Saturday, November 18, 2017

কাগজের টুকরো

অন্তত পনেরো বছর পর বাপ্পাদার সঙ্গে দেখা।

দক্ষিণ পাড়ার সর্বকালের সেরা অফ স্পিনার বাপ্পাদা। বিনি পয়সায় পাড়ার কুচেকাঁচাদের অঙ্ক আর আঁকা শেখানো বাপ্পাদা। বুল্টিদির এক ধমকে চেনস্মোকার থেকে চুইংগাম সর্বস্ব বাপ্পাদা। পুজোয় ধুনুচি নাচ, ভোগ বিতরণ আর লক্ষ্মী পুজোয় আলপনা স্পেশালিস্ট বাপ্পাদা। ছোটদের থিয়াটারের ডিরেক্টর বাপ্পাদা।

সব ঠিকঠাক ছিল। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে একটা চাকরী পেয়েছিল, বুল্টিদির সঙ্গে বিয়ে ঠিক। সাজানো গোছানো ছিমছাম। রঙ ওঠা ফ্যাকাসে গোলাপি বালিশের ওয়াড়ের মত ভালোলাগা চারদিকে।  আমরা মাঝেমধ্যেই বাপ্পাদার কাছে বৌভাতের মেনুর খোঁজখবর নিচ্ছি আর ওর থেকে "ডেঁপো ছেলের দল" মার্কা এন্তার কানমলা খাচ্ছি। ইন্টার-পাড়া ক্রিকেটে বাপ্পাদা উইকেট নিলেই বুল্টিদির ফর্সা কান দুটো টকটকে লাল হয়ে উঠছে।

আমরা সবাই বাপ্পাদা হতে চাইতাম। আমরা সবাই স্বপ্ন দেখতাম আমাদের লেখা কবিতার চিরকুট বুল্টিদির মত কারুর কেমিস্ট্রির বইয়ের বুকমার্ক হবে।

বাপ্পাদা-বুল্টিদির বিয়ে জানুয়ারিতে হবে বলে ঠিক ছিল। নভেম্বরের শেষের দিকে বাপ্পাদার বাবা স্বদেশ জ্যেঠু মারা গেলেন। সেরিব্রাল। আমরা বাপ্পাদাকে কাঁদতে দেখিনি; আগেও না, সে'দিনও না।

স্বদেশ জ্যেঠুকে পোড়ানো শেষ হয়েছিল সন্ধে সাতটা নাগাদ। বাপ্পাদা গোটা রাত গঙ্গার ধারে কাটিয়েছিল। সঙ্গে ছিলাম আমরা দু'তিনজন।
মাঝরাতের পর বাপ্পাদা গেম থিওরি নিয়ে ঘণ্টাখানেক আলোচনা করেছিল। ভোর তিনটে নাগাদ "চলি" বলে ঘাট ছেড়ে গেছিল, তারপর থেকে পনেরো বছর পাড়ার কেউ ওর দেখা পায়নি।

সেই বাপ্পাদা। হঠাৎ আবার। হাড় জিরজিরে চেহারা, একমুখ দাড়িগোঁফ। গলার স্বর ক্ষীণ।

আমায় চিনতে ওকে নিশ্চয়ই বেগ পেতে হয়নি। তবু প্রথম ঘণ্টাখানেক কোনও কথা বলেনি। দু'জনে চা খেলাম, ডিমভাজা কিনে অফার করতেও আপত্তি করলে না। বাড়ি ফিরেছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে মাথা নেড়ে না বললে।

অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল "তুই কেমন আছিস"?

সেই বাপ্পাদা। আমায় অঙ্কে ঠেলেঠুলে পাশ করানো বাপ্পাদা। সোমাকে লেখা গোপন চিঠির বানান ঠিক করে দেওয়া বাপ্পাদা। "তুই কেমন আছিস"টুকুতে গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়।

অথচ বাপ্পাদার চোখে যেন কাচ বসানো। স্থির, অবিচল।
নিজের চাকরীর কথা জানালাম। ঘাড় নাড়া দেখে মনে হল অখুশি হয়নি।
"ট্যাক্স ফাঁকি দিস না কোনওদিন",  বেমক্কা জোর দিয়ে বলে ডিমভাজার প্লেটটা খটাস করে নামিয়ে রাখল মধুদার দোকানের বেঞ্চিতে।

"কোথায় চললে বাপ্পাদা? বৃষ্টি পড়ছে তো। অন্তত আমাদের বাড়ি চলো আজ"।

"উপায় নেই"।

"বাপ্পাদা প্লীজ, একবার ক্লাবে যাবে না? রুরু, তপুরা তোমায় দেখলে..."।

"চারদিকে ফড়ফড়িয়ে টেবিল ফ্যান চলছে রে"।

"টে...টেবল ফ্যান"?

"টেবিল ফ্যান। ফুলস্পীডে ঘুরছে। আর আমি...কাগজের টুকরো। যা বুঝলাম, বাবা পেপারওয়েট ছিল রে। বাবা যাওয়ার পর, আমার ভেসে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না"।

"বুল্টিদি এখন ক্যানাডায়। ওর বর ওখানে..."।

"পেপারওয়েট। বুল্টি বেচারিও চিরকুট, তবে সে কাগজের গায়ে দামী ফাউন্টেন পেনে দরদী হাতের লেখায় কীটস কোট করা। আমার মত হিজিবিজি বাজারের ফর্দ নয়। আর যে'টা বললাম মনে রাখিস, ট্যাক্স ফাঁকি দিস না কোনওদিন। আর বানান ভুল নৈবচ। ডিমটা বড় ভালো ভেজেছিল মধুদা। তোর অ্যালজেব্রা আর ব্যাটিং স্টান্সের ঋণ শোধ হল। আসি, কেমন"?

মুখোমুখি বসিবার

- এক্সকিউজ মী!

- আমায়? আমায় বলছেন কিছু?

- আরে ক'টা লোক আছে এখন মেট্রোতে?

- অদ্ভুত। তাই তো। এই মাত্র ভিড় ছিল। এখন শুধু আপনি আর আমি।  স্ট্রেঞ্জ। 

- খবরের কাগজে মুখ গুঁজে থাকলে ওই হবে। ভিড়  আচমকা গায়েব। কামরায় শুধু আমরা দু'জনে। আর সমস্যাটা সে'খানেই...। 

- ওহ মাই গড! 

- যাক, ধরতে পেরেছেন তা'হলে!

- অবিশ্বাস্য! অভাবনীয়! 

- নয়ত আপনাকে ডাকলাম কেন বলুন!। 

- আপনি...আপনি অবিকল আমার মত।

- অথবা আপনি অবিকল আমার মত। 

- আমার দু'জনেই...। 

- সেম টু সেম। 

- ভাবা যায়?

- দশ মিনিট আগেও ভাবতে পারতাম না । কিন্তু এখন স্পষ্ট দেখতে পারছি। 

- অবিকল এক চেহারা। শুধু তাই নয়। একই পোশাক। একই চশমার ফ্রেম। আপনার গাল দেখে মনে হচ্ছে দাড়ি দু'দিন আগে কামিয়েছেন। 

- পরশু সকালে। করেক্ট। আটটা নাগাদ। 

- একদম তাই। গত পরশু সকাল আটটা নাগাদ। ভুল রেজার চালানোয় থুতনির কাছের কাটা দাগটা এখনও টাটকা আমার চিবুকে। 

- আমারই মত। আর আপনার বুকপকেটে ডালের ছিটে। 

- আপনার বুকপকেটের মতই । তাড়াহুড়োয় লাঞ্চ করতে গিয়ে...। 

- এগজ্যাক্টলি। তা'হলে কী বুঝছেন?

- দাঁড়ান। একটু ভেবে উঠতে দিন...মেট্রোটা কালীঘাট পেরোতেই...। বিস্ফোরণ। 

- ওহ হো!। মনে পড়েছে। ঠিক। বিস্ফোরণ। তবে কালীঘাট পেরোনোর পরে নয়, কালীঘাট ঢোকার মুখে। 

- না না, স্পষ্ট মনে আছে। কালীঘাট পেরোনোর পর। 

- ধুর। তা হবে কী করে? আমি রোজ সন্ধেবেলা টালিগঞ্জ থেকে চাঁদনী চক ফিরে যাই, কালীঘাটের ওপর দিয়ে। 

- এই সেরেছে। এ'টা তো মিলল না। আমি ফিরি কালীঘাটের ওপর দিয়েই তবে চাঁদনী চৌক  থেকে কালীঘাট। রিভার্স ডাইরেকশন।  

- লে হালুয়া! তা'হলে আমরা এক নই, আর আমাদের মেট্রো ট্রেন দু'টোও আলাদা। 

- মহামুশকিল। অথচ বাকি সব মিলে যাচ্ছে। আর দু'টো মেট্রোয় একই সময়ে বিস্ফোরণ! এত বড় কোইন্সিডেন্স? 

- বিস্ফোরণ বলে বিস্ফোরণ! আরডিএক্সে কাঁপিয়ে দিয়েছে মাইরি। 

- আরডিএক্স?

- টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে আপনি আরডিএক্সের নাম শোনেননি? টেররিস্টরা শুনলে কষ্ট পাবে। 

- টেররিস্টরা আরডিএক্স ব্যবহার করে বিস্ফোরণ ঘটায়? মানুষ মারতে?

- অবভিয়াসলি। হাফ কিলো আরডিএক্সে শুনেছি খান চারেক পাড়া নিকেশ হয়ে যেতে পারে। 

- গুলিয়ে যাচ্ছে মশাই। আরডিএক্সের নাম অবশ্যই শুনেছি। কিন্তু ও জিনিস তো আমরা লুচির পর খাই; মিনিমাম দেড়বাটি। মর্নিং ডেজার্ট আর কী। তবে আরডিএক্স পচে গেলে একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে বটে...। 

- আরডিএক্স ডেজার্ট? গুল দেওয়ার একটা লিমিট থাকবে তো? 

- ওহ হো। গুল নয় স্যর। গুল নয়। এ'বার স্পষ্ট হচ্ছে ব্যাপারটা। 

- আপনি আরডিএক্স খান এ'টা আমায় বিশ্বাস করতে হবে?

- আলবাত। জলের মত স্পষ্ট তো। আমি আপনি একই তবে আমাদের পৃথিবী আলাদা। সমস্তই এক, শুধু পৃথিবী আলাদা। আর স্রেফ প্যারালালই নয়। কন্ট্রাস্টিং অর্থাৎ দু'টো দুনিয়া বিপরীত দিকে দৌড়চ্ছে । আপনার মেট্রোর রুট আমার উলটো। খেয়াল করে দেখুন আপনার দাড়ি কাটতে গিয়ে কেটেছে থুতনির ডান দিক, আমার ঘা বাঁ দিক। 

- বুক পকেটের দাগ যে একই দিকে। 

- আপনি কোন ডাল খেয়েছেন?

- আমি? মুসুরি। 

- আমি মুগ। 

- প্যারালাল ওয়ার্ল্ড?

- ওই যে বললাম জলের মত। আমার দুনিয়ায় আমিই আপনি। আপনার দুনিয়ায় আপনিই আমি। 

- বড্ড ঘোড়েল। তা ভিড় মেট্রোয় সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর কী হল?

- অত্যন্ত সরল! বিস্ফোরণের চোটে আমাদের দু'টো দুনিয়া ওয়ার্ম হোলে দলা পাকিয়ে গেল। এই আমি আর আপনি এখন মুখোমুখি। 

- আর আপনার পৃথিবীতে সবাই লুচির পর বাটি বাটি আরডিএক্স সাঁটায়? 

- আরডিএক্স নিয়ে কবিতা লিখতে লিখতে আমাদের কবিরা কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছেন মশাই। রোম্যান্সের নদী বয়ে চলেছে আরডিএক্স নিয়ে। 

- তাহলে আপনাদের টেররিস্টরা বিস্ফোরণ ঘটান কী দিয়ে?

- পচা মিহিদানা, অফ কোর্স। দেড়শ গ্রাম পচা মিহিদানা চার্জ করে আমাদের নবালিতা জঙ্গি গোষ্ঠীরা একটা ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। 

Monday, November 13, 2017

গামছা

- শুনুন!
- কী চাই?
- অমন ধমকে কী চাই বলছেন কেন স্যর?
- আমায় স্যর বলার কী আছে? একে পাখি তায় আবার ফিঙে। কী চাই?
- যদি অভয় দেন তো বলি!
- ওরে আমার ন্যাকা রে। ক্যুইক। টেলিগ্রাফের তারে বসে আমার ন্যাকামি বরদাস্ত হয় না। ক্যুইক।
- বলছিলাম যে আপনার ল্যাজটা কি ফাঁকা আছে? গামছা মেলার ছিল। ভেজা।
- আমার ল্যাজে ভেজা গামছা?
- ভরসা বলতে তো ও'টুকুই।

**
খোকা রোজ দেখে বাবা অফিস থেকে ফিরে ভিজে গামছায় গা মুছছে। মিনিট দশেক লাগে সে গামছা চৌবাচ্চার জলে ভিজিয়ে রাখতে, মিনিট পাঁচেক গা মুছতে।
সবুজ লাল চেক গামছা। দেখেই মনে হয় কী মোলায়েম, কী আদুরে। কিন্তু গা মোছার পর বাবা গামছাটা যে কোথায় মেলেন সে'টা কিছুতেই ঠাহর করতে পারে না খোকা।

বাবাকে বেশ ম্যাজিশিয়ান মনে হয়। ভেজা গামছা গায়েব, শুকনো গামছা ওয়াপস। রোজ।

বাবা মাঝেমধ্যেই বলেন; "যারা ভিজে গামছা বরদাস্ত করতে পারে না, তাঁদের কিছুতেই ভরসা করবি না। সে ব্যাটারা দিব্যি মানুষ খুন করে গজল গাইতে পারে"।

Wednesday, November 8, 2017

ছুঁচ

মেজমামা থাকলে বলতেন "ইট ইজ আ বিউটিফুল মর্নিং"। আরও দু'একটা মন ভালো করা কঠিন ইংরেজি শব্দও থাকত বোধ হয়।

শুভেন্দুরও ঠিক তেমনটাই মনে হচ্ছিল। হাওয়ায় তিরতিরে শীত। কফির মনোরম উষ্ণতায় সেঁকে নেওয়া হাতের তালু। আকাশের নীলে রোদের সেলোফেন। নিখুঁত; ঠিক যেমনটা হওয়া উচিৎ। এফএমে কোন চ্যানেল যেন 'কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে' চালিয়েছে।

দীপার কপালে এলোমেলো চুল, চোখে অল্প ঘুমের রেশ তখনও লেগে রয়েছে। ভালো লাগার গ্যাস বেলুনে ঝুলে ভেসে যেতে ইচ্ছে করছিল শুভেন্দুর। 'আহা' না বলে 'অহো' বলতে ইচ্ছে করছিল।

ঠিক তখনই। বেলুনে ফুস শব্দে ঢুলে গেল ছুঁচ আর কফিতে পড়ল চোনা। আকাশের মন কেমনের নীল কেউ যেন বাথরুম-ফ্লোর-ক্লীনার ঢেলে ফ্যাকাশে করে দিল।

ছুঁচ কাম চোনা কাম ফ্লোর ক্লীনার মার্কা প্রশ্নটা ছিল দীপার।

- আচ্ছা শুভেন্দু, আমি কি ইরিপ্লেসেবল?
- উঁ?
- আমি কি ইরিপ্লেসেবল?
- আমায় জিজ্ঞেস করছ গো?
- এখানে আর কে আছে বসে?
- আই সী। আমায় জিজ্ঞেস করছ।
- আমি কি ইরেপ্লেসেবল? আমার অভাব কি তোমার অপূরণীয় মনে হবে?
- অফ কোর্স। অবশ্যই। ডেফিনিটলি। নিঃসন্দেহে।
- রিয়েলি?
- আলবাত। তাছাড়া একজন মানুষ কখনও রিপ্লেসেবল হতে পারে?
- ও। তাহলে কেউই তোমার কাছে রিপ্লেসেবল নয়।
- হ্যাঁ। মানে হিউম্যান এলিমেন্ট, দোষে গুণে সকলেই ইউনিক পারমুটেশন।
- বুঝলাম।
- ইয়ে দীপা, অমন রাগ করে 'বুঝলাম' বলার কী আছে!
- রাগ? রাগের কী আছে? তবে আমার ব্যাপারে তোমার পারসেপশনটা স্পষ্ট হল।
- তোমার ব্যাপারে আমার ইয়ে? তেমন কিছু বললাম নাকি?
- ন্যাকা সেজো না।  খুব সাটল কিন্তু স্পষ্ট ভাবে বলেছ। কেউই রিপ্লেসেবল নয়। প্রত্যেক মানুষের অভাবই অপূরণীয়। আর আমিও তোমার কাছে আর পাঁচটা মানুষের মতই।
- যাহ্। এ'টা কখন বললাম? এক্স প্লাস ওয়াই আর এক্স মাইনাস ওয়াই কে মিশিয়ে সাইমালটেনিয়াস ইকুয়েশন কষা সম্ভব। এক্স প্লাস ওয়াই আর জেড মাইনাস ডাব্লু মেশালে কিস্যু পাবে না গুরু।
- প্রথমত, আমি তোমার কাছে আর পাঁচ জনের মতই। দ্বিতীয়ত আমি তোমার মত ম্যাথেম্যাটিকালি করেক্ট নই।  কেন সকাল সকাল আমার সঙ্গে বসে সময় নষ্ট করছ শুভেন্দু?
- না মানে ইয়ে...।
- ইয়ে কী?
- তোমার প্রতি আমার এই যে অপত্য স্নেহ...।
- স্নেহ? তুমি বাবলুকে স্নেহ কর..।
- বাবলু আমার ভাইপো..।
- মিঠুকে স্নেহ কর..।
- মিঠু পাশের বাড়িতে থাকে, ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি ওকে অঙ্ক পড়াই।
- তো? আমি সবার মতই। তুমি রাম শ্যাম যদুকেও স্নেহ কর, আমার ভাগ্যেও তোমার স্নেহর কিছুটা অ্যালোকেট করা আছে। তোমার স্নেহের স্টকে এক্স কিলো থাকলে আর তোমার পরিচিত মানুষের সংখ্যা এন হলে আমার কপালে জুটবে এক্স বাই এন পরিমাণ স্নেহ। আর পাঁচজনের মতই। তোমার হোমোজিনিয়াস দর্শনের দেওয়ালে আমি একটা ইট মাত্র।
- না না..সেমান্টিক্সে কনফিউজড হচ্ছ।
- বেশ। আমার গুরুত্ব আর পাঁচজনের মতই। আমি অঙ্ক বুঝি না কাজেই আমার ইন্টেলিজেন্স কম। আমি সেমান্টিক্স নিয়ে ভির্মি খাই, অতএব আমার ভাষাজ্ঞানও হাস্যকর। আমার সঙ্গে কত কষ্ট সহ্য করে তোমায় থাকতে হচ্ছে, তাই না?
- যাহ্ শালা! সেমান্টিক্স মানে...। আরে স্নেহর ক্যাটেগরি আছে তো।
- তাই বলে আমার সঙ্গে খিস্তি দিয়ে কথা বলবে?
- শালাটা খিস্তি? বাপের জন্মে শুনেছ শালার মত হার্মলেস স্বগতোক্তিকে কেউ খিস্তি বলে রেফার করছে?
- তুমি আমার বাপ তুলে কথা বললে শুভেন্দু?
- আমি একটু বেরোচ্ছি, কেমন? হাওড়া থেকে  হিমালয় লোকাল যেহেতু এখনও চালু হয়নি, ভাবছি পার্ক থেকেই একটু হাঁটাহাঁটি করে আসব।

Tuesday, November 7, 2017

জালিম খাঁ


কয়েক হাজার বছর আগের কথা। ভাগ্যিস নিউমোদক স্যুইটসের ফুলকপি-শিঙাড়ার তেলে ল্যাপ্টানো আঙুলে হিস্ট্রি বইয়ের পাতা ওল্টাতে গিয়ে সেই গোপন চ্যাপ্টারটার পৌঁছনো গেছিল। ভাগ্যিস।
নয়ত কুমার জালিম খাঁর খবরাখবর পাওয়া হত না।

চারদিকে রক্তারক্তি অবস্থা। দুশমনিস্তানের বিরুদ্ধে শত্রুপুরের এন্তার খুনোখুনি চলছে দেড়শো বছর জুড়ে।   যুদ্ধের ইন্ট্রারভ্যালে কুমার জালিম খাঁ এক বাটি চানাচুর নিয়ে বসেছিলেন  যুদ্ধক্ষেত্রের এক নিরিবিলি কোণে। বাতাসে বারুদ, বালি আর লেবুপাতা ঘষা সুবাস। জালিম খাঁ মনে মনে সুরে ধরেছিলেন;
"মহব্বত মে নহি হ্যায় ফর্ক জিনে অউর মরনে কা, উসি কো দেখকে জিতে হ্যায় জিস কাফির মে দম নিকলে, হজারো খোয়াইশে অ্যাইসি কি হর খোয়াইশ মে দম নিকলে"। গানের কথা তো আর তলোয়ার নয় আর সুরও বল্লম নয় যে জালিম খাঁর হুকুমে তাদের নড়নচড়ন। চানাচুর মুখে বেশ নাস্তানাবুদ হচ্ছিলেন ভদ্রলোক।
ঠিক তখনই ভসভসে স্টোভ জ্বালানোর গন্ধে খাঁ সাহেবের গান থামল। ডিমের মুণ্ডুপাত করে যে যেন চাটুতে ঢেলেছে।  কুচো পেঁয়াজের অভাবেই স্পষ্ট; শত্রুপুরের খুনে দৃষ্টির থেকে এত সহজে রেহাই মিলবে না।
স্যান্ডো গেঞ্জির বর্মেও ভয় ঠেকাতে পারলেন না বাহাদুর জালিম খাঁ।
- সুর ঠিকঠাক লাগেনি, তাই না গো?
- আমার কান বেয়ে রক্ত ঝরছে, তা'তে তোমার কী?
- আসলে দু'দিন আগে বাথরুমে সুরটা অবিকল খাপে খাপ বসে গেছিল। গড প্রমিস। আজ তোমার সামনে একটু নার্ভাস হয়ে..।
- আমি তোমায় নার্ভাস করি?
- ইন আ ভেরি স্যুইট ওয়ে অফ কোর্স।
- বটে? বেশ। নোটেড।
কুমার জালিম খাঁর নোটেড গাছটি সে'খানেই মুড়িয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে খোলাখুলি কিছু না বলে দেখা যাচ্ছে ইতিহাস মুখে কুলুপ এঁটে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। ইতিহাসের চোখ ছলছল, আঁচল দুরমুশ, হাতের মুঠোয় ঝগড়াহত সিনেমার জোড়া টিকিট।
জালিম খাঁয়ের মুখে চানাচুর আর লে হালুয়া।

Monday, November 6, 2017

ক্রিফ্যাবাবুর গল্প

- আরে ক্রিফ্যাবাবু যে!

- চিনতে পেরেছেন স্যার?

- না চিনে আর উপায় কী বলুন। বিষমে বিষমে বেঁধে রেখেছিলেন যে এদ্দিন। তা ক্রিফ্যাবাবু, একটা কথা বলুন। বছর দশেক আগে যখন দেখেছিলাম তখন তো দিব্যি নাদুসনুদুস ছিলেন, এখন এমন হাড়গিলের মত চেহারা হল কী করে?

- ক্রিফ্যা তো আমি এক পিস নই স্যার। একপিস আমি হাড়গিলে হলে কী এসে গেল!

- এমন বিমর্ষ হাবভাব আপনাকে মানায় না ক্রিফ্যাবাবু। সে'বার কী ফুর্তি দেখেছিলাম আপনার মধ্যে।

- সেই অদ্দিন আগে? তখন আমার ভিটামিন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেটরা সবাই ছিলেন, আমিও ভুঁড়ি বাগিয়ে সুখে ছিলাম। শেষ পুষ্টির সোর্স আপনি পড়েছিলেন, সে জন্যেই এ দেহ নিয়ে কোনওক্রমে পড়েছিলাম...। এ'বার ইউথ্যানেসিয়া।

- ও কী কথা ক্রিফ্যাবাবু! আপনারাই তো সব, আমরা সবাই একে একে যাবই, যেতেই হবে। কিন্তু আপনাদের থাকতে হবে যে।

- বললাম যে স্যার, এক এক ক্রিফ্যার এক এক জাতের খাদ্য। আমাদের ব্যাচের পাতের পাশে প্লাস্টিক বাটিতে গরম জল আর কাগজের সাবান সার্ভ হয়ে গেছে। আপনি এদ্দিন ছিলেন, তাই পরের ব্যাচের হল্লা শুনেও চেয়ার ছাড়িনি...।

- কিন্তু এ'বার যে আমাকেও যেতে হবে ক্রিফ্যাবাবু।

- ক্রিকেটারদেরই শুধু রিটায়ারমেন্ট থাকে? আজ আপনার কাছে এলাম কেন? আপনি চললেন, আমার আর থেকে কী কাজ? এ'বার পরের ব্যাচ কবজি ডুবোবে। মহেন্দ্রবাবু, আজ্ঞা করুন; আপনার সঙ্গে এই আমি, বাবু ক্রিকেটফ্যান এইবারে মানে মানে কেটে পড়ি। একটা স্যুটকেস আমায় দিন দেখি মশাই!

Thursday, November 2, 2017

পঞ্চার এন্ট্রান্স পরীক্ষা

- কী রে পঞ্চা, নার্ভাস?
- না..ইয়ে..মানে বলাইদা, এত বড় এন্ট্রান্স...।
- এগজামিনেশনেই এত ভয়? এরপর গ্রুপ ডিসকাশন, ভাইবা। তখন তা'হলে কী করবি?  রিল্যাক্স।
- খুব খেটেছি বলাইদা, তুমিই তো কোচিং করালে। জানোই তো।
- সে জন্যেই বলছি। তোর প্রিপারেশন চমৎকার হয়েছে। স্পট-হিউমরের অব্জেক্টিভ টাইপ কোশ্চেনগুলো একটু মাথা ঠাণ্ডা রেখে হ্যান্ডেল করিস। কেমন?
- প্রচুর ক্যান্ডিডেট, তাই না বলাইদা?
- প্রতি বছর মড়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মেডিকাল সায়েন্সের প্রগ্রেসেও মহামারী যুদ্ধ আটকাচ্ছে না। আর মড়াদের ইন্টেলিজেন্সও বাড়ছে। আমার কোচিং সেন্টারেই দেখ না, পাঁচ বছর আগে দেড়শো মড়া নিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন হাজার দুই, তিরিশটা ব্যাচ।
- একবার যদি লাগিয়ে দিতে পারি...।
- তাহলে একটা হিল্লে হলো আর কী! এস-ও-বি এন্ট্রান্স ক্লীয়ার করা ! এর মানে স্ট্রেট অফ ফেমে চলে যাওয়া। প্রতি বছর কয়েক লাখ ভূত এই পরীক্ষার জন্য মেহেনত করে। কোয়ালিফাই করে জনা দশেক। এস-ও কোয়ালিফায়েড ভূত চাঁদু, শুধু ভূতেরা নয়; মানুষও তেনাদের হিংসে করে।
- বলাইদা এস-ও কোয়ালিফাইড ভূতেরা নাকি রবি ঘোষের ডায়লগের মত? নতুন ছুরির মত ধারাল অথচ গুপ্তিপাড়ার মাখা সন্দেশের মত নরম?
- নিশ্চয়ই এ'সব বাজে এক্সপ্রেশন আঁশবাজার পত্রিকায় পড়েছিস? পত্রিকাটা কী ছিল আর কী হল! যাক গে, তবে এস-ও-বি'রাই শ্রেষ্ঠ। পূর্ণেন্দুবাবুর পোয়েট্রির চেয়েও লিরিকাল তেনারা, লক্ষণের ব্যাটের পেটির মত শানানো।  তোর মধ্যে এস-ও-বি এন্ট্রান্স ক্লীয়ার করার সমস্ত কোয়ালিটি আছে।
- জীবদ্দশায় সে ভদ্রলোকের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী চোর হতে পারলাম না। সে দুঃখ যাওয়ার নয়। বলাইদা, আশীর্বাদ কর মড়া হয়ে  অন্তত যেন শীর্ষেন্দু-অদ্ভুতুড়ে-ভূত এন্ট্রান্স ক্লীয়ার করে সেল্ফ অ্যাকচুয়ালাইজেশন স্পর্শ করতে পারি।