গুপ্তিপাড়ার পুটুপিসির আনা সম্বন্ধটা বেশ মনে ধরেছিল মন্টুবাবুর। ফটোতেও কমলার হাসিটা কী উজ্জ্বল, মন ভালো করা। পিসি একপ্রকার ধাঁতানি দিয়েই বলেছিলেন "মেঘে মেঘে বেলা তো কম হল না। কলকাতায় একা একা বাউণ্ডুলে হয়ে আর কদ্দিন পড়ে থাকবি? চাকরীবাকরী করছিস, এ'বার বিয়ে করতেই হবে"।
মন্টুবাবু গাঁইগুঁই যে'টুকু করেছিলেন সে'টুকু স্রেফ লজ্জায়। আদতে ভদ্রলোকের বড় শখ ছিল একটা বিয়ের। আয়নায় সাঁটানো টিপ, কাচে তুলে নেওয়া টিপের ফেলে আসা আঠার ছাপ। আলনায় রংচঙ। আলমারির ছোট লকারে দু'টো হার, কয়েক গাছা চুরি, চার জোড়া দুল। বাথরুম থেকে ভেজা পায়ে বেরোলে মুখ ঝামটা, যার ঝাঁজ ডাইলুট হয়ে যাবে চুরির খনরখনে। ড্রেসিংটেবিলে চোদ্দ রকমের ক্রীম আর লোশন, ঘরময় ফুরফুরে পন্ডসিও সুবাতাস। শীতে চেসমী গ্লিসারিন সাবান, বাকি সময় মোতি স্যান্ডালউড। হপ্তায় একবারের বেশি দু'বার 'মাংস খাবো' গোছের হাভাতে স্লোগান তুললেই ভুঁড়ির খোঁটা খাওয়া। চটপট একটা এলআইসি আর খান কয়েক মিউচুয়াল ফান্ডের কথা ভাবতে হত। মেডিক্লেমটা আর একটু পোক্ত করতে হত। বছরে একবার রাজস্থান বা দার্জিলিং।
আর ছুটির দিনগুলোয় বৌয়ের একবার পরা শাড়িগুলো নিয়ে বসতে হত ইস্তিরি করতে। মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে গুছিয়ে বসে। অপার মনোযোগ দিয়ে ছাপার থেকে তাঁতে, এ রঙ থেকে ও রঙের ওপর ইস্তিরি বোলানো। রান্নাঘর থেকে ডালে ফোঁড়ন দেওয়ার মনমোহিনী গন্ধ ভেসে আসবে। শাড়িগুলোকে পরিপাটি করে বাধ্য গরুদের মত গুনে গুনে আলমারির গোয়ালে চালান করা, আহা। মাংস কষানোটা আবার পুরুষের হাতেই ভালো হয়, মন্টুবাবু সে দায়িত্ব নিজের কাঁধেই রাখতে চান।
কিন্তু স্বপ্ন থাকলেই তো সবসময় স্বপ্নপূরণের পথে পা বাড়ানো সম্ভব হয় না। শত ইচ্ছে থাকলেও মন্টুবাবুকে শেষ পর্যন্ত গুপ্তিপাড়ার ঠিকানায় কমলার ছবিটা ফেরত পাঠাতে হল। মেয়েটার চোখ দেখে বোঝা যায় ওর মনটা কতটা ভালো, কী ভীষণ নিষ্পাপ। অফিসের মানুষজন, পাড়ার কিছু মানুষ আর ছ'মাসে ন'মাসে দেখা হওয়া পুটুপিসিকে ঠকানো যায়। কিন্তু কমলাকে বিয়ে করে অমন দাগা মন্টুবাবু কিছুতেই দিতে পারবেন না।
পাড়া অফিসের লোক আর পিসি আঁচ করতে না পারলেও, ঘরের বৌ কি টের পাবে না? যে বছর দুয়েকে আগের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষদের যে লিস্টিখবর কাগজে বেরিয়েছিল তাতে মন্টুবাবুরও নাম ছিল? বৌ কি টের পাবে না যে মন্টুবাবু হপ্তায় একবার মর্গের সেই ঘরটায় ফেরত যান যে'খানে দু'বছর আগে নিজের বডিটা ফেলে আসতে হয়েছিল?
No comments:
Post a Comment