Wednesday, February 28, 2018

সৈন্যদল


- জাহাঁপনা!
- উঁ...। 
- জাহাঁপনা!
- ধ্যার। আবার কী হল? শান্তিতে একটু দেশলাই কাঠি দিয়ে কান খোঁচাব তারও উপায় নেই। থেকে থেকে জ্যাঁহ্যাঁপঁন জ্যাঁহ্যাঁপঁন। কী চাই?
- আসলে হয়েছে কী জাহাঁপনা...। 
- বুঝলে মন্ত্রী, তোমায় নিয়ে এই এক সমস্যা। ধানাইপানাই ছাড়া কোনও কথা বলতে পারবে না। ঢেঁকুরের কথা বলতে এসে আগে বলবে বাসি লুচির গল্প। ধেত্তেরি। আমি এখন ব্যস্ত। তুমি পরে এসো'খন। 
- জাহাঁপনা, ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী। 
- বটে?
- আজ্ঞে। 
- জরুরী?
- রীতিমত। জাহাঁপনা। 
- আমার যে পা মালিশের তেল গরম হয়ে গেছে। আর যে সময় নেই হাতে। 
- কয়েকটা ব্যাপারে আপনার হুকুম বড় দরকারি...। 
- তোমার মাইনেটা এ'বার থেকে আমাকেই দিও। আমাকেই যখন সব সামাল দিতে হবে তখন...।
- হুকুম দিন। আমিই তবে সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে ফেলি...। 
- সিদ্ধান্ত? তুমি কি রাজা?
- আজ্ঞে না। 
- তবে তুমি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কে? তুমি কি চক্রান্ত করছ আমার বিরুদ্ধে? ব্যাটাচ্ছেলে! দুধ কলা মদ দিয়ে আমি কালসাপ পুষছি?
- আমি ও'ভাবে বলতে চাইনি জাহাঁপনা। 
- পিঠে ছুরি ঢোকাবে তার আবার ও'ভাবে এ'ভাবে কী?
- একটু শুনুন আমার কথাটা মহারাজ! সেনাবাহিনী বড় বিপদে রয়েছে। 
- সেনাবাহিনী বিপদে? কে বলেছে?
- আজ্ঞে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পত্রবাহক এসেছে যে। 
- মহা-মুশকিল। ওদের অমুকপুর জয় করতে পাঠিয়েছি না ওখানে গিয়ে বুকে বালিশ নিয়ে চিঠি লিখতে বলেছি? অমুকপুরের সেনা আর প্রজাদের খুনটুন না করে ওরা চিঠি লিখছে কেন? আমি কি মেঘবালিকা? 
- তারা খুব বিপদে পড়েছে?
- বিপদ? কচুকাটা করার লোকের অভাব পড়েছে? অনুশীলনে ব্যাঘাত? ওদের চিন্তা করতে বারণ করো। অমুকপুরে চন্দন কাঠের জঙ্গল বগলদাবা করে তাঁদের যেতে হবে তমুকপুরে। সে'খানে রয়েছে অঢেল লোহা। আর অঢেল বোকাপাঁঠা মানুষজন যাদের কুচিকুচি না করতে পারলে শান্তি নেই। যা হোক। কথাবার্তা যখন হয়েই গেল তখন আমি যাইগে, পা মালিশ আর কানে পালকের সুড়সুড়ি। এক জাতের পাহাড়ি শকুনের পালক আনিয়েছি বুঝলে মন্ত্রী। কানে ছোঁয়ালেই.....জাদু!
- আজ্ঞে জাহাঁপনা, কথাটা বলা হয়নি। 
- আবার কোন কথা? বলে দিলাম তো। অমুকপুর ঘ্যাচাংফু করে সিধে তমুকপুর। তমুকপুর যাওয়ার আগে সেনাবাহিনীকে আমি তিন রাত ধরে মদ মাংস খাওয়াবো। তুমি আবার তখন বাঁধাকপি বাঁধাকপি করে আসর মাটি কোরো না যেন মন্ত্রী। কেমন?
- জাহাঁপনা। আমাদের সেনাবাহিনী বড় বিপদে পড়েছে। অমুকপুরের রাজধানী চন্দনপুর আমাদের হাতছাড়া হতে চলেছে যে। 
- কী? 
- তমুকপুর অমুকপুরে  সৈন্য পাঠিয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। অমুকপুরের সেনাদের সঙ্গে মিলে তারা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তমুকপুরের সেনাদের সঙ্গে এসেছে অত্যাধুনিক কামান, বিষ মাখানো তরবারি...।
- চোপরাও! তোমায় ফর্দ করতে কে বলেছে আহাম্মক?
- গোস্তাখি মাফ জাহাঁপনা। 
- সেনার কী অবস্থা?
- তিন দিক থেকে তাঁদের ঘিরে ফেলা হয়েছে। ইতিমধ্যে আশি হাজার সেনার মধ্যে তিরিশ হাজার নিহত। অপর দিকে কয়েক লাখ সৈন্য। আমাদের রসদ শেষ...টিকে থাকার কোনও সুযোগই নেই। এ'বার আপনি হুকুম দিলে সেনাপতি সৈন্যদল নিয়ে পশ্চাদপসরণ শুরু করতে পারে। 
- পশ্চাদপসরণ?
- যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ জাহাঁপনা। 
- তোমার মাথা। 
- আজ্ঞে?
- কেউ পিছু হটবে না। তোমরা শোনোনি জননী জন্মভূমিশ্চ ওই কী একটা যেন? 
- জাহাঁপনা, আমরা অন্যদের ভূমি দখল করেছি। আমাদের জন্মভূমি ঠিক ও'টা নয়। কাছেই এ'তে কোনও অসম্মান নেই। বরং এখনই রণভঙ্গ দিলে সেনাবাহিনীর কচিকাঁচা ছেলে ছোকরাগুলোকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হবে না। 
- এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি আমার মন্ত্রী হয়েছ? ওরে মূর্খ, অমুকপুর এখন আমার। আলবাত ও'টা এখন আমাদের দেশ। আমাদের রক্তের শেষ বিন্দু পর্যন্ত দেশের মাটি ছাড়া চলবে না। শেষ সৈন্য বেঁচে থাকতে আমি সেনাবাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করার অনুমতি দেব না, বুঝলে? 
- কিন্তু মহারাজ এ যে তাঁদের নিশ্চিত মৃত্যু...। 
- তোমার চামড়া তুলে তা দিয়ে পাশবালিশের ওয়াড় দিলে যদি শান্তি পাই। সৈন্য মরবে না তো কি মরবে আমার বাগানের মালী? ওদের মাইনে দিয়েছি কী করতে? ওরা যুদ্ধ হেরে না মরে ফিরে এলে আমার নাক আস্ত থাকবে ভেবেছ?
- যে আজ্ঞে মহারাজ। 
- ও চিঠির উত্তর দাও। পিছু হঠার উপায় নেই। সবাইকে আমি মরণোত্তর মহাবীর উপাধি দেব। আর পিতলের শংসাপত্র। 
- যে আজ্ঞে। 
- আর শোন। 
- জাহাঁপনা?
- জল্লাদকে ডেকে আন। 
- কেন? 
- কেন? ন্যাকা! ভাজা মাছ উল্টোতে গিয়ে থালা পালটি করে ফেলেছে। তোমা শূলে বসতে হবে। 
- জাহাঁপনা! আমি কী করলাম?
- আমার পা মালিশের তেল যে ঠাণ্ডা হয়েছে তোমার জন্য। দেশের ক্ষতি করে দশের ক্ষতি করে সটকে যাবে ভেবেছ? আমি কি অতটাই বোকা? 

Monday, February 26, 2018

খোকা আর দেশ



আহ্। খোকা।


কত ভালোবাসার। নার্সিংহোমে প্রথম কোলে নেওয়া তুলতুলের। মিহি কুঁইকুঁই কান্নার মিঠে সুর বুকে আগলে নেওয়ার। খোকা।



নরমস্য নরম আঙুলের ছোঁয়ার। নাহ্, অপরিষ্কার কর্মব্যস্ত হাতে ছোঁয়া যায়না খোকাকে, ওর গা বড় সরল। আদরের, তাতে ধুলো লাগতে নেই।

খোকার ঘুমে পাখির বাসার ঠুনকো আসবাব, সামান্য শব্দে কেঁপে ওঠে সে। তার মুখের বিরক্তিতে বুকে মোচড় খেলে যায়। অতএব বাড়তি কোনও শব্দ নয়; শুধু ঘুমপাড়ানির মাপা সুর।

সমস্ত ঘাম ধুলো শুষে নিক বাবার জামা, মায়ের কাপড়। সমস্ত সবুজ হোক খোকার। টলটলে চুমু থাক খোকার গালে। খোকার বুকের নরম ধুকপুক শুনুক মায়ের কান, খোকার গালে ঠেসে থাক বাবার সদ্য দাড়ি কাটা গাল।

থাকুক খোকার সামান্য পেটে ব্যথায় 
মায়ের যন্ত্রণা মাখানো ছটফট, 
থাকুক বাবার 'কেন কিছু করতে পারছি না'র কাচুমাচু।

বোমার আঘাতে,রক্তে, ধুলোয়, অমানুষিক যন্ত্রাণায় হতবাক সে খোকার পাথুরে নিশ্চুপ মুখ বুকে বয়ে বেড়াতে কত হাজার বার মরতে হয় তার মা বাবাকে?

খোকার ব্যথায় বাবা কোন সংগ্রাম সান্ত্বনা খুঁজে নেবে? খোকার গাল বেয়ে নামা রক্তে খোকার মা কোন সিরিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, বেহালার হিসেব বুঝে নেবে?

আমার দেশ নেই। সংগ্রাম নেই। যুদ্ধ নেই। 
আমার খোকা আছে। সে থাকার মত করে থাকুক।

সবার খোকা খুকি থাকুক। তারা থাকার মত করে থাকুক।

(২০১৬য় লেখা। আলেপ্পোর যুদ্ধ থমকে দিয়েছিল পাঁচ বছরের এই খোকাকে। খবরের ওয়েবসাইটে তার ছবি দেখা)। 

সিঁড়ি

তিনলায় এক কামরার ভাড়া ঘর। সে'খানে নরেনবাবুর একার সংসার, দিব্যি চলে যায়। দিব্যি চলেও যাচ্ছিল বারো বছর ধরে। একটা চৌকি, একটা স্টোভ, কিছু বাসনপত্র, বিস্কুট চানাচুরের বয়াম, ঘরভাড়া সূত্রে পাওয়া স্টিলের তোবড়ানো আলমারি; ভালো থাকার যথেষ্ট রসদ মজুত রেখেছিলেন নরেনবাবু।

অফিস ফেরতা বাসডিপো থেকে জানালা নিয়ে মৌজ করে বাড়ি ফেরা। বাড়ি ঢোকার মুখে মধুর হোটেল থেকে রাতের খাবার কিনে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে এসে ওঠা। মনোরম গতে বাঁধা পড়ে গেছিলেন তিনি।

এই বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে নামা ওঠার ব্যাপারটা বড় ভালো লাগে তাঁর। অনেকের যেমন অনেক কিছু ভালো লাগে, ঠিক তেমনই। অফিসের  দিলীপবাবুর ভালো লাগে ব্রিজ খেলতে, হালিশহরের ন'কাকা ভালোবাসেন নস্যি নিতে, পাড়ার গণেশ মাতাল ভালোবাসে রামপ্রসাদী; ঠিক তেমনই নরেনবাবু ভালোবাসেন সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় সুরে সুরে সিঁড়ি গুনতে। বেয়াল্লিশ খানা সিঁড়ি। প্রতিদিন নামার সময় গোনেন এক, দুই, তিন থেকে বেয়াল্লিশ। আর ওঠার সময় গোনেন বেয়াল্লিশ, একচল্লিশ,  চল্লিশ থেকে এক। প্রতিবার। প্রতিদিন। কোনওদিন যদি অন্যমনস্ক হয়ে গোনার ছন্দে বাধা পড়ে, তাহলে নেমে বা উঠে গিয়ে ফের প্রথম থেকে শুরু করতে হয়।

তা বারো বছর ধরে সমস্ত কিছু দিব্যি চলার পর আজ সব কেমন গুবলেট হয়ে গেল। মধুর দোকান থেকে বাঁধাকপির তরকারি আর রুটি কিনে দিব্যি সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন। সিঁড়ির গায়ে তখন স্ট্রিটল্যাম্পের আবছা আলো। বাড়িওলা হারু সেনের যত গড়িমসি এই সিঁড়ির কেটে যাওয়া বাল্ব জোড়া বদলাতে। দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে ছপড়ার বুদ্ধিনাথ। বুদ্ধিনাথ সন্ধের এই সময়টা হারমোনিয়াম নিয়ে গাইতে বসে। তার সুর সিঁড়িতে উপচে পড়ে। বুদ্ধিনাথের হারমোনিয়ামের রিড টেপা খটরখটে সিঁড়ি গুনতে দিব্যি লাগছিল নরেনবাবুর।

কিন্তু সমস্ত গোলমাল হয়ে গেল দরজার মুখে। দেশোয়ালি সুরে সাত, ছয়, পাঁচ, চার, তিন গুনে দুই পেরিয়েই দরজা চলে এল। নরেনবাবু খিস্তি করেন না। "শালা"ও শেষ বলেছিলেন গ্র‍্যাজুয়েশনের সেকেন্ড ইয়ারে। কিন্তু এক নম্বর সিঁড়িটা না পেয়ে তিনি ফস্ করে বলে ফেললেন "যাহ্শ্লা"। নিশ্চয়ই কোনও ভুল হয়েছে গোনায়। বুদ্ধিনাথের হারমোনিয়ামের ওপর বড্ড রাগ হল, ওই সুরে তাল মেলাতে গিয়েই হয়েছে গড়বড়। বারো বছরে এই প্রথম সিঁড়ি গোনায় ভুল হল। শরীর আনচান  করে উঠল নরেনবাবুর। এখুনি এ ভুল শুধরে না নিলেই নয়। এ'বার সিঁড়ি গুনতে গুনতে নামতে শুরু করলেন তিনি। এক, দুই, তিন..কিন্তু সে এক সর্বনেশে সন্ধে। একচল্লিশে এসে সিঁড়ি গেল শেষ হয়ে। অস্থির হয়ে আরও অন্তত বার চারেক সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামা করলেন নরেনবাবু। যথারীতি একটা সিঁড়ি কম। বেয়াল্লিশের বদলে একচল্লিশ।

বাড়িওলা হারু সেন থাকেন নিচে। তখুনি তার কাছে ছুটে গেলেন নরেনবাবু। সিঁড়ি কমে যাওয়ার খবরটাকে তেমন পাত্তা দিলেন না হারু সেন। হারু সেন বাড়ির মালিক হয়েও কোনওদিন সিঁড়ি গুনে দেখেননি। অদ্ভুত বেআক্কেলে মানুষ!  কী মুস্কিল। উলটে হারু সেন বলে কিনা "আপনার প্রেশার বেড়েছে। ডাক্তার দেখান"। নরেনবাবু কোনওদিনও কাউকে "আহাম্মক" বলেননি,  আজও হারু সেনকে বললেন না।

বুদ্ধিনাথের নামটাও বৃথা, সে ব্যাটাও কোনওদিন সিঁড়ি গুনে দেখেনি। আরও বার দশেক ওঠা নামা করেও নরেনবাবু বেয়াল্লিশ নম্বর সিঁড়িটা খুঁজে পেলেন না। এক রাশ ভূতের ভয় চেপে ধরল নরেনবাবুকে, সিঁড়িটা গেল কই?

***

~~~ঘণ্টাখানেক আগে~~~

মৃণ্ময়ী কাঁপছিলেন।
এ'খানেই থাকে নরেনদাদা। তাঁর নরেনদাদা। গাঁয়ের মেঠো বিকেলের গন্ধমাখানো নরেনদাদা। ছোটবেলার অভিমানের নরেনদাদা। অঙ্ক শেখানো নরেনদাদা। ইংরেজি গ্রামার ভুল করলে ধমক দেওয়ার নরেনদাদা। স্কুল ছুটির পর সাইকেলের নরেনদাদা।

এই হল নরেনদাদার আস্তানা। এ পাড়ায় এসে তাঁকে দেখতে পেয়েই ঠিক চিনেছিল মৃণ্ময়ী। বহু চেষ্টায় খুঁজে পেয়েছে তাঁর ঠাঁই। দুপুর রোদের আবডালে তাই ছুটে এসেছিল। নরেনদাদা এই সময় অফিসে থাকে, দেখা হওয়ার ভয় নেই। চিঠিখানা নিশ্চিন্তে দেওয়া যাবে। সামনাসামনি না হোক, অন্তত চিঠি লিখে মনের কথাটা জানাতে চায় মৃণ্ময়ী।  নরেনদাদাকে চিৎকার করে বলতে চায় মৃণ্ময়ী যে তাঁর মিনু ভালো সম্বন্ধের লোভে তাঁকে ঠকায়নি। বলতে চায় নরেনদাদার জামার হাতা সে আজও একই রকম ভাবে টেনে ধরতে চায়। ভালোবাসে। সংসারের ভয়ে নরেনদাদার সামনে আসতে পারবে না বটে, কিন্তু ভালোবাসে। নরেনদাদার কথা মনে পড়লে বুক ভেঙে কান্না আসে, কেউ জানতে পারে না। সে সমস্ত কথাই চিঠিতে লিখেছিল মৃণ্ময়ী। সে লিখেছিল যে আজকাল সেও নরেনদাদার মত সুযোগ পেলেই সিঁড়ি গোনে। সিঁড়ি গুনলে নরেনদাদার সুবাস নাকে আসে যে। তার নরেনদাদা। নরেনদাদার এই বাসায় বেয়াল্লিশটা সিঁড়ি।

কিন্তু নরেনদাদার দরজার কাছে পৌঁছে থমকে গেলেন মৃণ্ময়ী। হাতের চিঠি দরজার নিচে গুঁজে দেওয়ার কথা। কিন্তু কী হবে নরেনদাদাকে অকারণ জ্বালিয়ে? তাঁর দুঃখ জেনে নরেনদাদা করবেটাই বা কী? হয়ত নরেনদাদা সুখে আছে, এই চিঠিতে বরং তাঁর সুখে আগুন লাগবে। শেষ সিঁড়িতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলে সে। বড় কান্না পেল।
বহুক্ষণ পর নিজেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে আনলে মৃণ্ময়ী। চিঠিটা নষ্ট হল। কী অদ্ভুত, নামার সময় ফের গুনে মাত্র একচল্লিশটা সিঁড়ি পেলে মৃণ্ময়ী। ওঠার সময় ভুল গুনেছে না নামার সময়; তা নিয়ে ভাবার সময় ছিল না তার।

নরেনদাদার বাড়ি থেকে সোজা ঘাটের দিকে ছুটে গেছিল মৃণ্ময়ী। এর আগে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে বহুবার শেষ সিঁড়ি পর্যন্ত নেমে গেছে সে। সে জানে যে বত্রিশ নম্বর সিঁড়ির পরেই অথৈ জল। অনেকে এ ঘাটে এককালে ডুবে মরেছে। আজকাল বড় একটা কেউ আসে না। মৃণ্ময়ী আসে। নরেনদাদার কথা বুকে বাজলেই আসে। কতবার ভেবেছে ঘাটের বত্রিশ নম্বর পেরিয়ে নিজের সাঁতার না জানা শরীরটাকে ভাসিয়ে দেবে সে। কতবার। বত্রিশ নম্বর সিঁড়ি থেকে এক পা বাড়িয়ে গোড়ালি ডুবিয়েওছে। পারেনি।
কিন্তু আজ পারার কথা। নিজেকে চিঠিশুদ্ধু ডুবিয়ে দেওয়াটা আজ বড় সহজ মনে হচ্ছিল মৃণ্ময়ীর।

দুপুর রোদের খাঁখাঁ ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল মৃণ্ময়ী;
"নরেনদাদা, মিনু তোমায় মরার দিন পর্যন্ত ভোলেনি গো"। তিরিশ একত্রিশ পেরিয়ে বত্রিশ নম্বর সিঁড়িতে এসে দাঁড়ায় নরেনদাদার মিনু। মন শক্ত করে।

"আসি নরেনদাদা" বলে ডান পা এগোতেই তেত্রিশ নম্বর সিঁড়িতে পা পড়ল মৃণ্ময়ীর। এতদিন ধরে সিঁড়ি ভুল গুনেছে মৃণ্ময়ী? সে নিশ্চিত তা কিছুতেই সম্ভব নয়। ঘাটের এই বাড়তি সিঁড়িটা এলো কোথা থেকে?

হতবাক মৃণ্ময়ীর নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া হল না।

Tuesday, February 20, 2018

পোস্টঅফিস



সে আকাশ সবসময় মেঘলা। ঘোলাটে, তবে গুমোট নয়। বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ কিন্তু ঝেঁপে নামার কোনও লক্ষণ নেই। সে আকাশের নিচে দাঁড়ালে মনকেমন জাঁকিয়ে বসে, অথচ ভালোলাগাটুকুও দিব্যি রয়ে যায় অল্প শীতে গায়ে জড়ানো ভাগলপুরি চাদরটার মত।

সে ছলছলে আকাশের নিচে জুবুথুবু এক লাল পাথুরে টিলা। আর সে টিলার  মাথায় ছোট্ট লাল বাড়িটা আদতে একটা পোস্টঅফিস।

সে পোস্টঅফিসের ঘর ছোট্ট হলে কী হবে, তা'র ভিতরে জায়গার অভাব নেই। স্তুপ স্তুপ চিঠি জমা হয় সে'খানে। ঘরের এক কোণে এক সাতপুরনো টেবিলের গা ঘেঁষে রাখা এক মচমচে জীর্ণ চেয়ার আলো করে বসে থাকেন পোস্টমাস্টার অনন্তবাবু।

এই পোস্টঅফিসে তিনিই পোস্টমাস্টার, তিনিও পিওন, তিনিই আর্দালি। এত কাজ তাঁর অথচ ব্যস্ততা ব্যাপারটা অনন্তবাবুর ধাতে সয় না। মেঘলা হাওয়ার মতই তার মেজাজে সামান্য আয়েশি ফুরফুর রয়েছে সর্বদা, কানে তাঁর সর্বক্ষণ সরোদের আশ্বাস। ফিনফিনে নীল ফতুয়া আর ঢলা পাঞ্জাবিতে একা গোটা পোস্ট অফিস সামাল দিয়ে থাকেন অনন্তবাবু। অবশ্য ব্যস্ত হয়েই বা কী লাভ হত, এ'খানে প্রতি মুহূর্তে স্তুপ স্তুপ চিঠি জমা পড়ে। কোনও কোনও চিঠি দিস্তেদিস্তে অভিমানে সুদীর্ঘ,  কোনওটা আবার দু'কলমের ফিক হাসি। 'পথ হারাবো বলেই এ'বার পথে নেমেছি'র সুরে নিজেকে উল্টেপাল্টে নিয়ে স্তুপ স্তুপ চিঠির জমা হওয়া দেখেন তিনি।

কখনও কখনও;
যখন সামান্য কাজ করার লোভ মনের মধ্যে জড়ো হয়, তখন হয়ত অনন্তবাবু নিজের চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে দু'একটা চিঠি হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখেন। তারপর ঠিকানা মিলিয়ে,স্টাম্প মেরে; সে চিঠি হাতে বেরিয়ে পড়েন অনন্ত পোস্টমাস্টার। তখন অবিশ্যি তাঁকে পোস্টমাস্টার বলা চলে না, তখন তাঁর পরিচয় টেলিপ্যাথি-পিওন।

না-লেখা-চিঠির পোস্টঅফিসের পোস্টমাস্টার হওয়া যে কী হ্যাপা, তা অনন্তবাবুই জানেন।

Thursday, February 15, 2018

ডুব

- হাত বাড়িয়ে দে খোকা। দে!
- পারছি না।
- চেষ্টা কর। ঠিক পারবি।
- মাগো, পারছি না।
- পারবি। আর একটু। আর একটু এগিয়ে আয়। হাত দে। হাত দে বাবু।
- মা, বড় কষ্ট। বড় শীত। বুকজল মা। বড্ড কাঁপুনি...।
- কথায় কাজ নেই খোকা। হাত দে। হাত দিতেই হবে। দ্যাখ। দিব্যি টেনে তুলব। আয় বাবা। আয়।
- মাগো। বুকে কষ্ট মা। শ্বাস আটকে যায়।
- কাঁদে না খোকা। এর বড় ছেলে হয়ে কাঁদতে আছে?
- দুপুরের গন্ধ নাকে আসে মা। গরমকালের দুপুর। তুমি বলতে ঘুমো। বিল্টু ডাকতে আসত। ফুটবল। আমতলার মাঠে।
- বিল্টুকে দেখবি না খোকা? চ'। বাড়ি যাব। চ'।
- মাগো। বিল্টুর বাড়ির ছাদে দু'টো নয়নতারার চারা মা।
- চোখ বুজতে নেই খোকা। তাকা। এই যে আমি বাবু। হাত বাড়িয়ে দে। আয় সোনা।
- গলাজল মা। আর যে ভেসে থাকতে পারি না।  যন্ত্রণা।
- আয় বাবা। আয়। আসতে হবেই।
- অন্ধকার মা। বড় জ্বর।
- কাঁদে না খোকা।
- তোমার গায়ে মোমের গন্ধ। যেতে দিও না মা।
- হাত দে না খোকা। দে। আয়...আয় বাবা।
- তোমার ওই নীল শালে কী গরম মা। মাগো।
- আয়।
- ডুবে যাই যে। আর যে ভাসতে পারি না।
- কাঁদে না বাবা।  আছি তো।
- আসি মা।

***

- আসি মা।
- দু'দিন থাকবি না খোকা?
- প্রতিবার সেই একই কথা। জানোই তো মা। কাজ তো কম পড়ে নেই।
- বিল্টু তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল এই সেদিন।
- ওকে বোলো পারলে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে না বেড়িয়ে একবার অফিসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ইফ হি নীডস এনি হেল্প। আসি মা।
- আয়।

Wednesday, February 7, 2018

ধুরন্ধর বটু গোয়েন্দা

- এ কী! দোর্দণ্ডপ্রতাপ দারোগা গোবিন্দ হালদার সকাল স্বয়ং সকাল এই অধমের বাড়ি?
- বটুবাবু! বাজে কথা সময় নেই। গামছা পরে খালি গায়ে নিমের দাঁতন মুখে মৌরুসিপাট্টাও চলবে না। শার্ট আর প্যান্টেলুন গলিয়ে চটপট বেরিয়ে আসুন। ক্যুইক।
- ক্যুইক? সে সম্ভাবনা নেই স্যার। কী কুক্ষণেই যে দার্জিলিং-অরেঞ্জ ফ্লেভারের ইসবগুল নিয়েছিলাম। রঙেই বাহার, কাজে অষ্টরম্ভা।
- দোহাই বটুবাবু। আপনার ওই নক্সাটক্সা এখন বাদ দিন। মেজর ক্রাইসিস। আপনি অকুস্থলে না পৌঁছলে আমার প্রমোশনটা ঝুলে যাবে।
- ঘটেছেটা কী?
- বিস্ফোরণ মশাই।
- এক্সপ্লোশন?
- আহ। ও'টা ফিগারেটিভলি বলা, তবে এ'টা এক্সপ্লোশনের বাবা। চুরি। তাও খোদ এমএলএর বাড়িতে।
- হরেকেষ্টবাবুর বাড়িতে চুরি?
- আলমারির লকার ভেঙে। কুড়ি লাখ গন।
- বাড়ির আলমারির লকারে কুড়ি লাখ? প্রমোটারির কমিশনে বাড়াবাড়ি রকমের দাঁও মারতে শুরু করেছিলেন ভদ্রলোক। চোর তো সোশ্যাল ওয়ার্ক করে গেছে স্যার। যাক গে, তবে এই চুরির ব্যাপারে আমি কী করব? বটু গোয়েন্দা পাড়ায় পাড়ায় চোর খুঁজতে বেরোবে?
- হরকেষ্টবাবুর ধারণা চোর বাড়ির কোনও চাকরই হবে। চুরি হয়েছে আজ ভোর রাত্রে। বাইরে থেকে কেউ দরজা ভেঙে ঢোকেনি, সিঁদ কাটেনি। শুধু লকার ভাঙা।
- ক'জন চাকর বাড়িতে?
- সাতজন।
- সাতজন চাকর? বাড়িতে আছে ক'জন?
- হরকেষ্টবাবু আর তাঁর গিন্নী।
- দু'জন মানুষের সাতজন সেবায়েত?
- দু'জন রাঁধুনি। দু'জন ড্রাইভার। দু'জনে ঘরের অন্যান্য কাজ। একজন মালি। সকলেই তাঁর বাড়িতেই থাকে। সবাইকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। এখন আপনি গিয়ে জেরা করবেন। বটুবাবু, প্লীজ। ক্যুইক।
- লাল চা খাবেন? কন্সটিপেশনে হেল্প করে।
- আপনি আমার কথার তোয়াক্কা করছেন না। অবিশ্যি প্রমোশন গেলে আমার যাবে। এমএলএর রোষে জঙ্গলে ট্রান্সফার হবে আমার। আপনার কী? আমি আপনার জন্য কীই বা করি? বর্ষায় বড় জোর ইলিশ খাওয়াই, আর গ্রীষ্মে আম, আর শীতে নলেনের রসগোল্লা। সে তো আমার বদলে যে দারোগা আসবে সেই খাওয়াবে। বটু গোয়েন্দার ব্রেন ছাড়া তো আর দারোগাদের চলবে না। আপনি নিশ্চিন্তে বানান লাল চা। আমি আসি।
- আরে চটছেন কেন দারোগাবাবু। দু'মিনিট ধৈর্য ধরে বসুন। তা'তে আখেরে আপনার বেনিফিট।
- আর বেনেফিট। সকাল থেকে হরকেষ্টবাবু "নিনকম্পুপ দারোগা" বলে ঘেউঘেউ করতে করতে পায়চারী করে চলেছেন। আমার সব গেল।
- আপনি তো অকুস্থল ঘুরেই আসছেন। তাই না?
- ইয়েস।
- ভাঙা লকারে হাতের ছাপ?
- শুধু হরকেষ্টবাবুর আর তাঁর গিন্নীর।
- চাকরদের তল্লাশি নেওয়া হয়েছে? দস্তানা বা টাকা পাওয়া গেছে?
- নাহ্।
- লকার ভোর রাত্রে ভাঙা হয়েছে? শব্দ?
- হরকেষ্টবাবু তিন পেগ হুইস্কি খেয়ে শোন। গিন্নীর ঘুমের ওষুধ। চাকরদের থাকার ঘর দূরে।
- আলমারিটা স্টিলের?
- হ্যাঁ।
- পুরো বাড়ি তল্লাশি করেছেন দারোগাবাবু?
- না, শুধু চাকরদের ঘরগুলোয়।
- স্বাভাবিক। ইয়ে,  ওই আলমারিটা কে কে ব্যবহার করেন?
- শুধু হরকেষ্টবাবু। ঝাঁপা মালকড়ির প্রটেকশনের ব্যাপারে তিনি বেশ খুঁতখুঁতে দেখলাম, দু'টো চাবিই তাঁর কাছে থাকে। তবে ড্রাইভাররা ছাড়া বাকি সমস্ত চাকরের ওই ঘরে আনাগোনা আছে। রাতেরবেলাও সেখানে আসতে কারুরই বাধা নেই। সাতজন চাকর বটুবাবু। আপনি জেরা না করলে...।
- আপনার হাতের আঙুলগুলো দেখি।
- এ কী! কেন?
- শুঁকব।
- আপনার ইনভেস্টিগেশনের নেচার এমন অদ্ভুত!
- উমমম। আপনি হাত শেষ কখন ধুয়েছেন?
- ইয়ে, জলখাবার খেয়ে।
- সাবান দিয়ে?
- ডেটল হ্যান্ডওয়াশ।
- তারপর কী কী ধরেছেন?
- গাড়ির স্টিয়ারিং, লাঠি আর...।
- আপনার স্টিয়ারিং লাঠির থানামার্কা গন্ধ আমার জানা। আর কিছু ধরেছেন? এই হাতে?
- এমএলএ হরকেষ্টবাবুর ভাঙা লকার।
- হেঁ হেঁ।
- অমন হাসছেন যে?
- এমএলএর নাচনকোঁদনের পাল্লায় পড়ে অযথা গরীব চাকরগুলোকে হেনস্থা করছেন।
- মানে?
- মানে ভাঙা লকার যে গোস্ত বিরিয়ানির সুবাসে গুলজার দারোগাবাবু। সে সুবাসের এমন তেজ যে রাত পেরিয়েও সে মিইয়ে যায়নি। বরং আপনার আঙুলের ডগায় চড়ে সে এখানে এসেছে।
- আমি সে সুবাস পাচ্ছি না কেন?
- সবার নাক বটুর মত হলে বটুর কী হবে দারোগাবাবু? আমার গ্রীষ্মের আম আর বর্ষার ইলিশের যোগান হবে কী করে?
- কিন্তু হরকেষ্টবাবু ঘোর বোষ্টম বংশের পুরুষ। বটুবাবু, তাঁদের বাড়িতে পেঁয়াজ রসুন ঢোকেনা। এমন কী তাঁর সমস্ত চাকরবাকরও নিষ্ঠাবান বোষ্টম।
- সেই হরকেষ্টই প্রতি বিস্যুদবার রাতে গোপন অভিসারে সিরাজের বিরিয়ানি খেতে যান। ছদ্মবেশে।
- স্ক্যান্ডালাস। বোষ্টম ভোটের জোরেই তো তাঁর ইলেকশনে জেতা। সে মানুষ বিরিয়ানি খাচ্ছে?
- রীতিমত। বোষ্টমদের কাঁচকলা দেখিয়ে তিনি প্রতি বিস্যুদে সিরাজের বিরিয়ানি সাঁটিয়ে আসেন। গোপনে। তিনি ভাবেন তাঁর ছদ্মবেশের ওই নকল চাপদাড়ি সকলকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বটু গোয়েন্দার নেটওয়ার্ক সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই ভদ্রলোকের।
- আপনি বলতে কী চাইছেন বটুবাবু?
- আমায় অকুস্থলে টেনে নিয়ে গিয়ে কোনও লাভ নেই। নিজের আলমারি ভেঙে নিজের টাকা চুরি করেছেন হরকেষ্টবাবু নিজে। গতকাল সিরাজেও তিনি গেছিলেন, তদন্ত করলে সে'টুকু জানতেই পারবেন। শত ধুলেও সে বিরিয়ানির সুবাস এক রাতে যাওয়ার নয়। ফলে যা হওয়ার হল। লকার থেকে টাকা সরল কিন্তু রয়ে গেল মহামূল্যবান বিরিয়ানি সুবাস।
- হরকেষ্টবাবু নিজে চুরি করেছেন? বাট হোয়াই?
- নিজের আলমারি ভেঙে কুড়ি লাখ টাকা সরালেন। তারপর পুলিশ ডেকে নাটকও হল। ফলে সে টাকা থেকে বখরা দেওয়ার দায় গেল মিটে। হরকেষ্টবাবুকে নিশ্চয়ই অনেক মহলের অনেক লোককে এই কালো আয়ের ভাগ দেওয়ার কথা।
- বলেন কী মশাই।
- জলের মত স্পষ্ট।
- কিন্তু এখন উপায়? হরকেষ্টকে চোরও বলতে পারব না। তাহলে সে ব্যাটাকে চুপ করাব কী করে?
- বেশি ত্যান্ডাইম্যান্ডাই করলে তাঁর বিস্যুদে বিরিয়ানি খাওয়ার কথাটা হালকা করে ভাসিয়ে দিন। দেখুন বাছাধন সুড়সুড় করে লাইনে চলে আসবে। বোষ্টমদের ভোট হারানোর রিস্ক তিনি নিতে পারবেন না। আপনার প্রমোশন তরতর করে হবে দারোগাবাবু। বিরিয়ানি স্ক্যান্ডেল তাঁকে চেপে রাখতে হবেই।
- ব্রাভো বটু গোয়েন্দা, ব্রাভো! এ বর্ষায় ইলিশের সাপ্লাই আমি ডবল করব।
- আপনার দয়ার শরীর।

***

(দু'দিন আগে)।

- গিন্নীমা, আপনার কথা অনুযায়ী আপনি আপনার স্বামীর আলমারি থেকে কুড়ি লাখ টাকা সরিয়েছেন? নকল চাবি বানিয়ে?
- কারণটা তো বলেছি আপনাকে বটুবাবু!
- কারণটা রীতিমত মহৎ। আপনার স্বামীর পাপের টাকা সরিয়ে আপনি গোপনে বিভিন্ন চ্যারিটিতে বিলিয়ে  দিয়েছেন। আপনি রবিনহুড-সম গিন্নীমা। কিন্তু এ'বার আপনার ভয় আপনার স্বামী আলমারি খুলে টাকা না পেলে দক্ষযজ্ঞ শুরু হবে।
- আমি এ কাজ করেছি জানলে আমায় আস্ত চিবিয়ে খাবে সে বটুবাবু। সে পাষাণ।
- আপনার কোনও চিন্তা নেই। আপনি শুধু আমার কথামত কাজ করবেন। হরকেষ্টবাবুর হুইস্কিতে এই ঘুমের বড়ি মিশিয়ে দেবেন বিস্যুদ রাতে। নিজে ঘুমের ওষুধ খাবেন না।আর ভোরের দিকে শিলনোড়া দিয়ে সে ফাঁকা লকার ভেঙে রাখবেন। তেমন মজবুত নয়, বেগ পেতে হবে না। বাকিটা আমি দেখে নেব। শুধু হরকেষ্টবাবুর বিরিয়ানি স্ক্যান্ডালটা আমি একটু ব্যবহার করব।
- বড় বিশ্বাস করে আপনাকে সে কথা বলেছি বটুবাবু।
- চিন্তা করবেন না। কথা যখন দিয়েছি, হরকেষ্টবাবুর রাজনৈতিক জীবনে কোনও বিরিয়ানি-ঘটিত ক্ষতি আমি হতে দেব না। সে'খবর আমি শুধু আমার দারোগা বন্ধুটিকে ভোলাতে আর বাঁচাতে ব্যবহার করব, সামনেই তাঁর প্রমোশনের সুযোগ রয়েছে যে। আর মানুষটা বড় ভালো।

Saturday, February 3, 2018

এ'দিকে আর ও'দিকে

- গুরুদেব। 

- কিছু বলবে ভাই?

- শুধব। 

- নিশ্চয়ই। প্রশ্ন আছে, তাই তো মন সতেজ। যে মনে প্রশ্ন নেই, সে মন তো পান-খেকো দাঁতের গায়ের লালচে ছোপ মাত্র। 

- যেয়াজ্ঞে। তাহলে শুধোই? গুরুদেব?

- ভয় কীসে? শুধোও। প্রশ্ন সুধা এ বুকে সঞ্চারিত না হলে আমি জ্ঞানের অ্যালুমিনিয়াম বাটি তোমার সামনে উপুড় করে দেব কী করে?

- বলছিলাম যে গুরুদেব...আপনার চ্যালাগিরি করে তো কম ঘুরলাম না। হিমালয়ে তপস্যা, অস্ট্রিয়ায় ব্যালাড শোনা, মোজাম্বিকে চ্যারিটি ক্যাম্প, সাউথ পোলে পেঙ্গুইন সেবা। কিন্তু আজ পর্যন্ত কলকাতা গেলাম না যে। 

- দুর্জনে বলে আমি নাকি কলকাতার বড় ব্যবসায়ী বিনোদ দত্তকে ঠকিয়ে টু পাইস কামিয়েছিলাম। যৌবনে। আর তারপর নাকি আমি পুলিশের ভয়ে সন্ন্যাসী সেজে কলকাতা ছেড়েছি। কী সব বিশ্রী গুজব। 

- লোক না পোক গুরুদেব। এরা পারলে বিরিয়ানির থালা ফেলে দু'টো লঙ্কা ডলে গসিপ চিবিয়ে খাবে।  তা আপনি কি গুজবের ভয় কলকাতা যান না গুরুদেব? 

- ইহলোক পরলোকে পায়চারী করে বেড়াই কি কলকাতার বিনোদ দত্তকে ডরাব বলে ভাই? আর তাছাড়া কলকাতার পুলিশের ওপর মহলের অনেকে আমার ভক্ত। আমি পঞ্জিকা দেখে দিন বাতলে দিলে তবে তারা রেড বা এনকাউন্টার করে। আমার আবার ভয় কীসের? আমি কলকাতা যাইনা অন্য একটা কারণে। 

- পুরনো লাভ লাইফ গুরুদেব? সন্ন্যাস টলে যাবে? 

- ধ্যুত। নারী। আর আমি? কলেজ লাইফে বাহাত্তর নম্বর চিঠি জলে যাওয়ার পরেই বুঝে গেছিলাম, আমি ও'সব পাতি ব্যাপারের অনেক ওপরে।

- তবে? গুরুদেব? 

- মোক্ষলাভের স্পেকট্রামে একদিকে হিমালয়। বহুদিন আগেই যে বাধ্য হয়ে আমি সেই  পথ বেছে নিয়েছি ভাই। ইজি মোক্ষলাভ। হিমালয়ে খালি গায়ে বছর দুই তপস্যা করলেই মা অন্নপূর্ণা নিজে বোনচায়নার বাটিতে করে পায়েস নিয়ে আসবেন, সে বাটিতে আবার স্টিলের চামচে। মোক্ষলাভ স্পেকট্রামের অন্য জটিল দিক পড়ে রয়েছে কলকাতায়। হন্যে হয়ে চেষ্টা করেছিলাম। বহু বছর ব্যর্থ হয়ে তবেই হিমালয়ের জন্য কৌপীন অ্যাডপ্ট করে বেরিয়ে পড়েছি। এখন কলকাতায় ফিরলে সেই না পাওয়ার দুঃখ উথলে উঠবে যে। 

- কলকাতায় মোক্ষলাভ? সে'টা কী ভাবে হয়?  

- অফিসটাইমে ভিড় বাসে উঠে মার্ফিদেবকে অবিরাম ডেকে চলা, হে ভগবান, আমার সামনের জানালার সীটটা ফাঁকা করিয়ে দাও। সে তপস্যায় খোদ হিমালয়ও অল্প গলে গিয়ে কিছুদিনের জন্য রাজারহাটের ইকোপার্কে ঘুরে যেতে পারে। কিন্তু আমার সামনের জানালার সীট বহু বছরের তপস্যাতেও একবারও খালি হয়নি। মাদুলি পর্যন্ত নিয়েছিলাম। যা হোক।  সে ব্যর্থ তপস্যার ব্যথা ফের ফিরে আসবে কলকাতা গেলে। কাজেই আমাদের পরের গন্তব্য ভোপাল। সে'খানের কোনও রইস ব্যবসায়ীর মনে আবার ভক্তি জেগেছে। যাই..। ঘুরে আসি। 

- জ্ঞানে ভরা অ্যালুমিনিয়ামের বাটি সে বান্দার সামনে উপুড় করবেন, তাই তো?

- শিষ্য হিসেবে কিন্তু তোমার এলেম আছে ভায়া। তোমার হবে ।