Tuesday, April 24, 2018

বিনোদবাবুর অম্বল

- শুনুন।
- আমায় ডাকছেন?
- র‍্যান্ডম ফায়ার করেছিলাম। আপনি ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন। তা'হলে আপনাকেই ডেকেছি।
- ভিড় প্ল্যাটফর্মে ইয়ার্কি পেয়েছেন?
- এই দমবন্ধ করা ভিড় আর ভ্যাপসা গরমে ইয়ার্কি? প্রাণে অত ফুর্তি থাকলে কবি হতাম যে মশাই।
- মাফ করবেন, আপনি কবিদের চেনেন না। তারা দিব্যি নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকতে পারে, দিনের পর দিন।
- আপনি কবি?
- পাগল নাকি! যাক গে, ডাকলেন কেন?
- তিন নম্বরের দিকে যাচ্ছেন?
- আপ কাটোয়া লোকাল তিনে দিয়েছে। অ্যানাউন্স করল তো। আপনার কি ওই লাইনেই?
- আমি? না। আমি কুদঘাট টু হাওড়া, হাওড়া থেকে ওয়াপস।
- হাওড়া? কুদঘাট থেকে? রেলের অফিসে চাকরী নাকি?
- না না, আমি রোজ স্টেশনে ঘুরতে আসি।
- স্টেশনে রোজ ঘুরতে আসেন?
- রোজ। সব প্ল্যাটফর্মে ঘুরি। বড় ঘড়ির তলায় দাঁড়াই। মাঝেমধ্যে পুরিভাজির দোকানের ব্যস্ততা দেখি। ঘণ্টা তিনেক পর ফের মিনিবাসে করে ওয়াপস।
- রোজ?
- অবভিয়াসলি রোববারে নয়। ওইদিনটা রেস্ট।
- আপনি তো নোবেলটোবেল পেয়ে যাবেন যে কোনো দিন।
- সারকাজম রয়েসয়ে ব্যবহার করতে হয়।
- গুল দিচ্ছেন না তো?
- গা ছুঁয়ে প্রমিস করব?
- অত বাড়াবাড়ির দরকার নেই।
- আমি অবশ্য চাইলেও গা ছুঁতে পারতাম না।
- মানে?
- আমার নাম রাধাকান্ত হাজরা। নিবাস, কুদঘাট। আগেই বলেছি। তা, আপনার নাম?
- বিনোদ দাস। বৈদ্যবাটি। ইয়ে চোরডাকাত নন তো? চেহারা দেখে তো তেমন মনে হয় না। তবে গা ছুঁতে পারবেন না কেন বলুন দেখি?
- আমার শরীর তো হাওয়া।
- ভূত?
- ধ্যাত্তেরি। সবেতেই বাঙালির ভূত ভূত বাতিক। হাওয়ার শরীর মানেই ভূত?
- যাব্বাবা, অশরীরী! ভূত নয়?
- আপনি কি ভূত? বিনোদবাবু?
- যাচ্চলে, আমি কি অশরীরী?
- আলবাত।
- ইয়ার্কি হচ্ছে?
- আপনার মূল দেহ আর আত্মা দু'টোই এখন কাটোয়া লোকালের হ্যান্ডেল ধরে হাফঘুমে ঢুলছে।
- আমার মাথা কেমন ঘোরাচ্ছে, নিজের গা হাত পা কেমন ছায়ার মত তিরতির করে কাঁপছে। আমি কি ভূত?
- ধুত্তোরিছাই। বললাম তো, আই রিপীট; আপনার আত্মা নিশ্চিন্তে আপনার দেহের মধ্যে রয়েছে। আপনার দেহ আপ কাটোয়া লোকালের চার নম্বর কামরায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢুলছে।
- সর্বনাশ, তা'হলে আমি কে রাধাকান্তবাবু?
- আপনি আদতে বিনোদবাবু পুরোটা নন। আপনি বৈদ্যবাটির বিনোদবাবুর পুষে রাখা দাঁতকিড়মিড়। এই যেমন আমি ঠিক রাধাকান্ত নই। আমি রাধাকান্তের পোষ্য অপরাধ বোধ।
- কেমন গা গুলোচ্ছে রাধাকান্তবাবু।
- গা থাকলে তবে তো গোলাবে।
- তা ঠিক! কিন্তু কেসটা কী?
- আজ থেকে দেড় বছর আগে, আমি যাচ্ছিলাম কাটোয়া, পিসিমার বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল। এই কাটোয়া লোকালে উঠে জানালার লোভে আমি আপনাকে ঠেলে ফেলে আপনার পা মাড়িয়ে গিয়ে জানালা দখল করি। লজ্জার সঙ্গে আজ স্বীকার করছি সে জানালা আপনার প্রাপ্য ছিল। অথচ আপনি প্রতিবাদ করতেই আপনাকে বাপ তুলে খিস্তি করি। আপনি ঘাবড়ে চুপ করে যান। জানালার আনন্দ অবশ্য তেমন ভোগ করতে পারিনি। অপরাধ বোধে দগ্ধ হতে থাকি। সেই থেকে আমার অপরাধ বোধ রোজ কুদঘাট থেকে হাওড়া এসে আপনার মনের সেই পুরনো ব্যথা আর দাঁতকিড়মিড়ের খোঁজ করতে থাকে। কত  আর্তি নিয়ে ডাকি; "শুনুন"। এদ্দিন পর আজ সাড়া পেলাম। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় আপনি  আমার হাঁক শুনতে পান। ব্যস,  শুনতে পেয়েই আপনার অন্তরের পোষা সেই আমি-ঘটিত ব্যথা-আর-দাঁতকিড়মিড় বেরিয়ে আসে। বহুদিন আপনার খোঁজ করেছি স্যর, রোজ, হপ্তায় ছ'দিন। আমায় এ'বার মাফ করুন। বিনোদবাবু প্লীজ। আমি জানোয়ারের মত কাজ করেছিলাম।
- আমি যে কী বলব রাধাকান্তবাবু, আমি অভিভূত।  আর রাগ রইল না।
- গা ছুঁয়ে প্রমিস?
- হে হে হে।
- হে হে হে।
- ও কী, আপনি আবছা হয়ে পড়ছেন যে!
- স্বাভাবিক,  এ'বার আপনারও আর থাকার দরকার নেই; আপনিও গায়েব হচ্ছেন। সে'টা টের পাচ্ছেন কি?

***

বেলুড় আসার পর লোকের ওঠা নামার ধাক্কায় হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকা হাফ ঘুমন্ত বিনোদ দাসের তন্দ্রা গেল চটকে।

আর ঠিক তখনি; একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলেন ভদ্রলোক। এদ্দিনের চাপা অম্বল আর বুকজ্বালা ভাবটা  দুম করে গায়েব। খানিক আগেও ছিল, এখন নেই। নতুন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারটার এলেম নাকি?

No comments: