স্টিলের প্লেটে এক বাটি ঘুগনি আর দু'টুকরো পাউরুটি। ঘুগনিটা সামান্য আলুনি, তবে ধোঁয়া ওঠা গরম; তাই দিব্যি। পাউরুটি চুবিয়ে প্রথম কামড় দিতেই মনঃপ্রাণ জুড়ে সে কী আরাম। বুদ্ধি করে দোকানির থেকে সামান্য পেঁয়াজ-লঙ্কা কুচি চেয়ে নিয়েছিলেন সতীনাথ। আর প্লেটের কোনে ছোট্ট এক ঢিপি ফাউ বিট নুন। দোকানি বলতে বছর সাতেকের একটা ছেলে, যে একটানা বাসন মেজে যাচ্ছিল। খালি গায়ে কালো হাফ প্যান্ট পরে দিব্যি সামাল দিয়ে যাচ্ছে। বাপ নাকি বিড়ি খেতে গেছে। চটপটে আর শশব্যস্ত বাচ্চা ছেলেটা হাল ধরে রেখেছে।
স্বাদে গলে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল। আহ, কদ্দিন পর সামান্য ঘুগনি আর পাউরুটি। এর সঙ্গে একটা ডিম সেদ্ধ পেলেই সতীনাথের চোখে জল আসত। কত দিন পর।
নীল রঙ করা কাঠের বেঞ্চিতে যে আরও একজন বসে রয়েছে সে'টা খেয়াল হল মিনিট খানেক পর। ততক্ষণে আরও দু'টো পাউরুটি চেয়ে নিয়েছে সতীনাথ। পরনে সাদা ফতুয়া আর সবুজ-নীল লুঙ্গি। গালে খোঁচা দাড়ি, ঝিমনো ঢুলঢুলে চোখ।
সুট করে প্লেট নামিয়ে রেখে সরে পড়তে চেয়েছিলেন সতীনাথ। লাভ হল না। হাত টেনে ধরলেন সাদা ফতুয়া।
- আধ বাটি ঘুগনি পড়ে রইল যে, খেয়ে যাও!
- না মানে...আমি আসি।
- যেতে চাইলেই কী যাওয়া যায় সতীনাথ?
- আপনি...কে...কে বলুন তো?
- ঘুগনি ঠাণ্ডা হচ্ছে যে ভাই।
- আমি আসি...।
- কোথায় যাবে?
- তা'তে আপনার কী? আপনি কে?
- আহ্, হুড়মুড় কেন। আর এক বাটি ঘুগনি বলি? তোমার জন্য?
- আমায় যেতে দিন ওস্তাদ।
- এই যে বললে চিনতে পারনি?
- আসলে...আসলে...আমায় যেতেই হবে।
- যাবে তো বটেই। তোমাকে নিতেই তো এসেছি আমি।
- না মানে...ফেরত যাওয়ার কথা বলছি না। আমায় একটু টালিগঞ্জে যেতে হবে।
- সতীনাথ। তুমি জান সে'টা হওয়ার নয়। বছরে একটি বার একদিনের জন্য ছাড়। সে ছাড় আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়েছে। এ'বার ফেরত যাওয়া।
- ওস্তাদ। ওস্তাদ। এমন করে বোলো না। গতকাল...গতকাল...।
- তোমার খোকার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তুমি আইসক্রীমওলা সেজে ওকে আইসক্রীম বিক্রি করেছ। বছরের এই দিনটা ভূতেরা সাপের পাঁচ পা দেখে। আর দেখবে নাই বা কেন। এক দিনের জন্য এই দুনিয়ায় এসে মানবদেহ ধারণ করা যায়। ভূতদেরও শখ আহ্লাদ থাকবেই। সে জন্য আমি তোমায় দোষ দিই নি। তুমি যখন মারা গেলে তখন খোকার বয়স কতই বা...।
- দু'বছর দেড় মাস।
- রাইট। পাঁচ বছর পর শখ হওয়াটা ভুল নয়। কিন্তু পরলোকের নিয়ম অমান্য করবে হে? এমন বেহেড বেআক্কেলে কাজ করবে? ভূতচতুর্দশী খতম হওয়ার পরেও তুমি আমাদের স্পেসে ফিরে গেলে না? ধর্মে সইবে? তুমি জানো না এর ফলাফল কী? এখনও গ্রেস পিরিয়ড আছে। চুপচাপ ফিরে চলো। নয়ত কেলেঙ্কারি ঘটবে আর তখন আমার কিছু করার থাকবে না।
- ওস্তাদ! প্লীজ। আর একটা দিন। আর এক দিনের জন্য খোকাকে দেখব।
- দেখে?
- আজ্ঞে?
- দেখে কী হবে সতীনাথ? তোমাদের দুনিয়া আলাদা! আর তুমি তো জানো। ভূতচতুর্দশীর গ্রেস পিরিয়ড পেরিয়ে গেলেও এ'দিকে পড়ে থাকার পরিণতি ভয়ানক। অতৃপ্ত আত্মা হয়ে এ দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ানো। অসম্ভব যন্ত্রণা। ছটফট। ফিরে চলো সতীনাথ। খোকা ভালো আছে। এমনিতেও মা ন্যাওটা ছিল চিরকাল। আর তাছাড়া এখন ও যাকে বাবা বলে চিনেছে সে তোমার মত বেহেড বেআক্কেলে ইডিয়টের চেয়ে অনেক বেশি ব্যালান্সড। খোকা ভালো আছে সতীনাথ। নিজের জেদের বসে ওকে নষ্ট করো না। যদি অতৃপ্ত আত্মা হয়ে থেকে যাও তাহলে দুঃস্বপ্ন হয়ে বার বার ওর আশেপাশে ঘুরতে শুরু করবে তুমি, সে'টাই তুমি চাও?
- ওস্তাদ। খোকা। আমার খোকা। এতোটুকুন খোকাকে বুকে জড়িয়ে দুলে দুলে ঘুরতাম। 'আমি যে জলসাঘর'য়ের টিউনটা বেশ ঘুমপাড়ানির কাজ করত।
- সতীনাথ। ঘুগনি শেষ করো। এ শরীর এ'বার ঝেড়ে ফেলতেই হবে। নয়ত মুশকিল...।
- কিন্তু খোকা? ওস্তাদ?
- ও ভালো আছে। ওকে ভালো থাকতে দাও। চলো এ'বার। আর আমার তো আর কাজের শেষ নেই। শুধু তোমাকে নিয়ে গেলেই হবে না। আর এক ব্যাটাচ্ছেলেও সময়মত পরলোকে ফেরেনি, তাকেও না নিয়ে গেলে নয়।
- কে?
সতীনাথ অবাক হয়ে দেখলে ওস্তাদ বেঞ্চি ছেড়ে উঠে গিয়ে বাসনের স্তূপের মধ্যে থেকে দোকানি খোকার হাত টেনে ধরলেন।
"এই যে বাবলুবাবু, ইনি ফি বছর বাপকে দেখতে ফেরত আসেন আর সময় শেষ হওয়ার পরেও ফেরার নামটি নেন না। প্রতি বছর এই সময় ওর বাপ অবাক হয়ে ভাবে থরে থরে বাসন কোন জাদুমন্ত্রবলে আপনা থেকে মাজা ধোয়া করে গুছিয়ে রাখা হচ্ছে। যাকগে, এ'বার দু'জনেই ওয়াপস চলো দেখি। আমার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে"।
"বাবা বিড়ি কিনে ফিরুক গো ওস্তাদ , আর একবার অন্তত দেখি। ওস্তাদ গো। আর একটু সময় ওস্তাদ"। বাবলুর কান্নাকাটি ওস্তাদকে স্পর্শ করল না, ওর ডান হাত ওস্তাদের নির্মম মুঠোয় বন্দী।
বাবলুর বাঁ হাতটা নরম করে ধরলেন ঘুগনি তৃপ্ত সতীনাথ।
No comments:
Post a Comment