Monday, February 26, 2018

সিঁড়ি

তিনলায় এক কামরার ভাড়া ঘর। সে'খানে নরেনবাবুর একার সংসার, দিব্যি চলে যায়। দিব্যি চলেও যাচ্ছিল বারো বছর ধরে। একটা চৌকি, একটা স্টোভ, কিছু বাসনপত্র, বিস্কুট চানাচুরের বয়াম, ঘরভাড়া সূত্রে পাওয়া স্টিলের তোবড়ানো আলমারি; ভালো থাকার যথেষ্ট রসদ মজুত রেখেছিলেন নরেনবাবু।

অফিস ফেরতা বাসডিপো থেকে জানালা নিয়ে মৌজ করে বাড়ি ফেরা। বাড়ি ঢোকার মুখে মধুর হোটেল থেকে রাতের খাবার কিনে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে এসে ওঠা। মনোরম গতে বাঁধা পড়ে গেছিলেন তিনি।

এই বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে নামা ওঠার ব্যাপারটা বড় ভালো লাগে তাঁর। অনেকের যেমন অনেক কিছু ভালো লাগে, ঠিক তেমনই। অফিসের  দিলীপবাবুর ভালো লাগে ব্রিজ খেলতে, হালিশহরের ন'কাকা ভালোবাসেন নস্যি নিতে, পাড়ার গণেশ মাতাল ভালোবাসে রামপ্রসাদী; ঠিক তেমনই নরেনবাবু ভালোবাসেন সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় সুরে সুরে সিঁড়ি গুনতে। বেয়াল্লিশ খানা সিঁড়ি। প্রতিদিন নামার সময় গোনেন এক, দুই, তিন থেকে বেয়াল্লিশ। আর ওঠার সময় গোনেন বেয়াল্লিশ, একচল্লিশ,  চল্লিশ থেকে এক। প্রতিবার। প্রতিদিন। কোনওদিন যদি অন্যমনস্ক হয়ে গোনার ছন্দে বাধা পড়ে, তাহলে নেমে বা উঠে গিয়ে ফের প্রথম থেকে শুরু করতে হয়।

তা বারো বছর ধরে সমস্ত কিছু দিব্যি চলার পর আজ সব কেমন গুবলেট হয়ে গেল। মধুর দোকান থেকে বাঁধাকপির তরকারি আর রুটি কিনে দিব্যি সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন। সিঁড়ির গায়ে তখন স্ট্রিটল্যাম্পের আবছা আলো। বাড়িওলা হারু সেনের যত গড়িমসি এই সিঁড়ির কেটে যাওয়া বাল্ব জোড়া বদলাতে। দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে ছপড়ার বুদ্ধিনাথ। বুদ্ধিনাথ সন্ধের এই সময়টা হারমোনিয়াম নিয়ে গাইতে বসে। তার সুর সিঁড়িতে উপচে পড়ে। বুদ্ধিনাথের হারমোনিয়ামের রিড টেপা খটরখটে সিঁড়ি গুনতে দিব্যি লাগছিল নরেনবাবুর।

কিন্তু সমস্ত গোলমাল হয়ে গেল দরজার মুখে। দেশোয়ালি সুরে সাত, ছয়, পাঁচ, চার, তিন গুনে দুই পেরিয়েই দরজা চলে এল। নরেনবাবু খিস্তি করেন না। "শালা"ও শেষ বলেছিলেন গ্র‍্যাজুয়েশনের সেকেন্ড ইয়ারে। কিন্তু এক নম্বর সিঁড়িটা না পেয়ে তিনি ফস্ করে বলে ফেললেন "যাহ্শ্লা"। নিশ্চয়ই কোনও ভুল হয়েছে গোনায়। বুদ্ধিনাথের হারমোনিয়ামের ওপর বড্ড রাগ হল, ওই সুরে তাল মেলাতে গিয়েই হয়েছে গড়বড়। বারো বছরে এই প্রথম সিঁড়ি গোনায় ভুল হল। শরীর আনচান  করে উঠল নরেনবাবুর। এখুনি এ ভুল শুধরে না নিলেই নয়। এ'বার সিঁড়ি গুনতে গুনতে নামতে শুরু করলেন তিনি। এক, দুই, তিন..কিন্তু সে এক সর্বনেশে সন্ধে। একচল্লিশে এসে সিঁড়ি গেল শেষ হয়ে। অস্থির হয়ে আরও অন্তত বার চারেক সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামা করলেন নরেনবাবু। যথারীতি একটা সিঁড়ি কম। বেয়াল্লিশের বদলে একচল্লিশ।

বাড়িওলা হারু সেন থাকেন নিচে। তখুনি তার কাছে ছুটে গেলেন নরেনবাবু। সিঁড়ি কমে যাওয়ার খবরটাকে তেমন পাত্তা দিলেন না হারু সেন। হারু সেন বাড়ির মালিক হয়েও কোনওদিন সিঁড়ি গুনে দেখেননি। অদ্ভুত বেআক্কেলে মানুষ!  কী মুস্কিল। উলটে হারু সেন বলে কিনা "আপনার প্রেশার বেড়েছে। ডাক্তার দেখান"। নরেনবাবু কোনওদিনও কাউকে "আহাম্মক" বলেননি,  আজও হারু সেনকে বললেন না।

বুদ্ধিনাথের নামটাও বৃথা, সে ব্যাটাও কোনওদিন সিঁড়ি গুনে দেখেনি। আরও বার দশেক ওঠা নামা করেও নরেনবাবু বেয়াল্লিশ নম্বর সিঁড়িটা খুঁজে পেলেন না। এক রাশ ভূতের ভয় চেপে ধরল নরেনবাবুকে, সিঁড়িটা গেল কই?

***

~~~ঘণ্টাখানেক আগে~~~

মৃণ্ময়ী কাঁপছিলেন।
এ'খানেই থাকে নরেনদাদা। তাঁর নরেনদাদা। গাঁয়ের মেঠো বিকেলের গন্ধমাখানো নরেনদাদা। ছোটবেলার অভিমানের নরেনদাদা। অঙ্ক শেখানো নরেনদাদা। ইংরেজি গ্রামার ভুল করলে ধমক দেওয়ার নরেনদাদা। স্কুল ছুটির পর সাইকেলের নরেনদাদা।

এই হল নরেনদাদার আস্তানা। এ পাড়ায় এসে তাঁকে দেখতে পেয়েই ঠিক চিনেছিল মৃণ্ময়ী। বহু চেষ্টায় খুঁজে পেয়েছে তাঁর ঠাঁই। দুপুর রোদের আবডালে তাই ছুটে এসেছিল। নরেনদাদা এই সময় অফিসে থাকে, দেখা হওয়ার ভয় নেই। চিঠিখানা নিশ্চিন্তে দেওয়া যাবে। সামনাসামনি না হোক, অন্তত চিঠি লিখে মনের কথাটা জানাতে চায় মৃণ্ময়ী।  নরেনদাদাকে চিৎকার করে বলতে চায় মৃণ্ময়ী যে তাঁর মিনু ভালো সম্বন্ধের লোভে তাঁকে ঠকায়নি। বলতে চায় নরেনদাদার জামার হাতা সে আজও একই রকম ভাবে টেনে ধরতে চায়। ভালোবাসে। সংসারের ভয়ে নরেনদাদার সামনে আসতে পারবে না বটে, কিন্তু ভালোবাসে। নরেনদাদার কথা মনে পড়লে বুক ভেঙে কান্না আসে, কেউ জানতে পারে না। সে সমস্ত কথাই চিঠিতে লিখেছিল মৃণ্ময়ী। সে লিখেছিল যে আজকাল সেও নরেনদাদার মত সুযোগ পেলেই সিঁড়ি গোনে। সিঁড়ি গুনলে নরেনদাদার সুবাস নাকে আসে যে। তার নরেনদাদা। নরেনদাদার এই বাসায় বেয়াল্লিশটা সিঁড়ি।

কিন্তু নরেনদাদার দরজার কাছে পৌঁছে থমকে গেলেন মৃণ্ময়ী। হাতের চিঠি দরজার নিচে গুঁজে দেওয়ার কথা। কিন্তু কী হবে নরেনদাদাকে অকারণ জ্বালিয়ে? তাঁর দুঃখ জেনে নরেনদাদা করবেটাই বা কী? হয়ত নরেনদাদা সুখে আছে, এই চিঠিতে বরং তাঁর সুখে আগুন লাগবে। শেষ সিঁড়িতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলে সে। বড় কান্না পেল।
বহুক্ষণ পর নিজেকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে আনলে মৃণ্ময়ী। চিঠিটা নষ্ট হল। কী অদ্ভুত, নামার সময় ফের গুনে মাত্র একচল্লিশটা সিঁড়ি পেলে মৃণ্ময়ী। ওঠার সময় ভুল গুনেছে না নামার সময়; তা নিয়ে ভাবার সময় ছিল না তার।

নরেনদাদার বাড়ি থেকে সোজা ঘাটের দিকে ছুটে গেছিল মৃণ্ময়ী। এর আগে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে বহুবার শেষ সিঁড়ি পর্যন্ত নেমে গেছে সে। সে জানে যে বত্রিশ নম্বর সিঁড়ির পরেই অথৈ জল। অনেকে এ ঘাটে এককালে ডুবে মরেছে। আজকাল বড় একটা কেউ আসে না। মৃণ্ময়ী আসে। নরেনদাদার কথা বুকে বাজলেই আসে। কতবার ভেবেছে ঘাটের বত্রিশ নম্বর পেরিয়ে নিজের সাঁতার না জানা শরীরটাকে ভাসিয়ে দেবে সে। কতবার। বত্রিশ নম্বর সিঁড়ি থেকে এক পা বাড়িয়ে গোড়ালি ডুবিয়েওছে। পারেনি।
কিন্তু আজ পারার কথা। নিজেকে চিঠিশুদ্ধু ডুবিয়ে দেওয়াটা আজ বড় সহজ মনে হচ্ছিল মৃণ্ময়ীর।

দুপুর রোদের খাঁখাঁ ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল মৃণ্ময়ী;
"নরেনদাদা, মিনু তোমায় মরার দিন পর্যন্ত ভোলেনি গো"। তিরিশ একত্রিশ পেরিয়ে বত্রিশ নম্বর সিঁড়িতে এসে দাঁড়ায় নরেনদাদার মিনু। মন শক্ত করে।

"আসি নরেনদাদা" বলে ডান পা এগোতেই তেত্রিশ নম্বর সিঁড়িতে পা পড়ল মৃণ্ময়ীর। এতদিন ধরে সিঁড়ি ভুল গুনেছে মৃণ্ময়ী? সে নিশ্চিত তা কিছুতেই সম্ভব নয়। ঘাটের এই বাড়তি সিঁড়িটা এলো কোথা থেকে?

হতবাক মৃণ্ময়ীর নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া হল না।

No comments: