“আকাশ কী বিশ্রী রকম নীল দেখেছ”? পকেট থেকে পিতলের ছোট্ট
ডিবেটা বের করে এক চিমটি মশলা জোয়ান মুখে ফেলে বলল পার্থ।
লাঞ্চের পর অফিসের নিচে নেমে খানিকক্ষণ আড্ডা দেওয়াটা প্রায়
অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। অজিত আর দেবনাথের সঙ্গে আড্ডাটাও এই সময় জমে ভালো। দেবনাথ পার্থর
মতই পারচেজ ডিপার্টমেন্টে কাজ করে, অজিত রয়েছে ফাইনান্সে। খেলাধুলো, সাহিত্য,রাজনীতি, সিনেমা
থেকে অফিস-গসিপ; আড্ডা থেকে কিছুই বাদ থাকে না। তবে যা দিনকাল পড়েছে কোনও আড্ডা-তর্কই
তো বেশি দিন চলে না। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ওদের তিনজনের এই দুপুরের আড্ডার বয়স
প্রায় এক বছর হতে চলেছে। দিনের এই সময়টুকু বেশ প্রিয় ছিল পার্থর। সবচেয়ে বড় কথা
ওদের তিনজনের মধ্যে গল্প বেশ জমেও ভালো, বেশির ভাগ ব্যাপারেই ওদের মতামত অদ্ভুত
ভাবে মিলে যায়। মিনিট পনেরো গল্প করে একটা
সিগারেট ধরায় তিন জনে, তার দশ মিনিটের মাথায় যে যার কাজে ফেরত যায়।
আজকেও যথারীতি দুপুর দেড়টা নাগাদ অফিসের ক্যান্টিনে
খেয়েদেয়ে তিনজনে মিলে নিচে নেমে এসেছিল। কিন্তু আগামীকাল থেকে অজিত আর থাকবে না,
তিনজনের আড্ডার আজই শেষ দিন। ভাবতেই পার্থর মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। অজিতের মত ফুরফুরে
মেজাজের মানুষ বড় একটা দেখা যায় না। কাজেকর্মেও একই রকম চটপটে। তাছাড়া সিনেমা আর
সাহিত্যের ব্যাপারেও ভদ্রলোকের জ্ঞানগম্যি নেহাত কম নয়। সবই ঠিকঠাক চলছিল, হঠাৎ যে
আজ কী হল।
মহাকাব্য নিয়ে কথা উঠেছিল। এ কথা সে কথা হতে হতে মহায়ণ
প্রসঙ্গ উঠেছিল। স্বাভাবিক ভাবেই পার্থ আর দেবনাথ মহায়ণ নিয়ে নিজেদের ভালো লাগার
কথা বলছিল। আজ থেকে শ’খানেক বছর আগে যখন অন্ধকার যুগ চলছিল, তখন মহায়ণের মত মহাকাব্যকেও লোকে হ্যাঠা করত। সে
যুগের হাতে গোনা যে কয়েকজন মহায়ণের গুণগ্রাহী ছিল, তাঁদেরও এই অপূর্ব সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ
মহাকাব্যের রসাস্বাদন করতে হত গোপনে। অথচ আজকে সেই মহায়ণ বিশ্ব-দরবারে সমাদৃত, সে
কাব্যের অংশ বিশেষ আজ জাতীয় সঙ্গীত, এ নিয়ে দেশের প্রত্যেক মানুষেরই গর্বিত হওয়া
উচিত; পার্থ আর দেবনাথের ভাবনাও আর পাঁচটা প্রগতিশীল ভারতীয়র মতই তেমনটাই মনে করত।
কিন্তু আজকের চমৎকার আড্ডাটা নষ্ট হল অজিত বেমক্কা উলটো কথা বলায়।
“মহায়ণ অত্যন্ত সস্তা আর নিম্নমানের”। অজিতের এই কথাটা শুনে
পার্থ আর দেবনাথ দু’জনেরই মাথা ঘুরে গেছিল।
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছ”? দেবনাথ আর পার্থ দু’জনে মিলে
অজিতকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে ব্যাটার জেদ কম নয়। বার বার বলে গেল মহায়ণ
নাকি কাব্য-গুণে অত্যন্ত নিম্নমানের। তর্ক শুরু হল, এ’দিকে হাতে সময় কম ছিল।
তার ফলে যা হওয়ার হল। দেবনাথ রাস্তা থেকে একটা আঁধলা ইট
ছুঁড়ে মারল অজিতের মাথা লক্ষ্য করে। অজিত একটা ঘা খেয়েই পালাতে চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু পার্থ ওকে বাধ্য হয়ে জাপটে ধরে ফেলল। ব্যাটাচ্ছেলের একে গায়ের জোর নেই তার
ওপর নিজে একজন হয়ে দু’জনের সঙ্গে তর্ক জুড়েছে। ওকে মাটিতে ফেলে ওর পেটে দমাদম লাথি
মারা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। অবশ্য এমন তর্ক কফি হাউসে হলে আজকাল খুব সুবিধে। সে’খানে
টেবিলে টেবিলে আজকাল অ্যাসিডের বয়াম আর অজস্র
পেরেকওলা লাঠি রাখা আছে। দুর্বল তর্কবাজের হাড়গোড় ভেঙে, নাড়িভুঁড়ি বের করে দেওয়ার আর
বহুরকমের সরঞ্জাম রয়েছে সে’খানে। এমন কী তর্কবাজকে পুরোপুরি নিকেশ করতে ইলেকট্রিক
স্লো বার্নিং চুল্লিরও ব্যবস্থাও চালু হয়েছে গতবছর থেকে। সরকারের আমজনতার তর্ক-তৃপ্তির
খাতিরে এমন অনেক প্রগতিশীল ব্যবস্থা চালু করেছে ইদানীং; ভাগ্যিস। শোনা যাচ্ছে
জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য অ্যাসিডের বয়াম আর পেরেক-লাঠি প্রত্যেক পাড়ার প্রত্যেক
রোয়াকে রাখার প্রপোজাল আসছে পরের পঞ্চবার্ষিকী যোজনায়। পাড়ায় পাড়ায় তর্ক-নিকেশ চুল্লির ব্যবস্থা এখনই
করা যাচ্ছে না জমির অভাবে।
যা হোক, পার্থ আর দেবনাথের কাছে তর্কজয়ের জন্য সে’সব আধুনিক
সুযোগ সুবিধে না থাকায়, হাতের কাছের জিনিসপত্র নিয়ে কাজ সারতে হল। ফুটপাথে অজিতের
মাথা ঠুকতে ঠুকতে যখন অজিতের মাথা থেকে ঘিলু রক্ত সব বেরিয়ে আসছে তখন পার্থর খেয়াল
হল লাঞ্চের সময় প্রায় শেষ। তর্ক এখুনি শেষ না করলে সিগারেট খাওয়ার সময় থাকবে না।
সে’বার বাস ভাড়া নিয়ে গণ্ডগোল হওয়ার পর থেকে এক শিশি পেট্রোল নিয়েই ঘোরে পার্থ, সে’টাই
অজিতের গায়ে ছড়িয়ে দিল সে। দেবনাথ ইঙ্গিত বুঝতে তৎক্ষণাৎ নিজের জ্বলন্ত লাইটারটাই
ছুঁড়ে ফেলল অজিতের গায়ে। অমনি দাউদাউ করে তর্ক ফুরিয়ে গেল।
জোয়ান চিবুতে চিবুতে পকেট থেকে গোল্ডফ্লেকের প্যাকেট বার
করেই জিভ কাটল পার্থ। এই যাহ! দেবনাথ নিজের লাইটারটা নষ্ট করে ফেলল এ’দিকে পার্থ
নিজের লাইটারটা অফিসের ড্রয়ারে ফেলে এসেছে। অগত্যা সিগারেট না খেয়েই দু’জনকে অফিসে
ফিরতে হল। অজিতের ডিপার্টমেন্টে একটা মেমো পাঠিয়ে খবরটা জানিয়ে দিতে হবে। পার্থ আর
দেবনাথ যখন অফিসের সদর দরজার সামনে তখন আকাশের নীল অনেকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে অজিত-পোড়ানো
ধোঁয়ায়।
No comments:
Post a Comment