অন্তত পনেরো বছর পর বাপ্পাদার সঙ্গে দেখা।
দক্ষিণ পাড়ার সর্বকালের সেরা অফ স্পিনার বাপ্পাদা। বিনি পয়সায় পাড়ার কুচেকাঁচাদের অঙ্ক আর আঁকা শেখানো বাপ্পাদা। বুল্টিদির এক ধমকে চেনস্মোকার থেকে চুইংগাম সর্বস্ব বাপ্পাদা। পুজোয় ধুনুচি নাচ, ভোগ বিতরণ আর লক্ষ্মী পুজোয় আলপনা স্পেশালিস্ট বাপ্পাদা। ছোটদের থিয়াটারের ডিরেক্টর বাপ্পাদা।
সব ঠিকঠাক ছিল। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে একটা চাকরী পেয়েছিল, বুল্টিদির সঙ্গে বিয়ে ঠিক। সাজানো গোছানো ছিমছাম। রঙ ওঠা ফ্যাকাসে গোলাপি বালিশের ওয়াড়ের মত ভালোলাগা চারদিকে। আমরা মাঝেমধ্যেই বাপ্পাদার কাছে বৌভাতের মেনুর খোঁজখবর নিচ্ছি আর ওর থেকে "ডেঁপো ছেলের দল" মার্কা এন্তার কানমলা খাচ্ছি। ইন্টার-পাড়া ক্রিকেটে বাপ্পাদা উইকেট নিলেই বুল্টিদির ফর্সা কান দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠছে।
আমরা সবাই বাপ্পাদা হতে চাইতাম। আমরা সবাই স্বপ্ন দেখতাম আমাদের লেখা কবিতার চিরকুট বুল্টিদির মত কারুর কেমিস্ট্রির বইয়ের বুকমার্ক হবে।
বাপ্পাদা-বুল্টিদির বিয়ে জানুয়ারিতে হবে বলে ঠিক ছিল। নভেম্বরের শেষের দিকে বাপ্পাদার বাবা স্বদেশ জ্যেঠু মারা গেলেন। সেরিব্রাল। আমরা বাপ্পাদাকে কাঁদতে দেখিনি; আগেও না, সে'দিনও না।
স্বদেশ জ্যেঠুকে পোড়ানো শেষ হয়েছিল সন্ধে সাতটা নাগাদ। বাপ্পাদা গোটা রাত গঙ্গার ধারে কাটিয়েছিল। সঙ্গে ছিলাম আমরা দু'তিনজন।
মাঝরাতের পর বাপ্পাদা গেম থিওরি নিয়ে ঘণ্টাখানেক আলোচনা করেছিল। ভোর তিনটে নাগাদ "চলি" বলে ঘাট ছেড়ে গেছিল, তারপর থেকে পনেরো বছর পাড়ার কেউ ওর দেখা পায়নি।
সেই বাপ্পাদা। হঠাৎ আবার। হাড় জিরজিরে চেহারা, একমুখ দাড়িগোঁফ। গলার স্বর ক্ষীণ।
আমায় চিনতে ওকে নিশ্চয়ই বেগ পেতে হয়নি। তবু প্রথম ঘণ্টাখানেক কোনও কথা বলেনি। দু'জনে চা খেলাম, ডিমভাজা কিনে অফার করতেও আপত্তি করলে না। বাড়ি ফিরেছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে মাথা নেড়ে না বললে।
অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল "তুই কেমন আছিস"?
সেই বাপ্পাদা। আমায় অঙ্কে ঠেলেঠুলে পাশ করানো বাপ্পাদা। সোমাকে লেখা গোপন চিঠির বানান ঠিক করে দেওয়া বাপ্পাদা। "তুই কেমন আছিস"টুকুতে গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়।
অথচ বাপ্পাদার চোখে যেন কাচ বসানো। স্থির, অবিচল।
নিজের চাকরীর কথা জানালাম। ঘাড় নাড়া দেখে মনে হল অখুশি হয়নি।
"ট্যাক্স ফাঁকি দিস না কোনওদিন", বেমক্কা জোর দিয়ে বলে ডিমভাজার প্লেটটা খটাস করে নামিয়ে রাখল মধুদার দোকানের বেঞ্চিতে।
"কোথায় চললে বাপ্পাদা? বৃষ্টি পড়ছে তো। অন্তত আমাদের বাড়ি চলো আজ"।
"উপায় নেই"।
"বাপ্পাদা প্লীজ, একবার ক্লাবে যাবে না? রুরু, তপুরা তোমায় দেখলে..."।
"চারদিকে ফড়ফড়িয়ে টেবিল ফ্যান চলছে রে"।
"টে...টেবল ফ্যান"?
"টেবিল ফ্যান। ফুলস্পীডে ঘুরছে। আর আমি...কাগজের টুকরো। যা বুঝলাম, বাবা পেপারওয়েট ছিল রে। বাবা যাওয়ার পর, আমার ভেসে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না"।
"বুল্টিদি এখন ক্যানাডায়। ওর বর ওখানে..."।
"পেপারওয়েট। বুল্টি বেচারিও চিরকুট, তবে সে কাগজের গায়ে দামী ফাউন্টেন পেনে দরদী হাতের লেখায় কীটস কোট করা। আমার মত হিজিবিজি বাজারের ফর্দ নয়। আর যে'টা বললাম মনে রাখিস, ট্যাক্স ফাঁকি দিস না কোনওদিন। আর বানান ভুল নৈবচ। ডিমটা বড় ভালো ভেজেছিল মধুদা। তোর অ্যালজেব্রা আর ব্যাটিং স্টান্সের ঋণ শোধ হল। আসি, কেমন"?