রাধাবিনোদবাবু একা মানুষ। অনেক চেয়েও কারুর সাতপাঁচে
থাকা হয় না। কদ্দিন যে একা আছেন তার ইয়ত্তা নেই। কদ্দিন। কতদিন। এই বাড়িতে তিনি
চিরকালের একা। বাড়ি বলতে দু’কামরার একরত্তি আস্তানা, তার সামনে ছোট্ট উঠোন। উঠোন কিছু
গাঁদাফুল আর শাকসবজির গাছপালা। একটা কাঠবেরালির গুষ্টি সে বাগানেই আছে বটে, তবে তারা
বংশানুক্রমে রাধাবিনোদকে পাত্তা দেয় না। এ’টাই ওদের ট্র্যাডিশন।
যেমন রাধাবিনোদবাবুর ট্র্যাডিশন হল একা
থাকা।
অনেক ছোটবেলায় এক পিসিমা ছিলেন সঙ্গে। তবে
সে পিসিমার মুখ বড় একটা মনে পড়ে না। পিসিমার স্মৃতি বলতে পিসিমার বিড়বিড়ানি। বুড়ি
একটানা বিড়বিড় করে যেতেন, তাঁর থেকেই মন্ত্রটা প্রথম শিখেছিলেন রাধাবিনোদবাবু;
“ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত
বেশি”।
রাধাবিনোদবাবুর শোওয়ার ঘরের দক্ষিণের দিকের
দেওয়ালে ঝোলানো ছবি; তা’তে লেখা “ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”।
রাধাবিনোদবাবুর খাটের পাশে রাখা ছোট্ট বেতের টেবিল; সেই টেবিলের ওপর রাখা একটা
কাচের গেলাস আর একটা বই।
খয়েরী চামড়ায় বাঁধানো বই; যার নাম হল “ফাঁসি
ভালো না ইলেকট্রিক চেয়ার”? বইটা ইয়াম্মোটা। হাজার দেড়েক পাতার বই। তবে গোটা বই
জুড়ে একটাই লাইন বার বার লেখা; “ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে এই বইয়ের খান তিরিশেক পাতা না পড়লে রাধাবিনোদবাবুর কিছুতেই ঘুম
আসতে চায় না; ছোটবেলার অভ্যাস যে।
বাইরের ঘরের সোফার পাশের দেওয়ালে ঝোলানো
আড়াইশো বছরের ক্যালেন্ডার। সে ক্যালেন্ডারে গাঁদা ফুলের ছবি; তার নিচে লেখা; “ফাঁসিতে
ঝোলার চেয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”। দিনের শেষে সেই তারিখে দাগিয়ে দেওয়াটা
রাধাবিনোদবাবুর আরও একটি অভ্যাস।
রাধাবিনোদবাবুর আরও একটি অভ্যাস আছে; খবরের
কাগজ পড়ার। ভোর বেলা মুখ ধুয়ে কাগজ না নিয়ে বসলে তার হয় না। “দৈনিক ইলেকট্রিকচেয়ার
সংবাদ”। কাগজ জুড়ে রোজই থাকে ইলেকট্রিক চেয়ারের দুনিয়ার রংবেরঙে খবরাখবর। অবশ্য ফাঁসি
বিরোধী খবরাখবরও যে দু’একটা থাকে না তা নয়। এ কাগজ পড়া না হলে রাধাবিনোদবাবুর মুখে
জলখাবার রোচে না।
তবে খবরের কাগজ আর একটা বই উলটে পালটে
কতক্ষণ আর সময় কাটে। মাঝেমধ্যে তিনি নেমে পড়েন বাগানের পরিচর্যায়। তখন তাঁর কোমরে
কষে বাঁধা থাকে গামছা, হাতে খুপরি আর মুখে লোকগীতি;
“ফাঁসিতে ঝোলার চেয়ে ও ভাই,
ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”।
সে গানের যেমন সুর, তেমনি মন কেমন করা গানের
কথা। বুকে আরাম লাগে।
তা, একরকম একাএকাই দিন কেটে যাচ্ছিল
রাধাবিনোদবাবুর। মাঝেমধ্যে একঘেয়ে লাগে বটে, তবে কী আর করা যাবে।
এইসব কিছুর মধ্যেই একটু বেহিসাব ঘটে গেল এই
সেইদিন।
হঠাৎ একদল পেয়াদা এসে হাজির। রাধাবিনোদ
সেলাম ঠুকে জানতে চাইলে ব্যাপারটা কী।
পেয়াদাদের সর্দার গলায় জানালে যে রাজাবাহাদুরের
শমন নিয়ে এসেছে সে।
রাজাবাহাদুরের ইচ্ছে হয়েছে রাধাবিনোদের
বাড়িটা ভেঙে সেখানে একটা বিড়ির দোকান বসাবেন। রাজার আদেশ, রাধাবিনোদকে নিকেশ করে
তাঁর জমি বাড়ি কব্জা করতে হবে; তারপর সে’খানে বসবে এলাহি এক বিড়ির দোকান।
তবে রাজাবাহাদুর অবুঝ পাষাণ নন। তিনি নিজে
জানতে চেয়েছেন যে রাধাবিনোদবাবুর ফাঁসিতে ঝুলতে বেশি ভালো লাগবে না ইলেকট্রিক
চেয়ারে বসতে। আনন্দে চোখে জল এসেছিল রাধাবিনোদের। একটু খটকা ছিল অবশ্য মনে, তাই
তিনি একবার মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন;
“পেয়াদা ভাই, তুমি বলছ বটে আমার কান্নাটা
আনন্দের। তবু বুকের ভিতর থেকে দুঃখ দুঃখ মার্কা পোড়া গন্ধ আসছে কেন”?
“পোড়া গন্ধ? পাগল হলে নাকি রাধাবিনোদ। খোশবু
বলো। রাজা তোমার পছন্দ অপছন্দ জানতে চেয়েছেন। এমন নসীব ক’জনের হয় বলতে পারো? তাই
তোমার বুকে আনন্দের ঢেউ। এই খোশবু আনন্দের। আর তোমার চোখের জলও, আনন্দের চোটে বইছে”।
অমনি সমস্ত ধন্দ কেটে গেছিল রাধাবিনোদের মন
থেক। সে গুনগুন করে গেয়ে উঠেছিল;
“ফাঁসিতে
ঝোলার চেয়ে ও ভাই,
ইলেকট্রিক চেয়ারে ইজ্জত বেশি”।
সুরে মোহিত হয়ে পেয়াদা সর্দার বলেছিলেন; “আহা,
তোমার গলায় কী অপূর্ব সুর ভায়া রাধাবিনোদ। আরও গাও দেখি খানিকক্ষণ”।
পরের দিন “দৈনিক ইলেকট্রিক চেয়ার সংবাদ”য়ের
প্রথম পাতার অর্ধেকটা জুড়ে ছিল রাধাবিনোদের হাসি হাসি ছবি। শিরোনাম; “রাজ্যের
স্বার্থে স্বেচ্ছায় ইলেকট্রিক চেয়ার বরণ করলেন মানবশ্রেষ্ঠ রাধাবিনোদ”।
1 comment:
kathberali te "Daw-e Shunyo Raw" hobe
Post a Comment