- এ কী! দোর্দণ্ডপ্রতাপ দারোগা গোবিন্দ হালদার সকাল স্বয়ং সকাল এই অধমের বাড়ি?
- বটুবাবু! বাজে কথা সময় নেই। গামছা পরে খালি গায়ে নিমের দাঁতন মুখে মৌরুসিপাট্টাও চলবে না। শার্ট আর প্যান্টেলুন গলিয়ে চটপট বেরিয়ে আসুন। ক্যুইক।
- ক্যুইক? সে সম্ভাবনা নেই স্যার। কী কুক্ষণেই যে দার্জিলিং-অরেঞ্জ ফ্লেভারের ইসবগুল নিয়েছিলাম। রঙেই বাহার, কাজে অষ্টরম্ভা।
- দোহাই বটুবাবু। আপনার ওই নক্সাটক্সা এখন বাদ দিন। মেজর ক্রাইসিস। আপনি অকুস্থলে না পৌঁছলে আমার প্রমোশনটা ঝুলে যাবে।
- ঘটেছেটা কী?
- বিস্ফোরণ মশাই।
- এক্সপ্লোশন?
- আহ। ও'টা ফিগারেটিভলি বলা, তবে এ'টা এক্সপ্লোশনের বাবা। চুরি। তাও খোদ এমএলএর বাড়িতে।
- হরেকেষ্টবাবুর বাড়িতে চুরি?
- আলমারির লকার ভেঙে। কুড়ি লাখ গন।
- বাড়ির আলমারির লকারে কুড়ি লাখ? প্রমোটারির কমিশনে বাড়াবাড়ি রকমের দাঁও মারতে শুরু করেছিলেন ভদ্রলোক। চোর তো সোশ্যাল ওয়ার্ক করে গেছে স্যার। যাক গে, তবে এই চুরির ব্যাপারে আমি কী করব? বটু গোয়েন্দা পাড়ায় পাড়ায় চোর খুঁজতে বেরোবে?
- হরকেষ্টবাবুর ধারণা চোর বাড়ির কোনও চাকরই হবে। চুরি হয়েছে আজ ভোর রাত্রে। বাইরে থেকে কেউ দরজা ভেঙে ঢোকেনি, সিঁদ কাটেনি। শুধু লকার ভাঙা।
- ক'জন চাকর বাড়িতে?
- সাতজন।
- সাতজন চাকর? বাড়িতে আছে ক'জন?
- হরকেষ্টবাবু আর তাঁর গিন্নী।
- দু'জন মানুষের সাতজন সেবায়েত?
- দু'জন রাঁধুনি। দু'জন ড্রাইভার। দু'জনে ঘরের অন্যান্য কাজ। একজন মালি। সকলেই তাঁর বাড়িতেই থাকে। সবাইকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। এখন আপনি গিয়ে জেরা করবেন। বটুবাবু, প্লীজ। ক্যুইক।
- লাল চা খাবেন? কন্সটিপেশনে হেল্প করে।
- আপনি আমার কথার তোয়াক্কা করছেন না। অবিশ্যি প্রমোশন গেলে আমার যাবে। এমএলএর রোষে জঙ্গলে ট্রান্সফার হবে আমার। আপনার কী? আমি আপনার জন্য কীই বা করি? বর্ষায় বড় জোর ইলিশ খাওয়াই, আর গ্রীষ্মে আম, আর শীতে নলেনের রসগোল্লা। সে তো আমার বদলে যে দারোগা আসবে সেই খাওয়াবে। বটু গোয়েন্দার ব্রেন ছাড়া তো আর দারোগাদের চলবে না। আপনি নিশ্চিন্তে বানান লাল চা। আমি আসি।
- আরে চটছেন কেন দারোগাবাবু। দু'মিনিট ধৈর্য ধরে বসুন। তা'তে আখেরে আপনার বেনিফিট।
- আর বেনেফিট। সকাল থেকে হরকেষ্টবাবু "নিনকম্পুপ দারোগা" বলে ঘেউঘেউ করতে করতে পায়চারী করে চলেছেন। আমার সব গেল।
- আপনি তো অকুস্থল ঘুরেই আসছেন। তাই না?
- ইয়েস।
- ভাঙা লকারে হাতের ছাপ?
- শুধু হরকেষ্টবাবুর আর তাঁর গিন্নীর।
- চাকরদের তল্লাশি নেওয়া হয়েছে? দস্তানা বা টাকা পাওয়া গেছে?
- নাহ্।
- লকার ভোর রাত্রে ভাঙা হয়েছে? শব্দ?
- হরকেষ্টবাবু তিন পেগ হুইস্কি খেয়ে শোন। গিন্নীর ঘুমের ওষুধ। চাকরদের থাকার ঘর দূরে।
- আলমারিটা স্টিলের?
- হ্যাঁ।
- পুরো বাড়ি তল্লাশি করেছেন দারোগাবাবু?
- না, শুধু চাকরদের ঘরগুলোয়।
- স্বাভাবিক। ইয়ে, ওই আলমারিটা কে কে ব্যবহার করেন?
- শুধু হরকেষ্টবাবু। ঝাঁপা মালকড়ির প্রটেকশনের ব্যাপারে তিনি বেশ খুঁতখুঁতে দেখলাম, দু'টো চাবিই তাঁর কাছে থাকে। তবে ড্রাইভাররা ছাড়া বাকি সমস্ত চাকরের ওই ঘরে আনাগোনা আছে। রাতেরবেলাও সেখানে আসতে কারুরই বাধা নেই। সাতজন চাকর বটুবাবু। আপনি জেরা না করলে...।
- আপনার হাতের আঙুলগুলো দেখি।
- এ কী! কেন?
- শুঁকব।
- আপনার ইনভেস্টিগেশনের নেচার এমন অদ্ভুত!
- উমমম। আপনি হাত শেষ কখন ধুয়েছেন?
- ইয়ে, জলখাবার খেয়ে।
- সাবান দিয়ে?
- ডেটল হ্যান্ডওয়াশ।
- তারপর কী কী ধরেছেন?
- গাড়ির স্টিয়ারিং, লাঠি আর...।
- আপনার স্টিয়ারিং লাঠির থানামার্কা গন্ধ আমার জানা। আর কিছু ধরেছেন? এই হাতে?
- এমএলএ হরকেষ্টবাবুর ভাঙা লকার।
- হেঁ হেঁ।
- অমন হাসছেন যে?
- এমএলএর নাচনকোঁদনের পাল্লায় পড়ে অযথা গরীব চাকরগুলোকে হেনস্থা করছেন।
- মানে?
- মানে ভাঙা লকার যে গোস্ত বিরিয়ানির সুবাসে গুলজার দারোগাবাবু। সে সুবাসের এমন তেজ যে রাত পেরিয়েও সে মিইয়ে যায়নি। বরং আপনার আঙুলের ডগায় চড়ে সে এখানে এসেছে।
- আমি সে সুবাস পাচ্ছি না কেন?
- সবার নাক বটুর মত হলে বটুর কী হবে দারোগাবাবু? আমার গ্রীষ্মের আম আর বর্ষার ইলিশের যোগান হবে কী করে?
- কিন্তু হরকেষ্টবাবু ঘোর বোষ্টম বংশের পুরুষ। বটুবাবু, তাঁদের বাড়িতে পেঁয়াজ রসুন ঢোকেনা। এমন কী তাঁর সমস্ত চাকরবাকরও নিষ্ঠাবান বোষ্টম।
- সেই হরকেষ্টই প্রতি বিস্যুদবার রাতে গোপন অভিসারে সিরাজের বিরিয়ানি খেতে যান। ছদ্মবেশে।
- স্ক্যান্ডালাস। বোষ্টম ভোটের জোরেই তো তাঁর ইলেকশনে জেতা। সে মানুষ বিরিয়ানি খাচ্ছে?
- রীতিমত। বোষ্টমদের কাঁচকলা দেখিয়ে তিনি প্রতি বিস্যুদে সিরাজের বিরিয়ানি সাঁটিয়ে আসেন। গোপনে। তিনি ভাবেন তাঁর ছদ্মবেশের ওই নকল চাপদাড়ি সকলকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বটু গোয়েন্দার নেটওয়ার্ক সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই ভদ্রলোকের।
- আপনি বলতে কী চাইছেন বটুবাবু?
- আমায় অকুস্থলে টেনে নিয়ে গিয়ে কোনও লাভ নেই। নিজের আলমারি ভেঙে নিজের টাকা চুরি করেছেন হরকেষ্টবাবু নিজে। গতকাল সিরাজেও তিনি গেছিলেন, তদন্ত করলে সে'টুকু জানতেই পারবেন। শত ধুলেও সে বিরিয়ানির সুবাস এক রাতে যাওয়ার নয়। ফলে যা হওয়ার হল। লকার থেকে টাকা সরল কিন্তু রয়ে গেল মহামূল্যবান বিরিয়ানি সুবাস।
- হরকেষ্টবাবু নিজে চুরি করেছেন? বাট হোয়াই?
- নিজের আলমারি ভেঙে কুড়ি লাখ টাকা সরালেন। তারপর পুলিশ ডেকে নাটকও হল। ফলে সে টাকা থেকে বখরা দেওয়ার দায় গেল মিটে। হরকেষ্টবাবুকে নিশ্চয়ই অনেক মহলের অনেক লোককে এই কালো আয়ের ভাগ দেওয়ার কথা।
- বলেন কী মশাই।
- জলের মত স্পষ্ট।
- কিন্তু এখন উপায়? হরকেষ্টকে চোরও বলতে পারব না। তাহলে সে ব্যাটাকে চুপ করাব কী করে?
- বেশি ত্যান্ডাইম্যান্ডাই করলে তাঁর বিস্যুদে বিরিয়ানি খাওয়ার কথাটা হালকা করে ভাসিয়ে দিন। দেখুন বাছাধন সুড়সুড় করে লাইনে চলে আসবে। বোষ্টমদের ভোট হারানোর রিস্ক তিনি নিতে পারবেন না। আপনার প্রমোশন তরতর করে হবে দারোগাবাবু। বিরিয়ানি স্ক্যান্ডেল তাঁকে চেপে রাখতে হবেই।
- ব্রাভো বটু গোয়েন্দা, ব্রাভো! এ বর্ষায় ইলিশের সাপ্লাই আমি ডবল করব।
- আপনার দয়ার শরীর।
***
(দু'দিন আগে)।
- গিন্নীমা, আপনার কথা অনুযায়ী আপনি আপনার স্বামীর আলমারি থেকে কুড়ি লাখ টাকা সরিয়েছেন? নকল চাবি বানিয়ে?
- কারণটা তো বলেছি আপনাকে বটুবাবু!
- কারণটা রীতিমত মহৎ। আপনার স্বামীর পাপের টাকা সরিয়ে আপনি গোপনে বিভিন্ন চ্যারিটিতে বিলিয়ে দিয়েছেন। আপনি রবিনহুড-সম গিন্নীমা। কিন্তু এ'বার আপনার ভয় আপনার স্বামী আলমারি খুলে টাকা না পেলে দক্ষযজ্ঞ শুরু হবে।
- আমি এ কাজ করেছি জানলে আমায় আস্ত চিবিয়ে খাবে সে বটুবাবু। সে পাষাণ।
- আপনার কোনও চিন্তা নেই। আপনি শুধু আমার কথামত কাজ করবেন। হরকেষ্টবাবুর হুইস্কিতে এই ঘুমের বড়ি মিশিয়ে দেবেন বিস্যুদ রাতে। নিজে ঘুমের ওষুধ খাবেন না।আর ভোরের দিকে শিলনোড়া দিয়ে সে ফাঁকা লকার ভেঙে রাখবেন। তেমন মজবুত নয়, বেগ পেতে হবে না। বাকিটা আমি দেখে নেব। শুধু হরকেষ্টবাবুর বিরিয়ানি স্ক্যান্ডালটা আমি একটু ব্যবহার করব।
- বড় বিশ্বাস করে আপনাকে সে কথা বলেছি বটুবাবু।
- চিন্তা করবেন না। কথা যখন দিয়েছি, হরকেষ্টবাবুর রাজনৈতিক জীবনে কোনও বিরিয়ানি-ঘটিত ক্ষতি আমি হতে দেব না। সে'খবর আমি শুধু আমার দারোগা বন্ধুটিকে ভোলাতে আর বাঁচাতে ব্যবহার করব, সামনেই তাঁর প্রমোশনের সুযোগ রয়েছে যে। আর মানুষটা বড় ভালো।
No comments:
Post a Comment