রাতের অন্ধকারে সদর দরজাটার দিকে তাকালে বড় মায়া হয়। কোনও এককালে সবুর রঙ ছিল বোধ হয়, এখন ফ্যাকাসে, অল্পেতেই মচমচ করে ওঠে। কব্জায় বারবার নারকোল তেল দিয়েও ক্যাঁচক্যাঁচ দূর করা যায়নি। অথচ বড় মায়া।
একটা কলিং বেল আছে বটে, কিন্তু সে’টা ব্যবহার করতে মন চায় না। সেলসম্যানের কাজে রোজ যে কত বাড়ির কলিং বেলে হানা দিতে হয়। কত রকমের টুংটাং, কত রকমের দরজা, কত রকমের মানুষ। ছোট্ট এক কামরার রেলের কোয়ার্টার থেকে ঝাঁ চকচকে ডুপ্লে; সবার বাড়িতেই আরশোলা আছে। আমার বিশ্বাস রাজভবনেও আরশোলা আছে। মিসেস রাজ্যপালের সঙ্গে মিনিট দশে কথা বলতে পারলেই আয়ুর্বেদিক গুণ সম্পন্ন সুগন্ধি আরশোলাশ-প্লাস লিকুইডের তিনটে বড় শিশি আমি গছিয়ে দিতে পারতাম। গোটা ব্যাপারটাই আত্মবিশ্বাসের খেল। “বিলীভ ইন ইওর প্রডাক্ট”, আমাদের সেলস ম্যানেজার মাঝে মধ্যেই বলে। আমি রীতিমত বিশ্বাস করি। এবং সেই বিশ্বাসের প্রমাণ আমার বিক্রির পরিমাণ। শ্রীগোকুল গ্রীন ইন্সেক্টিসাইড কোম্পানির পয়লা নম্বর সেলসম্যান!
তবে রাতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার সময় কড়া নাড়তে ইচ্ছে করে। খটর খট খটর। এ’টুকুতেই দীপা সাড়া দেয়। দীপার পায়ের মৃদু ধুপধুপ শুনতে বড় ভালো লাগে, সাত সেকেন্ডের মাথায় দরজা খোলে দীপা। রোজ একই ঘ্যানঘ্যান;
“আজ এত দেরী হল কেন”?
দীপার ঘ্যানঘ্যান শুনতে বড় ভালো লাগে। অল্প সুর মিশে থাকে। রাতের ঝুমঝুমি। সোফার গায়ে বেড়ালের আঁচড়ের মত ওঁর শাড়ির আঁচলের খসখস; ক্লান্তি ঝরে যায় কয়েক মুহূর্তেই।
চটি আর ঘামে ভেজা জামা খুলতেই হাতে একটা পাট করা শুকনো গামছা, পাজামা আর ফতুয়া দিয়ে যায় সে। বাথরুমে দু’টো বালতিতে জল তোলা থাকে; একটা লোহার বালতি আর একটা নীল প্লাস্টিকের। সাদায় সবুজ ছোপ ছোপ প্লাস্টিক মগ। স্যাতলা পড়া বাথরুম, অ্যাসবেস্টসের ছাত, টিনের দরজা; কিন্তু ফাইভ স্টার সুবাস। বাথরুমের ভেন্টিলেটরের গা বেয়েই কামিনী গাছ; সে সুবাস আর ঘাড়ের কাছে ঠাণ্ডা জলের ছিটে পড়লে গা শিরশির করে ওঠে, বুকের ভিতর ছ্যাঁতছ্যাঁত। বাথরুমে পাশেই এক চিলতে উঠোন, তার ও’পাশে সুর বারান্দা। সে’খানে একটা ছোট্ট স্টোভ জ্বেলে বসে দীপা, ঘুপচি রান্নাঘরে তার গুমোট লাগে। স্টোভের সঁসঁ ছাপিয়ে দীপার গুনগুন বারান্দা উঠোন পেরিয়ে, টিনের দরজা ছাপিয়ে কানে এসে পড়ে। সে সুর এসে মনে আলপনা দেয়; “...কারে দাও মা ব্রহ্মপদ কারে কর অধোগামী, সকলি তোমার ইচ্ছা..........”।
মার্গো আর কামিনী মিলে তখন মনের ভিতর দাবা বোর্ড সাজিয়ে বসে; সুর মেলানোর চেষ্টা করি:
“আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী।
আমি রথ তুমি রথী, যেমনি চালাও তেমনি চলি”।
গা মুছে পাজামা গেঞ্জি গলিয়ে সোজা দীপার ড্রেসিংটেবিলের সামনে। এক খাবলা পন্ডস নিয়ে ঘাড়ে বুকে পিঠে। আর তারপর সোজা এসে দীপার স্টোভের পাশে টুল টেনে বসা।
দীপা কাপে চা ঢালার সময়ই চারিদিক পাহাড়ি হয়ে যায়, নিয়ম করে। অল্প শীত। অথচ দীপার কপালে দু’চারটে ঘামের দানা, মাঝেমধ্যেই ব্যস্ত হাতে কপালের চুল সরিয়ে চলে সে। দীপা সদর দরজাটার মত; বড় মায়া। চায়ের কাপ হাতে দীপা মোড়া টেনে নেয়,
তার আজেবাজে কথায় প্রশ্নে রাত এগিয়ে চলে।
“তোমার গা থেকে মরা আরশোলার গন্ধ পাই মাঝেমধ্যে”।
“আমায় এ’বার জয়দেবের মেলায় নিয়ে যাবে”?
“তুমি পদাবলী অ্যাপ্রিশিয়েট করো না? তুমি কি মানুষ”?
"খোলাখাম বলে একটা জায়গার খোঁজ পেয়েছি, সময় করে দু'জনে ঘুরে আসব, কেমন" ?
"সেই যে'খানে কাটলেটের সঙ্গে ঘরে বানানো ঝাঁঝালো কাসুন্দি আর অল্প আপেল কুচি দেয়, সেই দোকানটায় আমায় নিয়ে যাও না কেন "?
"নজরুল। নজরুল। নজরুল। সমঝে জনাব? শুধুই নজরুল"।
রাত ঘন হয়। টুল থেমে নেমে বসতে হয় দীপার পায়ের কাছে। দীপার পায়ে রক্ত, ও বলে আলতা অথচ আমার কান্না পায়। দীপা ঘন হয়ে আসে।
আকাশ ফ্যাকাসে হতে শুরু করলে মায়ের গন্ধে আকাশ আর বারান্দা ঢেকে যায়। দীপা চুলে বিলি কেটে জানান দেয়;
"আজ ফের যাওয়ার সময় হল, তৈরি হয়ে নাও। কেমন? আর আজ তাড়াতাড়ি করে ফিরবে গো? একটি বারের জন্য? গোটাদিনের জন্য এ ঘর আগলে বসে থাকি। একা। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরো, কেমন"?
আমার বলা হয়ে ওঠে না যে সদর দরজার ও'দিকে গেলেই আমিও একা। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো বোকা।
আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে দীপা ক্রমশ আবছা হতে শুরু করে। আমি বুঝতে পারি অ্যালার্ম বাজার সময় এগিয়ে আসছে। উঠতে হবে। হুড়মুড়িয়ে উঠেই খবরের কাগজ, স্নান, জলখাবার, অফিসের তাড়া।
অ্যালার্মে সব কেঁপে ওঠে। দীপার চোখ ছলছল। স্নুজ্ টিকিয়ে রাখে মিনিট দশেক।
"আজ তাড়াতাড়ি ফিরো, কেমন"?
দীপা মিলিয়ে যায়। সদর দরজাটাও। শ্রীগোকুল গ্রীন ইন্সেক্টিসাইড কোম্পানির চাকরীটাও গায়েব। শাওয়ারে রাতটুকু ঝেড়ে ফেলে মড়া টোস্ট চিবুতে চিবুতে ফের রাতের অপেক্ষা শুরু।
No comments:
Post a Comment