Wednesday, December 6, 2017

অঙ্কের ছ্যাঁত, ছ্যাঁতের অঙ্ক



১। 

মান্তুদা জবাব দিয়ে দিয়েছে। ফাইনালে অঙ্ক পরীক্ষায় ভদ্রস্থ নম্বরের আশা প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু যদি কোনও ক্রমে পাশটা করা যায়। কোনও ক্রমে চল্লিশ।

বেশ কিছুদিন ধরে দীপুকে মান্তুদা একা পড়াচ্ছেন। মান্তুদার মতে দীপুর অঙ্ক-ভয়কে ম্যান টু ম্যান মার্কিং না করলে ক্যালামিটি এড়ানো অসম্ভব। গত তিন মাস ধরে প্রতিদিন রাত্রে মান্তুদার বারান্দায় এসে পড়ে থেকেছে দীপু। প্রবাবিলিটি পারমুটেশন অমুক তমুক পড়ানো শেষ হলে মান্তুদা নিজের পকেট রেডিওতে গান শোনাতেন। সাত-পুরনো হিন্দী গান। রোজ।  

"তোর মনে টার্বুলেন্স চলছে। এতগুলো কনসেপ্ট একসঙ্গে মাথায় ঘুরপাক খেয়ে ঘোল পাকাচ্ছে। সেডিমেন্ট জমতে না দিলে মুশকিল। মিউজিক কে ইউটিলাইজ করতে শেখ। নোটেশনেও অঙ্ক থাকে, সে খবর রাখিস তো"? 

ডিসেম্বরের রাত বারান্দাকে জাপটে ধরত। দীপুর হাফ সোয়েটার ছাপিয়ে গা শিরশির।  মান্তুদার টেবিলে তাল দেওয়া। দীপুর বুকে " আর হল না" গোছের ছ্যাঁত ছ্যাঁত। 

বারান্দা পেরিয়ে মান্তুদার বাবার নিজের হাতে চাষ করা গোলাপ বাগান। সে বাগানের ও'পাশে গোলাপের সুবাসকে জুতোপেটা করা সারের ঢিপি। তার ও'পাশে সরু গলি। গলির ও'পাশে নীল রঙের দোতলা বাড়ি। 

সেই দোতলার ব্যালকনিতে আবছায়ার সঙ্গে মিশে যেত মান্তুদার রেডিওর "রাহ্‌ হে পড়ে হ্যায় হম কব সে আপ কি কসম, দেখিয়ে তো কম সে কম, বোলিয়ে না বোলিয়ে, হম হ্যায় রাহি পেয়ার কে হম সে কুছ না বোলিয়ে"। 

আবছায়ায় গান আর বাতাসের গুঁড়ো গুঁড়ো শীত মিলে মিশে সে বারান্দায় তৈরি হত নীল রঙের শালের পায়চারি। নীল শাল জানে রাস্তার ও'দিকের বারান্দায় অঙ্ক কাহিল কলজের থেবড়ে বসে থাকা। নীল শাল অঙ্কে তুখোড়, মায়ায় নিখুঁত। 

বুকের ছ্যাঁত নরম হয়ে আসত। দুপুরের জমানো রোদ আর অল্প ন্যাপথালিন মেশানো লেপের সুবাস, ঠাকুমার ছ্যাঁচা পানের স্বাদ আর মায়ের হাতে মাখা আলুসেদ্ধ; সমস্ত মিলে মনের অসোয়াস্তি কমে আসত। দীপুর বুকের ভিতরের যাবতীয় "হল না" ভাব উবে যেত।  
ব্যালকনির গুনগুন আর রেডিওর মিনমিন বাতাসে মিশে অন্য ছ্যাঁত তৈরি হত 
"দিল পে আসরা কিয়ে, হম তো বস ইউ হি জিয়ে, 
এক কদম পে হস লিয়ে, এক কদম পে রোল লিয়ে"।  


২।

"দীপক, ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া এই কোয়ার্টারের মার্কেট শেয়ার কতটা নেমেছে"?

"ইয়েস স্যর? আমায় কিছু বললেন"?

"হোয়াটস রং উইথ ইউ? তোমার মার্কেট শেয়ার প্লাঞ্জ করছে আর তুমি ক্লুলেস হয়ে বসে রয়েছ"? 

দীপকের কানে বুকে দমাদম আছাড় খেতে থাকে উৎকট সব অর্থহীন শব্দ; মার্কেটশেয়ার, রেস্পন্সিবিলিটি, টার্গেটস, ফোকাস...আরও কত কী। শহরের ঠুঁটো ডিসেম্বরে মান্তুদার রেডিও খাপ খেত না কিছুতেই। বুকে ছ্যাঁত জমতে শুরু করে, স্পষ্ট টের পায় দীপক।  

ছ্যাঁতছ্যাঁতের মেঘ ক্রমশ ডাগর হয়ে বুক ভারি করে ফেলে। দীপুর আঙুলগুলো তিরতির করে কাঁপতে থাকে। নোটেশনেও অঙ্ক থাকে।  মান্তুদার ফতুয়ার পকেট থেকে বেরোনো নীল কালো রেডিওটার কথা মনে পড়ে দীপুর। বারান্দার ও'পাশে গোলাপ বাগান, তার ও'পাশে রাস্তা, রাস্তার ও'দিকে দোতলা বাড়ি। ব্যালকনি। 

"দর্দ ভি হমে কবুল, চ্যেন ভি হমে কবুল 
হমনে হর তরহ কে ফুল হার মে পিরো লিয়ে"। 

দীপু বুকের মধ্যে অঙ্ক পরীক্ষা মার্কা "হল না"র জাপ্টে ধরা টের পায়। "আর হল না"গুলো  আর উবে যেতে পারে না। 

নীল শালের "বাবু দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে" মার্কা অপ্রয়োজনীয় স্প্যাম এসএমএস ডিলিটি করে, মার্কেট শেয়ারের জরুরী স্প্রেডশিটে চোখ রাখেন দীপক চ্যাটার্জী।  ইয়ারফোনে ছ্যাঁত-রেগুলেটর:

"ধুপ থি নসীব মে, ধুপ মে লিয়া হ্যায় দম, 
চাঁদনী মিলি তো হম, চাঁদনী মে সো লিয়ে"।  

No comments: