তোমার মত বেহেড বেআক্কেলে ইডিয়টের চেয়ে অনেক বেশি ব্যালান্সড। খোকা ভালো আছে সতীনাথ। নিজের জেদের বসে ওকে নষ্ট করো না। যদি অতৃপ্ত আত্মা হয়ে থেকে যাও তাহলে দুঃস্বপ্ন হয়ে বার বার ওর  আশেপাশে ঘুরতে শুরু করবে তুমি, সে'টাই তুমি চাও? 
- ওস্তাদ। খোকা। আমার খোকা। এতোটুকুন খোকাকে বুকে জড়িয়ে দুলে দুলে ঘুরতাম। 'আমি যে জলসাঘর'য়ের টিউনটা বেশ ঘুমপাড়ানির কাজ করত। 
- সতীনাথ। ঘুগনি শেষ করো। এ শরীর এ'বার ঝেড়ে ফেলতেই হবে।  নয়ত মুশকিল...।
- কিন্তু খোকা? ওস্তাদ?
- ও ভালো আছে। ওকে ভালো থাকতে দাও। চলো এ'বার। আর আমার তো আর কাজের শেষ নেই। শুধু তোমাকে নিয়ে গেলেই হবে না। আর এক ব্যাটাচ্ছেলেও সময়মত পরলোকে ফেরেনি, তাকেও না নিয়ে গেলে নয়। 
- কে?

সতীনাথ অবাক হয়ে দেখলে ওস্তাদ বেঞ্চি ছেড়ে উঠে গিয়ে বাসনের স্তূপের মধ্যে থেকে দোকানি খোকার হাত টেনে ধরলেন। 
"এই যে বাবলুবাবু, ইনি ফি বছর বাপকে দেখতে ফেরত আসেন আর সময় শেষ হওয়ার পরেও ফেরার নামটি নেন না। প্রতি বছর এই সময় ওর বাপ অবাক হয়ে ভাবে থরে থরে বাসন কোন জাদুমন্ত্রবলে আপনা থেকে মাজা ধোয়া করে গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। যাকগে, এ'বার দু'জনেই ওয়াপস চলো দেখি। আমার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে"। 

"বাবা বিড়ি কিনে ফিরুক গো ওস্তাদ , আর একবার অন্তত দেখি। ওস্তাদ গো। আর একটু সময় ওস্তাদ"। বাবলুর কান্নাকাটি ওস্তাদকে স্পর্শ করল না, ওর ডান হাত ওস্তাদের নির্মম মুঠোয় বন্দী। 

বাবলুর বাঁ হাতটা নরম করে ধরলেন ঘুগনি তৃপ্ত সতীনাথ। 

Friday, October 13, 2017

সৈনিক আর হারমোনিকা


- বিল্টুবাবু!
- কে?
- ভয় পেয়েছ?
- তুমি কে?
- আমি? আমি সৈনিক।
- তুমি আমার শোওয়ার ঘরে এলে কী করে? তুমি কি ভূত?
- ঠিক ধরেছ। আমি ভূত। মৃত সৈনিকের ভূত।
- তুমি আমার ঘরে কেন এসেছ? আমি চিৎকার করলেই মা ছুটে আসবে কিন্তু।  তারপর তোমার যে কী দুরবস্থা হবে...।
- তুমি চিৎকার কেন করবে বিল্টুবাবু? তুমি কি ভয় পেয়েছ?
- ক্লাস ফোর পর্যন্ত খুব ভয় পেতাম, জানো। গতকাল ক্লাস ফাইভে যেই উঠেছি, অমনি ভয়টয় গেছে কমে।
- তাই? কী রকম ব্যাপারটা?
- ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ও ধুন্ধুমার যুদ্ধ চলছিল তো। রোজ রাত্রে পাড়া অন্ধকার।  চুপটি করে বসে থাকা, এই বুঝি বোমা পড়ল। হারুদাদাদের কী হয়েছিল জানো তো?
- কী হয়েছিল?
- শত্রুদের একটা বোমা, পড়বি তো পড় এক্কেবারে হারুদাদাদের বাড়ি ছাদে। হারুদাদা, হারুদাদার মা, বাবা, হারুদাদার গরু লালি, আর আরও অনেকে; ছাই হয়ে গেছিল।
- ওহ হো।
- গোটা ক্লাস ফোর তো আমায় স্কুলেই যেতে হয়নি। যুদ্ধের জন্য।
- ওহ।


- জল...। একটু জল।
- চোপ্।
- আররে, মরেই তো যাচ্ছি। একটু জল দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে হে ক্যাপ্টেন?
- চারটে বুলেট খরচ করতে হয়েছে তোমার ওপর, তারপরেও এতক্ষণ তড়পে চলবে ভাবিনি।
- এই এক ঢোক জলের দাম পাঁচ নম্বর বুলেটের চেয়ে অনেক কম ক্যাপ্টেন।
- শত্রুকে জল দেব?
- পরাজিত শত্রু। মরতে বসেছে। জল দিলে বেঁচে উঠব না। দাও না ভাই ক্যাপ্টেন, এক ঢোক জল। তোমার পিঠের জলের বোতলটা দেখে থেকে কেমন মনটা আনচান করছে। তোমায় আশীর্বাদ করে যাব। বয়সে তুমি আমার চেয়ে বোধ হয় ছোট।
- এই নাও, জল। আর শোন, আমায় খবরদার ভাই বলে ডাকবে না। তোমার আশীর্বাদের মাথায় আমি লাথি মারি। এই নাও জল, হাঁ করো দেখি।
- আহ্, বাঁচালে ক্যাপ্টেন। মড়ার মুখে জল দেওয়া বড় পুণ্যির কাজ গো।
- আশা করি তোমায় বাঁচাইনি,  কিছুক্ষণের মধ্যেই ভবলীলা সাঙ্গ হবে। আর আমার পুণ্যির লোভও নেই। যুদ্ধটা জিতলেই যথেষ্ট।
- আমাদের প্রতিরোধ তো...। শেষের দিকেই..।
- হ্যাঁ, আর দিন দুয়েক। তারপর তোমাদের রাজধানী আমাদের দখলে।

- আচ্ছা বিল্টুবাবু, যুদ্ধ খুব খারাপ, তাই না?
- আমার বাবা যুদ্ধে গেছে, যুদ্ধ খারাপ কেন হবে? যুদ্ধ খারাপ হলে কি বাবা যুদ্ধে যেত?
- তাও বটে। তা যুদ্ধ তো শেষ। তোমার বাবা...।
- বাবা ফিরছে তো। সৈন্যদলের সঙ্গে। কুচকাওয়াজ করতে করতে। বিজয় নিশান উড়িয়ে। আর কয়েক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে...।
- ওহ্, আচ্ছা।
- আমিও বাবার মত একদিন যুদ্ধে যাব। পরনে ইউনিফর্ম, হাতে বন্দুক। বাবার মত ফিরব কুচকাওয়াজ করতে করতে।
- তুমি বেশ সাহসী ছেলে তো বিল্টুবাবু।
- ক্লাস ফোরে আমি খুব ভীতু ছিলাম। এখন বেশ সাহস হয়ে গেছে। কিন্তু সৈনিক, তুমি এখনও বললে না কেন এসেছ! তুমি আমার বাবাকে চিনতে?
- চিনতাম বৈকি। আমাদের কত গল্প আড্ডা হয়েছিল। তোমার বাবা বেশ বীর যোদ্ধা। আর বড় ভালো মানুষ।
- তুমি জানো আমার বাবা খুব ভালো হারমোনিকা বাজাতে পারে?

- ক্যাপ্টেন!
- কই মাছের জান তোমার মাইরি। এখনও বেঁচে আছ। আর জল চাইলে পাবে না, এ'টুকু বলে দিলাম।
- তোমার পকেটে... তোমার পকেটে..।
- এ'টা? হারমোনিকা!
- শোনাবে? একটু? শোনাবে?
- নাহ্, পাঁচ নম্বর বুলেট তোমার মাথায় না গুঁজে দেওয়া পর্যন্ত তুমি বোধ হয় এমনি ভাবেই ঘ্যানঘ্যান করে যাবে।
- সমস্ত কেমন কালচে নীল হয়ে আসছে ক্যাপ্টেন।
- ওহ্, তার মানে আর দেরী নেই।
- জানো ক্যাপ্টেন, রিলোড করতে সামান্য তিন সেকেন্ড দেরী করে ফেলেছিলাম...নয়তো...।
- নয়তো তোমার বদলে এ'খানে আমার লাশ পড়ে থাকত।  জানি। স্কার্মিশে এমনটাই হয়। দু'তিন সেকেন্ডের দেরীতে হিসেব এ'দিক ও'দিক।
- আচ্ছা, ক্যাপ্টেন...। দোষ কার? তোমার দেশের? না আমার দেশের?
- দেশের আবার দোষ কী? নেতাদের ইচ্ছেয় যুদ্ধ। আমরা সৈনিক, হুকুম তামিল করব। ব্যাস।
- কালচে নীল ক্যাপ্টেন। কানে ঝুনঝুনি বাজছে। আমার খোকার রিনরিনে হাসি...।
- বয়স কত তোমার খোকার?
- বারো। ওর গালে টিপলে এখনও হাসির মধুর ঝরে ক্যাপ্টেন। খোকাও হারমোনিকা বাজায়।
- বটে?
- মন কেমনের বাঁশি গো ক্যাপ্টেন। আমার আর শোনা হল না।
- সরি।
- আরে ধুস। তুমি আমায় না মারলে..আমিই তোমায়...। হুকুম। তামিল। জানোই তো। তোমার বাড়িতে..।
- প্রায় ওই বয়সেরই আমার ছেলে। নাম বিল্টু।
- আমার ছেলের নাম ইবু। হারমোনিকা অন্ত প্রাণ,বাজাবে একটু? হারমোনিকা? ক্যাপ্টেন? ইবুর কথা বড় মনে পড়ছে। চারদিকে কালচে নীল...সমস্ত আলো নিভে যাচ্ছে।

- বিল্টুবাবু, তোমার বাবা অপূর্ব সুরে হারমোনিকা বাজায়। সে সুর শুনলে মনে হয় পাহাড় গলে পড়ছে। মনে হয় শিউলি টুপটাপ ঝরে পড়ছে ঘাসের নরমে। তোমার বাবার হারমোনিকায় মায়া আছে বিল্টুবাবু।
- তুমি বড় ভালোমানুষ সৈনিক। তুমি বাবার দলে ছিলে?
- আমি এখন তোমার বাবার দলে।
- তোমার নাম কি?
- ইবুর বাবা।
- ওহ।
- বিল্টুবাবু। আমি কেন এসেছি জানো?
- কেন?
- আমায় ক্ষমা করবে বিল্টুবাবু?
- মানে?
- আমায় হারমোনিকা শোনাতে গিয়ে...তোমার বাবা...।
- আমার বাবার কী হয়েছে সৈনিক?
- আমি খুব গোঁ ধরেছিলাম, আমায় একটু হারমোনিকা শোনানোর জন্য। আহা, কী অপূর্ব সুর তোমার বাবার হারমোনিকায়। কিন্তু হারমোনিকার শব্দে শত্রুপক্ষ তোমার বাবার পোজিশন জেনে যায় আর...।
- সৈনিক।
- সরি বিল্টুবাবু। আমায় ক্ষমা করবে?
- ক্লাস ফোরে থাকলে করতাম না। কিন্তু আমি এখন ক্লাস ফাইভ।
- কাঁদছ বিল্টুবাবু?
- ইবু কোন ক্লাসে পড়ে?
- ক্লাস ফাইভ। সেও হারমোনিকা বাজায় বেশ।
- তুমি ইবুর সঙ্গে দেখা করতে যাওনি?
- ইবুর কাছে ক্ষমা চাওয়ার নেই। কিছু ফেরত দেওয়ার নেই। বিল্টুবাবু, তোমার যদি কোনওদিন ইবুর সঙ্গে দেখা হয়, ওকে বলবে যে ওর বাবা মারা যাওয়ার আগের মুহূর্তে হারমোনিকা শুনতে শুনতে শুধু ইবুর কথা ভেবেছে?
- খুব কষ্ট হচ্ছে সৈনিক।
- তুমি না ক্লাস ফাইভে পড়ো?
- তবুও। বাবা। বাবার হারমোনিকা।
- সে'টাই তোমায় ফেরত দেওয়ার ছিল।

পরের দিন খুব ভোরের দিকে খবরটা পেয়ে মা এসে জড়িয়ে ধরেছিলেন বিল্টুকে। বিল্টুর বালিশের তলায় রাখা হারমোনিকায় তখনও বাবার গায়ের সুবাস।

Thursday, October 12, 2017

ফিরে আসার গল্প

রাতের অন্ধকারে সদর দরজাটার দিকে তাকালে বড় মায়া হয়। কোনও এককালে সবুর রঙ ছিল বোধ হয়, এখন ফ্যাকাসে, অল্পেতেই মচমচ করে ওঠে। কব্জায় বারবার নারকোল তেল দিয়েও ক্যাঁচক্যাঁচ দূর করা যায়নি। অথচ বড় মায়া।

একটা কলিং বেল আছে বটে, কিন্তু সে’টা ব্যবহার করতে মন চায় না। সেলসম্যানের কাজে রোজ যে কত বাড়ির কলিং বেলে হানা দিতে হয়। কত রকমের টুংটাং, কত রকমের দরজা, কত রকমের মানুষ। ছোট্ট এক কামরার রেলের কোয়ার্টার থেকে ঝাঁ চকচকে ডুপ্লে; সবার বাড়িতেই আরশোলা আছে। আমার বিশ্বাস রাজভবনেও আরশোলা আছে।  মিসেস রাজ্যপালের সঙ্গে মিনিট দশে কথা বলতে পারলেই আয়ুর্বেদিক গুণ সম্পন্ন সুগন্ধি আরশোলাশ-প্লাস লিকুইডের তিনটে বড় শিশি আমি গছিয়ে দিতে পারতাম। গোটা ব্যাপারটাই আত্মবিশ্বাসের খেল। “বিলীভ ইন ইওর প্রডাক্ট”, আমাদের সেলস ম্যানেজার মাঝে মধ্যেই বলে। আমি রীতিমত বিশ্বাস করি। এবং সেই বিশ্বাসের প্রমাণ আমার বিক্রির পরিমাণ। শ্রীগোকুল গ্রীন ইন্সেক্টিসাইড কোম্পানির পয়লা নম্বর সেলসম্যান!

তবে রাতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার সময় কড়া নাড়তে ইচ্ছে করে। খটর খট খটর। এ’টুকুতেই দীপা সাড়া দেয়। দীপার পায়ের মৃদু ধুপধুপ শুনতে বড় ভালো লাগে, সাত সেকেন্ডের মাথায় দরজা খোলে দীপা। রোজ একই ঘ্যানঘ্যান;
“আজ এত দেরী হল কেন”?

দীপার ঘ্যানঘ্যান শুনতে বড় ভালো লাগে। অল্প সুর মিশে থাকে। রাতের ঝুমঝুমি। সোফার গায়ে বেড়ালের আঁচড়ের মত ওঁর শাড়ির আঁচলের খসখস; ক্লান্তি ঝরে যায় কয়েক মুহূর্তেই।
চটি আর ঘামে ভেজা জামা খুলতেই হাতে একটা পাট করা শুকনো গামছা, পাজামা আর ফতুয়া দিয়ে যায় সে। বাথরুমে দু’টো বালতিতে জল তোলা থাকে; একটা লোহার বালতি আর একটা নীল প্লাস্টিকের। সাদায় সবুজ ছোপ ছোপ প্লাস্টিক মগ। স্যাতলা পড়া বাথরুম, অ্যাসবেস্টসের ছাত, টিনের দরজা; কিন্তু ফাইভ স্টার সুবাস। বাথরুমের ভেন্টিলেটরের গা বেয়েই কামিনী গাছ;  সে সুবাস আর ঘাড়ের কাছে ঠাণ্ডা জলের ছিটে পড়লে গা শিরশির করে ওঠে, বুকের ভিতর ছ্যাঁতছ্যাঁত। বাথরুমে পাশেই এক চিলতে উঠোন, তার ও’পাশে সুর বারান্দা। সে’খানে একটা ছোট্ট স্টোভ জ্বেলে বসে দীপা, ঘুপচি রান্নাঘরে তার গুমোট লাগে। স্টোভের সঁসঁ ছাপিয়ে দীপার গুনগুন বারান্দা উঠোন পেরিয়ে, টিনের দরজা ছাপিয়ে কানে এসে পড়ে। সে সুর এসে মনে আলপনা দেয়;  “...কারে দাও মা ব্রহ্মপদ কারে কর অধোগামী, সকলি তোমার ইচ্ছা..........”।
মার্গো আর কামিনী মিলে তখন মনের ভিতর দাবা বোর্ড সাজিয়ে বসে; সুর মেলানোর চেষ্টা করি:
“আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী।
আমি রথ তুমি রথী, যেমনি চালাও তেমনি চলি”। 
গা মুছে পাজামা গেঞ্জি গলিয়ে সোজা দীপার ড্রেসিংটেবিলের সামনে। এক খাবলা পন্ডস নিয়ে ঘাড়ে বুকে পিঠে। আর তারপর সোজা এসে দীপার স্টোভের পাশে টুল টেনে বসা।
দীপা কাপে চা ঢালার সময়ই চারিদিক পাহাড়ি হয়ে যায়, নিয়ম করে। অল্প শীত। অথচ দীপার কপালে দু’চারটে ঘামের দানা, মাঝেমধ্যেই ব্যস্ত হাতে কপালের চুল সরিয়ে চলে সে। দীপা সদর দরজাটার মত; বড় মায়া। চায়ের কাপ হাতে দীপা মোড়া টেনে নেয়, 
তার আজেবাজে কথায় প্রশ্নে রাত এগিয়ে চলে।

“তোমার গা থেকে মরা আরশোলার গন্ধ পাই মাঝেমধ্যে”।
“আমায় এ’বার জয়দেবের মেলায় নিয়ে যাবে”?
“তুমি পদাবলী অ্যাপ্রিশিয়েট করো না? তুমি কি মানুষ”?
"খোলাখাম বলে একটা জায়গার খোঁজ পেয়েছি, সময় করে দু'জনে ঘুরে আসব, কেমন" ?
"সেই যে'খানে কাটলেটের সঙ্গে ঘরে বানানো ঝাঁঝালো কাসুন্দি আর অল্প আপেল কুচি দেয়, সেই দোকানটায় আমায় নিয়ে যাও না কেন "? 
"নজরুল। নজরুল। নজরুল। সমঝে জনাব? শুধুই নজরুল"।  

রাত ঘন হয়। টুল থেমে নেমে বসতে হয় দীপার পায়ের কাছে। দীপার পায়ে রক্ত, ও বলে আলতা অথচ আমার কান্না পায়। দীপা ঘন হয়ে আসে। 

আকাশ ফ্যাকাসে হতে শুরু করলে মায়ের গন্ধে আকাশ আর বারান্দা ঢেকে যায়। দীপা চুলে বিলি কেটে জানান দেয়;
"আজ ফের যাওয়ার সময় হল, তৈরি হয়ে নাও। কেমন? আর আজ তাড়াতাড়ি করে ফিরবে গো? একটি বারের জন্য? গোটাদিনের জন্য এ ঘর আগলে বসে থাকি। একা। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরো, কেমন"?
আমার বলা হয়ে ওঠে না যে সদর দরজার ও'দিকে গেলেই আমিও একা। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো বোকা। 

আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে দীপা ক্রমশ আবছা হতে শুরু করে। আমি বুঝতে পারি অ্যালার্ম বাজার সময় এগিয়ে আসছে। উঠতে হবে। হুড়মুড়িয়ে উঠেই খবরের কাগজ, স্নান, জলখাবার, অফিসের তাড়া। 

অ্যালার্মে সব কেঁপে ওঠে। দীপার চোখ ছলছল। স্নুজ্‌ টিকিয়ে রাখে মিনিট দশেক। 
"আজ তাড়াতাড়ি ফিরো, কেমন"?

দীপা মিলিয়ে যায়। সদর দরজাটাও।   শ্রীগোকুল গ্রীন ইন্সেক্টিসাইড কোম্পানির চাকরীটাও গায়েব। শাওয়ারে রাতটুকু ঝেড়ে ফেলে মড়া টোস্ট চিবুতে চিবুতে ফের রাতের অপেক্ষা শুরু। 

Monday, October 9, 2017

কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি!

- দাদা গো! কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি!

- বটে?

- ঝমঝম শুনতে পাচ্ছ না?

- ঝমঝম কি? ঝিরঝির মনে হচ্ছে।

- তোমার কান গ্যাছে। এদিকে আবার শঁশঁশঁশঁ করে ঝড়!

- সামান্য ফুরফুর কানে এসেছে বটে।

- প্রলয় এলো বুঝি, এমন দিন তিনেক চললে কলকাতা বে অফ বেঙ্গলে মার্জ হয়ে যেতে পারে।

- না না। বড় জোর বেহালায় অটো উল্টোবে, আমহার্স্ট স্ট্রিটে হাঁটুজল। মেজকাকার সামান্য সর্দিজ্বর। ঠাম্মার সাধের গামছাজোড়া শুকোবে না।

- এই আন্ডারপ্লে করাটা তোমার একটা বদভ্যাস দাদা। সে'বার মোদীর ল্যান্ডস্লাইড ভিক্ট্রিকে বললে স্টেজম্যানেজ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। মোহনবাগানের চার গোল খাওয়ার পর বললে ক্লোজলি ফট্ কনটেস্ট। পিসিমার কিডনি স্টোনের দুর্দান্ত ব্যথাকে মাইল্ড ডিসকমফর্ট বলে পিসেমশাইকে রিপোর্ট করলে।

- বাঙালির এই অকারণ লাফিয়ে ওঠার স্বভাবটা বড় বিশ্রী রে ছোট।

- ধুস, তোমার সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি। তার চেয়ে বরং রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের কড়াইয়ে খুন্তি নাড়া দেখি। বাবা আজ ঢাউস ইলিশ এনেছে; দেড় কিলোর।

- খোকা ইলিশ নয়, সে'টা ঠিক। তাই বলে ঢাউস? ধুস। এক কিলো সাড়ে তিনশো। অনলি।

- বাজে না বকে পড়তে বসো। গতবার ফিজিক্সে অক্কা পেয়েছিলে সে'টা মনে আছে তো? জ্যাঠা বলেছে এ'বারেও ফেল করলে তোমার কান ছিঁড়ে নেবে।

- অক্কা কি বলা চলে রে? আর পঁয়ত্রিশটা নম্বর পেলেই ফার্স্ট ক্লাস হয়ে যেত। আর জ্যাঠা অতটা কানিং নয় যে গাধা পিটিয়ে ভ্যান গঘ বানাবে।

- আমি চললাম রান্নাঘরে।

- অ্যাই ছোট শোন! অল্প এক কুচি ভাজা ইলিশ আনিস তো বাটিতে করে। টেস্ট করব। মুখ জিভ ফ্রেশ থাকলে টোটাল ইন্টারনাল রিফ্লেকশনটা ভালো ভাবে ইন্টারনালাইজ করা যাবে।

- এক কুচি ইলিশ ভাজা, তাই তো?

- এক কুচি মাত্র। মাইনর। ইনসিগনিফিকেন্ট। এই ধর, তোদের মত বাঙালিদের হিসেবে দু'টো পেটির পিস। চট করে রান্নাঘর থেকে নিয়ে আয় দেখি।

Sunday, October 8, 2017

ক্যাপ্টেন ক্ক্ব্র আর ঈশ্বর

- কী বুঝছ ভধ্রকিধস? 
- ক্যাপ্টেন ক্ক্ব্র, আমাদের এই মিশন ঐতিহাসিক সাফল্য লাভ করতে চলেছে।
- এই গ্রহ মড়া নয়?
- মরাদের গ্রহ, তব এ গ্রহ চিরকালীন মড়া নয়। আজ থেকে মাত্র দেড় লাখ বছর আগেও এখানে বাসযোগ্য পরিবেশ ছিল। প্রচুর অক্সিজেন, অফুরন্ত জল। আর প্রাণ।
- তুমি নিশ্চিত ভাই ভধ্রকিধস? এ'খানে প্রাণ ছিল? আমাদের টীম তো কোনও প্রমাণই যোগাড় করতে পারেনি। এ'দিকে স্পেসশিপ ফেরত নিয়ে যাওয়ার দিন সামনেই।
- ক্যাপ্টেন ক্ক্ব্র, প্রমাণ যোগাড় করতে পেরেছি বলেই তো আপনার কাছে আসা। এ গ্রহে শুধু বহু রকমের প্রাণিই ছিল না, রীতিমত উন্নত প্রজাতিও বাস করত।
- দেশে ফিরে এমন বাজে বাতেলা দিলে হবে না। যদি এতই উন্নত প্রাণীদের বাস ছিল তবে সে সব চিহ্ন কই? তাঁদের ফসিল? তাঁদের সৃষ্টি?
- আমি এই বিস্তীর্ণ প্রান্তর চষে ফেলেছি ক্যাপ্টেন ক্ক্ব্র, আর এ'খানে সে'সব চিহ্ন কিছু নেই বটে। তবে প্রতিটা বালুকণায় রয়েছে পারমাণবিক বিস্ফোরনের চিহ্ন, সে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ যে এ গ্রহের সমস্ত কিছু সাফ হয়ে গেছে। পাহাড়  নিশ্চিহ্ন,  সমুদ্র গায়েব, বাতাস হাওয়া। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ গ্রহের আয়তনও অনেক বড় ছিল। কিন্তু সে বিস্ফোরণ এতই খতরনাক ছিল যে গ্রহ থেকে কয়েক খাবলা উড়ে যায়। 
- পারমাণবিক বিস্ফোরণ? অত্যাধুনিক পারমাণবিক অস্ত্র?
- হ্যাঁ। 
- তার মানে ততটাও উন্নত বুদ্ধির প্রাণি নয়।
- সে'খানেই খটকা ক্যাপ্টেন ক্ক্ব্র, পারমাণবিক অস্ত্রে নিজেদের গ্রহ নিকেশ করে দেওয়া প্রাণীদের মগজ অত সুবিশাল আর ক্ষুরধার কী ভাবে হয়? দেহগঠনেই বা তাঁরা অত উন্নত কী ভাবে হয়েছিল? 
- যে'খানে পাহাড় সমুদ্রের নিশ্চিহ্ন, সে'খানে তুমি সে প্রাণীদের মগজ আর দেহগঠনের ব্যাপারে কী ভাবে জানলে হে ভধ্রকিধস?
- সে'টাই তো চমক! যে'খানে সমস্ত কিছুই ধুলো হয় গেছে, সে'খানে কোনও এক জাদু মন্ত্রবলে  একটা অতিকায় মূর্তি রয়ে গেছে। 
- বলো কী!
- স্পেসশিপ থেকে দেড় হাজার মাইল পশ্চিমে বালি খুঁড়ে এ'টা উদ্ধার করেছি ক্যাপ্টেন। স্পেসশিপের জানালা দিয়ে দেখুন, আপনার খিদমতে হাজির করেছি সেই মূর্তি।
- কই দেখি!
- এই যে। এ'দিকে!
- দুর্ধর্ষ,  দুরন্ত, দুর্দান্ত।
- কেমন দেখলেন? ক্যাপ্টেন ক্ক্ব্র?
- ঈশ্বর! আমার যে ঈশ্বর দর্শন হল হে ভধ্রকিধস!
- অতি উন্নত প্রাণী!
- আমাদেরই মত পা; পেশিবহুল,  মজবুত, ক্ষিপ্র। অথচ বুকের বাহুল্য নেই। হৃদয়ের টনটন নেই, অম্বলে বুকজ্বালা নেই। মগজ আর উদর মিলে...।
- যে সে উদর নয় ভধ্রকিধস! স্ফীতোদর। তা'তে মগজগুণ মেশাতে পারলেই ইভোলিউশনের চরম স্তর; ঈশ্বর। পাহাড়, সমুদ্র লোপাট হয়ে গেলেও, ঈশ্বর তাঁর নিজের চিহ্নটুকু বিলিন হতে দেননি। 
- ক্যাপ্টেন ক্ক্ব্র, আদেশ দিন।
- এসেছিলাম ভিনগ্রহে প্রাণের খোঁজে, ফিরে যাচ্ছি ঈশ্বরের চিহ্নটুকু নিয়ে। ও মূর্তিকে এখুনি স্পেসশিপে নিয়ে এসে ধূপদীপ দাও। 



Monday, October 2, 2017

নেশাভাং

- হ্যালো!
- হুঁ।
- বাবু, শুভ বিজয়া।
- হুঁ?
- শুভ। বিজয়া।
- শু..শুভ।
- এ'বারেও মন্টুদারা সিদ্ধিতে তামা ঘষে দিয়েছে?
- আমি ভাবলাম তোর সঙ্গে কথা বলতে নেই।
- নেই তো।
- তাহলে...ফোন করলি কেন?
- এমনি।
- আমি ফোন করব? কাল?
- না?
- কেন?
- তোর ফোন করতে নেই।
- ওহ। কিন্তু তুই ফোন করতে পারিস?
- পারি। সবসময় নয়। এই যেমন আজ, তোর জ্ঞানগম্যি যখন গুলিয়ে গেছে।
- ভাবছি...।
- তুই ভাবিস? বাবু?
- ওহ,  ভাবতে নেই?
- ভাবলে কেরিয়ারের কথা আর একটু মন দিয়ে ভাবতিস। অন্তত মায়ের কথা ভাবতিস। সে যাক, এখন কী ভাবছিলিস?
- সিদ্ধির জন্য বিজয়াদশমী পর্যন্ত ওয়েট না করে যদি মাঝেমধ্যেই...।
- মাঝেমধ্যেই আমাদের কথা বলতে নেই।
- ওউক্কে। আন্টিল নেক্সট বিজয়া দশমী দেন।
- কেন এমন করিস?
- যাস না।
- আমি নেই তো। যাব কই?
- ট্রু। সরি। শুভ বিজয়া।
- সাবধানে থাকিস। কেমন?
- যাস না।
- আবার?
- সরি।
- সামনের বিজয়ার সিদ্ধির আগে আর কোনও নেশাভাঙ নয়, কেমন?
- তোর শশীকাকাকে মনে আছে?
- স্কুলের বিহারী দারোয়ান? তুই যার সঙ্গে লুকিয়ে তাস খেলতিস?
- হুঁ।
- তাঁর কী হয়েছে?
- অষ্টমীর দিন মারা গেছেন। ওর বডি নিয়ে ছপড়া এসেছি ওর তিনজন দেশোয়ালির সঙ্গে। নবমী থেকে এখানেই। এ'টা ঠিক সিদ্ধি নয়, জানিস? ভাংয়ের গুলি।
- তুই এখন কোথায় বাবু?
- শ্মশান। পাশে গঙ্গা। চাঁদ, নীলচে কালো আকাশ। শীত শীত হাওয়া। শশীকাকাকে এ পুজোয় একটা ফতুয়া কিনে দিয়েছিলাম। আই জিঙ্কসড হিম। না রে?
- ধুর বোকা।
- কী ভয় রে। কী ভয়। ভূতের নয়।
- জানি।
- আই জিঙ্কস এভ্রিওয়ান।
- একটা চড় মারব।
- হেহ্।
- বাড়ি কবে ফিরছিস?
- যবে, তবে।
- তোর সর্দি লেগেছে?
- আমায় ফোন করিস না আর।
- ছিঃ বাবু।
- করিস না।
- আচ্ছা।
- জানিস, নতুন ফতুয়াটাও চিতায় চড়িয়ে এসেছি। বড় ভালো হনুমানের গান গাইত শশীকাকা। বড় দরাজ গলা। ভাব আসলে চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়ত। ট্রু সেন্ট। জুয়া না খেললে চুরি করত না।
- আমিও খুব ভালো হনুমানের গান গাইতে পারি। তোর ল্যাজটা থাকলে বেশ টের পেতিস।
- হেহ্। তোকে সেই যে একবার একটা শাড়ি দিলাম...। জিঙ্কস সে'খানেই হল।
- ক্যাটক্যাটে লাল! জিঙ্কস হওয়াই ভালো। এখন রাখি। কেমন?
- আয়। শুভ বিজয়া।
- শুভ। শ্মশান থেকে ফিরে স্নান করিস। আর এ'দিক ও'দিক হুটহাট চলে যাওয়ার আগে মায়ের কথাটা একটু ভাবিস। কেমন?

Sunday, October 1, 2017

বিপিনবাবুর একাদশী

(এই লেখাটা ২০১৬তে 'এই সময়'য়ের জন্য লেখা, সে'বার একাদশী রোব্বারে পড়েনি)

বিপিনবাবুর জ্ঞান যখন ফিরলো তখন গোটা মুখে রোদ! গোটা গায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথার বিশ্রী দপদপ আর ঝিমঝিম মেশানো অনুভূতিটা কিছুতেই যাচ্ছে না। শরীরটা মনে হচ্ছিল আড়াইশো কিলোর এক বস্তা লোহা।

“অফিস যাবে না নাকি”? বৌয়ের স্টিলের-বাসনপত্র-আছড়ে-পড়া কণ্ঠস্বরে বিপিনবাবুর মনের মধ্যে একটা সুতীব্র ঝাঁকুনি পড়ল। ঝাঁকুনি জিনিসটা খুব দরকারি। দৈনিক অটোরিকশার ঝাঁকুনিটাকে বিপিনবাবু ফ্রি জীম বলে ধরে নেন। আজকের এই বৌয়ের ডাকের ঝাঁকুনিটা তেঁতুলজলের কাজ করল। গোটা গা থেকে সিদ্ধির ভারটা এক ধাক্কায় অনেকটা নেমে গেল।

অফিস! পুজো খতম! একাদশী ইজ হিয়ার! অফিস! অফিস! অফিস! ঢনঢনিয়ার ফাইলের রিকনসিলিয়েশন, বড়সাহেবের চাওয়া গত কোয়ার্টারের রিভিউ স্টেটমেন্ট; একে একে সমস্ত পড়ে থাকা কাজ মাথায় হুড়মুড় করে এসে বুকের ভিতরের ঝিমঝিমে সিদ্ধি তন্দ্রাটা ঘুচিয়ে দিল। বমিবমি ভাব অবশ্য কম হল না।

ছয় গেলাস সিদ্ধি,

তারপর চার পিস পান্তুয়া,

তারপর দলের মেহেন্দির গানের তালে ধুনুচি নাচ। একটানা। ঠাকুর না ভাসানো পর্যন্ত।

সেই থেকে বুকের ভিতরটা এমন হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় হয়ে গেলো। রাতের মাটন রেজালা আর রুমালি রুটিতেও সবিশেষ মন দেওয়া হয়নি। নেশা এমনই জবরদস্ত উঠেছিল যে রুমালি রুটিতে মাখাবার জন্য মাঝেমাঝেই জ্যাম আর ধনেপাতা বাটা চেয়ে বসছিলেন। নেহাত গিন্নী সামাল দিয়ে বের করেছে। তবে বিজয়া দশমীর ডিনার এদিক ওদিক হলেও, পুজোর বাকি দিনগুলো বিপিনবাবু মন্দ খেয়েছেন, তেমন কথা পরম শত্রুও বলবে না। জলখাবারে পাঁচ দিনই থেকেছে লুচি, সাথে কখনও বেগুন ভাজা , কখনও আলু ভাজা, কখনও আলুর দম, কখনও নারকোল কুচি দেওয়া ছোলার ডাল। সঙ্গে পায়েস (রকমফেরে) এবং দু’রকমের মিষ্টি। দুপুরের খাওয়া হয়েছে বাড়িতে। থেকেছে দু’রকম মাছ; অসময়ে ইলিশ থেকে শুরু করে মৌড়লা বা ট্যাঙরা বা লইঠ্যা বা বোয়াল বা কাঁকড়া বা চিংড়ী। সাথে চিকেন বা মাটন। মুর্গি বলতে অবশ্য দেশীই বোঝেন বিপিনবাবু, তাঁর মতে ব্রয়লারের ভাজা পিস দিয়ে ভাল টেনিস বল বানানো যেতে পারে। ডিনার কেটেছে রেস্তোরাঁ হপিং করে। বিপিনবাবু প্যান্ডেল হপিঙয়ে বিশ্বাস করেন না। তিনি পুজো বলতে পাড়ার পুজো মণ্ডপ বোঝেন, তার বাইরে সমস্তটাই অন্ধকার। পাড়ার মণ্ডপ আর খাওয়াদাওয়া। চাইনিজ টু মুঘলাই ডিনারের মাঝে টুকিটাকি রোল ফুচকায় ডাইভারসন থাকে অবশ্য থাকেই।

“অমন ড্যাবা চোখে বসে আছো যে এখনও? এ’দিকে সাড়ে সাতটা বাজতে চললো যে! খবরদার বাজার না করে যদি বাড়ি থেকে বেরিয়েছ”। ফের বৌয়ের গলায়  স্টিলের-বাসনপত্র-আছড়ে-পড়া হুমকি। ফের চমকে উঠে নিজের খোঁচা দাড়ির গাল চুলকে ফেলেন বিপিনবাবু।

অফিস! পুজো শেষ! সামান্য ভূমিকম্প অনুভূত হল কি? দু’সেকেন্ড তেমনটাই মনে হলেও বিপিনবাবু বুঝলেন তিনি নিজেই সামান্য দুলে উঠেছিলেন। ফের বড়সাহেব, ফের ইয়ে করো,উয়ো করো। পুজোর সমস্ত নবাবী খতম।

“ইয়ে, বাজার ফেরতা আজ কচুরি আনব”? ফতুয়াটা গলাতে গলাতে মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন বিপিনবাবু।

“পুজোয় গজানো আড়াই হাতের ল্যাজটা এবার কাটো। পাঁচ দিন ধরে লুচি গিলে আজ আবার কচুরি? লক্ষ্মীপুজোর আগেই নিমতলায় যাওয়ার ইচ্ছে নাকি? ভালো করে দাঁড়াতে পারছেন না আবার কচুরি খাবেন। কচুরি আনলে আজ তোমারই একদিন কি আমারই একদিন। অনেক আদেখলামো আর জমিদারি সহ্য করেছি পুজোর এ কয়দিন। এবারে আমি যেমন বলব তেমনটি খাওয়া! আর জেলুসিল চাইলেও পাবে না, বলে রাখলাম”!

“ওহ। আচ্ছা বেশ। আজ জলখাবারে তাহলে...”।

“ছাতু”!

“ছা...ছা...”?

“ছাতু! নাম শোনোনি বাপের জন্মে মনে হচ্ছে”?

“ছাতু খাওয়াবে জলখাবারে, আর বাপ তুলে কথাও বলবে”?

“এক হপ্তার মধ্যে যদি তেলেভাজা কিছু খাওয়ার নাম শুনেছি, তাহলে আমি চোদ্দ-পুরুষ তুলে কথা বলব। পুলিশে কমপ্লেইন করব”।

“আচ্ছা বেশ। ছাতু”।

“নুন লেবু লঙ্কাকুচি পেঁয়াজকুচি দিয়ে গুলে দেব। অমৃতের চেয়ে কম নয়”।

“ছাতু! অমৃতসমান হতেও পারে গো, তাই বলে লুচি তো নয়”!

“গা জ্বালিও না তো! গা জ্বালিও না। চটপট বাজার করে এনে উদ্ধার করো”।

“মাছ আছে কি? না কি আনতে হবে”?

“চারাপোনা এনো। আমি পাতলা ঝোল করে দেব। সাথে ভাত আর শসা মুলো কুচোনো স্যালাড। আজ তোমার টিফিনে”।

“চা...চা...চার...”।

“আবার গোঙায় ধরলো দেখি। চারাপোনার ঝোল”!

“সঙ্গে মুলো”?

“পেট ক্লেন্স করতে হবে না! ওই ডিজেলে ভাজা চপ রোল যে’ভাবে কিলো কিলো খেয়েছ”!

“সকালে ছাতু আর দুপুরে চারাপোনার ঝোল আর ভাত। ওহ্‌!ক্লেন্সিং! বটে”!

“আর একটু কুমড়ো এনো বুঝলে! রাতে কুমড়োর ঝাল ছাড়া ছক্কা আর দু’টো রুটি” ।

"ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা! ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা! ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা"!

"ও মা! অমন নামতা পড়া শুরু করলে কেন"?

বিপিনবাবু বিড়বিড় করেই চললেন; “ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা!ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”!

অটোওলা খুচরো চাইলে তিনি ফস করে বলে বসলেনঃ “ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”। অটোওলা আর ঘাঁটাতে সাহস না পেয়ে নিজে সুড়সুড় করে খুচরো বার করে ব্যাপারটা সামাল দিলেন।

অফিসের বড়সাহেব জিজ্ঞেস করলেন “হাউ ডু ইউ ডু”। বিপিনবাবু অম্লানবদনে বলে ফেললেন; “ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”! বড়সাহেব চশমা কপালে তুলে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

পিসতুতো ভাই ফোন করে বিজয়ার প্রণাম জানালে, বিপিনবাবু বললেন “ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”!পিসতুতো ভাই “ক্রস কনেকশনের যুগ ফিরে এসেছে” বলে লাইন কেটে দিলেন।

অফিস ফেরতা রাতে খেতে বসে বিপিনবাবু যথারীতি গিন্নীকে বললেন “কই দাও! ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কা”!

গিন্নী থালায় সাজিয়ে দিলেন ফুলকো ডিমের কচুরি আর কিমা ঘুগনি। পাশে ঘরে বানানো নারকোলের সন্দেশ।

ফের সেই ঝাঁকুনি অনুভব করলেন বিপিনবাবু; ছাতু, চারাপোনা, মুলো আর কুমড়োর ছক্কার তাল কেটে এ কী এলাহি ব্যাপার! আজ একাদশী যে! আজ যে ছাতু-মুলো দিবস।

“এ কী গো! আমার পেট ক্লেন্স করার কথা যে! কুমড়োর ছক্কা দিয়ে! এ’সব কী”? বিপিনবাবু বিহ্বল বোধ করছিলেন।

“সেই যে প্রথম বিয়ের পর, প্রথম বিজয়ার রাতে কী বলেছিলে খেয়াল আছে”? 

“ক্..কী? কী বলেছি?”

“বলেছিলে যে শাস্ত্রে আছে মেয়েদের বরের সাথে বিজয়া কোলাকুলিতেই সারা উচিৎ। গোপনে”।

“অ। ওহ! আচ্ছা! হ্যাঁ। তাই তো”।

“সকাল থেকে চারাপোনা ছাতু শুনে সেই যে নামতা পড়া শুরু করেছ, তখনই বুঝেছি গণ্ডগোল। তোমার পেট সাফ করতে গিয়ে আমাদের বিজয়ার কোলাকুলিটাই না নষ্ট করে ফেলি”।

“হেহ্! হেহ্‌ হে”!

“অমন হাঁ করে ড্যাবা চোখে বসে না থেকো কচুরিগুলো গিলে আমায় উদ্ধার করো দেখি। ও হ্যাঁ! কাল তো সিদ্ধিতে ডুবে ছিলে তাই বলা হয়নি। বিজয়ার শুভেচ্ছা জানালাম। মন থেকে। আর খেয়ে ওঠো, তারপর প্রণামটা সেরে নেব’খন। আরও কচুরি দেব। গরমাগরম। ভাজছি কিন্তু”।

গিন্নীর হাতের খুন্তিটাকে যেন জগজ্জননীর ত্রিশূল বলে মনে হল বিপিনবাবুর! দেবীর তৃতীয় নয়ন সদা সজাগ থাকে, ভক্তের যন্ত্রণাকে ভুলেও অবহেলায় রাখেন না তিনি। বিপিনবাবু তক্ষুনি “ভালোবাসি গো, বিজয়ার শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ রইল’ বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চোখ ভরা ছলছল আর মুখভরা কচুরির গ্রাসে তাঁর মুখ দিয়ে কেবল বেরোল “বিববাব বুবেব্বা বো বাবীর্বাব বইবো”।

হট্টগোলের পৃথিবীতে এক জোড়া মানুষ হৃদয় উজাড় করে রান্নাঘর আলো করে পড়ে রইলেন। আফটার অল,  অষ্টমী সন্ধ্যে ইজ আ স্টেট অফ মাইন্ড।